তবু মনে রেখো পর্ব ১০

0
99

#তবু_মনে_রেখো
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১০

গভীর রাত। চারদিকে ঝিঁঝি পোকার ডাক। ঝিঁঝি পোকাগুলি মাঝে মাঝে দিক-বেদিক ছুটে আঁধারের মাঝে হলদে জ্বলকানি দিচ্ছে। সন্ধ্যা জানালা খুলে সেই অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশটির দিকে তাকিয়ে আছে। বাহিরে হাল্কা চাঁদের আলোতে সব স্পষ্ট কিন্তু কুয়াশার ভিড়ে ঝিঁঝি পোকাগুলোর হলদে ঝলকানি ছাতা আর কিছুই চোখে পড়ছে না। চারদিকে ধোয়ার মতো ভুতুড়ে মনে হচ্ছে। ক্ষনে ক্ষনে বাহির থেকে শো শো করে তীব্র ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে কিন্তু সন্ধ্যার কোনো হেলদোল নেই।
দূরের ওই বাঁশঝাড়টা মাঝে মাঝে নড়ে উঠছে। অন্যসময় হলে সন্ধ্যা এক্ষুনি ভয় পেয়ে জানালা বন্ধ করে দিতো কিন্তু আজকে তার মাঝে কোনো ভয়-ভীতি দেখা গেল না।
সন্ধ্যা স্বাভাবিকভাবে হারিকেনটা তার সামনে টেবিলে রাখল। এরপর চিঠির বক্সটা খুলল। এতক্ষন ধরে এই বক্সটা নিয়েই বসেছিল সে। বক্সটির দিকে তাকাতেই মুহিবের কথা মনে পড়ে গেল। বক্সটি মুহিবই দিয়েছিল তাকে। এরূপ সুন্দর কারুকার্যের বক্স সন্ধ্যা আগে কোনোদিন দেখেনি।
মুহিব সেদিন এটা হাতে এগিয়ে দিতেই সন্ধ্যা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। তার চাহনি দেখে মুহিব বলেছিল,’আমি যেখানে থাকি সেখানে এগুলোর অনেক চলন আছে।’
বিনিময়ে সন্ধ্যা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মুহিবকে শুধালো,’এটা কী? এটা দিয়ে আমি কী করবো?’
তখন মুহিব হেসে জবাব দিয়েছিলো,’সবাই সবার স্মৃতিতে মুড়িয়ে প্ৰিয়জনের উপহার, চিঠিগুলো এই বক্সে সযত্নে রেখে দেয়। তুমিও এভাবে রেখো। যখন আমরা বুড়ো হয়ে যাবো আর আমি বিদায় নিবো তখন এই বক্সটাতে আমার স্মৃতিমুড়ানো ভালোবাসাগুলো নাতি-নাতনিদের বলে চোখের অশ্রু ফেলবে। ঠিক আছে?’
সেদিন সন্ধ্যা রেগে মুহিবের কাছ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল। তার এরূপ কান্ড দেখে মুহিব উচ্চস্বরে হেসে দিয়ে বলেছিল,’এখনো তো বিদায় নিচ্ছি না। তোমার সাথে আরো বহবছর একসাথে কাটানোর বাকী। তারপরই তো বিদায় নিবো।’

মুহূর্তটা মনে পড়তেই সন্ধ্যার মনে হচ্ছে মুহিবের হাসিতে মুড়ানো সেই কথাটা এখনো কানে বাজছে। সন্ধ্যা আপনমনেই আওড়ালো,’আমারও তো ইচ্ছে আপনার সাথে বহুবছর কাটানোর।’ কথাটি নিজমনে বলতেই সন্ধ্যার চোখ অশ্রুতে টলমল করে উঠল। এই সুন্দর মুহূর্তগুলো পাওয়ার আগেই কী হারিয়ে ফেলবে সে! সে চিঠির বক্সটির দিকে তাকিয়ে পরম আদরে হাত বুলিয়ে দিল। সন্ধ্যার হাত বুলানোতে মনে হচ্ছে এটা কোনো বস্তু নয়, এটা একটা মানুষ। আর মানুষটি আর কেউ নয়, একমাত্র মুহিব।
এই তিনদিনে ডাকপীয়ন থেকে কোনো চিঠি দেয়নি। সন্ধ্যা ভেবেছিল, মুহিব হয়ত চিঠি দিবে কিন্তু না। সন্ধ্যার খারাপ লাগলো এই ভেবে যে – মুহিব কী শহরে গিয়েই তাকে ভুলে গেল! এমন ভাবনা আসতেই পরমুহূর্তে সে নিজেকে নিজে বকলো। মুহিব কেন তাকে ভুলে যাবে! মুহিবের পরীক্ষা, হয়ত এজন্য চিন্তায় আর মনে পড়েনি।
সে চিঠির বক্স থেকে মুহিবের আগের দেওয়া চিঠিগুলো খুলে দেখতে লাগলো। এই চিঠিগুলোতে মুহিবের ঘ্রান পায় সন্ধ্যা। সে চিঠিগুলো বুঁকের মধ্যে রেখে চোখ বন্ধ করে ফেলল। মুহিব কী জানে! তার জীবন যে সম্পূর্ণরূপে বদলে যাচ্ছে! সন্ধ্যার চোখ গড়িয়ে অশ্রু পড়লো। সে যে মুহিবকেই তার প্রাণের স্বপ্নপুরুষ হিসেবে কল্পনায় মেতে ছিল! অথচ তার জীবনের মোর এমনভাবে ঘুরে যাবে তাতো সে জীবনে কল্পনাতেও আনেনি। এই মুহূর্তে সে মুহিবকে খুব করে পাশে চাইছে। এতদিনের দমানো ইচ্ছেগুলো আর দমিয়ে রাখতে পারছে না সে। ইচ্ছে করছে, ছুটে মুহিবের কাছে গিয়ে বলতে, আমি আর পারছি না, আমার আপনাকে দরকার ভীষণ করে। কিন্তু আফসোস! এখন আর মুহিব সেইভাবে তার পাশে নেই। চাইলেও ইচ্ছেগুলো পূর্ণতা পাবে না।

জোহরা শব্দহীন পায়ে মেয়ের পেছনে এসে দাঁড়ালেন। তার নিজেকে অপরাধবোধে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। তাই তো ঘুম না আসায় এপাশ ওপাশ করতে গিয়ে বেড়ার ফাঁকে পাশে মেয়েদের রুমের মিটিমিটি আলো দেখে সে এসেছে। এতরাতে মেয়েকে এভাবে বসে থাকতে দেখে জোহরার মনে আরো তীব্রভাবে অনুশোচনা ঘিরে ধরলো। সে খোলা জানালার দিকে একবার তাকিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। তার দৃষ্টি পড়লো মেয়ের অশ্রুমিশ্রিত চেহারাটির দিকে।
জোহরা মেয়ের কাঁধে হাত দিতে চাইলেও হাত গুটিয়ে নিলো। থাক না সে একটু নিজের মতো করে।
জোহরা ধীরপায়ে পিছু ফিরে চলে আসতে নিতেই সন্ধ্যা একই স্থান থেকে ডাক দিল।
‘মা।’
জোহরা ফিরে তাকালো। আজ তিনদিন পরে সন্ধ্যা তাকে ডাকলো। তা কথা বলল। এই তিনদিন সন্ধ্যা কোনো কথা বলেনি। সম্পূর্ণ নিশ্চুপ ছিল।
জোহরা এগিয়ে আসতেই মেয়ের হাতে চিঠির বক্স দেখে মেয়ের দিকে তাকালেন।
সন্ধ্যা শান্তসরে বলল,
‘বসো।’
জোহরা মেয়ের দিকে তাকালেন। তার মেয়ের এমন শান্ত কণ্ঠস্বর তাকে পু’ড়া’চ্ছে।
‘আমাকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাবা?’
জোহরা অপরাধবোধে মাথা নিচু করে ফেলল।
‘মা, ওই হারুনই আমাকে স’র্ব’না’শ করতে চেয়েছিল। আমি যে করবো না এই বিয়ে। খুব কী বোঝা হয়ে গিয়েছি?’

জোহরা থমকালো। সে মেয়ের দিকে তাকালেন। মেয়ের শান্ত অশ্রুতে টলমলে মুখখানি দেখে তার ভেতরে বুক ধড়ফড় করে উঠল।
‘কী বলছিস? হারুনই এসব।’
সন্ধ্যা কিছু বলল না। কিন্তু জোহরা বুঝে নিল। জোহরা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। সন্ধ্যা মায়ের বুকে নিজেকে আরো গুটিয়ে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে নিল। জোহরা মেয়েকে দুহাতে আগলে নিয়ে হারিকেনটির দিকে তাকিয়ে বসে রইল।
বেশ কিছুক্ষন পরে সন্ধ্যা নিজেই মাকে বলল,’তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো মা।’
জোহরা মেয়ের দিকে তাকালেন,’তুই ঘুমাবি না?’

‘হ্যাঁ।’ সন্ধ্যার এমন ছোট জবাব পেয়ে জোহরা উঠে দাঁড়ালো। পা বাড়াতে নিয়ে সে একবার পিছু ফিরে মেয়ের দিকে তাকালেন। এরপর চোখ মুছে রুম ত্যাগ করলেন।

সন্ধ্যা একটা কাগজ এগিয়ে নিলো। হারিকেনের মৃদু আলোয় গুটি গুটি অক্ষরে লিখল,
‘আপনার সন্ধ্যা ভালো নেই, আপনাকে দরকার। ভীষণ করে দরকার। ভালোবাসেন তো ফিরে এসে নিয়ে যান আমাকে। যদিও এটা অকেজো আবদার তবুও বলছি। আপনাকে খুব করে পাশে চাইছি।’

লিখা শেষ হতেই সে কাগজটা সযত্নে খামে ঢুকিয়ে ফেলল। হারিকেনের জ্বালানি ফুরিয়ে আসার আগ পর্যন্ত সন্ধ্যা একইভাবে খোলা জানালার ধারে বসে রইল। চোখের সামনেই আঁধার কাটিয়ে ভোর ফুটতে শুরু করেছে। ঠান্ডার জোরটা আরো বেড়ে গিয়েছে। সন্ধ্যা দরজা খুলে বিস্তীর্ণ উঠান পেরিয়ে সেই বিলের ধারে গিয়ে দাঁড়ালো। শীতের শেষ এখন কিন্তু শেষদিকে যেন শীত আরো বেশি করে পড়ছে। সন্ধ্যা গায়ে ভালোমতো চাঁদর জড়িয়ে নিল। সে না চাইতেও তার পাশে একবার তাকালো। এই জায়গাটাতে মুহিব দাঁড়িয়ে থাকত। আজ ভীষণ করে তার উষ্ণ পেতে ইচ্ছে করছে। সন্ধ্যা চোখ ফিরিয়ে অদূরের কুয়াশায় ঘেরা বিলগুলোর দিকে দৃষ্টি দিল। মুহিবকে মনে পড়ছে আজ ভীষণ করে। মুহিবও কী তাকে এভাবে মনে করছে! কী জানি! আর কী সে এই সুন্দর মুহূর্তগুলো ফিরে পাবে! না কি এভাবেই স্মৃতির আড়ালে ঢেকে পড়বে সব!

#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম। অসুস্থ ছিলাম তাই আরো বেশি ইনাক্টিভ হয়ে গিয়েছিলাম। ভুল ভ্রান্তি ক্ষমার নজরে দেখার অনুরোধ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here