#ধারাবাহিক
#রাখি_আগলে_তোমায়_অনুরাগে ( দ্বিতীয় পর্ব )
#কলমে—- অর্পিতা চক্রবর্তী
( যাঁরা মা হতে চলেছেন তাঁরা প্লিজ পড়বেন না । সব গল্প সকলের জন্য নয় ।)
আলট্রা সোনোগ্রাফি পর্বের দুইদিন পর ডক্টর ব্যানার্জির চেম্বারে বসে আছে রাই আর সুমন । ডক্টর ব্যানার্জি মন দিয়ে রিপোর্ট দেখছেন । তিনি বয়স্ক এবং অভিজ্ঞ চিকিৎসক । সুমন গতকাল রাতে রাইয়ের বাড়ি এসেছে । কিছু ক্ষণ পর ডক্টর ব্যানার্জি বললেন,
ডক্টর : শোনো । এখন যা বলবো একটু মন দিয়ে শুনবে । মাতৃগর্ভে অনেক সময় ভ্রূণ পূর্ণতা পায় না । তোমাদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে । বাচ্চাটির গঠনে ত্রুটি রয়েছে । এটা এমন একটা জটিল স্নায়বিক রোগ যা খুব কম মানুষের মধ্যে দেখা যায় । সবথেকে বড়ো কথা এই ধরনের ভ্রূণের এতোদিন বেঁচে থাকাটাই আশ্চর্যজনক । যদি পাঁচ মাসে পরীক্ষা করাতে তাহলে অনেক আগেই কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতো ।
রাই : আমি বুঝতে পারছি না আপনি কি বলছেন । আমি তো গত মাসেও ওর নড়াচড়া অনুভব করেছি । বাবির মতো অতোটা না হলেও খুব আস্তে আস্তে তো নড়াচড়া করেছে । তাহলে ? গঠনে ত্রুটি থাকলে নড়বে কিভাবে ?
ডক্টর : মা রে, তুই আমার কথা একটু বোঝার চেষ্টা কর । তোর ছেলেও তো আমার হাতেই হয়েছে । কিন্তু এখন তোর নমাস পেড়িয়ে গিয়েছে । অ্যাডভান্স স্টেজে এসে এই ধরনের প্রেগন্যান্সি খুব মুশকিল । আর দেরি করা উচিত নয় । যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভর্তি হয়ে যা । তারপর দেখছি । কিন্তু মন শক্ত কর ।
সুমন : রাই, তুমি একটু বোঝার চেষ্টা কর । তুমি এক কাজ করো । বাইরে গিয়ে বস । আমি ভর্তির বিষয়টি জেনে আসছি ।
রাই কোনোরকমে বাইরে এসে ধপ করে বসে পড়ে । অপরিণত ভ্রূণ ! এ কি করে সম্ভব ? নয়টা মাস কম কথা তো নয় । তবে কি সে ভুল করলো ? কিন্তু তা কিকরে হয় ! সে তো গতমাসেও নড়াচড়া অনুভব করেছে । হঠাৎ করেই তার মনে হয়, তাইতো । দুদিনের ঝামেলায় সে তো খেয়ালই করেনি যে বাচ্চাটা নড়ছে না । তবে কি??? হে ভগবান !
ঠিক তখনই বেড়িয়ে আসে সুমন । এসে বলে, ” চলো । আগামীকাল সকালেই আমরা চলে আসবো । তুমি ভর্তি হবে । ” রাই বলে, ” আমি আরেকবার ডক্টরের সাথে কথা বলতে চাই । ” সুমন বলে, ” আমি তো সব জেনে এসেছি । বাড়ি গিয়ে তোমাকে বুঝিয়ে বলবো । এখন চলো । তাছাড়া বাবিকেও অনেকক্ষণ দেখিনি । ” বিধ্বস্ত অবস্থায় ফিরে চলে দুজনে । বাড়ি ফিরে সকলের মুখোমুখি হয় সুমন । সবাইকে বুঝিয়ে বলে । কেউ যেন বিশ্বাস করতে চাইছেনা, কিন্তু রাইয়ের কথা ভেবে ভেঙে পড়তেও পারছে না ।
বাবির আজ খুব মজা । তার দাদুভাই, দিদিভাইরা অর্থাৎ রাইয়ের কাকু , কাকিমারা সবাই এসেছেন । বাবি মামাদের সাথে খেলছে, মামাদের বাইকে চড়ে বেড়াতে যাচ্ছে । আহা রে ! ছোট্ট মানুষ বুঝতেও পারছে না তার বাড়ির লোকজনের উপর দিয়ে কেমন ঝড় বয়ে যাচ্ছে । রাই চুপচাপ বসে আছে । সে ভাবছে তাদের দুজনেরই আশা ছিলো এবার তাদের ঘরে একটা মিষ্টি কন্যাসন্তান আসবে । তাদের ছোট পরিবার পূর্ণতা পাবে । কিন্তু মানুষ একজীবনে সব পায় না ।
রাতে ঘুমাতে এসে সুমন জড়িয়ে ধরে রাইকে । একপাশে বাবি অকাতরে ঘুমোচ্ছে । রাই অনুভব করে সুমন খুব কষ্ট পাচ্ছে । আসলে ছোট থেকেই ছেলেদের শেখানো হয় যে, ” তুমি ছেলে, তুমি কাঁদবেনা । কান্না করা তো মেয়েদের কাজ । ” ছেলেরাও তো মানুষ । কাঁদতে পারলে তাদের কষ্ট খানিক লাঘব হতো ।
রাই বলে, ” তুমি ডক্টর ব্যানার্জির চেম্বারে বসে কিকি বলছিলে সুমন ? ”
সুমন বলে, ” কিছু না । তোমাকে আগামীকাল কখন ভর্তি করতে হবে তাই জানতে চাইছিলাম । ”
রাই : না সুমন । তুমি আমার কাছে কিছু লুকিয়ে যাচ্ছ । আমি জানিনা কাল কি হবে ? কিন্তু এর আগে কখনো তুমি আমার কাছে কিছু লুকিয়ে রাখোনি । আমার সেই বিশ্বাসের মর্যাদা দিও ।
সুমন আর নিজেকে সামলাতে পারে না । ডক্টর ব্যানার্জি তাকে বলেছেন যে এই ধরনের জটিল স্নায়বিক রোগ কখনো সারে না । বিশেষ করে এই অ্যাডভান্স প্রেগন্যান্সি স্টেজে এই ধরনের অপারেশন মা ও বাচ্চা দুইজনের পক্ষেই ঝুঁকিপূর্ণ । অপারেশনের পরও রাইয়ের অনেক শারীরিক সমস্যা দেখা দেবে , তাই তাকে সাবধানে রাখতে হবে । সুমন ডক্টরকে জানিয়েছে তিনি যেন রাইকে তার কাছে ফিরিয়ে দেন ।
রাই বলে এতো তাড়াতাড়ি ভর্তি না হয়ে আর একজন চিকিৎসকের সাথে কথা বলা উচিত । উত্তরে সুমন জানায় বাবিকে যে চিকিৎসক দেখেন তাঁর কাছে রিপোর্টের ছবি পাঠিয়েছিলো । তিনিও একই কথা জানিয়েছেন । তাদের কপালে হয়তো এই দিনটা দেখার কথা ছিলো । রাই চুপচাপ শুনে চলে । তার মন অন্য হিসাব কষতে ব্যস্ত । ডক্টর ব্যানার্জিকে কাল সকালে একটা ফোন করতেই হবে ।
পরদিন সকালে সকলের অলক্ষ্যে রাই ডক্টর ব্যানার্জিকে ফোন করে । ওঁকে অনুরোধ করে, যাতে উনি বাচ্চার বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করেন । চিকিৎসা বিজ্ঞান তো অনেক উন্নতি করেছে । ডক্টর ব্যানার্জি তাকে বলেন সে যেন মনের জোর বজায় রাখে । বাবি হওয়ার সময় রাই বলেছিলো, ” স্ট্রেচার লাগবে না । আমি হেঁটেই ওটি তে পৌঁছে যাবো । ” সেই কথা মনে করিয়ে দিয়ে তাকে শক্ত হতে বলেন ।
সময় এগিয়ে আসে । বাবিকে প্রাণভরে আদর করে রাই । বাড়ির পরিবেশ থমথমে হয়ে রয়েছে । তার শ্বশুর বাড়ির থেকে সবাই এসেছে । সুমন রাইয়ের হাতটা শক্ত করে ধরে । রাই জানেনা কি হবে কিন্তু সুমনের, বাবা – মা – কাকু – কাকিমা সকলের মনের অবস্থা বুঝতে পারে সে । রাই মাকে বলে, ” বাবির খেয়াল রেখো । ” আর সুমনকে বলে, ” চিন্তা কোরোনা । আমি ফিরে আসবো । ”
হসপিটালে ঢুকেই তারা ডক্টর ব্যানার্জির চেম্বারে যায় । ডক্টর বলেন, ” বেশি চিন্তা করিসনা রে মা । আমাদের উপর একটু ভরসা রাখ । ” রাই আবার তাঁকে অনুরোধ করে তিনি যেন বাচ্চাকেই বাঁচান । দৃশ্যতই অস্বস্তিতে পড়েন ডক্টর ব্যানার্জি এবং বলেন, “দেখ , মেডিকাল সায়েন্স অনেক উন্নতি করেছে কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিজ্ঞানেরও হাত পা বাঁধা রয়েছে । তোর শুনতে ভালো লাগবে না তবু বলবো, এইধরনের বাচ্চারা বাঁচেনা । আর যদি কোনোভাবে বেঁচেও যায়, তুই সহ্য করতে পারবি না । মা হয়ে চাইবি যাতে সে না থাকে । তোর ছেলে সম্পূর্ণ সুস্থ । তুই তাকেই ভালোভাবে মানুষ কর । তার জন্য তোকে সুস্থ হতেই হবে । ”
সারাদিন ধরে রাইয়ের চিকিৎসা চলে । পরদিন রাতে প্রচণ্ড ব্যথা ওঠায় তাকে ওটিতে তোলা হয় । যতক্ষণ জ্ঞান ছিলো সে এক অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করেছে । তারপর সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে । জ্ঞান ফিরলে দেখে তাকে বেডে দেওয়া হয়েছে । কিন্তু নয়মাস ধরে যাকে নিজের শরীরে পালন করলো তার কি হলো ? কার কাছে জানতে চাইবে ? একটু পরে সিস্টার আসলে রাই তাঁকে প্রশ্ন করে । কিন্তু তিনি রাইয়ের পরিচর্যা করলেও তার প্রশ্নের উত্তর দেননা । অনেক কাকুতি মিনতির পরে জানান, যাকিছু বলার তা ডক্টর ব্যানার্জি বলবেন । সিস্টারদের কিছু বলার অনুমতি নেই ।
পরদিন সকালে সুমন আর রাইয়ের ভাই তাকে দেখতে এলে রাই তাদের কাছেও একই প্রশ্ন করে । সুমন মাথা নিচু করে বসে থাকে । রাই যা বোঝার বুঝে যায় । সে শুধু জিজ্ঞাসা করে, ” তুমি দেখেছিলে ? ” সুমন জানায়, ” হ্যাঁ । আমি, তোমার বাবা, কাকু সবাই দেখেছি । ” রাই বলে, ” তাহলে আমাকে দেখতে দিলে না কেন ? ” সুমন বলে, ” তুমি সহ্য করতে পারতে না রাই । ”
রাই স্তম্ভিত হয়ে যায় । সে সহ্য করতে পারতো না ! যে হোক, যেমনই হোক না কেন তার সন্তান ছিলো । নয়মাস ধরে যাকে গর্ভে ধারন করেছে তাকে সহ্য করতে পারতো না ! রাই বোঝেনি আরও নিদারুণ সংবাদ তার জন্য অপেক্ষা করছে । রাতে ডক্টর ব্যানার্জি রাউন্ডে এসে রাইয়ের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চান । রাই তাঁকে প্রশ্ন করে, ” আমার কি হয়েছিল ? ” খানিকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর ডক্টর ব্যানার্জি বললেন, ” তোর মেয়ে হয়েছিলো । ”
মেয়ে— কতোদিন ধরে তার আশা, একটা মেয়ে হবে যাকে সে সুন্দর করে সাজাবে, পড়াশোনা শেখাবে । আরও কতো কি । ভগবান, যদি কেড়েই নিতে হলো তাহলে দিয়েছিলে কেন ? শরীরের দুর্বলতা, যন্ত্রণার পাশাপাশি প্রবল মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে তার দিন কাটছে । সুমনও কর্মক্ষেত্রে ফিরে গেলো । তারও কিছু ভালো লাগেনা, একটা কষ্ট একটা মনখারাপের অনুভূতি তাকে সবসময় ঘিরে রাখে । অন্যদিকে রাই যতোই নিজেকে বাস্তববাদী ভাবুক না কেন, এই ঘটনার জেরে সেও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়লো । আজকাল প্রায়ই তার মাথা ঘোরে, হাত পা কাঁপে । তার কোনোকিছুই ভালো লাগেনা । সে প্রতিদিন মনখারাপিয়া সন্ধ্যায় ডুবে যেতে লাগলো । এর মধ্যেই শ্বশুর মশাই তাকে বাড়ি ফিরতে বললেন কারণ শাশুড়ি মায়ের শরীর খুব খারাপ , তিনি নাতিকে দেখতে চাইছেন । রাইয়ের বাবা তাকে সেখানে পৌঁছে দিয়ে এলেন । রাইয়ের জীবনে অন্য এক অধ্যায় শুরু হলো ।
////////////////////////////////////////
ঘরেতে এলোনা সেতো / মনে তার নিত্য আসা যাওয়া
আজকাল প্রায়ই রাই একটা স্বপ্ন দেখে । তার স্বপ্নে একটা ছোট মেয়ে আসে । পরনে তার গোলাপী অথবা সাদা ফ্রক । শুধু মুখটা আবছা । রাইয়ের ঘুম ভেঙে যায়, সে বিছানায় উঠে বসে । জল খায় । এটা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় দাঁড়িয়ে গেছে । এই বিষয়টি কাওকে বলতেও পারছে না । নিজের মনের উপর চাপ নিতে নিতে অসুস্থ হয়ে পড়ে সে । শুয়ে থাকে বিছানায় । শাশুড়ি মা অত্যন্ত বিরক্ত হন । বৌমাকে নিয়ে এসে যদি নিজেকেই কাজ করতে হবে তাহলে কিকরেই বা ভালো লাগে ! তিনি গজগজ করতে করতে বলেন, ” ওর আগে থেকেই অনেক অসুখ ছিলো । পাগল মেয়ে একটা । আমার ছেলের গলায় এই পাগলটাকে ঝুলিয়ে দিয়ে আমার সুমনের জীবনটাই নষ্ট করে দিলো । ”
রাই মৃতবৎ শুয়ে থাকে, সে যেন কিছু শুনতেই পাচ্ছে না । তার খিদে, তৃষ্ণা পায় না । অন্যদিকে বাবি অনাদরে, অবহেলায় বড়ো হতে থাকে । তার বাবা বাইরে থাকেন, মা অসুস্থ অবস্থায় পড়ে আছে । তাকে দেখার কেউ নেই । রাইয়েরও এই সময়ে একটু সহমর্মিতা, সহযোগিতা দরকার ছিলো । এই সময়েই সুমনকে তার বেশি দরকার ছিলো । সে লুকিয়ে চোখের জলে ভাসে । জানেনা এর শেষ কোথায় ।
( ক্রমশঃ )