#একটা_সাধারণ_গল্প
#পর্ব_পাঁচ
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
ঘরে এসেও নিজেকে চার দেওয়ালে বন্দী করে রাখলো শুভ। মনের মধ্যে একটা অপরাধবোধ ঘড়ির কাটার মতন টিকটিক করে চলছে। ওর মা এসে একবার সেধে গেছে খাওয়ার জন্য, রাজি হয়নি ও। তবে সময় যত পেরচ্ছে খিদেটাও চাগড় দিচ্ছে।
দুশ্চিন্তা-মনখারাপ-খারাপলাগাকে ছাপিয়ে পেটের জ্বালাটা বড় হয়ে উঠল। তেতো মুখেই রাতের খাবারে দুধ-রুটি খেল শুভদ।
অন্যদিনের চেয়ে তড়িঘড়ি বিছানাও নিল ।
আক্ষেপ যে কিছুতেই যাচ্ছে না। ওর কারণে ওদের সম্পর্কে চিড় ধরবে না তো!
না ও সেটা চাই না। পর্ণার মুখের হাসিটাই যেন মলিন না হয়। আজ সারাদিন ওর মুখে হাসিটা অনুপস্থিত ছিল।
তবে পর্ণা যে বললো ও ছোট থেকে নিলয়কে ভালোবাসে বলেই ওর সব অত্যাচার সহ্য করবে।
পর্ণা নিলয়কে কয়েক বছর ধরেই ভালোবাসে,আর ওর ভালোবাসার মেয়াদ মেরেকেটে দুইমাস। এখন পর্ণার জন্যই বেশি খারাপ লাগছে।কিন্তু কেন,সত্যিই কি প্রথম দর্শনে প্রেম হয়, না পর্ণা শুধুই ওর ভালোলাগা? যেটা যে কোনো সুন্দরী মেয়ের উপর হতে পারে।
নিজের অন্তরাত্মাকে প্রশ্ন করল শুভদ।
জোর করে দুচোখ বুজল ও। বন্ধ চোখের মধ্যে সেই কন্যার গজদন্ত বের করা সদাহাস্যোজ্জ্বল মুখাবয়ব ভেসে উঠল।
চোখের পাতা খুলতেই ঘরের জমাট বাঁধা অন্ধকারে ধাক্কা খেল। আবারো দুইনয়ন মুদিল ও..
আবারো প্রথম দিনে দেখা সেই কন্যার প্রতিবিম্ব ধরা দিল।
পর্ণা ওর ভালোবাসা না ভালোলাগা এই নিয়ে মন-মস্তিস্কের দ্বন্দ্ব শুরু হল।
নাহ! পর্ণা ওর যাই হোক না কেন,পর্ণার ভালো ও সর্বদা চায় । তাই তো আজ ওদের সম্পর্ক নিয়ে এতটা বিচলিত।
পর্ণা ওর কাছে এক অনুভূতি। পর্ণা ওর কাছাকাছি থাকলে ও খুশি থাকে, ওর চেহারা দর্শন করলেই চোখের আরাম হয়।বাড়তি হিসেবে পর্ণা যখন ওর সাথে কথা বললে নিজেকে সুখী মানুষ মনে করে শুভদ।অন্তত সেই সময় টুকু..
-পর্ণা রে আমি তোকে ভালোই বাসি রে।
অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলো শুভদ ঘোষ।
সেই স্বপ্নের রাজকন্যাকে ভাবতে ভাবতে চোখের ঘুম উড়লো শুভর। যখন ও দুই চোখ মুজল তখন
ঘড়িতে প্রায় রাত দুটো..
-প্লিজ নিলয় এমনি করিস না। আমি তোকে ভালোবাসি এটাই শেষ কথা।
-তোর বলা শেষ হয়েছে তাহলে আমি ফোনটা রাখব।
-প্লিজ ওমনি করিস না।
নাক টেনে টেনে বললো পর্ণা।কাঁদতে কাঁদতে বুকের ভেতর এতটাই কষ্ট হচ্ছে এবার যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মরেই যাবে ।
-কাঁদিসনা পর্ণা,আমাদের সম্পর্কটা দিনদিন একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে এর থেকে বেরোনো প্রয়োজন এতে তুই আমি দুজনে ভালো থাকবো।
-নিলয় আমি তোকে ছাড়া বাঁচতে পারব না।
-ওমনি মনে হয়,পরে পরে ঠিক হয়ে যাবে। এবার তুই ভাবিস না আমার মাকে নালিশ করলেই সমস্যার শেষ হবে। আসলে আমি এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি চাই..
-আমি তো তোকে আবদ্ধ করে রাখিনি।তাহলে কেন তুই হাঁপিয়ে উঠেছিস? কারণটা আমাকে খুলে বল নিলয়।
-শুনবি তুই?
-হ্যাঁ বল!
ডান হাতের চেটো দিয়ে চোখের জল মুছে নিজেকে শক্ত করে বলল পর্ণশ্রী।
-শোন তাহলে আমি সুমিকে ভালোবাসি। ওকে দেখে এমনকি ওর সঙ্গে মেলামেশা করে আমার মনে হয়েছে ওই সেই মেয়ে যাকে আমি এতদিন খুঁজছিলাম। ওর সাথে ঘর বাঁধা যায়।
-নিলয়!!
গলা বুজে এল পর্ণার।
-বল!
ঠান্ডা গলায় বললো নিলয়..
-তুই ওকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে বেছে নিলি?আমার কি হবে নিলয়..
-কিচ্ছু হবে না,তুই ও জীবনে কাউকে বেছে নে। কোনদিনও আমি এই সম্পর্কে সিরিয়াস ছিলাম না। তবে তোর পাগলামিতে কিছু বলতে পারতাম না। কলেজের ওঠার পর সুমির সঙ্গে পরিচয় হয়ে বুঝলাম সম্পর্কের সংজ্ঞা কি..
আজ আজ পিকনিকে গিয়েছিলাম সেই কারণেই, তোর কাছে সত্যিটা প্রকাশ করব বলে। কিন্তু ঐ নচ্ছার ছেলেটা সব ঘটনাটা ঘুরিয়ে দিল। ভালো থাকিস। অনেক রাত হল এবার ঘুমো,ফোন রাখছি আমি।
প্রত্যুত্তরে মৌন থাকে পর্ণা।
কিই বা বলবে ও। ওর মুখের কথা যে ফুরিয়েছে।
-ওহে শেষে একটা ইমপরটেন্ট কথা, মা যেন এই বিষয়ে কিছুই না জানতে পারে।সম্পর্ক যে আমাদের নেই সেটা জানতে পারিস কিন্তু কারণটা জানাতে পারবি না। আমার দিব্যি রইল।যদি আমাকে এতটুকু ভালোবেসে থাকিস তো এটা মানবি।
-এতটুকু ভালোবাসা!!
-পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ নেই। ভালো থাকিস পর্ণা।
ফোনের লাইন ডিসকানেক্ট করে নিলয়।
বালিশে মুখ গুজে সশব্দে কাঁদতে থাকে পর্ণা।
নিলয়কে ছাড়া বাঁচবে কি করে!
চোখ খুলতেই শুভদ দেখল ঘড়িতে ছয়টা চল্লিশ বাজছে। মাথাটা প্রচন্ড ভারী লাগছে। মাথা তুলতে পারলো না। তলপেটে চাপ অনুভব করল,তাই উঠতেই হল। বাথরুমে পৌঁছেই হড়হড়িয়ে বমি । টক গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে..
এটা তো হওয়ারই ছিল।
আগের দিন ভালো করে খাবার জোটেনি,বলাভালো খেতে পারেনি। রাতে দুধ -রুটি খেয়ে অর্ধেক রাত জাগা। শরীর তো প্রতিশোধ নেবেই। টলতে টলতে ঘরে আসছিল শুভদ।
ওর মা ও সঙ্গে সঙ্গে ধরল ওকে। ছোট ছেলের এমন অবস্থা দেখে কপালে হাত ঠেকিয়ে দেখল অত্যাধিক উষ্ণ হয়ে আছে শরীর।
-শুভ তোর যে জ্বর এসেছে।
হবে না কেন অত ভোরে ওঠা কি সহ্য হয়।
বেলা দশটা:
শুভদদের শরীর সকালের থেকে অনেকটাই ভালো আছে। আজ রথীন স্যারের কাছে পড়ার দিন ছিল,গতকাল পিকনিকের ধকলের জন্য স্যার আগেই ছুটি দিয়েছে আজ।
তারমানে পর্ণার সাক্ষাৎ পাবে সেই পরশু।
কি অবস্থার সাথে দিন কাটাচ্ছে মেয়েটা কি জানি!
প্রয়োজনে নিলয়কে সরি বলবে। ওর জন্য সম্পর্ক নষ্ট হোক চাই না ও।
ইস একবার যদি পর্ণার সাথে কথা বলা যেত..
খাচায় বন্দী পাখির মতন ছটপট করছে শুভদ।
পর্ণাকে কখনো ফোন করেনি শুভদ। পারতপক্ষে মেসেজও করে না।
তবে আজ নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না।
নিজ অনুতপ্ত স্বীকার করে লম্বা মেসেজ করল শুভদ।
দুপুর পেরিয়ে বিকেল হতে চললো বারংবার নিজের কি প্যাড মোবাইলটা দেখছে শুভদ।না কোনো মেসেজ নেই..
ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়েছিল শুভদ।
মৃদু শব্দে মেসেজ ঢুকলো। ঘুমন্ত শুভদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই তড়াক করে উঠে বসলো ও।
ঘুম চোখে মেসেজ খুলল ও..
“আমদের আর কোনো রিলেশন নেই”
আবারো একটা কাঁটা বিধল ওর অন্তরে। চাইনি ও, এটা চাইনি কখনো।
ফোন দূরে থাক মেসেজ করার সাহস হলনা শুভদের।
সেই রাতে আবারো জ্বর এল ওর।
পরের দিন মহিম এল ওর কাছে।
-কি করে জ্বর বাধালি?নিশ্চয় ঠান্ডা লেগে।ঐ জন্যই বলি কেত কম মার..
-তোকে কে বললো স্ট্যাইল মারলে জ্বর হয়?
-তাছাড়া আর কি!
-মহিম তুই একটু বল ওকে। কাল থেকে কিচ্ছু দাঁতে কাটছে না।
-হ্যাঁ কাকিমা আমি ওকে ওটাই বলি। তুমি একটু আদা চা করো না, এই ঠান্ডায় বারবার চা খেতেই ইচ্ছে করছে।
-চা খাবি? যাই করে আনি। শুভ তুই খাবি?
এতক্ষণ মা-মহিমের কথোপকথন শুনছিল। শুনছিল প্রাণের বন্ধু কিভাবে মায়ের কাছে বাঁশ খাওয়াতে পারে..
তবে মায়ের প্রশ্নের জবাবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো শুভদ।
-আর কিছু বলা বাকি আছে তোর??
হেঁকিয়ে উঠলো শুভদ।
-পর্ণার লাভারের সাথে তোর ঝামেলা হয়েছে বলিস নি তো!
শুভ এবার বুঝল মাকে রান্নাঘরের পাঠানো
শুধু একটা বাহানা এই কথাগুলো বলবো বলেই মহিম ওর বাড়িতে এসেছে।
-তুই কি করে জানলি?
গলা নামালো শুভদ।
-ওদের পার্সোনাল ঝামেলায় তুই কেন ঢুকেছিস, তোকে তো আমি পইপই করে বারণ করেছিলাম ওদের জীবনে নাক না গলাতে।সেই তাই করলি তুই। নিলয় ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে, এবার তো ও বলছে তোকে দেখে নেবে..
-যা করেছি আমি বেশ করেছি। ঐ মালটা আমার কি ছিড়ে নেবে!
-শুভ তুই ব্যাপারটা যতটা হাল্কা ভাবছিস ততটা কিন্তু নয়।
নিঃশব্দের ঢোক গিলল শুভদ। ভয় যে ওর অন্তরেও আশ্রয় নিচ্ছে এবার। ওরজন্যই যে পর্ণা নিলয়ের সম্পর্ক ভেঙেছে একরকম নিশ্চিত হয়ে গেল ও।এই কারণে বেশি দুশ্চিন্তা হচ্ছে পর্ণার জন্য..
-আসলে নিলয় তখন..
-শুভ আজ কিন্তু তেল মেখে স্নান করতে হবে।জ্বর বলে পার পেয়ে যাবি না।
চা নিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বললো শুভদের মা কৃষ্ণা।
বাধ্য হয়েই প্রসঙ্গ পাল্টাতে হল ওকে।
পরের দিনও শরীর জুড়ে ওর দুর্বলতা শুভদের,ওর মা কিছুতেই রথীন স্যারের কাছে পড়তে যেতে দিল না। শুভদের সাহস হল না ঐ কন্যার মুখোমুখি হতে।
“তোর নাকি শরীর খারাপ?”
মেসেজটা পড়ে হৃদপিণ্ড যেন বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
ঐ কন্যা ওর শারীরিক অবস্থা জানতে চেয়েছে,তাহলে নিশ্চয়ই কিছুটা দোষ খন্ডন হয়েছে।
উচ্চাকাঙ্খা বেড়েই গেল ওর।
সাথে সাথেই পর্ণার নম্বর ডায়াল করল..
ঐ প্রান্তে তখন রিং হচ্ছে..
চলবে: