রাখি আগলে তোমায় আনুরাগে,পর্ব:৩

0
1220

#ধারাবাহিক
#রাখি_আগলে_তোমায়_অনুরাগে ( তৃতীয় পর্ব )
#কলমে— অর্পিতা চক্রবর্তী

গতানুগতিক ভাবে দিন কেটে যাচ্ছিলো । এর মধ্যেই একদিন সুমন বাড়ি এলো এবং এই জটিল পরিস্থিতি দেখতে পেলো । রাইয়ের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা দেখে, বাবির অসহায় অবস্থা দেখে সে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো । ওদিকে সুমনের মা কোনোদিনই রাইকে পছন্দ করতেন না, এখন তাঁর বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে যে ঐ মেয়েটির ( রাইয়ের ) ইচ্ছাকৃত অসাবধানতাবশত তিনি তাঁর নাতনিকে হারিয়েছেন । তিনি এ নিয়ে যথেষ্ট চেঁচামেচি করছেন । কিন্তু একবারও ভেবে দেখছেন না যে সেই মেয়েটি নিজের সন্তানকে হারিয়েছে । তাকে কথা শোনানোর জন্য অনেকেই জুটে যায়, কিন্তু তার মাথায় হাত বুলিয়ে ভরসা দেওয়ার মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন ।

সুমন আজ রাইকে নিয়ে একজন স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে এসেছে । তিনি সব শুনে সুমনকে পরামর্শ দিলেন যাতে সে রাইয়ের যত্ন নেয়, তার খেয়াল রাখে, তাকে ভরসা যোগায় । এই সময়ে রাইয়ের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করতে হবে, তার মনের ভিতরকার জমাট বাঁধা কষ্টটাকে গলাতে হবে । তিনি প্রয়োজনীয় ওষুধ দিলেন এবং বললেন প্রয়োজনে তারা একজন psycho therapist এর কাছে যেতে পারে । এছাড়া রাইকে তিনি পরামর্শ দিলেন যে , সে যেন মনের জোর বজায় রাখে । অসুখ হলে তার চিকিৎসাও থাকে । অন্তত বাচ্চার কথা চিন্তা করেও তাকে সুস্থ হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হবে ।

সুমন মনস্থির করে নেয়, সে রাই আর বাবিকে আবার নিজের কর্মস্থলে নিয়ে যাবে । সেখানে মাঝে মধ্যে হলেও সে রাইয়ের খেয়াল রাখতে পারবে । আর বাবিকে দেখার জন্য তার সহকর্মীদের সাহায্য নিয়ে কাওকে নিয়োগ করবে । বিশেষ করে তার বাড়ির পরিবেশ রাইয়ের পক্ষে প্রতিকূল হয়ে উঠছে । বাড়ির লোকজনের সাথে আলোচনা করায় তাঁরা বলেন, এ ব্যাপারে তাঁদের আপত্তি আছে । রাই চলে গেলে রান্না কে করবে ? রাই কি চিরকাল শুয়েই কাটিয়ে দিতে চায় নাকি ? সুমন এবার দৃঢ় সংকল্প, সে বাড়িতে জানায় তাঁরা যেন রান্না এবং অন্যান্য কাজকর্মের জন্য লোক নিয়োগ করেন, সুমন প্রতিমাসে প্রয়োজনীয় টাকা পাঠিয়ে দেবে । কিন্তু রাই অসুস্থ, তার বিশ্রাম প্রয়োজন ।

^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^

সুমন তার স্ত্রী ও পুত্রকে নিয়ে পুনরায় নিজের কর্মস্থলে ফিরে যায় । সেখানে সবাই রাইকে স্বাগত জানান । সুমনের সহকর্মী এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যরা বাবির দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নেন । তাকে খাওয়ানো, বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, তার সাথে খেলা করা ইত্যাদি সব কাজ তাঁরা আনন্দের সাথে করেন । রাইয়ের খোঁজ খবর নেওয়া, তার সাথে হাসিঠাট্টা ও গল্প করে তার মনের গুমোট ভাবটা কাটানোর চেষ্টা করেন । কোনো কোনো রাতে অফিসে পিকনিকের আয়োজন করা হয় যাতে রাই একটু স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে পারে । সুমনের অফিস পাশেই হওয়ার কারণে সে একফাঁকে বেড়িয়ে রাইকে দেখে যেতে পারে । বাবিও ভালোই আছে, আনন্দে আছে । আত্মীয় অর্থাৎ যার সাথে আত্মার সম্পর্ক রয়েছে । কিন্তু কখনো কখনো অনেক অল্প পরিচিত মানুষও পরমাত্মীয় হয়ে ওঠেন কারণ তাঁর / তাঁদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে ।

রাই এখনও পর্যন্ত স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে পারেনি । প্রায় রাতেই চমকে উঠে ঘুম থেকে উঠে পড়ে । মুখে হাসি নেই, কোনো বিষয়ে মন নেই । প্রতিরাতে সুমন তার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করে কেন সে ওভাবে চমকে ওঠে ? সে কি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখে ? এভাবে চলতে চলতে রাই একদিন নিজের স্বপ্নের কথা স্বীকার করে । সেই ছোট্ট মেয়েটিকে স্বপ্নে দেখার কথা বলে । আশ্চর্যজনকভাবে সেই রাতেই রাই সেই মেয়েটিকে শেষবারের মতো দেখতে পায় । আর কখনও সে দেখা দেয়নি ।

ছোট্ট বাবি মনের আনন্দে তার বাবার অফিসে গিয়ে বসে থাকে , বাবার অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে ঘুরে বেড়ায় । কিন্তু এই ঘুরে বেড়ানোর চক্করে একদিন সে দুর্ঘটনার কবলে পড়লো এবং একটি ছেলের সতর্কতার জন্য সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এলো । এই ঘটনা রাইকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিলো এবং সে আবার বাস্তব জগতে ফিরে এলো । এক সন্তানকে সে হারিয়েছে, আরেক জনকে সে হারাতে পারবে না । এতদিনে তার মনে হয় বাবি কেমন আছে ? সে তো অনেকদিন ছেলেকে জড়িয়ে ধরেনি , কাছে ডাকেনি । বাবিকে খুঁটিয়ে দেখে সে । আহা রে ! কতো রোগা হয়ে গেছে তার সন্তান, চোখমুখ বসে গেছে । সে মা হয়েও এতোদিন কিছু লক্ষ্য করেনি ভেবেই সে অনুতপ্ত হয়ে ওঠে । বাবিও দেখছে তার মাকে । বাবা বলেছেন মা অসুস্থ । কিন্তু কতোদিন পর মা আবার তাকে আদর করছে । ছোট ছোট হাত দিয়ে মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দেয় সে, জড়িয়ে ধরে মাকে । মা ও সন্তানের বন্ধন যে অবিচ্ছেদ্য ।

///////////////////////////////////////////////////

‘ চলাই জীবন থেমে যাওয়াই মরণ
ভেবে নাও তুমি কাকে করবে বরণ ।। ‘

রাই প্রতিনিয়ত নিজের সাথে লড়াই করছে । সে নিজেকে বোঝায় যে বাবির জন্য তাকে যত শীঘ্র সম্ভব সুস্থ হতে হবে । সুমনের কাছে গিয়ে আর সে থাকবে না, আবার বাবিকে স্কুলে ভর্তি করার সময়ও হয়ে গেছে । এখন সব দায়িত্ব তাকে নিতে হবে, তার আগে নিজেকে উপযুক্ত করে তুলতে হবে । সুমনের বাড়িতে গিয়ে বসবাস করতে হবে, তারজন্য মানসিক দিক থেকে প্রস্তুত থাকতে হবে । সবসময় সুমন তাকে আগলে রাখার জন্য আসবে না, নিজের লড়াইটা তাকে নিজেকেই লড়তে হবে । জীবনে চলার পথে কত না চড়াই উতরাই থাকে । সুখ – দুঃখ , হাসি- কান্না নিয়েই তো জীবন । সকলের চলার পথ কুসুমাস্তীর্ণ থাকে না, কারও কারও চলার পথ কণ্টকাকীর্ণও হয়ে থাকে । এটা তোমার সিদ্ধান্ত যে তুমি কাঁটার ভয়ে পালিয়ে যাবে, নাকি কাঁটা সরিয়ে সামনে এগিয়ে যাবে ।

বেশ কয়েক বছর পরের ঘটনা । বাবি এখন দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র । গৃহস্থালির কাজকর্ম, বাবির দেখাশোনা করা, বাবিকে স্কুলে দিয়ে আসা / স্কুল থেকে নিয়ে আসা সবই রাইয়ের দায়িত্ব । বাড়ির অশান্তি , বাবির দায়িত্ব, ঘরের কাজ সব মিলিয়ে রাইকে হিমশিম খেতে হয় । এইরকম একদিন সে ছেলেকে স্কুলে দিতে গেছে , এমন সময় তার বড়ো ভাগনে অর্থাৎ বড়ো ননদের ছেলে তাকে ফোন করলো এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরে আসতে বললো । রাই তাড়াহুড়ো করে বাড়ি ফিরে দেখে সুমনের সহকর্মীরা এসেছেন । তাঁরা অসুস্থ সুমনকে বাড়ি পৌঁছে দিতে এসেছেন । সুমনের অগোছালো অবস্থা, শূন্য দৃষ্টি সবকিছু মিলিয়ে দেখে রাইয়ের খুব অস্বাভাবিক মনে হলো । সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যে সুমনকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে । শ্বশুর মশাই যে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে চলেন, তাঁর কাছেই সুমনকে নিয়ে যাওয়া হলো । কিন্তু সব মিলিয়ে দেখে তিনি জানালেন এটা সম্ভবত গভীর অবসাদজনিত রোগ ( ডিপ্রেশন ) এবং সত্বর একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন । সেইমতো রাই আর তার ভাগনে সুমনকে নিয়ে সেই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে গেলো । হসপিটালে বসে আছে রাই, সুমন এলিয়ে শুয়ে আছে । রাই সেদিকে তাকিয়ে ভাবে, ‘ ভগবান তুমি আমার আর কতো পরীক্ষা নেবে ? আমাকে কি শান্তিতে থাকতে দেবে না ?

পরবর্তী পর্বে সমাপ্য ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here