অলকানন্দার নির্বাসন পর্ব ৩৭

0
297

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

[৩৭]

হেমন্তের বিদায় বার্তা প্রকৃতি জুড়ে। এলোমেলো কুয়াশার জয়ধ্বনি বুঝিয়ে দিচ্ছে শীত এলো বলে। কৃষ্ণচূড়ার গাছে এখন আর বড়ো বড়ো লাল ফুল ফুটছে না। সেই অবধারিত কাজের বোধহয় বিশ্রাম কাল শুরু হয়েছে। শস্য হীন মাঠকে এখন আর উচ্ছ্বল প্রেমিকা মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে ইতিহাসের বিধ্বস্ত ট্রয় নগরী। ভরা যৌবনা দিঘির জলেও তরঙ্গের তেমন দেখা নেই। চারপাশে সব কেমন নেই নেই অনুভূতি। তবে লুকিয়ে চুরিয়ে এই নেই প্রকৃতিতে শাসন-শোষন এবং বিদ্রোহের এক গমগমে ভাব বিরাজিত। নিবিড় ভাবেই সেই কার্য গুলো পরিচালিত হচ্ছে। নন্দার ভেতরেও হাজারো বিষন্নতা ঠেলে এসবে সুক্ষ্ম লক্ষণ পরিলক্ষিত।

অ্যালেন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে তাদের বিশাল ছাঁদের উপর। কোথাও যেন মন খারাপের রেষ উপস্থিত। তন্মধ্যে ছাঁদে উপস্থিত হলো নন্দা। বেশ চপল পায়ে উপস্থিত হওয়াতেই তার উপস্থিতি টের পেল অ্যালেন। ঘাড় ঘুরিয়ে নন্দাকে দেখতেই সে স্বভাবতই মাথা নুয়ানো। নন্দার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা থেকেই যে সে এ কাজটি করে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। হুট করে কারো ব্যাক্তিগত একাকীত্বে প্রবেশ করে ফেলেছে ভেবে অস্বস্তি হলো নন্দারও। সে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
“ঠাকুরপো, আপনি এখানে! জানতাম না তো। আপনি থাকুন তাহলে। কিছু প্রয়োজন হলে বলবেন, আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

“বৌঠান, আপনার সাথে কী আমি কিছু কথা বলিতে পারি?”

অ্যালেনের প্রশ্নের মাঝেই ইচ্ছে প্রকাশ। কথাটা অত্যন্ত জরুরি না হলে যে লোকটা এভাবে বলতো না তাও নন্দার ঢের জানা। তাই সে সম্মতি জানাল, বিনীত কণ্ঠেই বলল,
“অবশ্যই। বলুন না, ঠাকুরপো। কী বলতে চান?”

নন্দার শুনতে চাওয়ার প্রশ্রয় অ্যালেনের মনে সাহস জাগাল। সে কতক্ষণ ইতস্তত করে অতঃপর বলল,
“আপনি স্টিফেনকে নিয়া একটু ভাবিবেন, বৌঠান। তাকে নিয়া ভাবিবার লোকের বড়ো অভাব।”

নন্দা ঠিক ধরতে পারলে না অ্যালের সাধারণ বাক্যের ভেতরে থাকা অন্তর্নিহিত অর্থটা। শুধাল,
“কেমন ভাবনার কথা বলছেন, ঠাকুরপো?”

“যেমন ভাবনায় ও ভালো থাকিবে। স্টিফেনকে আমি বরাবরই অনুভূতিশূন্য ভাবিয়া ছিলাম। কিন্তু আপনাকে দেখার পর বুঝিলাম ছেলেটার অনুভূতি আছে। তাও আবার যেমন-তেমন অনুভূতি না, খুব ভালোবাসিতে চাহিবার মতন অনুভূতি। সেই অনুভূতির ক্ষতিসাধন করিবেন না, বৌঠান। প্রথমে ক্ষমা চাহিয়া নিচ্ছি আমার এমন ক্ষমা অযোগ্য অপরাধের জন্য। কী করিব বলেন? স্টিফেনকে আমি বড়ো ভালোবাসি। কিন্তু আজকাল আমার মনে হইতেছে স্টিফেনের বড়ো কোনো ক্ষতি হইতে পারে আর সেটা কেবল আপনার জন্য। তাই আপনি যদি কৃপা করিয়া সাবধান হোন তাহলে বড়োই কৃতজ্ঞ হইবো, বৌঠান।”

অ্যালেনের কথায় চমকালো নন্দা। ক্ষানিক থমকালোও। হতভম্ব কণ্ঠে বলল,
“আমার জন্য উনার ক্ষতি হবে? কী ক্ষতি?”

“আপনি গ্রামবাসীর হইয়ে প্রস্তাব রাখিয়াছেন কর দিতে পারিবেন না এই মাসের। একমাত্র আপনি কথাটি বলিয়াছেন বলিয়া স্টিফেন এক কথায় রাজি হইয়া গিয়াছে কিন্তু আপনি কী জানেন এর জন্য তাকে কতটা ভুগিতে হইবে? কোম্পানি বার বার তাকে চাপ দিচ্ছে কর সংগ্রহ করিবার জন্য। আপনি ভালো করিয়াই জানেন, বনে থেকে বাঘের সহিত বিবাদ করিয়া বাঁচা সহজ হইবে না। স্টিফেন আপনাকে বড়ো ভালোবাসে। অন্ততপক্ষে সে ভালোবাসাকে সম্মান করিয়া তাকে নিয়া ভাবিবেন।”

অ্যালেন সবটুকু কথা বড়ো শ্রদ্ধার সাথে মাথা নিচু করে বলেই বিদায় নিয়েছে। নন্দার অবস্থা এখনো স্থির। গত পরশুই সে গ্রামবাসীর হয়ে প্রস্তাব রেখেছিল যে এবার কর দিতে পারবে না কারণ গ্রামবাসীর ফসলের জমি বৃষ্টিতে হাবুডুবু খেয়েছিল যার জন্য অনেক ফসলের ক্ষতি হয়েছে। সে তো একবারও ভেবে দেখেনি স্টিফেনের উপরেও তো কত মানুষ আছে। এতে সমস্যা তো স্টিফেনেরই বেশি হবে। অ্যালেন কী সেজন্যই তাকে কয়েকদিন যাবত এড়িয়ে যাচ্ছিল রুষ্ট চোখে! কিন্তু সে করবে টা কী? গ্রামের দায়িত্ব তার উপর। দেশের ভালোর দায়িত্বও তার উপর। আবার সংসারও তার। কোনটা রক্ষা করা তবে ধর্ম হবে?

_

“দেখেছো ভাই নন্দা, তোমার স্বামী কি-না শেষমেশ আমার কাছে এসে আবদার করল তার মিষ্টান্ন খেতে ইচ্ছে করছে! কী করি বলো! ঝটপট হেঁশেলে গিয়ে নিজের হাতে মিষ্টান্ন রেঁধে আনলাম। সে এলে মনে করে দিও তো তাকে। আমার মনে থাকে কি না থাকে।”

নন্দা স্নাগার থেকে বেরুতেই বিহারিণী পর পর কথার ঝুলি খুলে বসল। যেন সে অপেক্ষাতেই ছিল কতক্ষণে সব কথা উগড়ে ফেলতে পারবে। নন্দা ভ্রু কুঁচকালো। অবাক কণ্ঠে বলল,
“তোমার কাছে মিষ্টান্ন চেয়েছে!”

“তাই তো চাইলো। বলল খেতে ইচ্ছে করছে। তুমি তো কলেজ গিয়েছিলে তাই আমাকে বলল।”

নন্দার শরীর ক্লান্ত। সে ক্লান্ত চোখেই বিহারিণীর দিকে চাইল। বিহারিণীর ঠোঁটে হাসির ছাঁপ। মিষ্টি হাসছে মেয়েটা। বেশ সুন্দর একটা মেয়ে। আচ্ছা, তাকে এতদিন এই বাড়িতে জায়গা দিয়েছিল স্টিফেনরা, তাদের কী একবারও ভুল করে এই নারীর প্রতি মন ঝুঁকেনি? লোকে তো বলে- পুরুষ মানুষ নারী পেলে নিজেদেরও ভুলে যায় অথচ এত সুন্দর একটা নারীকে পেয়েও একবার তাদের মাথা ঘুরেনি? নন্দা নিজের ভাবনাতেই নিজে অবাক হলো। তার ভাবনা গুলে কেমন সেকেলে, আটপৌরে লাগল নিজের কাছেই। এসব ভাবনা সেই মানুষ গুলোকে নিয়ে ভাবা বড়োই বেমানান ঠেকল।

নন্দার ভাবনার মাঝেই বিহারিণী হাসল। কিছুটা ঠাট্টা করে বলল,
“স্বামীর সোহাগে আজকাল বড়ো সুন্দরী হয়ে যাচ্ছ বোধকরি, অলকানন্দা!”

নন্দা চমকে গেল এমন একটা বিশ্রী ঠাট্টায়। স্তম্ভিত, থমথমে হয়ে গেলো তার মুখ। লজ্জায় চোখ বুঝে আসতে চাইল। বিহারিণীর মতন মানুষ এমন একটা ঠাট্টা কীভাবে করল! নন্দা কঠিন কথা বলতে গিয়েও মায়া হরিণীর মতন আঁখি যুগল দেখে থেমে গেল। যেন দুটো টলমল করা ভরা দিঘি। এই চোখের মায়ায় লেপ্টে গেলে আর কিছু বলা সম্ভব না। নন্দাও পারল না তাই কিছু বলতে।

তন্মধ্যে স্টিফেন এসে উপস্থিত হলো। হাসি-ঠাট্টার সমাপ্তি ঘটিয়ে বিহারিণী বেরিয়ে গেল সাথে সাথেই। নন্দার চোখ-মুখে একটা হতভম্ব ভাব। স্টিফেন ভ্রু দুটো কুঞ্চিত করল,
“এমন অবাক হইয়া আছো যে!”

নন্দা চোখ ফিরিয়ে স্টিফেনের দিকে তাকাল। লোকটারও ক্লান্ত, পাংশুটে মুখ তবে ঠোঁটে লেপটানো মিষ্টি হাসি। সেই হাসির দিকে তাকিয়েই নন্দার বুক কাঁপল। গতকালকের বলা অ্যালেনের কথা বার বার প্রতিধ্বনিত হলো। তন্মধ্যে আজ সকালেই কলেজ যাওয়ার পর তাদের দলের বড়ো মেম্বার দীপকদা তার স্বামীর সম্পর্কে আজ বেশ আগ্রহ দেখিয়েছে। নন্দার আজকাল মানুষ গুলোকে ভয় লাগে। সেদিন ললিতা কীভাবে নিজের বাবাকে মে রে ফেলল! যদিও পরে নন্দা জানতে পেরেছে এটা দীপকদারই নির্দেশ ছিল। এমন একটা ভয়াবহ কাজ করেও যারা নির্লিপ্ত থাকতে পারে তারা তো যা-কিছু করার ক্ষমতা রাখে। নন্দার ভয় হচ্ছে৷ সত্যিই অ্যালেনের ভাষ্যমতে নন্দা’ই কী স্টিফেনের বড়ো ক্ষতিটা করবে!

স্টিফেন নন্দার কাছে এলো, মেয়েটার ঘোরগ্রস্ত হাবভাব দেখে বাহু ক্ষানিকটা ঝাঁকিয়ে বলল,
“কী হইয়াছে? তোমাকে চিন্তিত দেখাইতেছে!”

নন্দা স্টিফেনের কৌতূহলী মুখশ্রীর দিকে চাইল। বলল,
“আপনি বিহারিণী দিদির কাছে মিষ্টান্ন খেতে চেয়েছেন?”

প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে নিজেই থতমত খেল সে। না চাইতেও এই প্রশ্নটা বেরিয়ে গিয়েছে। নারীর মন, এত সহজে শখের পুরুষের উপর কী নির্লিপ্ত হতে পারে? কোথাও একটা গোপন টান তো থাকেই। নারী যে নিজের শখের পুরুষের ছায়ার কাছেও অন্য কোনো নারীর গন্ধ সইতে পারে না।

স্টিফেন ভারী চমকাল। জবাব দিল, “নো। আমি তো কখনোই মিষ্টান্ন খাই না। কেমন মিষ্টি মিষ্টি স্বাদ! আই ডোন্ট লাইক ইট।”

নন্দার চোখ ছোটো ছোটো হয়ে এলো। বিহারিণী কী তবে মিথ্যা বলল?

_

ঝড়ো আবহাওয়ায় উন্মাদ প্রকৃতি। ভয়ঙ্কর শব্দে ডেকে উঠছে আকাশ। নন্দার সকালটা যেন মুহূর্তেই ধূলিসাৎ হয়ে গেলো। এ কেমন নির্মম দৃশ্য দেখতে হলো তাকে? স্টিফেন আর বিহারিণী এতটা কাছাকাছি! নন্দার বুকে তীব্র যন্ত্রণা। এ দৃশ্য দেখার আগে মৃত্যু হলো না কেন?

#চলবে…..

[সবাই একটু কমেন্ট করবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here