অপরিচিত পর্বঃ ১৫
লেখিকাঃ তাহমিনা তমা
রুমের সব ভাঙচুর করে মাথায় হাত দিয়ে বেডে বসে পড়লো মেহরাব। এতোক্ষণ টর্নেডো চলতে থাকা রুমে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে। হঠাৎই ম্যাসেজের শব্দে ফোনটা টোন করে উঠলো। পাশের টেবিলেই আরফার ফোনটা চার্জে বসিয়েছিলো মেহরাব। ফোন অফ হয়ে গিয়েছিলো আর আরফার মাকে আরফার কথা জানানোর প্রয়োজন ছিলো। তাই চার্জে বসিয়ে অন করার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু অন হয়ে আবার অফ হয়ে যাচ্ছিলো তাই মেহরাব বিরক্ত হয়ে রেখে দেয় তারপর কখন বসে বসে ঘুমিয়ে পড়েছে জানে না। আরফার ফোনে ম্যাসেজের শব্দ শুনে মেহরাব সেদিকে তাকালো। আননোন একটা নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এসেছে। এখন কেমন লাগছে মিস আরফা,,, এটুকুই দেখা যাচ্ছে। মেহরাব কৌতুহল নিয়ে ফোনটা হাতে নিলো। আরফা কখনো ফোন লক করে না তাই মেহরাবের কোন প্রবলেম হলো না ম্যাসেজটা ওপেন করতে।
এখন কেমন লাগছে মিস আরফা ? আমি তোমাকে বলেছিলাম মুজাহিদ খানের থেকে দূরে থাকতে তার বিষয়ে নাক না গলাতে। তাহলে তোমার সূর্যের মতো চমকাতে থাকা ক্যারিয়ার আমি রাতের অন্ধকারে তলিয়ে দিবো। আমার কথা শুনলে না এবার তার ফল ভোগ করো। আমি তো শুধু ঘরের একটা কোণে এক ফুলকি আগুন লাগিয়েছি। এখন বাকি ঘরটা একাই দাউদাউ করে ছাই হয়ে যাবে আমার কিছু করতে হবে না। Welcome to hell doctor Arfa.
ম্যাসেজটা পড়ে রাগে মেহরাবের ফর্সা মুখ লালবর্ণ ধারণ করছে। কপালের রগ গুলো ফোটে উঠেছে হাতটা আপনাআপনি মুঠো হয়ে গেলো। মেহরাব আরফাকে কিছু বলতে যাবে তখন মেহরাবের হুশ হলো আরফা রুমে নেই। এতোক্ষন এতোটাই রেগে ছিলো সামনে কী আছে আর নেই সেটা বুঝতেই পারেনি। আরফা রুমে নেই বুঝতে পেরেই তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেরিয়ে। বাড়ি মেইন ডোর ভেতর থেকে বন্ধ আর সার্ভেন্ট বললো কেউ বাইরে যায়নি কারণ দরজার বাইরে এখনো মিডিয়ার লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। মেহরাব এবার চিন্তায় পরে গেলো আরফা কোথায় গেলো ভেবে।
আরফা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিচের দিকে। উচ্চতায় বরাবরই ভয় ছিলো আরফার। একটু উচুতে গেলেই দম বন্ধ হয়ে আসে ভয়ে। কিন্তু আজ একটুও ভয় করছে না। মনে হচ্ছে এটাই একমাত্র পথ এই অপবাদ থেকে মুক্তি পাওয়ার। আর মরে গেলে বাবাকেও দেখতে পাবে সে। যেই ভাবা সেই কাজ। পিছনে ঘুরে গেলো আরফা, চোখ বন্ধ করে দুহাত মেলে শরীরের ভর ছেড়ে দিলো পেছনের দিকে। একটু পর হয়তো তাকে গ্রাস করে নিবে মৃত্যুর নিকষ কালো অন্ধকার। আরফার মনে হলো সে নিচের দিকে যাচ্ছে না বরং ঝুলে আছে। পিটপিট করে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলো মেহরাব তার একহাত শক্ত করে ধরে আছে। পা ছাঁদে হলেও শরীরটা ছাঁদের বাইরে ঝুলে আছে মেহরাব হাতটা ছেড়ে দিলেই সব শেষ।
দাঁতে দাঁত চেপে মেহরাব বললো, একজন ডক্টর হয়ে এমন জঘন্য একটা কাজ কী করে করতে পারেন আপনি ?
আরফা কোনো কথা বলছে না মাটির পুতুলের মতো তাকিয়ে আছে মেহরাবের দিকে। মেহরাব আরফার হাত ধরে আচমকা টান দিতেই আরফা সোজা মেহরাবের বুকে গিয়ে ধাক্কা খেলো।
মেহরাব আরফার দুবাহু শক্ত করে চেপে ধরে নিজের মুখোমুখি করে বললো, এমন কতো মানুষ আছে নিজের জীবনের শেষ মুহূর্তটা কাটাতে কাটাতেও বাঁচার জন্য কতো চেষ্টা করে। কোটি কোটি টাকা নষ্ট করে একটা বছর, একটা মাস অথবা একটা দিনই বেশি বাঁচার জন্য। সেসব নিজের চোখে দেখা একজন মানুষ এমন একটা সিদ্ধান্ত কীভাবে নিতে পারে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।
আরফা এখনো মেহরাবের দিকে তাকিয়ে। সেই দৃষ্টি একদম অনুভুতিহীন। সেই দৃষ্টিতে না আছে কষ্ট আর না আছে সুখ।
মেহরাব আরফাকে চুপ থাকতে দেখে রেগে ধমক দিয়ে বললো, কী হলো এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো হ্যাঁ ? আমি তোমার সাথে কথা বলছি। যার ধর্মই কিনা অন্যের জীবন বাঁচানো সে নিজের জীবন কেঁড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত কীভাবে নিতে পারে,, আনসার মি ?
আরফা তখনো নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে মেহরাবের দিকে। আরফার দৃষ্টি মেহরাবের দিকে থাকলেও যেনো মেহরাবকে দেখছে না। অন্য কোনো ভাবনায় ডুবে আছে। এদিকে মেহরাব রাগের মাথায় কখন আরফাকে তুমি করে বলা শুরু করেছে সেদিকে খেয়ালই নেই। মেহরাব আবার কিছু বলার আগেই আরফা সেন্সলেস হয়ে ঢলে পড়লো মেহরাবের বুকে। তা দেখে মেহরাব অবাক হয়ে গেলো। কিছু না ভেবেই কোলে তোলে ছাঁদ থেকে নেমে রুমে নিয়ে বেডে শুইয়ে দিলো। চুলগুলো দিয়ে মুখ ডেকে গেছে আরফার। মেহরাব চুলগুলো না সরিয়েই আরফার মুখের দিকে তাকালো। একদম নিষ্পাপ লাগছে মেয়েটাকে। মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা ধক করে উঠলো মেহরাবের। আর এক সেকেন্ড লেট করে গেলে হয়তো এখনকার পরিস্থিতিটা অন্যরকম হতো। মেহরাব কখনো নিজেকে মাফ করতে পারতো না। তাদের হেল্প করার জন্য আজ এই নিষ্পাপ মেয়েটার চরিত্রে দাগ লাগিয়ে দিয়েছে ওরা। রাগে হাত শক্ত করে মুঠো করে নিলো মেহরাব। দাদাজানকে তিলে তিলে মারতে চাওয়া মানুষগুলোকে এতোদিন হন্নে হয়ে খুঁজেছে মেহরাব। ছন্নছাড়া হয়ে খোঁজার জন্য ফলাফল দাঁড়িয়েছে শূন্য। মেহরাব বরাবরই চুপচাপ প্রকৃতির ছিলো কখনো কোন ঝামেলায় জড়াতো না তাই এসবে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তবে মেহরাব বুঝতে পেরেছে এভাবে হবে না শত্রুপক্ষ অতিমাত্রায় চালাক। এদের সামনে আনতে হলে এদের মতোই খেলতে হবে। মেহরাব নিজের ফোন খোঁজে কাকে যেনো কল দিয়ে কথা শেষ করে আরফার দিকে তাকালো।
আরফার দিকে তাকিয়ে বললো, আমি তোমাকে তোমার সম্মান ফিরিয়ে দিবো এতে আমাকে যা করতে হয় করবো।
মেহরাব আরফার পালস চেক করতে গিয়ে হাতে ইনজেকশনের দাগ পেলো। এতোক্ষণে বুঝতে পরলো আরফা কেনো বারবার সেন্সলেস হয়ে পড়ছে। গার্ডকে ফোন দিয়ে বললো গাড়ি থেকে ফাস্টএইড বাক্স নিয়ে আসতে। আসলে আরফাকে অজ্ঞান করার জন্য ক্লোরোফরম ব্যবহার করা হলেও বেশি হয় অজ্ঞান রাখার জন্য ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিলো। যার কার্যকারিতা এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। এজন্যই হয়তো মেহরাব রাতে শত চেষ্টা করেও জ্ঞান ফেরাতে পারেনি ওর। গার্ড ফাস্টএইড বাক্স এনে দিলে মেহরাব একটা ইনজেকশন পুশ করলো আরফাকে। এতে তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে উঠবে আরফা। ইনজেকশন দেওয়া শেষে মেহরাব আগের ইনজেকশনের দাগটা ভালো করে দেখতে লাগলো। দেখে মনে হচ্ছে কোনো অভিজ্ঞ ডাক্তার বা নার্স পুশ করেছে।
মেহরাব ফোন নিয়ে বেলকনিতে চলে গেলো আর দাদাজানকে কল দিলো।
দাদাজান ফোন রিসিভ করে অস্থির হয়ে বললো, দাদুভাই এসব কী হচ্ছে ? কোথায় আছো তুমি এখন আর আরফা মণি কোথায় ? ওরা যা বলছে সব কী সত্যি ? কিন্তু আরফা মণি তো খুব ভালো মেয়ে তাহলে এসব,,,
মেহরাব বললো, দাদাজান তুমি আগে শান্ত হও তারপর আমি সব বলছি।
মুজাহিদ সাহেব নিজেকে শান্ত করে বললো, আমি ঠিক আছি তুমি বলো।
মেহরাব বললো, দাদাজান আমি এখন আমাদের ফার্মহাউসে আছি আর আরফাও আমার সাথেই আছে।
দাদাজান বললো, তার মানে কী এসব সত্যি ?
মেহরাব একটু রেগে বললো, দাদাজান আমার কথা এখনো শেষ হয়নি।
মেহরাব এরপর গতকালের ঘটনা খোলে বললো দাদাজানকে।
দাদাজান চিন্তিত হয়ে বললো, কী থেকে কী বানিয়ে ফেলেছে সবাই ? তুমি এখন কী করবে ভাবছো ?
মেহরাব বললো, দাদাজান আমি বুঝতে পারছি না কী করবো ? সিচুয়েশন আউট অফ কন্টোল হয়ে গেছে, কী করবো এখন ?
মুজাহিদ খান গভীরভাবে একটু চিন্তা করে বললো, আমি বাসায় একটা প্রেস কনফারেন্সের ব্যবস্থা করছি তুমি সেখানে বলবে আরফা আর তুমি একে অপরকে ভালোবাসো। খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করছো আর গতরাতে লংড্রাইভে গিয়েছিলে কিন্তু বৃষ্টির জন্য আঁটকে গেছিলে। ফার্মহাউস কাছে ছিলো তাই ওখানেই ছিলে।
মুজাহিদ খানের কথা শুনে মেহরাব অবাকের চরম পর্যায় পৌঁছে বললো, এসব কী বলছো তুমি দাদাজান, তোমার মাথা ঠিক আছে ?
মুজাহিদ খান বললো, এর থেকে ভালো কোনো সমাধান এই মুহুর্তে তোমার কাছে থাকলে বলো আমি সেটার ব্যবস্থাই করে দিবো। দেখো অন্য কোনো সমাধান বের করতে সময় লাগবে আর ততদিনে প্রেস, মিডিয়া, জনসাধারণ এই বিষয়টাকে আরো ঘোলাটে করে তুলবে আর বর্তমানে সোশাল মিডিয়ার যুগ যেটা সম্পর্কে আমার থেকে তোমার ধারণা অনেক বেশি। মানুষ শুধু নিত্য নতুন সমালোচনার খোঁজে থাকে। তুমি একজন ছেলে তার ওপর খান ইন্ডাস্ট্রিস, হসপিটাল আর মেডিকেল কলেজের একমাত্র উত্তরাধিকারী। তোমার হয়তো সমস্যা হবে না এসবে কিন্তু আরফা খুব সাধারণ একটা মেয়ে। মানুষ ওর বাঁচা মুশকিল করে তুলবে। এর অন্যকোনো সমাধান বের করার আগেই মানুষ ওকে আত্নহত্যা করতে বাধ্য করবে।
মেহরাব চুপচাপ দাদাজানের কথা শুনছে। কারণ তার বলা প্রত্যেকটা কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। কিন্তু মেহরাব কীভাবে কাউকে বিয়ে করতে পারে তার মনে এখনো সিনথিয়ার রাজত্ব। সেখানে অন্যকারো জায়গা দিতে পারবে না মেহরাব।
মেহরাব বললো, কিন্তু দাদাজান আমি কীভাবে,,,,
মেহরাবের কথা শেষ হওয়ার আগেই মুজাহিদ খান বললো, দেখো দাদুভাই আজ নাহয় কাল তোমাকে বিয়ে করতেই হতো। আরফা খুবই ভালো মেয়ে সেটা আমার থেকে তোমার বেশি জানার কথা।
মেহরাব আবার বললো, কিন্তু এভাবে বিয়ে করা কীভাবে সম্ভব তুমি বলো৷
মুজাহিদ খান বললো, আমার যেটা ঠিক মনে হয়েছে আমি সেটা বলেছি। আমি তোমার ওপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দিবো না। তবে যা সিদ্ধান্ত নাও মেয়েটার কথা ভেবে নিয়ো।
মুজাহিদ খান ফোন কেটে দিলো আর মেহরাব বেলকনির ইজি চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে নিলো। আকাশ পাতাল ভাবতে লাগলো।
কী করবো আমি এখন ? এখন মনে করে আরফাকে হেল্প করতে যাওয়াটাই ভুল হয়েছে আমার৷ ছি ছি এটা কী বলছি আমি ? আজ আমাদের হেল্প করতে গিয়েই আরফা এই বিপদে পড়েছে। আমি ওকে উদ্ধার না করে কে জানে কী করতো ওরা আরফার সাথে।
মেহরাব বেলকনি থেকে উঠে রুমে গিয়ে সোফায় বসে তাকিয়ে আছে আরফার দিকে। সিনথিয়ার আগেও মেয়েদের সাথে তেমন কথা বলতো না মেহরাব আর সিনথিয়া চলে যাওয়ার পর আরো বেশী এড়িয়ে চলতো মেয়েদের থেকে। আজ এতোবছর পর একটা মেয়েকে এভাবে পর্যবেক্ষণ করছে মেহরাব। এই একমাসে কখনো হিজাব ছাড়া দেখেনি আরফাকে। আজ হিজাব পরা নেই ঘন কালো চুলগুলো বিছানায় ছড়িয়ে আছে। এতো লম্বা আর সুন্দর চুল আগে কখনো দেখেনি মেহরাব। চুলগুলো দিয়ে মুখের অনেকটা ঢেকে আছে। মেহরাবের কী হলো সে নিজেও জানে না। খুব ধীর পায়ে আরফার কাছে গিয়ে বসলো আর আলতো হাতে চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে তাকিয়ে থাকলো তার মায়াবী মুখের দিকে।
বিড়বিড় করে বললো, এই নিষ্পাপ মুখটাতে মিথ্যা অপবাদের দাগ লাগতে দিবো না, তাও আবার আমার জন্য। কিন্তু আমার জীবনের সাথে জড়ালে তোমার জীবনটা যে নষ্ট হয়ে যাবে।
চলবে,,,,,,