#অপরিচিত
লেখিকাঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ২৩
সিনথিয়া মেহরাবের কথা আনমনে বিড়বিড় করছিলো তখনই সিহাব রুমে এলো। সারাদিন অফিসে থেকে বড্ড ক্লান্ত লাগছে তাকে। বেডের দিকে তাকিয়ে দেখলো মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে তার পাশে শুইয়ে কিছু বিড়বিড় করছে সিনথিয়া। তবু কিছু বললো না চুপচাপ ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। আজকাল সিনথিয়াকে আর কিছুর জন্য জোর করতে ইচ্ছে করে না। এখন আর আগের মতো বাড়িতে থাকতেও বাধ্য করে না। সিনথিয়া তবু নিজের ইচ্ছেতেই বের হয় না বাসা থেকে। শুধু মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে যায়। সিহাব ওয়াশরুমের দরজা একটু জোরেই লাগিয়েছে তাতে ঘোর কাটে সিনথিয়ার। হুড়- মুড়িয়ে উঠে বসে। তাড়াতাড়ি কিচেনে চলে যায় সিহাবের জন্য খাবার রেডি করতে। সিহাব ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখে সিনথিয়া নেই রুমে৷ হাতের টাওয়েলটা সোফায় রেখে মেয়ের কপালে কিস করলো। মেয়েটা একদম সিহাবের মতোই হয়েছে দেখতে।
সিনথিয়া রুমে এসে বললো, আপনার খাবার দিয়েছি আসুন।
সিহাব দরজার দিকে তাকিয়ে সিনথিয়াকে দেখে উঠে এলো। চুপচাপ ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার খেতে লাগলো। সিনথিয়া তাকিয়ে আছে সিহাবের দিকে। মানুষটা কেমন যেনো চুপচাপ হয়ে গেছে। এখন আর আগের মতো হুটহাট রেগে সিনথিয়ার গায়ে হাত তুলে না। রাগ হলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। তবে সিনথিয়ার খেয়াল রাখা কমায়নি।
খাবার খেতে খেতে সিহাব বললো, তুমি খেয়েছো ?
সিহাব জানে উত্তরটা হ্যাঁ আসবে তবু জিজ্ঞেস করলো কারণ রোজ করে। বউ না খেয়ে তার জন্য অপেক্ষা করবে সেই সৌভাগ্য এখনো হয়নি তার।
কিন্তু সিনথিয়া সিহাবকে অবাক করে দিয়ে বললো, নাহ, ভেবেছিলাম আপনার সাথে খাবো কিন্তু আপনি তো জিজ্ঞেসই করলেন না আমাকে।
সিহাব খাবার মুখে দিতে গিয়ে থেমে গেলো। বিস্ময় নিয়ে তাকালো সিনথিয়াও দিকে। এই প্রথম সিনথিয়ার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি দেখতে পেলো সিহাব। সবসময় মনমরা দেখে এসেছে সিনথিয়াকে। তার থেকে যা পেয়েছে সব জোর করে তবে আজকের সিনথিয়াকে আলাদা লাগছে সিহাবের কাছে।
সিনথিয়া সিহাবকে আরো অবাক করে দিয়ে বললো, খাইয়ে দেবেন নিজের হাতে ? আমার অনেক ইচ্ছেছিলো বরের হাতে রোজ খাবার খাবো।
সিহাব যেনো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে সিনথিয়াকে দেখছে। সিনথিয়া সিহাবের উত্তরের অপেক্ষা না করে তার কোলে বসে পড়লো। সিহাবের মুখ আপনাআপনি হা হয়ে গেলো। সিনথিয়ার বেশ মজা লাগছে সিহাবকে এমন অবাক হতে দেখে। এক টুকরো রুটি ছিঁড়ে সবজি দিয়ে সিহাবের মুখে পুরে দিলো সিনথিয়া আর সিহাবের হাতের রুটি টুকু নিজের মুখে পুরে নিলো। এভাবে খাওয়া শেষ হলে সিহাব ভাবনার সাগরে ডুবে রুমে এলো। সিনথিয়ার কার্যকলাপ তার মাথায় ঢুকছে না। এসব চিন্তা মাথায় নিয়ে মেয়ের পাশে শুয়ে পড়লো কপালে হাত রেখে।
সিনথিয়া সব গুছিয়ে রুমে এসে সিহাবের সামনে দাঁড়িয়ে বললে, আজ পূর্ণিমা অনেক সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে। বেলকনিতে যাবেন চাঁদ দেখতে।
সিহাব বিস্ফোরিত চোখে তাকালো সিনথিয়ার দিকে। তবে এবারও সিনথিয়া সিহাবের রিয়াকশন সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে হাত ধরে টেনে বেলকনিতে নিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দিলো আর নিজে সিহাবের কোলে বসে বুকে মাথা রেখে গায়ের ভাড় ছেড়ে দিলো সিহাবের ওপর। সিহাব একেক পর এক বিস্ময়ে পরছে। সে কী স্বপ্ন দেখছে ?
সিনথিয়া হঠাৎ আবার বললো, আপনি এমন একটা রাতের স্বপ্ন সবসময় দেখতেন তাই না ?
সিহাব কী বলবে ? সে তো এখনো বুঝতে পারছে না এসব স্বপ্ন নাকি সত্যি।
সিনথিয়া সিহাবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। সিহাব না চাইতেও হাত দুটো সিনথিয়াকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো।
সিনথিয়া বললো, আজ কিছু কথা বলছি রাগ না করে আমার কথাগুলো শুনুন প্লিজ। বিয়ের প্রথম দিকে আমি আপনাকে মেনে নিতে পারিনি। কারণটা আপনি ভালো করেই জানেন। তবে ধীরে ধীরে আপনার ভালোবাসার কাছে হার মেনে যাই। ভালোবাসতে শুরু করি আপনাকে।
সিহাব নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সিনথিয়া তাকে ভালোবাসে ?
কিন্তু আমার ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারিনি। যখনই প্রকাশ করতে গিয়েছি তখনই মনে হয়েছে আমি একজনকে ঠকিয়ে তার জীবন নষ্ট করেছি। অন্যায় করেছি আমি তার সাথে। সারাজীবন পাশে থাকার কথা দিয়ে মিথ্যা বলেছি তাকে। প্রতিনিয়ত এই অপরাধবোধ আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে।যখনই আপনার ভালোবাসার ডাকে সাড়া দিতে ইচ্ছে করেছে তখনই মনে হয়েছে আমি তাকে ঠকাচ্ছি। তার জীবনের সুখ কেড়ে নিয়ে নিজে সুখের সংসার করছি।
সিহাবের চোখদুটো থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে আর এদিকে সিনথিয়ার চোখের পানিতে সিহাবের বুকের কাছের শার্ট ভিজে গেছে। সিহাব ভাবছে সে সবসময় নিজের কথাই চিন্তা করেছে। কখনো সিনথিয়ার এই কষ্টগুলো বুঝার চেষ্টা করেনি।
সিনথিয়া নাক টেনে আবার বললো, তবে আজ আর আমাদের মাঝে কোনো বাঁধা নেই। আমার মনে কোনো অপরাধবোধ নেই। যার জীবন থেকে ভালোবাসা কেঁড়ে নেওয়ার অপরাধে আপনার ভালোবাসায় সাড়া দিতে পারিনি সে তার ভালোবাসা পেয়ে গেছে। অপরাধবোধ থেকে মুক্তি দিয়েছে আমাকে। আমি আর ঐ খোলা আকাশে উড়তে চাই না। আপনার ভালোবাসার খাঁচায় সারাজীবন বন্দী থাকতে চাই।
সিহাবের মনে হচ্ছে জীবনে যা না পাওয়া ছিলো আজ সব পেয়ে গেছে সে। আর কিছু চাই না তার এ জীবনে।
সিনথিয়া ভেজা চোখে সিহাবের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, রাখবেন আপনার ভালোবাসার খাঁচায় বন্দী করে সারাজীবন।
সিহাব সিনথিয়ার চোখের পানি মুছে কপালে একটা কিস করে মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে বললো, হুম রাখবো। সারাজীবন আমার ভালোবাসার খাঁচায় বন্দী করে রাখবো।
সিনথিয়া সিহাবের বুকে মাথা রেখে বাইরের পূর্ণ চাঁদের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো, আজ আমার জীবনও তোমার মতো পূর্ণ হলো।
১৮
আরফার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চোখের পানি ফেলছে মেহরাব। ২৪ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে আরফার জ্ঞান ফিরেনি। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জ্ঞান না ফিরলে সব হাতের বাইরে চলে যাবে। হাতে গরম তরল অনুভব করে আরফা একটু নড়েচড়ে উঠলো। বড্ড কষ্ট হচ্ছে চোখ খোলতে তবু টেনেটুনে চোখ খুললো। কিন্তু সব ঝাপসা দেখে চোখ বন্ধ করে ফেললো আবার। চোখের সামনে ভেসে উঠলো ইশতিয়াক গান তাক করেছে মেহরাবের দিকে। ছটফট করতে লাগলো আরফা, আর তাতে আরফার দিকে তাকালো মেহরাব।
মেহরাব কিছু বলার আগেই আরফা চিৎকার করে উঠে বসলো, মেহরাব সরে জান।
মেহরাব তাড়াতাড়ি উঠে আরফাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ক,,কী হয়েছে আরফা ? এই দেখো আমি ঠিক আছি। চিৎকার করো না তোমার ক্ষতি হবে।
আরফা মেহরাবের বুক থেকে মাথা তুলে ব্যস্ত হয়ে বললো, আ,,,আপনি ঠিক আছেন ? আপনার কোথায় লেগেছে দেখি।
এটুকু বলেই আরফা কান্না শুধু করে দিলো।
মেহরাব আরফার মাথা নিজের বুকে নিয়ে বললো, হুশ,,, আমার কিছু হয়নি তুমি শান্ত হও আগে। কথা বলো না চুপ চুপ।
আরফা একটু শান্ত হতেই বুকে ব্যাথা অনুভব হলো তার। ব্যাথায় আহ্ করে উঠলে মেহরাব সাবধানে বেডে শুইয়ে দিয়ে বললো, খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে ?
আরফা মাথা দিয়ে হ্যাঁ বুঝালো। বুকে প্রডন্ড ব্যাথা করছে তার। মেহরাব একটা ইনজেকশন পুশ করে দিলো আরফাকে। তারপর ধীরে ধীরে ব্যাথা কমে এলে আরফা চোখ মেলে তাকালো। দেখতে পেলো মেহরাব উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
আরফাকে তাকাতে দেখে মেহরাব বললো, এখন কেমন লাগছে ?
আরফা ধীর গলায় বললো, ভালো,,, আপনি ঠিক আছেন ?
মেহরাব বললো, আমার কী হবে আমি ঠিক আছি।
আরফা মেহরাবকে একবার ভালো করে দেখে নিলো। কেমন ছন্নছাড়া লাগছে দেখতে। মুখটা শুকিয়ে গেছে, মাথার চুলগুলো এলোমেলো, একদিনে চোখের নিচে কালি পরে গেছে। ২৪ ঘন্টা পার হয়ে গেছে এক ফোঁটা পানি পরেনি মেহরাবের পেটে। এতোকিছুর মধ্যে খাওয়া যায় নাকি কিছু।
আরফা আবার বললো, আপনাকে এমন লাগছে কেনো, সবাই ঠিক আছে তো ?
মেহরাব চমকে উঠলো এই প্রশ্ন আর মনে মনে ভাবলো, কিছু ঠিক নেই আরফা। দাদাজান আমাদের সবাইকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেছে। মম কেমন পাথর হয়ে গেছে। তোমার মা তোমার চিন্তায় অসুস্থ হয়ে এখানেই ভর্তি। তোমার কেবল জ্ঞান ফিরেছে এসব কী করে বলবো তোমাকে আমি ?
মেহরাবের উত্তর না পেয়ে আরফা আবার ধীর গলায় উৎকণ্ঠা নিয়ে বললো, কী হলো কথা বলছেন না কেনো ? সবাই ঠিক আছে তো ?
মেহরাব জোর করে হাসার চেষ্টা করে বললো, হ্যাঁ সবাই ঠিক আছে। আসলে তোমার চিন্তায় ছিলাম তো তাই এমন লাগছে।
আরফা বললো, আপনি কিছু খেয়েছেন ?
এই প্রশ্নের উত্তরে মেহরাব কিছু বললো না। তাই আরফা বললো, আপনাকে দেখে বুঝা যাচ্ছে অনেক সময় হয়েছে পেটে কিছু পড়েনি। আমি এখন ঠিক আছি আপনি কিছু খেয়ে আসুন।
মেহরাব বললো, ২৪ ঘণ্টা পর কেবল সেন্স ফিরেছে তোমার আর তুমি বলছো তুমি ঠিক আছো ?
আরফা একটু হাসার চেষ্টা করে বললো, স্যার আপনি ভুলে যাচ্ছেন আমিও ডক্টর। আমার শরীরের কন্ডিশন আমি বুঝতে পারি।
মেহরাব আর কিছু বললো না চুপ করে গেলো। আরফার সেন্স না ফেরা পর্যন্ত বিপদ ছিলো কিন্তু আরফা এখন সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত। ক্ষত শুকিয়ে গেলে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে। আরফা জোর করে মেহরাবকে পাঠিয়ে দিলো কিছু খেয়ে আসতে। মেহরাব চলে গেলে আরফা আবার ঘুমিয়ে পড়লো, শরীর অতিরিক্ত দুর্বল থাকার কারণে। মেহরাব হালকা কিছু খেয়ে এসে দেখলো আরফা ঘুমিয়ে পড়েছে। আরফার এক হাত ধরে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো অন্যহাতে। একসময় বেডে মাথা রেখে নিজেও ঘুমিয়ে পড়লো কারণ সেও অনেক দুর্বল কম ধকল তো আর যায়নি।
হসপিটালের বাইরে বসে আছে রুমান। অনেক চেষ্টা করেছে আরফার কাছে যাওয়ার কিন্তু মেহরাব আরফার জন্য এমন সিকিউরিটির ব্যবস্থা করেছে একটা মাছিও ভেতরে যেতে পারবে না। মেহরাবের অনুমতি ছাড়া কোনো ডক্টর বা নার্সও না। আরফার অবস্থা জেনে বসে থাকতে পারেনি রুমান। জীবনের কিছু ভুল সত্যি হয়তো কোনোদিন শোধরানোর সুযোগ পাওয়া যায় না।রুমানও তেমন একটা ভুল করেছে আরফাকে ছেড়ে গিয়ে। ভেবেছিলো ভুলে যাবে আরফাকে কিন্তু পারেনি। যখন বুঝতে পেরেছে আরফাই ছিলো তার জীবনের সত্যি ভালোবাসা তখন আরফা তার জন্য আকাশের চাঁদ হয়ে গেছে। যা কখনো ধরা ছুঁয়া যায় না। দূর থেকে দেখে আফসোস করতে হয় শুধু। রাত গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে, রুমানের মনে হচ্ছে সেই অন্ধকারে সেও তলিয়ে যাচ্ছে। একসময় সেই ছিলো আরফার সব আর আজ সে আরফার কাছে একজন #অপরিচিত মানুষ। #অপরিচিত থেকে পরিচিত হওয়া গেলেও পরিচিত মানুষটা একবার #অপরিচিত হয়ে গেলে তাকে কখনো আর চেনা যায় না। বাকিটা জীবন সে #অপরিচিত হয়েই থেকে যায় আমাদের জীবনে।
চলবে,,,,