#চতুষ্কোণ /পর্ব:-০২
— Sharifa Suhasini
ওদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে-বাচ্চাটা নাবিলার নয়,ওদেরই। এসব দেখে শামীমের প্রচন্ড রাগ হলো। সে চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে,
—খবরদার, খবরদার ওই বাচ্চাকে কেউ স্পর্শ করবে না। যার তার বাচ্চাকে পেলেই এত আদর ভালোবাসা দিতে গেলে তো হবে না। কিছু ম্যানার শেখো। বাচ্চাটা যার,তার কাছে ফেরত দিয়ে দাও। ওর বাবা এসে ওকে নিয়ে যাবে।
শামীমের এমন অদ্ভুত প্রতিক্রিয়ায় প্রত্যেকেই প্রচন্ড অবাক হলো। সে এসব কী আবোল-তাবোল বকছে! তার বাবা রহমান খান একবার বাচ্চাটার দিকে,আরেকবার নিজের ছেলে শামীমের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। ছোট বাচ্চাদের চেহারা কার সাথে মিলেছে-এসব বুঝে ওঠা মুশকিল। কিন্তু এই বাচ্চাটা শামীমের না হয়ে আর কার হবে! না, না, তার বউমা নাবিলা এমন ধরণের মেয়েই নয়। তাছাড়া, শামীম নাবিলাকে যেমন গভীর ভালোবাসে, এমন ভালোবাসা পাবার পরে নাবিলা অন্য কোথাও যাবে-এটা অসম্ভব। ছেলে-বউয়ের সম্পর্কে কোনোদিন টু শব্দটিও তিনি করতে দেখেননি। শামীমের মনের ভিতর নিশ্চয় কোনো বিষয় নিয়ে প্রবল রাগ জমে আছে। আর সেই রাগ এখন তার বউ এবং বাচ্চার উপর ঝাড়ছে সে। তা না হলে তার এই ছেলেই বউমার প্রেগন্যান্ট থাকাকালীন কত যত্ন আত্তি করেছে, নিয়মিত শশুরবাড়িতে গিয়ে বউমার ভালো-মন্দের খোঁজ নিয়েছে। নিজের ঔরসজাত সন্তান না হলে তার আগমনে কোনো পুরুষ মানুষ এত গুরুত্ব দেয় নাকি?
তিনি তার ছেলের কাঁধে হাত রেখে শান্ত স্বরে বললেন,
—হ্যাঁ রে গাধা, বউমার সাথে রাগারাগি হয়ে থাকলে সেসব বাড়ি ফিরে পরেও তো করতে পারবি। এখন এই বাচ্চাটার সাথে এমন করছিস কেন? আচ্ছা, বউমা কোথায়? কই বেয়াইন, নাবিলাকে দেখছি না যে!
সায়লা বেগম তার জবাবে আঙুলের ইশারায় ওটি রুমের দিকে ইঙ্গিত দিলেন। সেই থেকে শামীমের এমন কান্ডে নাবিলার শারিরীক অবস্থা হঠাৎ খারাপ হতে শুরু করেছে। আর সেকারণেই তাকে এখন ইমার্জেন্সি আবার ওটি রুমে নেওয়া হয়েছে। সব শুনে রহমান খান নিজের ছেলের উপর বেশ বিরক্ত হলেন। এবার বেশ কড়া সুরেই ধমক দিয়ে তিনি ছেলেকে বললেন,
“শামীম, তোর কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে? বউমাকে এইভাবে এই অবস্থায় মানসিক অত্যাচার না করলে তোর পেটের ভাত হজম হচ্ছিলো না?”
“আমি সাফ সাফ বলে দিচ্ছি, আমি কোনো মিথ্যেকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই না। বাবা, আমাদের মধ্যে আপনি নাক গলাবেন না প্লিজ।”
শামীম আর কাউকে কিচ্ছুটি বলার সুযোগ না দিয়ে হনহন করে সেখান থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো। হাসপাতালের ডাক্তার নির্ঝর তার বেশ পরিচিত। একারণেই সে ডেলিভারির জন্য নাবিলাকে এখানে ভর্তি করিয়েছে। নির্ঝরের কেবিন রুম সে আগে থেকেই চিনতো। তার কেবিন রুম খুঁজে নিতে খুব বেশি অসুবিধে হলো না। নির্ঝরের কেবিনে ঢুকে সে বিরক্ত হয়ে চেয়ার টেনে বসে। নির্ঝর ওর দিকে একপলক চেয়ে নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
—কী ব্যাপার শামীম সাহেব? আপনার স্ত্রীর বাচ্চা হওয়াতে আপনি খুশি হননি? এভাবে হঠাৎ গোমড়ামুখ করে আছেন যে! এনিথিং সিরিয়াস?
—আমি এই বাচ্চার ডিএনএ টেস্ট করাবো। যদিও জানি, বাচ্চাটা আমার নয়। কিন্তু আমার বাড়ির লোকের কাছে প্রমাণ করতে গেলে ডিএনএ রিপোর্টটা জরুরি। আপনি আমাকে সাহায্য করবেন প্লিজ?
—মানে?আপনি আপনার স্ত্রীর উপর সন্দেহ করছেন!
—না। সন্দেহ করার মত কিছু নেই। আমি ওকে বিশ্বাস করি। নাবিলা অত্যন্ত ভালো মেয়ে। এটা আমি জানি। কিন্তু এই বাচ্চা আমার নয়, সেটাও জানি। ও আমার থেকে কিছু একটা লুকোচ্ছে।
ডাক্তার নির্ঝর হতবিহ্বল হয়ে ওর দিকে তাকালো। শামীম কী বলছে চাইছে এই ব্যাপারটা ঠিক মাথায় ঢুকলো না তার। স্ত্রীকে সে নাকি বিশ্বাস করে, সম্মান করে। সেই আবার বলছে এই বাচ্চা তার নয়। সেজন্য ডিএনএ টেস্টও করাবে। এটা আবার কেমন কথাবার্তা হলো! পুরুষ মানুষ হয় ডানদিকে আর না হয় বামদিকের ধারণা রাখার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু এই দুইয়ের মাঝামাঝি শামীম কীভাবে দাঁড়িয়ে আছে-সেটাই ঠিক বোধগম্য হচ্ছে ন।
সে প্রশ্নাতুর চোখে শামীমের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। শামীম সেটা খেয়াল করে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে একবার মুচকি হেসে বললো,
—ডাক্তারেরও বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে! ঠিক আছে, আমি ক্লিয়ার করছি। আমি নাবিলাকে সন্দেহ করছি না একারণেই যে,আমার সাথে বিয়ের পর সে আজ অব্দি কোনো ছেলের সাথেই মেশেনি। এমনকি প্রেগন্যান্ট হবার পর যখন প্রথম আমার রাগ হলো, তখন থেকেই ওর ফোন ট্র্যাকিংয়ে রেখেছি, নজরদারি করিয়েছি। আমি ব্যতীত দ্বিতীয় কোনো পুরুষ ওর জীবনে নেই। এমনকি খোঁজ নিয়ে এও জানতে পেরেছি, পাঁচ বছর আগে একটা ছেলে ওর সাথে টুকটাক কথা বলার চেষ্টা করতো। তার সাথেও যোগাযোগ নেই ওর। নাবিলা কোনো পুরুষকে সহ্যই করতে পারে না। ওর প্রতিটা মুভমেন্টের খবর আমি জানি। কিন্তু সবকিছুর বাইরে এটাই সত্য, এই বাচ্চাটা আমার নয়। আমাদের মধ্যে আজ পর্যন্ত এমন কিছু ঘটেনি, যার দরুণ আমি বাবা হতে পারি। তাছাড়া, ভুলক্রমে হবার সম্ভাবনাও নেই। কারণ, নাবিলা নিজেই আমার থেকে সময় চেয়েছিল। এখন এই সময়ের মধ্যে সে প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছে। আমার ধারণা, বিয়ের আগে বা সময়েই সেটা ঘটেছে। কিন্তু কীভাবে? অন্য কেউ বাচ্চাটার বাবা হলে নাবিলা একবার হলেও তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা তো করতো। নাবিলার কিছু একটা তো হয়েছেই। হয়তো কেউ ওকে জোর করে…
শামীম সহসা চুপ করে গেল। কষ্টে তার দুই চোখ ছলছল করছে। এক্ষুণি বোধহয় টপ করে পানি গড়িয়ে পড়বে। এতকিছুর পরেও তার ধারণা-নাবিলার সাথে কেউ খারাপ কিছু করেছে। আর সেটা একারণেই হয়তো নাবিলা কাউকে জানাতে চায় না৷
সব শুনে নির্ঝর কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে বসে রইলো। এমনটাও ঘটতে পারে! ব্যাপারটা ওর ঠিক হজম হলো না। তবু শামীমের বারবার অনুরোধে একরকম অনুরোধের ঢেঁকি গিলতে হলো তাকে। সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুর ডিএনএ টেস্ট। ভাবতেই কেমন সঙ্কোচ হচ্ছে। কিন্তু শামীমের দোটানাটাও দূর করা প্রয়োজন তার।
কিছুক্ষণ পর ওটির সামনে ফিরে এসে শামীম দেখে, তার বাবা এবং ভাই ডাক্তারের সাথে কথা বলছেন। নাবিলা আপাতত ভালো আছে। কিন্তু শামীমের কথায় হঠাৎ ওর প্যানিক এট্যাক হয়ে গেছে। ইমার্জেন্সি রুমটাও খালি ছিল না। নার্সরা ভেবেছিল, সিজারের ক্ষতে হয়তো বিশেষ সমস্যা হয়েছে। তবে ভাগ্য ভালো-সেটা ঘটেনি।
শামীমের দিকে প্রত্যেকেই ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। এমনটা সে না করলেও পারতো। ওর জন্যই আজ এই অবস্থা।
২.
তিন দিনের দিন নাবিলাকে বাসায় নিয়ে আসা হলো। এরমধ্যে শামীম সব অভিমান একপাশে রেখে নাবিলার যত্ম নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু বাচ্চাটাকে সে একবারের জন্যও ফিরে দেখেনি। সদ্য জন্মানো শিশুটি ওর সামনে তীব্র চিৎকার করেছে বহুবার। এতকিছুতেও শামীম সেদিকে ভ্রক্ষেপ করেনি। অথচ এসব নিয়ে নাবিলার যেন বিন্দু পরিমাণও মাথাব্যথা নেই। শামীমদের বাড়িতে এসে সে তার বাচ্চাকে একা একাই সামলে রাখার চেষ্টা করছে। এক মুহুর্তের জন্যও সন্তানকে নিজের থেকে আড়াল করছে না। একবার মাহদীর চার বছরের ছোট মেয়েটি ঘরে ঢুকেছিল। নাবিলা তাকে ইশারায় ডেকে নিয়ে বলে,
—ইলা,এই যে তোর ভাই। তোর মতই সুন্দর হয়েছে না?
ইলা বোকার মত কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ফিক করে হেসে দেয়। সেই হাসির অর্থ হলো-ভাইকে তার ভীষণ ভালো লেগেছে। সে এগিয়ে গিয়ে বাচ্চাটার গালে আলতো হাত বুলায়। কিন্তু তার পেছনে নাবিলা তার দিকে কোন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে, তা সে জানে না। ইলার দিকে চেয়ে নাবিলার প্রচন্ড আফসোস হয়। চোখের কোণে পানি জমে ওঠে। তবে সেটুকু সে গোপনেই মুছে নেয়। তারপর ইলার হাত ধরে বলে,
—তোমার ছোট ভাইয়ার নাম কী রাখবো জানো? মায়ান। সুন্দর নাম না?
—কিন্তু দাদু বলছিল ছোট কাকার নামের সাথে মিল রেখে নাম রাখবে।
“বললেই হলো? বাচ্চাটা কী ওর নাকি যে ওর নামের সাথে মিল রাখতে হবে! যত্তসব ঢং।”
কথাগুলো মনে মনে বলেই রাগ ঝাড়লো নাবিলা। এ সন্তান তার নয়-তা শামীমও জানে, নাবিলাও জানে। তবুও নাবিলা কাউকে খোলসা করে কিছুই বলছে না। অথচ এখনও শামীমের ধারণা-নাবিলার সাথে হয়তো খারাপ কিছু ঘটেছিল, যা সে বলতে চায় না। সেজন্যই ডিভোর্সের চাপ দিয়ে সত্যটা জানার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এতেও লাভ হয়নি।
তবুও এতকিছুর পরেও শামীম তাকে অগাধ বিশ্বাসে ঘরে এনেছে। আসলেই বিশ্বাসে? নাকি এরমধ্যে সত্যটা জানার জন্যই এত আয়োজন-তা একমাত্র শামীমই ভালো বলতে পারবে।
ইলা ছোট বাচ্চার সাথে খেলছে, এমন সময় শামীম একটা রিপোর্ট নিয়ে ভিতরে ঢোকে। তার চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, রিপোর্ট নিয়ে সে একেবারে কনফিউশানে পড়ে গেছে। নীরব ভঙ্গিতে সে বিছানার উপর বসে প্রথমবারের মত ছেলের মুখের দিকে তাকায়। উঁহু, তার সাথে কোনো মিলই নেই। কিন্তু এই বাচ্চাটির ডিএনএ-র সাথে তার ডিএনএ-র প্রায় পঁচিশ ভাগ মিল। এটা কীভাবে সম্ভব! বাবার সাথে সন্তানের ডিএনএ প্রায় পঞ্চাশ ভাগ মিলে যায়। সেখানে শামীম তো তার বাবা নয়। তাহলে এই পঁচিশ ভাগ মিল কীভাবে সম্ভব হলো? ডাক্তার নির্ঝর তাকে এর সম্ভাব্য কারণও বলেছে। কিন্তু শামীমের সেটা বিশ্বাস হয়নি।
নাবিলা তার মুখের দিকে প্রশ্নাতুর ভঙ্গিতে চেয়ে আছে। তবে শামীম তাকে কোনো জবাবই দিলো না। কাগজটা পকেটে রেখে মুচকি হেসে বললো,
—তোমার বাচ্চার শরীরের কন্ডিশন এখন বেশ ভালোই।
—তোমার হাতে কী সেটার রিপোর্ট?
—নাহ, আমার এক কলিগের শারিরীক কন্ডিশনের রিপোর্ট।
শামীম আর কথা না বাড়িয়ে সোজা বাইরে বেরিয়ে আসে। বাবা, বড় ভাই, ভাবি কারোর কোনো হদিস নেই। সবাই গেল কোথায়? অথচ কোনো একজনকে ভীষণ প্রয়োজন তার। বিশেষ করে তার ভাই মাহদী। মাহদীর সাথে ভাই হিসেবে ওর ডিএনএ পঞ্চাশ ভাগ ম্যাচ করে। আর তার সন্তানের সাথে পঁচিশ ভাগ ম্যাচ করার কথা। একভাগ বিশেষ ব্যাপার না৷ তবে এত মিল কীভাবে সম্ভব! ডাক্তার নির্ঝরের কথামতো বিজ্ঞানের ভাষায় তো এটাই দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু এটা কী আদৌ সম্ভব? সত্যটা আপাতত ধাপাচাপা দিয়ে সে নিজেই শেষ অব্দি খুঁজে বের করে। আচ্ছা, কোনোভাবে ইলার থেকে স্যাম্পল নিলেও তো কাজ চালানো যাবে। সে আবার ঘরে ফিরে এসে দেখে, ইলা ছোট্ট বাচ্চাটির সাথে একধ্যানে খেলছে। আর নাবিলাও পরম তৃপ্তি নিয়ে দুজনকে দেখছে। ব্যাপারটা কী!
(চলবে…)