মন শুধু মন ছুঁয়েছে
তামান্না জেনিফার
পর্ব ৩
__________________
সোহেল সকাল থেকে হাসপাতালের বারান্দায় বসে আছে ৷ সরকারী হাসপাতাল , অগনিত মানুষের ভিড় ৷ তার খুব বিরক্ত লাগছে , কিন্তু কিছু করার নাই ৷ তার বড়ভাই একটু আগে তাকে শাষিয়ে গেছে , টাকা দিতে না পারলে প্রয়োজনের সময় দায়িত্ব নিতেই হবে ৷ তার গার্মেন্টসে ছুটি দেবে না , তাই হাসপাতালে তিনি সময় দিতে পারবে না ৷ একজন যেহেতু টাকা দিচ্ছে , আর একজনের তো সময় দিতে হবে …
ভাইয়ের কথাগুলো বারবার কানে ভেসে আসছে সোহেলের ৷ বিরক্তিতে মুখে থুথু জমে যায় তার ৷ সামনের দিকে থুথু ফেলে আলিমকে ডাক দেয় সে ৷
আলিম তার থেকে একটু দূরে বসে আছে ৷ এখানকার সব কাজ আসলে আলিমই দেখছে ৷ ঔষধ আনা , টেষ্ট করানো … সোহেলের কাজ হলো শুধু বসে থাকা ৷ মাঝে মধ্যে মায়ের কাছে গিয়ে একটু বসা …
মায়ের বয়স হয়েছে ৷ তারউপর সোহেলের ভাবি তার ঠিকমতো যত্ন করে না ৷ সব মিলিয়ে দীর্ঘদিনের অসুখ একসাথে জমে আজ তিনি সরকারী হাসপাতালের ওয়ার্ডে …
সোহেলের গত দুদিনে একবারও অদিতির কথা মনে পরেনি ৷ সেদিন অদিতি এলো না , পরের দিন সকালেই খবর পেলো মা ভীষণ অসুস্থ …তারপর তো মায়ের সাথেই ৷ একবার ভেবেছিলো আলিমকে পাঠাবে অদিতির খোঁজ নিতে ৷ কিন্তু অালিমকে পাঠালে এখানকার ছোটাছুটি কে করবে ভেবে পাঠায়নি আর…
*******
অদিতিকে জাউভাত আর টেংরা মাছের ঝোল খাওয়াচ্ছে সুষ্মিতা ৷ আজকে ওর শরীর একটু ভালো , কাল পরশু হয়তো ছেড়ে দিবে ৷ শহরের সবচেয়ে দামী হসপিটালে আছে তারা ৷ বেশ খরচ হয়ে যাচ্ছে , এতটাও জমানো টাকা নাই এখন হাতে ৷ সুস্মিতা কি যে চিন্তায় আছে ৷ টাকার চিন্তা ! চিরকুটের চিন্তা ! ওর একবার মনে হচ্ছে অদিতিকে জিজ্ঞেস করে ৷ কিন্তু মেয়েটার শরীরের যে অবস্থা জিজ্ঞেস করা কি ঠিক হবে কি না বুঝতেছে না সে !
—আর খাবো না মা
—আর একটু খাও মা , একটু কষ্ট করে খাও
—বমি আসতেছে আমার
—আচ্ছা ঠিক আছে আর খেতে হবে না
—মা , আমার স্কুলে জানাইছিলা ?
—কোন ব্যাপারে ?
—ইশ মা , অংক পরীক্ষা দিতে পারলাম না , আজকে সামাজিক বিজ্ঞান পরীক্ষার ডেট ..এটাও তো দিতে পারলাম না …আমাকে যদি টেনে উঠায়ে না দেয় ?
—ও এই ব্যাপারে ! তোমার বাবা কথা বলেছে ৷ হেড মিসট্রেস বলেছেন তোমার যে দুটা পরীক্ষা মিস গেলো এটা তারা পরে নিবেন আলাদা করে ৷
—যাক তাহলে তো ভালো ৷ ইশ আমি যদি আর দু’চারটা দিন পরে অসুস্থ হতাম তাহলে পরীক্ষাগুলো দিতে পারতাম ৷
—শুধু কি পরীক্ষার জন্যই চিন্তা হচ্ছে তোমার ? আর কোন সমস্যা নেই তো ?
—আর কি সমস্যা থাকবে ? আমাকে অষুধ দাও তো মা , ঘুমাবো আমি …
ঔষধ খেয়ে অদিতি চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে ৷ তার ঘুম আসছে না , মা কে সে মিথ্যা বলেছে ৷ মা এভাবে বললো কেন ! মা কি তবে কিছু বুঝতে পেরেছে ? বান্ধবীরা কেউ মাকে কিছু বলেনি তো ! বলতেও পারে , ওরা কেউ সোহেল ভাইকে পছন্দ করে না …
কেউ কেন সোহেল ভাইকে পছন্দ করে না এটা অদিতির মাথায় ঢোকে না ৷ সবাই বলে সোহেল ভাই না কি নেশা করে, অদিতির এ কথা বিশ্বাস হয় না ৷ আবার বলে সে নাকি গুন্ডা ! এটাও অবিশ্বাস্য একটা কথা ৷ অদিতি দেখেছে সোহেল ভাই কতটা নরম মনের ৷ স্কুলের সামনে ভিখারীগুলোকে সে মাঝে মাঝেই খাওয়ায় , তাদের পাশে বসে নিজেও খায় ৷ কতটা উদার হলে একটা মানুষ এমন করতে পারে ! হ্যাঁ , এটা ঠিক সে এখনো কিছু করে না , তাতে কি হয়েছে ৷ করবে যখন সময় আসবে ৷ আর কিছু না কিছু একটা যে সোহেল ভাই করার যোগ্যতা রাখে এ ব্যাপারেও অদিতির কোন সন্দেহ নাই !
অদিতি গভীর দুশ্চিন্তায় পড়েছে ৷ সে তো চিঠির জবাব দিতে পারেনি , সোহেল ভাই যে কি ভাবলো কে জানে ! অদিতির বুকের ভেতরে কেমন যেন চাপ লেগে আসে ৷ সোহেল ভাইকে এক পলক দেখার জন্য তার মনটা ছটফট করতে থাকে …
আবার যে কবে দেখা হবে ! অদিতি মনে মনে কথা বলতে শুরু করে তার সাথে ..
—আপনি রাগ করেননি তো সোহেল ভাই ?
—রাগ করিনি , কিন্তু অভিমান হয়েছে
—আমি কি ইচ্ছে করে সেদিন আসিনি ? আমার হঠাৎ এমন ব্যথা শুরু হলো ! জানেন , আমার তখন শুধু আপনার কথা মনে হচ্ছিলো ৷ তারপর তো সেদিনই ডাক্তার আমার পেটটা কেটে দিলো !
—ইশ , তোমার অনেক অষ্ট হয়েছে তাই না অদিতি ! কোথায় কেটেছে ডাক্তার , দেখি আমাকে দেখাও তো !
অদিতি লজ্জায় লাল হয়ে উঠে … মৃদু মৃদু হাসতে হাসতে হাসতে সে বলে ” দেখতে হবে না , পরে একদিন দেখবেন , আমাদের বিয়ের পর …”
সুস্মিতা অবাক হয়ে দেখলেন অদিতি চোখ বন্ধ করে মিটিমিটি হাসছে , মনে হচ্ছে সে কোন কিছুতে ভীষণ লজ্জা পেয়েছে … সুস্মিতার বুকের মধ্যে কেমন যেন ধ্বক করে উঠে ! তার মেয়েটা কি তাহলে সত্যিই কারো প্রেমে পড়েছে ! এত ছোট্ট একটা মানুষ , যে এখনো ভাত নিজে খেতে গেলে প্লেটের চারপাশে ভাত ফেলে , যে এখনো নিজের চুলে তেল দিয়ে বাঁধতে পারে না , যার জামা কাপড় এখনও ধুয়ে দিতে হয় সে কি না কারো প্রেমে পড়েছে ! এটাও কি সম্ভব ! সুস্মিতা তার এই অব্যক্ত কথাগুলো কাকে বলবে বুঝতে পারে না ৷ তার মনের সংশয়গুলো কে বুঝবে সুস্মিতা তাও বোঝে না ! স্বামীকে বলার উপায় নেই তার ৷ বড্ড মাথা গরম মানুষটার , হুটহাট কি করে বসবে ! না না , এটা করা যাবে না ! অহনাকে বলবে ! অহনা এমনিতেই অদিতির জন্য চিন্তায় আছে , পরীক্ষা চলতেছে তাই আসতেও পারছে না ৷ ওকে আবার চিন্তা দেওয়াটা কি ঠিক হবে … সুস্মিতা পুরো শরীর ঘেমে উঠে , অথচ ঘরে এসি চলছে …
*************
সোহেল আলিমকে রেখে সিগারেট ধরাতে হাসপাতালের বাইরে আসে ৷ এমন সময় তার মোবাইলে কল আসে আসিফের ৷ আসিফ তার সাথেরই লোক ৷ একসাথে চলে , বন্ধুমানুষ … আসিফ কল দিয়ে বলে
—মামা , খবর শুনছো ! অদিতি ভাবি তো হাসপাতালে ….
—কি বলিস ? মাথামুথা ঠিক আছে ?
—হ মামা , এক্কের সলিড খবর
—কেমনে জানলি ?
—আবে , আমগো মিল্লাত আছে না , আরে কাল্লু ভাইয়ের সাগরেদ .. অয় গেছিলো হসপিটালে ৷ মামদো পোলা শালার এমডি দুই মাস হইলো টেকা দেয় না ! কাল্লু ভাই আইজ ওরে আর কয়ডা পোলারে পাঠাইছিলো ৷ তোমারেই পাঠাইতো , খালাম্মা অসুস্থ লেইগা পাঠায়নি ৷ মিল্লাতে দেখছে মাস্টারনীরে হসপিটালে
—মাস্টারনী কাউরে হয়তো দেখতে গেছে
—আবে মামা না ! মিল্লাত পরে খোঁজ নিয়া আসছে …
—কস কি !
—হ মামা !
—কি হইছে ? কিছু শুনছে ? তাইতো কই অদিতি ঐদিন আইলো না ক্যান ! মামা , তুই হসপিটালে লোক পাঠা , আমার অদিতির খবর নে ….
—আইচ্ছা , টেনশন লইও না , খোঁজ নিতাছি…
—আচ্ছা আমারে জানা
টেনশন নিও না বললেই কি টেনশন মুক্ত হওয়া যায় ! সোহেলের মাথা পুরো ঝিমঝিম করতেছে ৷ কি হলো তার অদিতির ! দুদিন আগে মেয়েটা আসেনি জন্য কত খারাপ কথাই না ভেবেছে সে , এমনকি খুন পর্যন্ত করার চিন্তা করছে , অথচ মেয়েটা অসুস্থ হয়ে হসপিটালে পড়ে আছে ! সেদিন মেয়েটা তাকে ফাঁকি দেয়নি , সে আসলে আসেইনি পরীক্ষা দিতে …
সোহেল যেন মরমে মরে যায় !
এর মধ্যে আলিম এসেছে ৷ এসে ঘাড় কাত করে বলে ” ওস্তাদ খালাম্মা আপনেরে ডাকতেছে …”
সোহেল মাথা নিচু করে মায়ের ওয়ার্ডের দিকে হাঁটা দিলো … তার মায়ের এখন মাঝে মাঝে জ্ঞান ফেরে ৷ তখন সে নানা রকম কথা বলতে চায় ৷ অসংলগ্ন কথাবার্তা ৷ যে কথার কোন আগামাথা নাই ৷ সোহেলের সেসব শুনতে ভালো লাগে না , কিন্তু একজন অসুস্থ মানুষ এত আগ্রহ নিয়ে বলছে সেটা না শোনাটাও কেমন যেন দেখায়…সোহেল গিয়ে মায়ের পাশে চেয়ার টেনে বসে ..
—আব্বা আইছো ? তোমার আব্বায় ঐদিকে গেছে দাক্তরের কাছে ৷ হ্যায় আমারে এইখানে থুইবো না
—আব্বারে কই পাইলেন আম্মা ? আব্বা তো মইরা গেছে সেই কবে !
—আলাই বালাই ! এগুলান কি কস ! তোর আব্বা শুনলে রাগ করবো ! কীড়া কাট , বল এগুলান আর বলব না !
—আচ্ছা বলব না
—তোর আব্বায় আমারে বকতাছে ৷ বলতাছে বউ তুমি এই নোংরার মধ্যে কেমনে আছো ? এরা কেউ তোমার যত্ন নিতাছে না ! এইখানে তোমারে আর রাখুম না , আমার কাছে নিয়া আসমু ৷
—আচ্ছা , আপনি এত কথা কইয়েন না ঘুমান , আমি আইতাছি …
সোহেল মায়ের কাছ থেকে চলে এসে আবার একটা সিগারেট ধরায় …
চলবে