#চতুষ্কোণ /পর্ব:-০৩
Sharifa Suhasini
ডাক্তার নির্ঝরের কথামতো বিজ্ঞানের ভাষায় তো এটাই দাঁড়াচ্ছে যে, এই বাচ্চাটি তাদেরই বংশধর। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? সত্যটা আপাতত ধাপাচাপা দিয়ে সে নিজেই শেষ অব্দি খুঁজে বের করে। আচ্ছা, কোনোভাবে ইলার থেকে স্যাম্পল নিলেও তো কাজ চালানো যাবে। সে আবার ঘরে ফিরে এসে দেখে, ইলা ছোট্ট বাচ্চাটির সাথে একধ্যানে খেলছে। আর নাবিলাও পরম তৃপ্তি নিয়ে দুজনকে দেখছে। ব্যাপারটা কী! সে কিছুক্ষণ আড়ালে দাঁড়িয়ে নাবিলার মতিগতি বোঝার চেষ্টা করে। প্রায় মিনিট পাঁচ মতন কেটে যাবার পরেও নাবিলার আচরণের বিভ্রান্তি ঘটলো না। সে তেমনই নির্বাক চেয়ে আছে ইলা আর নতুন শিশুটির দিকে। শামীমের বুকের ভেতর সব যেন দুমড়েমুচড়ে যেতে শুরু করে।
নাবিলাকে সে কতখানি ভালোবাসে, তা কোনোদিনও বুঝাতে পারবে না। প্রথম দেখাতেই তার মুখের দিকে চেয়ে যে অদ্ভুত মায়ায় সে জড়িয়ে গেছে, যে সুশীল এবং স্নিগ্ধ মেয়েটিকে দেখে সে মুগ্ধতায় ডুবে গেছিল, সেই অনুভূতিটুকু শামীম আজও গোপন করে রেখেছে ওর থেকে। যেদিন নাবিলা প্রথমবারের মত ওকে বুকে টেনে নিবে, সেদিনই সেই সমস্ত ভালোবাসাটুকু সে কড়ায়গণ্ডায় তাকে বুঝিয়ে দিবে-“দেখো নাবিলা, তোমাকে আমি কী ভীষণ ভালোবাসি।”
যেদিন নাবিলা নিজে থেকে তাকে ভালোবাসার আহবান জানাবে,সেদিনই নিজের সমস্ত আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা সবটা তাকে একেবারে হাতের কর মেপে মেপে বুঝিয়ে দিবে যে, সে আসলে নাবিলাকে কতখানি চায়। অথচ মাঝপথে এমন ভয়ংকর একটি ব্যাপার ঘটে গেল! সেই স্বপ্ন যে এভাবে দুঃস্বপ্ন হয়ে যাবে, তা কে জানতো?
শোকের অন্তরালে দাঁড়িয়ে শামীমের দুই চোখে কখন যে জল জমে উঠেছে, তা সে টেরই পেল না। যতক্ষণে পেল, ততক্ষণে দু’ফোঁটা জল ভালোবাসার নামে ভূপৃষ্ঠে বিসজর্ন হয়ে গেল।
নাবিলা আচমকা পিছন ফিরে ওকে দেখতে পেয়ে ক্ষণিক সময়ের জন্য চমকে উঠলো। কিন্তু সেই আচমকা ভাব বেশিক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী রাখে না। ক্ষণিকেই নিজের মুখভঙ্গি পরিবর্তন করে শামীমকে প্রশ্ন করে,
—তুমি কখন ফিরে এলে? কিছু বলবে?
—আমার প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে। হালকা পাতলা নাস্তা হবে ঘরে?
—হবে। তবে সেটা ঘরে নয়। সোজা রান্নাঘরে চলে যাও। ফ্রিজে চাওমিন রাখা আছে। গরম করে খাবে। লাচ্চিও আছে। নরমাল মোডের তাকে পাবে। আর কুকিজ খেতে মন চাইলে র্যাকের ভিতর হলুদ বাক্সে রাখা আছে। ওখান থেকে নিয়ে খাও।
কিন্তু শামীম নড়লো না। তার আশা ছিল নাবিলা অন্তত এগিয়ে এসে ওকে খুঁজে দেবে। অথচ সেই আশায় রীতিমতো ঠান্ডা পানি ঢেলে মেয়েটা ডানে-বামে না তাকিয়ে সোজা নিজের ছোট্ট বাচ্চার কাছে গিয়ে বসে পড়লো। শামীম সম্পূর্ণ হতভম্বের মত ওর দিকে চেয়ে আছে। যে নাবিলাকে সে প্রথম দেখায় ভালোবেসেছিল, এ তো সে নয়। এ যেন ভিন্ন কেউ, যাকে শামীম চেনে না৷ একমনে স্ত্রীর এই পরিবর্তনের কথা ভাবতে ভাবতে ওর খেয়ালই নেই নাবিলা ওকে লক্ষ্য করছে। শামীমকে আবার দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নাবিলা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
—কই, তোমার না ক্ষুধা লেগেছে? তবে যাও।
শামীম তবুও গেল না। সে এক পা, দু’পা করে এগিয়ে এসে নাবিলার ঠিক পাশেই বসলো। এতটা পাশে যে,চাইলেই তাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরা যাবে। তবু জড়িয়ে ধরার অধিকার নেই। কাউকে পাগলের মত ভালোবাসলেই কেবল জগতের সমস্ত কিছু তার বিরুদ্ধে চলে যায়। অলক্ষ্যের প্রাপ্তিতে জোটে কেবলই একরাশ অবজ্ঞা। ভালোবাসার পরিণাম এতটুকুই।
শামীমের পুরো ঘরজুড়ে কেবলই নাবিলার অস্তিত্ব জানান দেয়। সেদিকে একবার অবলোকন করে সে নাবিলাকে বললো,
—তুমি আমার ভালো-মন্দের খোঁজ রাখো?
—বিবাহ সূত্রে তুমি আমার স্বামী। আর স্বামীর ভালো-মন্দ দেখাটাও আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
—আমাকে ভালোবাসো তো?
শামীমের অকস্মাৎ প্রশ্নে নাবিলা চমকে ওঠে। তার চোখের দিকে ফিরে তাকানোর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ সাহসের সঞ্চারণ ঘটলো না আর। মুহুর্ত কয়েক নীরব থেকে সে শামীমের কথার জবাবে পাল্টা প্রশ্ন করে বলে,
—ক্ষুধার সাথে এখন প্রেম-ভালোবাসার কী সম্পর্ক, সেটাই বুঝলাম না। তুমি ঠিক কী বলতে চাইছো,আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না। দেখো শামীম, তুমি যদি চাও, তাহলে আমি আমার সন্তানকে নিয়ে এবাড়ি থেকে চলে যাবো। তুমি তো তাই চাও। তাই না?
নাবিলার প্রতি ওর এত অধিক দুর্বলতা তৈরি হয়ে গেছে যে, এই মুহুর্তে তার চলে যাওয়াটা শামীম কোনোভাবেই মানিয়ে নিতে পারবে না। এই ব্যাপারটা অনেক আগেই নাবিলার দৃষ্টিগোচর হয়ে গেছে। আর ঠিক সেকারণেই ভালোবাসার মত এতবড় দুর্বল অনুভূতিকে সে চমকপ্রদভাবেই কাজে লাগাতে পেরেছে। তাছাড়া শামীম নিজেও এখন জেনে গেছে-কোনো না কোনোভাবে এই বাচ্চাটা তারই বংশের। তাদেরই রক্ত। আর সেটা মাহদী ভাইয়ের হবার সম্ভাবনা শতভাগ। তবুও ফাইনাল রিপোর্ট হাতে না পাওয়া পর্যন্ত নাবিলাকে আর একটিও প্রশ্ন করতে চায় না।
শামীম ইলার হাত ধরে বাইরে বেরিয়ে আসে। যদিও ইলা তার ছোট ভাইটিকে ছেড়ে আসতে চাচ্ছিলো না। শেষ পর্যন্ত চিপসের অজুহাতই একমাত্র ভরসা হয়ে উঠলো। তাকে বাইরে এনে সোফার উপর বসে পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে সেটা ইলাকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
—এখানে কত টাকা আছে বলো তো বাবাই?
—পঞ্চাশ।
—তুমি টাকা চিনো? বাবাহ! কে শিখিয়েছে আমার মা’কে?
—মামনি।
ইলার সাথে কথা বলার ফাঁকে সে কৌশলে মেয়ের মাথা থেকে দুটো চুলের মাঝামাঝি জায়গা থেকে খুব সাবধানতার সাথে ছিঁড়ে নিলো। তারপর পঞ্চাশ টাকার নোটটা ইলার হাতে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। এগুলো নিয়ে সে আবার ডাক্তার নির্ঝরের কাছে যাবে। সেখান থেকে সোজা সন্ধানী ল্যাবে। পূর্বের রিপোর্টটাও ডাক্তার নির্ঝর সন্ধানী ল্যাব থেকে করিয়ে নেবার ব্যবস্থা করেছিল।
ডাক্তার নির্ঝরের চেম্বারে যাবার রোডের মাঝামাঝি গিয়ে সে সিদ্ধান্ত পাল্টালো। এই মুহুর্তে আবার নির্ঝরের কাছে যাওয়াটা ঠিক হবে না। যতই সে পরিচিত হোক, কাছের হোক, নিজের কিংবা নিজের পরিবারের দুর্বল দিকগুলো সে কাউকে দেখাতে পারবে না। মানুষের কাছে তার একটা সম্মান আছে। আর সেই সম্মান সে স্ত্রীর কারণে হাটে বিকিয়ে আসতে পারে না। শামীম বাইক ঘুরিয়ে বামে মোড় নিয়ে সোজা সন্ধানী ল্যাবের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
৩.
রাতে সবাইকে বাসায় পাওয়া গেল। ল্যাবের রিপোর্ট আজ পাওয়া যাবে না। ওখান থেকে জানানো হয়েছে- শামীমের রিপোর্ট পরশুদিন গিয়ে নিয়ে আসতে পারবে। তার মানে মাঝখানে আরও দুইদিনের অপেক্ষা। আর এই দুইদিন শামীমের কাছে জাহান্নামের দুই হাজার বছরের সমান। একদিকে স্ত্রী, আবার অন্যদিকে তার সম্মানীয় বড়ভাই। মাহদী’কে সে যতটুকু জানে, মানুষটা কখনোই খারাপ কিছু করতেই পারে না। বিয়ে আগে কোনোদিন কোনো মেয়ের দিকেও মাহদী ফিরে তাকায়নি। কোনো মেয়ে প্রোপোজ করলে সেই মেয়ের ধারেকাছেও কোনোদিন যায়নি সে। বিয়ের পর আতিয়া ভাবির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ করতেই পারছিল না। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে মোটামুটি মানানো গেছিল। আর বাকি অবদানটুকু আতিয়া ভাবিরই। এখনও নিজের স্ত্রী ব্যতীত অন্য মেয়েদের থেকে সে সবসময় নির্দিষ্ট দূরুত্ব বজায় রেখে চলে। সেই মানুষটার পক্ষে নাবিলার সাথে জোরজবরদস্তির সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। তাহলে এতকিছু কীভাবে ঘটে গেল!
শামীমের ভাবনার গভীরের দ্বারে কপাট পড়লো মাহদীর কন্ঠস্বরে। ছোটভাইকে চিন্তায় নিমঘ্ন থাকতে দেখে মাহদী ওর পিঠ চাপড়ে জিজ্ঞাসা করলো,
—কী রে! ছেলে হলে মানুষ খুশিতে গদগদ হয়। আর এক তোকে দেখছি। সেদিন থেকে কেমন মনমরা হয়ে আছিস। কী হয়েছে রে তোর?
—আমার কী হচ্ছে, সেটা তো সবার আগে তোমারই জানার কথা ভাইয়া।
ভায়ের সাথে এমন কড়া সুরে সে কথা বললো যে, ক্ষণিক মুহুর্ত পর নিজেই অবাক হয়ে গেল। এ তার কী কথা বলার ছিরি! সে মিটিমিটি চোখে ভায়ের দিকে তাকালো। মাহদী তখনও ভেবাচেকা খাওয়ার মত ভঙ্গিতে ওর দিকে চেয়ে আছে। শামীম ভাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত ক্ষীণ স্বরে বললো,
—ভাইয়া, তুমি আমাকে ঠকিয়েছো।
(চলবে…)