#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা
৩৬.
নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ এক কঠিন ঝড়ে পরিস্থিতি স্তব্ধ। সকলে যেন বুঝে উঠতে পারছে না এই জায়গায় কিছু ক্ষণের মাঝে কি ঘটে গেল!নন্দার রীতিমতো হাত পা কাঁপছে। শেখর ঘোষের নিথর দেহটা পড়ে আছে আরাম কেদারায় ভীষণ অযত্নে, অবহেলায়। ললিতার চোখে-মুখে নির্লিপ্ততা। শতাব্দও কিংকর্তব্যবিমুঢ়। হুট করে এমন একটা কান্ড হতে পারে এটা যেন কারো ধারণার মধ্যেই ছিল না। সব তো স্বাভাবিকই ছিল। সাধারণ কথা কাটাকাটি। সাধারণ কথা কাটাকাটির মাঝেই এত ভয়ঙ্কর একটা কাজ হয়ে গেল? ললিতার মত মেয়ে এমন কাজ করতে পারল? যে বাবা হাসি হাসি মুখে মেয়ের সাথে কথা বলছিলেন, এত বাক-বিতন্ডার পরও কিছু বলেনি মেয়েকে, সে বাবাকে খুন করতে ললিতার একবারও কি বুক কাঁপলো না!
শতাব্দ অস্ফুটস্বরে বলল, “এখন এখান থেকে বের হতে হবে ললিতা। এক মুহূর্ত এখানে দাঁড়ানো উচিত হবে না।”
ললিতার কাজের থেকেও শতাব্দের কথা নন্দাকে বেশি অবাক করে দিল। ললিতা যে একটা এমন ভয়ঙ্কর কাজ করে ফেলেছে তার জন্য শতাব্দ একটা কথাও বললোনা বরং চেষ্টা করছে এই জায়গা থেকে যাওয়ার! এত কিছু হয়ে গেল কোন শোক-তাপ দেখা গেল না তাদের মাঝে, তবে কি তারা এসব ভেবে এখানে এসেছিল? কেবল নন্দাই জানত না ব্যাপারটা! নন্দার ভাবনার মাঝেই ললিতার কণ্ঠস্বর পাওয়া গেলো,
“শতাব্দ, তুই নন্দাকে নিয়ে বাহিরে যা। আমি আসছি।”
“আসছি মানে? কোথায় যাবি তুই?”
“জমির ওই কাগজ গুলো যদি আমরা আমাদের কাছে নিয়ে যাই তাহলে হয়তো মানুষ গুলোকে জামাটি ছাড়তে হবে না।”
“তোর যাওয়ার দরকার নেই। তুই আমাকে বল কোথায় আছে সেগুলো আমি নিয়ে আসছি।”
নন্দা কেবল চুপচাপ করে শুনে গেল সবটা। একজন মানুষ দেশ সেবায় কতটা ব্রত হলে নিজের বাবাকে এভাবে মেরে ফেলতে দু’বারও ভাবে না! মেরে ফেলার পর অনুশোচনাও জাগে না! নন্দর ভাবনার মাঝেই একে কতগুলো কাগজ নিয়ে আসলো। শতাব্দ ও ললিতার মাঝে প্রচুর ব্যস্ততা থাকলেও নন্দা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। একটু আগে যে মানুষটার সাথে সে কথা বলল, সে মানুষটাই কিনা এখন তার সামনে নিথর হয়ে পড়ে আছে! ললিতা বলল,
“চল নন্দা বের হতে হবে। কোম্পানির কেউ আমাদের দেখে ফেললে ঘোর বিপদ হয়ে যাবে। বিভিন্ন সাহেবদের আনাগোনা থেকে বাড়িতে।”
নন্দা অস্ফুটস্বরে বলল, “মানুষটার লা শ কি তাহলে এভাবেই থাকবে? কতক্ষণ এমন লা শ পড়ে থাকবে? লা শ একা ফেলে রাখাও তো ভালো না।”
“কুসংস্কারের কথা বলিস না তো, নন্দা। এখন এসব বলার সময় নেই। না এখন আবেগ দেখানোর সময়। দ্রুত বের হতে হবে।”
”তোমরা বের হও, আমি নাহয় থাকছি উনার সাথে। মানুষটাকে একা ফেলে যেতে পারবো না। এক মুহূর্তের জন্য হলেও সে আমাকে খুব আপন মানুষের মতো অনুভব করিছে, ভালো আচরণ করেছে। সে কৃতজ্ঞতা ভুলে তো চলে যেতে পারি না।”
নন্দার কথায় হাসলো ললিতা। এবার তার বাম চোখের কোনায় চিকচিক করল কিছু অশ্রুবিন্দু। শক্ত থাকার পরও তার অশ্রুবিন্দুরা যেন তার কথা শুনল না, তার সাথে করলে চরম বেইমানি যেমন বেইমানি সে করেছে নিজের বাবার সাথে। যতই হোক, বাবার মৃত্যু কি সন্তান মানতে পারে? তাও যদি হয় নিজের হাতে!
নন্দার হতভম্ব ভঙ্গিতে বুঝাই যাচ্ছে সে যে নিজের মধ্যে নেই। ধীরে ধীরে ললিতাও যেন ঘোরের মাঝে চলে যাচ্ছিল। শতাব্দ দিকশূন্য হয়ে দু’জনের হাত ধরে টেনে বেরিয়ে গেল বাড়িটা থেকে। নন্দা তবুও ঘাড় ঘুরিয়ে পিছে ফেলে আসা শেখর ঘোষের দিকে তাকিয়ে রইলো। লোকটার চোখের পাতা মেলা। মনে হচ্ছে সুস্থ, সবল মানুষ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে পৃথিবী। নন্দার খুব পরিচিত মনে হলো এই মুখমন্ডল। মনে হলো বহুদিন আগ থেকে সে এই মুখমন্ডলের মানুষকে চেনে অথচ আজকেই শেখর ঘোষের সাথে তার প্রথম সাক্ষাৎ হলো। কেন এত পরিচিত ঠেকছে তাহলে!
শতাব্দ, ললিতা কিছুটা আগেই ছিল। পেছনে পরে গেল নন্দা। তারা গেইট থেকে বের হতেই সাহেবী একটা গাড়ি সেখানে উচ্চ শব্দে হর্ণ বাজিয়ে প্রবেশ করল।
_
আজ নন্দার বাড়িতে ফিরতে অনেক সময় লেগে গেল। চারপাশে তখন গোধূলি বিদায় নিয়েছে। কাকের অসহ্যকর হাঁক খর আশেপাশে শোনা যাচ্ছে না। উত্তপ্ত প্রকৃতি এখন প্রায় শীতল। বিরাট বিরাট তালগাছ মৃদুমন্দ বাতাসে যেন নাচছে আহ্লাদে। নন্দার চোখ জ্বালা করছে, মাথাটাও ধরে এসেছে প্রায়, ভারী একটা যন্ত্রণার আভাস মাথা জুড়ে। সে ক্লান্তভঙ্গিতে বাড়ির ভিতরে ঢুকলো। চারপাশে তখন কৃত্রিম আলোর ঘনঘটা।
নন্দা বাড়ির ভিতর প্রবেশ করতেই দেখল বসার জায়গাটাতে বসে আছে স্টিফেন। তার পড়ণে বাহিরের পোশাক। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বারবার প্রহর গুনছে বোধ হয়। তার কপাল জুড়ে ঘামের আভাস। হয়তো কিছুর অপেক্ষা করছে।
নন্দা ভ্রু কুঁচকালো। মৃদুস্বরে ডাকলো,
“কি হয়েছে?”
স্টিফেন সাথে সাথে চমকে গেল। উঠে গেল তৎক্ষণাৎ। পাশ ফিরে তাকাতেই নন্দাকে দৃষ্টিগোচর হলো তার। মুহূর্তে সে বাতাসের বেগে নন্দার দিকে এগিয়ে এলো, ব্যস্ত কণ্ঠে বারংবার শুধালো,
“সারাটি দিন কোথায় ছিলে, সানশাইন? তোমার কলেজ ছুটি হইয়াছে সেই দুপুর বেলা তারপর আমি এই বিকেল অব্দি তোমার কলেজে তোমাকে খুঁজিয়াছি।”
নন্দা চমকালো, বিস্মিত ভঙ্গিতে বলল, “আমার কলেজ গিয়েছিলেন আপনি?”
“শহরে আমার কাজ ছিল বিধায় আমি গিয়াছিলাম। ভাবলাম, তোমার কলেজ থেকে তোমাকে সাথে নিয়ে ফেরা যাক। অথচ তোমার কলেজ যাওয়ার পর জানিতে পারিলাম তুমি নাকি কলেজে নাই। কোথায় ছিলা, সানশাইন? চিন্তা হইয়াছিল খুব।”
নন্দা আমতা আমতা করে উত্তর দিল,
“আ আসলে ললিতা আছে না, ওদের সাথে গিয়েছিলাম।”
এতোটুকু কথা বলতেই নন্দার ঘাম ছুটে গেল। যেন শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। বারবার ভেসে উঠছে দুপুর বেলার দৃশ্য গুলো। কেমন করে হাস্যজ্জল মানুষটা নিমিষেই প্রাণ হারালো! নন্দার অনাকাঙ্ক্ষিত উত্তেজনাটা দৃষ্টিগোচর হয় স্টিফেনেরও। সেখানে কপাল ভাঁজ করল, নন্দার বাহু ধরে শুধাল,
“কিছু কি হইয়াছে? এমন কাঁপিতেছ কেন?”
নন্দা বামে-ডানে মাথা নাড়াল। ঘটনাটা ভুলে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালালো। স্টিফেন নন্দার হাতের বই গুলো সাবধানে নিয়ে টেবিলের উপর রাখল। বাড়ির গৃহ ভৃত্যদের ডেকে জল নিয়ে আসার নির্দেশ দিল। শাড়ির আঁচল আটকানো পিনটাও খুলে দিল। উপরে ঠান্ডা বাতাস প্রদানকারী তিন পাখা ওয়ালা যন্ত্রটা চলা স্বত্বেও সে কোথা থেকে যেন একটি হাত পাখা খুঁজে আনল। ব্যস্ত হাতে বাতাস দিতে আরম্ভ করল নিজের স্ত্রীকে। নন্দা চুপচাপ সবটা দৃশ্যই পর্যবেক্ষণ করছিল। মানুষটার কী যত্ন তার প্রতি! মুগ্ধতায় চোখ বুজে এলো নন্দার। মুহূর্তেই চোখের সামনে ভেসে উঠল ললিতার সেই হিংস্র মুখ এবং হাতে বন্দুক ধরার রূপটা। কেবল তার বাবা কোম্পানির হয়ে কাজ করে বলে মেয়েটা নিজের বাবাকে খু ন করতে দু’বার ভাবল না অথচ স্টিফেন তো নিজেই ব্রিটিশদের দলের। স্টিফেনকে কী ছেড়ে দিবে ওরা?
কথাটা মাথায় আসতেই নন্দার মন ভীত হলো। সে জড়িয়ে ধরলো স্টিফেনের কোমড় শক্ত হাতে। অনবরত বলতে লাগল,
“কিছু হবে না আপনার, কিছু হবে না।”
স্টিফেন কেবল আহম্মক হয়ে তাকিয়ে রইলো। যে মেয়ে তাকে পছন্দ করেনা সে মেয়েই কি-না নিজ ইচ্ছায় তাকে জড়িয়ে ধরেছে এবং বিড়বিড় করে কিছু বলছে!
স্টিফেন ও নন্দার এই ব্যাক্তিগত মুহূর্তেই প্রবেশ করল অ্যালেন। আকস্মিক এই দৃশ্যে সেও কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেল। ফিরে যেতে চেয়েও ফিরতে পারল না। অপলক তাকিয়ে রইলো সে দিকে। আপনমনে ভাবল, এই মুহূর্তটা তার হলে খুব কী বেশি ক্ষতি হয়ে যেত? নিজের ভাবনায় নিজেই ছি: ছি: করে উঠে অ্যালেন। নন্দা পবিত্র। তাকে নিয়ে এমন ভাবনা শোভনীয় না। কিন্তু ভালোবাসার জায়গায় যে সবই ঠিক সে কথা মস্তিষ্ক স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে বার বার।
#চলবে…..