তবু মনে রেখো পর্ব ১১

0
57

#তবু_মনে_রেখো
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১১

সকালে জোহরা আনিস মিয়াকে জানালো। কিন্তু আনিস মিয়া তার কথায় অনড়। সে নাকোচ করে স্ত্রীকে জানিয়ে দিলেন,
‘যাই কিছু হয়ে যাক এহন আর বিয়ে ভাঙ্গন যাইবো না। চেয়ারম্যান সাহেবের কথার খেলাপ করন যাইবো না।’
জোহরাও স্বামীর সাথে সাথে রেগে গেল। সেও সমানতালে উঁচু আওয়াজে প্রতিবাদের সুরে বলে উঠল,
‘আমি বেঁচে থাকতে আমার মেয়ের এমন সর্ব’না’শ আমি হতে দিবো না। ওই ছেলের কাছে আমি মেয়ে দিবো না। আমি…’
বাকী কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই আকস্মিক থা’প্প’ড়ে সে গালে হাত দিয়ে ঐভাবেই ঠায় দাঁড়িয়ে পড়লো।
আনিস মিয়া থা’প্প’ড় মেরেও ক্লান্ত হলেন না। তিনি রাগ সামলাতে না পেরে জোহরাকে ধাক্কা দিয়ে পা বাড়ালেন। আকস্মিক ধাক্কায় জোহরা তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নিতেই সন্ধ্যা দৌড়ে এসে আগলে নিল।
আনিস মিয়া রেগে হনহনিয়ে চলে গেলেন। আর সন্ধ্যা মাকে আগলে ধরে বাবার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। সে ঐভাবেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। তার জীবনটা কী এভাবেই শেষ হয়ে যাবে! আর কিছুই কী করার নেই!
——–

সন্ধ্যা জানালার শিকলে মাথা রেখে বাইরে তাকিয়ে আছে। শীতের রোদ্দুর অনেক মিঠা হয় কিন্তু এইমুহূর্তে একপাও বাড়াতে তার ইচ্ছে হচ্ছে না। তার জন্য বাবা মায়ের মধ্যে এমন সম্পর্ক তা সে মানতে পারছে না।
সন্ধ্যা জানালার বাইরে দৃষ্টি দিল। জানালার কাছেই বিলের ধারে মৃদু বাতাসে ঘাসের সাথে সাথে ডেইজিফুলের সবুজ পাতাগুলো ধুলে ধুলে উঠছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিশিরে ভেজা সবুজ ঘাসগুলো বেশ লাগছে। সবুজের সমারোহে হলুদে ভরা ডেইজিগুলো দেখতে ভারী আকর্ষণীয় লাগছে। বাড়ির আশেপাশে এই ফুলগুলো তাকে কোনোদিন সেভাবে টানেনি কিন্তু মুহিব জীবনে আসার পর থেকে সে উপলব্ধি করতে শিখেছে যে চারপাশে যা কিছুই আছে সবকিছুরই আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে।
সন্ধ্যা ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আরেকটি স্মৃতিতে ভেসে গেল।
মুহিবের কোনো একটা কথায় সন্ধ্যা সেদিন ভীষণ রেগে গিয়েছিল। তখনই মুহিব ডেইজি ফুল দিয়ে আঙুলের রিং করে সন্ধ্যার দিকে হাটু মুড়ে বাড়িয়ে দিয়ে অদ্ভুত হাসোজ্জল ভঙ্গিমায় বলে উঠেছিল,
‘এই গ্রামে তো ভালোবাসার প্রতীক গোলাপ পাওয়া যায় না তাই নাহয় এইটা দিয়েই শুরু করলাম। ফুলটি গ্রহণ করে আমাকে ধন্য করুন মহারানী।’
সন্ধ্যা পাশ ফিরে যেতেই মুহিব সেপাশে এগিয়ে গিয়ে আবারো বলে উঠেছিল,
‘বুঝছি, সামান্য ছোট ফুল তাই এইভাবে ফিরে যাচ্ছ তো? দেখো, এটারও কিন্তু আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে। আচ্ছা যখন বিয়ে হবে তখন নাহয় আরো আকর্ষণীয় ফুল নিয়ে আসবো। হয়ত দূর থেকে নিয়ে আসার ফলে কিছুটা শুকিয়ে বা কিছুটা চ্যাপ্টা হয়ে ফুলের গঠনটার সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে। সেজন্য কথা শোনাতে পারবে না কিন্তু।’
মুহিবের শেষ কথাটাতে সন্ধ্যা হাসি আটকে রাখতে না পেরে রাগী মুখ করে থাকতে আর পারেনি। তার হাসি দেখে মুহিবও সেদিন চমৎকার ভাবে হেসেছিল।
সন্ধ্যা সেদিন ডেইজি পেয়ে হাসলেও- সে কিন্তু খুব সুন্দর করে সেদিনের ফুলগুলো খুব যত্নের সহিত রেখে দিয়েছে। সন্ধ্যা ডায়রি খুলে সাদা পৃষ্ঠার সাথে লেপ্টে যাওয়া শুকিয়ে কালো ডেইজি গুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। তার না চাইতেও চোখ থেকে দুফোটা জল শুকিয়ে যাওয়া ফুলগুলোর উপর পড়লো। কেন এতো বেশি সুন্দর মুহূর্তগুলো তার হয়েছে! কেন এসব এতো বেশি পু’ড়া’চ্ছে তাকে!

——-

বিকাল গড়াতেই জোহরা তড়িঘড়ি করে বিস্তীর্ণ উঠান ভেদ করে রাস্তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। এই রাস্তা দিয়েই গ্রামে ঢুকে সবাই। জোহরাদের বাড়িই গ্রামের প্রথম। সে জানালা দিয়ে দেখেছিল অদূরে বিলের আইল ধরে চেয়ারম্যান আসছিলেন তাই তো তাড়াহুড়ো করে এখানে এসে দাঁড়িয়েছে।
আনিস মিয়া সুদূর উঠানের চারদিকে খড় দিয়ে ঘেরাও করে দিয়েছে। শুধু বিলের ধারে ঘেরাও করা হয়নি। কারণ সেদিকে সারি সারি লাইন ধরে অনেকগুলো গাছ দাঁড়িয়ে আছে আর যেহেতু সেদিকের পরে আর কোনো বাড়ি নেই, সব বিল সেই অনুসারে সেদিকে ছাড়া বাকী তিনদিকেই খড় দিয়ে ঘেরাও করে দিয়েছে আনিস মিয়া। আর সামনে দিয়ে উঠানে ঢোকার পথে একটা পর্দা টাঙিয়ে দিয়েছে গেটের মতো করে। জোহরা সেই পর্দার আড়াল দিয়ে এইপাশে দাঁড়িয়ে রইল।
গ্রামের রাস্তায় ঢোকার শুরুতেই আনিস মিয়ার বাড়িটি। আজগর শেখ গ্রামের রাস্তা ধরতেই বাড়িটার সামনে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল। সে চাই না এই বাড়িতে চোখ পড়ে তার কিছু মনে পড়ুক। তবুও নিজেরই অজান্তে এই বাড়িটা ডিঙিয়ে যেতে প্রতিবারই তার দৃষ্টি এই বাড়ির উঠানটাতে পড়ে। সে জানে না কেন এখনো এতো পিছুটান! আজও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সে স্বভাববশত তাকিয়ে চোখ ফেরাতেই বুঝতে পারলো উঠানে দেওয়া পর্দাটার আড়ালে কেউ একজন আছে।
রাস্তা দিয়ে কেউ এগিয়ে আসার পদধ্বনি কানে আসতেই জোহরা পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। চেয়ারম্যান তার ভ্রম ভেবে পা বাড়াতে নিতেই সেই অনাকাঙ্খিত কণ্ঠস্বর কর্ণকুহরে বাজতেই তার পা আপনাআপনি থেমে গেল। যেন জীবনের এতগুলো বছর পড়েও এই কণ্ঠস্বরটির কথায় তার পা এখনো মেনে চলে। আজগর শেখ মনে মনে হাসলো। তার অবচেতন মন এখনো সেই ষোড়শি কন্যাটাকেই ভেবে চলে। যেটা তার উচিত নয়।
আজগর শেখের ভাবনার মাঝে জোহরা এসে মুখোমুখি দাঁড়ালো। বহুবছর পরে সেই কাংক্ষিত মানুষটিকে দেখে জোহরা যা ভেবে এসেছিলো তা ভুলতে বসেছিল। জোহরা নিজেকে সংযত করতে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল।
এতবছর পরে সেই ষোড়শি মেয়েটাকে নিজের একদম কাছাকাছি দেখে আজগর শেখের বুক ধড়ফড় করে উঠল। এমন না যে, বিয়ের পরে জোহরাকে আগে দেখেনি। দেখেছে তবে খুব দূর থেকে এক পলকের জন্য। আজকের মতো এরকম আর দেখা হয়নি। আজগর শেখ তাকালেন। সেই তেজি চোখ এখনো আছে। যেটাকে দেখেই সে ভালোবেসেছিল এই মেয়েটাকে। সে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারল না। চোখ সরিয়ে নিল। যেটাই হোক, একদিন তো ভালোবেসেছিল এই মেয়েটাকে!
সময়ের ব্যবধানে আজ তারা ভিন্ন ভিন্ন মানুষের সংসারে। ভিন্ন ভিন্ন স্বপ্নে,ভিন্ন ভিন্ন জীবনে। নিয়তি বড়োই নিষ্ঠুর।
আজগর শেখ মলিন শ্বাস ফেললেন।
জোহরা দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘আপনি কেন করেছেন এমন?’
আজগর শেখ তাকালেন। শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন,
‘হারুন ভালোবাসে সন্ধ্যাকে। আর একজন ভালোবাসার মানুষকে তুলে দিতে চাচ্ছি। আর ভালোবাসার কদর আমি বুঝি।’
জোহরা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। আজগর শেখের শেষ কথাটা তাকে ভেতরে ভেতরে নাড়িয়ে দিচ্ছে কিন্তু তার নরম হওয়া চলবে না। জোহরা নিজেকে শক্ত করে জবাব দিল,
‘কিন্তু সন্ধ্যা তো ভালোবাসে না। সেটা আপনার বুঝতে হবে।’
আজগর শেখ হেসে প্রতুত্তর করলো,
‘বিয়ে ভাঙবে বলে এসেছো?’

জোহরা স্বাভাবিক কণ্ঠে জবাব দিল,
‘তা নয়ত কী!’
‘এই বিয়ে হবে।’
জোহরা আজগর শেখের কাছ থেকে এমন উত্তর আশা করেনি। সে বলে উঠল,
‘আপনার কী লাভ?’
আজগর শেখ সামনে তাকিয়ে জবাব দিল,
‘কোনো লাভ নেই, আমার মা ম’রা ভাইপোটা যাতে ঠিক হয়ে যায় সেটাই লাভ।’

‘নিজের স্বার্থটাই ভাবছেন?’

জোহরার শক্ত কণ্ঠে বলা কথাটা শুনে আজগর শেখ তাকিয়ে জবাব দিল,’মিথ্যা বলবো না। হ্যাঁ স্বার্থটাই দেখছি।’

‘আপনি কী জানেন? সন্ধ্যাকে সেই অপহরণ করেছিল। আমি বেঁচে থাকতে এই বিয়ে আমি দিবো না। আমার মেয়ের জীবন আমি ধ্বংস হতে দিবো না।’

‘কেউ কাউকে ভালোবেসে ভালো হতে চাইলে সেখানে দোষের তো কিছু নেই।’

‘আলবাত দোষ আছে। আমার মেয়ের জীবন কেন এভাবে জড়াবে! আমি ভাঙবোই এই বিয়ে।’
‘পারলে তাই করো।’
জোহরার আজগর শেখের কথার প্রতুত্তর আর করতে ইচ্ছে হলো না। সে পর্দা সরিয়ে উঠানের দিকে পা বাড়ালো। আজগর শেখ জোহরার যাওয়ার পানে তাকিয়ে বিড়বিড় নিজের মনেই আওড়ালেন,’সেই আগের তুমিই রয়ে গেলে!খালি আমি নেই, তুমি হয়ত জানবেই না,আমি এখন বদলে গিয়েছি। নিজের বংশের সুখ আগে। আর একজন মানুষের ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা আমি করবো। সেটাতে বিপথে গিয়ে তোমার চোখে খারাপ হতে হলেও তাই হবো। তবুও ভালোবাসার মানুষকে তার সাথে আবদ্ধ করে দিবোই। আমার মতো কষ্ট আর কেউ অনুভব করুক তা আমি চাই না।’

#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম। রিচেক করা হয়নি, তাড়াহুড়োয় লিখেছি তাই অনেক ভুল আছে। এজন্য ক্ষমাপ্রার্থী। পারলে ধরিয়ে দিবেন, সংশোধন করে নিবো ইন শা আল্লাহ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here