মন শুধু মন ছুঁয়েছে, পর্ব:৪

0
549

মন শুধু মন ছুঁয়েছে
তামান্না জেনিফার
পর্ব ৪
__________________

অদিতিকে হাসপাতাল থেকে যেদিন ছেড়ে দিলো , সেদিন সকালেই মারা গেলো সোহেলের মা ৷ মানুষটা বড্ড কষ্ট পাচ্ছিলো , মারা গিয়ে যেন সবাইকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেলেন তিনি ৷ সোহেলের ভাবী যে কিনা শ্বাশুড়ী বেঁচে থাকতে শুধু অবহেলাই করেছে , সেই শুধু খানিকক্ষন গলা ছেড়ে কাঁদলো … সোহেল বা তার ভাইয়ের চোখে কোন পানি দেখা গেলো না ৷
সোহেলের বড় ভাই গম্ভীর মুখে কার কার সাথে যেন মোবাইলে কথা বলছে , সোহেলের তাতে তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না ৷ তার বারবার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ছে ৷ বাবা যতদিন বেঁচে ছিল , অভাবের সংসারেও মা ছিল রাজরাণী হয়ে ৷ বাবা মারা যাবার সাথে সাথেই মা ঘুটেকুড়ানি হয়ে গেলেন ৷ মা ঠিকই বলেছিল , বাবা তাকে নিতেই এসেছিলেন ৷ সোহেলের ভাবী তখনও গুনগুনিয়ে কাঁদছিল , বড়ভাই এসে একটা ধমক দিয়ে তাকে চুপ করালো ৷ তারপর সোহেলকে বললো

—গ্রামে নিয়া যামু ৷ এইখানে জায়গা পাওন কঠিন আছে ৷ তুই কি কস ?

—গ্রামেই বা জায়গা কই ?

—ক্যান , আব্বারে যেইখানে কবর দেওয়া হইছে ঐখানেই দিমু ৷ আর গ্রামে গেলে একটা ব্যবস্থা হবেইনে , এইখানে হুদা বইসা থাইকা লাভ কি ৷

—যেটা ভালো মনে করো

—গাড়ি আইবো একটু পর ৷ তোর হাতে কিছু টেকা আছে ? আমার আবার হাত শর্ট ..হাসপাতালে মেলাগুলান টেকা চলে গেছে ৷

—কত লাগবে ?

—হাজার পাঁচেক

—আচ্ছা , আমি ম্যানেজ করতেছি

সোহেল বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরিয়ে কল করে পার্টি অফিসের বড় ভাইকে …

—ভাই , কিছু টাকা লাগতো

—আরে তোরে হারিকেন জ্বালায়া খুঁজতাছি বাল , জলদি জলদি অফিসে আয় … একখান কাম আছে ৷ তোরেই লাগবো ৷

—ভাই , আমার মা মারা গেছে আজকে

—ইন্নানিল্লাহ ! কস কি বেটা !

—বড় ভাইয়ের হাত খালি , আমার অবস্থাতো জানেন .. কিছু টেকা দিলে ভালো হইতো ৷ আমি আজ রাতেই ফিরমু , কাইল আপনের কাম করতাছি ৷ কি কাম ?

—আবে কইস না , মাস্টারনী তো বহুত ভেজাল করতাছে ৷ শুনতাছি হ্যায় বলে কোন সাংবাদিকের লগে মিল্যা আমগোর নামে রিপোর্ট বাইর করতাছে ৷ হ্যারে একটু টাইট দেওন লাগবো ৷

—ভাই , আপ্নে কিছুই কইরেন না ৷ আমি কাল ব্যবস্থা নিমু ৷ আপনে এইটা আমার উপরে ছাইড়া দেন ৷

—আমি জানি তো বেটা , এই কাম তুই ছাড়া কেউ পারতো না … কত টেকা লাগবো ? বিকাশ কইরা দিতাছি

—পাঁচ হাজার দেন ভাই

—আবে পাঁচ হাজারে কিছু হইবোনি ! আমি সাত হাজার দিতাছি , বাকি আরো লাগলে কইস …

—আচ্ছা ভাই

সোহেল মোবাইল পকেটে রেখে সেই বড় ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলে “শালা বাটপার … ”

মোবাইলের টুংটাং বলে দেয় টাকা এসেছে ৷ সোহেল ক্যাশআউট করে এনে ভাইয়ের হাতে পাঁচহাজার টাকা দেয় ৷ তারপর মায়ের লাশ নিয়ে তাদের যাত্রা শুরু হয় গ্রামের উদ্দেশ্যে …

*********

অদিতি নিজের ঘরে শুয়ে আছে ৷ ওর মন মননে এক সোহেল ছাড়া আর কিছু নেই ৷ মানুষটার সাথে কতদিন দেখা হয় না … মোবাইল নাম্বারটাও নেয়নি এতদিনেও … অদিতির নিজের উপর রাগ হয় খুব ৷

সুস্মিতা এসে চেয়ার টেনে বসে অদিতির সামনে ৷

—এখন কেমন লাগছে মা ? উঠে বসোতো , ভালো লাগবে

—শুয়ে থাকতেই ভালো লাগছে মা

—আচ্ছা থাকো ৷ অদিতি কিছু জানতে চাচ্ছিলাম ..

—হ্যাঁ মা বলো

—তুমি কি কারো প্রেমে পড়েছো ?

—না তো ! অদ্ভুত , এসব কথা তোমাকে কে বলেছে ? ছি মা , আমাকে দেখে তোমার মনে হয় এসব আমি করতে পারি ? আমি তোমার মেয়ে মা , আমি এমন কিছুই করবো না যাতে তোমাদের মান সম্মানে আঘাত লাগে … বিশ্বাস করো না মা তুমি আমাকে ? আমি আপুর মত ভালো ছাত্রী না হতে পারি কিন্তু আমি খারাপ মেয়ে নই মা …

অদিতি এক নিঃশ্বাসে সব বলে মায়ের দিকে তাঁকায় ৷ এই কথাগুলো সে নিজে নিজে কয়েকবার করে প্রাকটিস করেছে ৷ তার মন বলছিলো মা এমন কিছু জিজ্ঞেস করবে ৷ তার ধারনাই সঠিক ছিল ৷

—না আসলে ৷ বিশ্বাস তো করি ৷ কিন্তু আসলে এই বয়সটা খারাপ , এই বয়সে মানুষ ভালো মন্দ বোঝে না রে মা …

—আমি খুব কষ্ট পেয়েছি মা ৷ তুমি কিভাবে আমাকে এই কথা বললে ! আমাকে তুমি সবসময় কম ভালোবাসো মা , তোমার বড় মেয়েই তোমার চোখের মনি !

—এসব কি বলো তুমি অদিতি ! মায়ের কাছে সন্তান সবাই সমান ৷ আসলে তোমার জ্যামিতি বক্সে আমি তোমাকে ভালোবাসি লেখা একটা কাগজ ছিলো….সেটা দেখে না মানে…

—ও এই কথা ! তুমি এটা দেখে এগুলা ভাবছো ? আল্লাহ ! আমাকে জিজ্ঞেস তো করবা ? অংকের সুত্র আমার মনে থাকে না ৷ আমি তো তোমার বড় মেয়ের মত মেধাবী নই … আমার সূত্র মনে রাখতে খুব কষ্ট হয় ৷ এজন্য শর্ট ফর্মে অনেক বুদ্ধি করে এই সূত্র বানাইছি … বুঝায়ে বলি ৷ লেখা ছিলো ভালোবাসি .. ভা মানে হচ্ছে ভয় , আমি যে চেপ্টার সবচেয়ে ভয় পাই ওটার সূত্র হলো …

sin2 θ + cos2 θ = 1

sec2 θ = 1 + tan2 θ

cosec2 θ = 1 + cot2 θ

লো মানে লগারিদম , মানে …

—থাক বুঝতে পারছি ৷ আর বলতে হবে না

—না মা তুমি শোন , অযথা কেন আমাকে ভুল বুঝবে ?

—আচ্ছা আমার ভুল হয়ে গেছে ৷ তুমি রেস্ট নাও আমি আসছি …

সুস্মিতা দ্রুত নিজের ঘরে যায় ….. ঔষধের ডালা থেকে একটা টাফনিল নিয়ে বোতলে রাখা পানি দিয়ে ঢকঢক করে গিলে খায় ৷ প্রচন্ড মাথা ধরেছে তার …সেদিন জন্মানো তার মেয়েটা গড়গড় করে এতগুলো মিথ্যে কথা কিভাবে বললো , ভেবেই মাথাব্যথা শুরু হয়েছে তার… সুস্মিতা অদিতির প্রত্যেকটা মিথ্যা ধরতে পেরেও চুপচাপ ছিলো ! একটা বয়সে সন্তানরা মনে করে মা হচ্ছে দুনিয়ার সবচেয়ে বোকা মানুষ , তাকে ইচ্ছে করলেই ঠকানো যায় ! মায়েরা কি আসলেও বোকা হয় ? যে সন্তানকে নিজের জঠরে নিজের রক্ত বিন্দু দিয়ে ধারণ করলো , সেই সন্তানের ফাঁকি মা বুঝতে পারবে না তাও কি হয় ৷ মায়েরা বুঝেও চুপচাপ থাকে ৷ কারন এত যত্নের সন্তানকে কষ্ট দিতে মায়ের বুক ফেঁটে যায় …

*****************

সুস্মিতা চলে যেতেই চোখ বন্ধ করে ফেলে অদিতি ৷ চোখ বন্ধ করতেই তার চোখের সামনে আসে সোহেল .. অদিতি আদুরে গলায় তাকে বলে “জানো আজ একটু হলেই মায়ের কাছে ধরা পড়ে যাচ্ছিলাম …উফফ কি বাঁচাটাই না বাঁচলাম …” সোহেল ততক্ষনে ওর খুব কাছে চলে এসেছে ৷ সোহেলর নিঃশ্বাস নিজের শরীরে অনুভব করে অদিতি …ওর গলা জড়িয়ে আসে ৷ তবুও ফিসফিস করে বলে , “এত কাছে এসো না…কেউ দেখে ফেলবে…!” কল্পনার সোহেল বড্ড অবাধ্য ৷ অদিতির কথা সে শোনে না .. অদিতির বাম গালে একটা ছোট্ট চুমু বসিয়ে দেয় সোহেল ৷ অদিতির পুরো শরীর কাঁপছে … সে আরো ফিসফিসিয়ে বলে “ভালোবাসি … ভালোবাসি …ভালোবাসি…”

*************

রাতের বেলাই মায়ের দাফন কাফন শেষ হলো ৷ জায়গা নিয়ে কোন সমস্যাই হয়নি ৷ গ্রামে পৌছাতেই গ্রামের চেয়ারম্যান নিজ থেকে সব ঠিক করে দিলো ৷ তাদের পুরোনো বাড়ির উঠানেই চৌকি পেতে , মশারী টাঙিয়ে , বড়ই পাতা সিদ্ধ গরম পানিতে সোহেলের মাকে গোসল করানো হয় ৷ অনেকেই কাঁদছে , সোহেল তাদের কাউকেই চেনে না ৷ তার বড় ভাইকে দেখা গেলো একজন মুরুব্বি গৌছের কাউকে ধরে খুব কাঁদছে … সোহেল ভাইয়ের কান্না দেখে খুবই অবাক হলো ৷ মানুষের চেয়ে বহুরূপী প্রাণী গিরগিটিও না ….

কবর দেওয়া হয়ে গেলে সোহেল শহরের দিকে চলে আসলো ৷ তার ভাই আর ভাবী ফিরলো না ৷ কোথায় থাকবে রাতে তাও জানে না , বসত ভিটা পর্যন্ত বিক্রি করা ….. ঘর কই যে থাকবে !

গ্রামেরই একজন কেউ সোহেলের পাশের সিটে বসেছে ৷ সোহেল তাকে চেনে না , তবে উনি সোহেলকে চেনে … সোহেলকে দেখে আফসোস করে বললো “এক সপ্তার মদ্যে দুইখান মরা মরলো তোমাগো .. আহা ! ” সোহেল অবাক হয়ে ভাবছে আর কে মারা গেলো ? লোকটা নিজেই বললো “তোমার কাহা বড় ভালো মানুষ আছিলো ! আহারে , একখান পোলাও নাই , তিনখান সোমত্ত মাইয়্যা ফালাইয়া বাপটা মইরা গেলো !”

সোহেল এতক্ষনে পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারলো ৷ কেন মায়ের লাশ নিয়ে গ্রামে আসলো তার ভাই … আসলে তার চাচার কোন ছেলে নেই , তারউপর চাচার গ্রামে অনেক সম্পত্তি ৷ ছেলে না থাকলে ভাতিজারাও হয় অংশীদার… টাকার গন্ধে তার ভাই গ্রামে পড়ে আছে…সোহেল নিজের মনেই হাসতে থাকে ৷ পাশে বসা মানুষটা অবাক হয়ে ভাবে , এই ছেলে কি পাগল হয়ে গেলো ?

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here