#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা
৮.
দীঘল কালো রজনী কেমন উন্মাদনায় মেতেছে। নন্দন মশাই জেসে কুটিকুটি। হাসি দেখা গেল লক্ষ্মী দেবীর ঠোঁটের কোণাতেও। অলকানন্দা বড়ো অশ্বত্থ গাছের আড়াতে দাঁড়িয়ে সেই সুখ দেখছে। তার এখনও মস্তিষ্ক অব্দি ঘটনাটা পৌঁছাতে পারেনি। আসলে এখানে হচ্ছেটা কী! অলকানন্দার আর ভাবতে হলো না কষ্ট করে। তার আগেই পরিচিত সেই ব্রাহ্মণের কণ্ঠ ভেসে এলো,
“কন্যাকে আনিতে হবে এখনই। দাহ্য করার সঠিক সময় হইয়া গিয়াছে। আকাশে কেমন ভরা পূর্ণিমা! নিয়ে আসুন উনাকে।”
অলকানন্দা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। কাকে আনার কথা বলছে সেও দেখতে চায়। ব্রাহ্মণের আদেশ পেতেই লক্ষ্মী দেবী হন্তদন্ত পায়ে ছুটে গেলো কোথাও একটা। গম্ভীর আঁধারে মিশে গেল লক্ষ্মী দেবীর সুন্দর দেহটা। অলকানন্দা গম্ভীর ভাবে অপেক্ষা করলো। ঠিক কাকে এখানে আনা হবে সেটাই জানার আগ্রহ তার। অলকানন্দার অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটলো ঠিক মিনিট পাঁচেক পরেই। লক্ষ্মী দেবীকে ছুটে আসতে দেখা গেল হন্তদন্ত পায়ে। হাঁপিয়ে গেছে মানুষটা ছুটতে ছুটতে। অলকানন্দার এতক্ষণের অপেক্ষাকে বিশ্রাম দিয়ে উচ্চারণ করলো কাঙ্খিত বাক্য,
“ও মেয়ে তো ঘরে নেই। কোথায় গেল ও? ঘুমিয়ে ছিল দেখেছিলাম, এখন দেখি ঘর খালি।”
লক্ষ্মী দেবীর কথায় চমকে গেলো নন্দান মশাই। কিছুটা উচ্চস্বরেই বলল,
“কী!”
নন্দন মশাইয়ের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। কথাটা সে মোটেও আশা করেনি যেন। ব্রাহ্মণ ঠাকুর উঠে দাঁড়ালেন। ধমকে বললেন,
“এত যজ্ঞ, আয়োজন করিয়া এই কথা বলিলে কোনো লাভ হবে? যেখান হইতে পারিবেন সেখান হইতেই তাহা কে নিয়া আসুন৷”
“আমি ও মেয়েরে পুরো বাড়ি খুঁজে এলাম, কোথাও তার টিকি টুকুরও দেখা নেই। ও কী বুঝতে পেরে পালিয়ে গেল কোথাও?”
অলকানন্দা হয়তো বুঝতে পারলো ঠিক কাকে খুঁজছে এই তিনজন মানুষ। তাদেরকে আর ব্যস্ত হতে না দিয়েই অলকানন্দা গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। ভাবলে ভাবে হেঁটে গেলো তাদের সামনে। অলকানন্দাকে এখানে কেউ-ই আশা করেনি যার ফলস্বরূপ ভূত দেখার মতন চমকে উঠে তারা। যা দেখে খিলখিল করে হেসে উঠে অলকানন্দা। আজ তার মাথায় ঘোমটা নেই। আঁচলটা গড়াচ্ছে মাটিতে। এমন সুন্দর হাসিতেও মেয়েটাকে কেমন ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে! লক্ষ্মী দেবী প্রথমে ভীত হলেন। জঙ্গল থেকে ভূত প্রেত এসে পড়েছে ভেবেই দিলের চিৎকার। বারংবার বলতে লাগলে, “রক্ষে করো মা, রক্ষে করো”। নন্দন মশাই আর ব্রাহ্মণ ঠাকুর ড্যাবড্যাব করে কেবল তাকিয়ে রইলো। অলকানন্দার হাসি যেন প্রকৃতিতে ঝঙ্কার তুলেছে। গা শিরশির করে প্রবাহিত হচ্ছে কেমন ভয়ঙ্কর অনুভূতি! তাদের এমন ভীত অবস্থা দেখে অলকানন্দাই প্রথম কথা বলল,
“কি পিসিমা, পোড়াবেন না আমায়?”
লক্ষ্মী দেবী সংশয় নিয়ে চাইলো অলকানন্দার পানে। বিড়বিড় করে বললেন,
“বউ, তুই এত রাত্তিকালে এখানে কী করিস?”
“ওমা আপনারা এত সমাদার করে আমাকে পোড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন আমি না এলে কেমন বাজে দেখায় না? তাই এলুম।”
অলকানন্দার কথায় থতমত খেলো ওরা সকলে। লক্ষ্মী দেবী আমতা-আমতা করে বললেন,
“কী সব বলছিস, বাছা! এগুলো তোরে কে বললো?”
“আপনি আমাকে খুঁজতে গেলেন অথচ এখন এসব বলছেন পিসিমা? মিথ্যে কথা বলা কিন্তু পাপ। চলেন পিসিমা, আমি বেধবা দেখে আমাকে পোড়াতে চাচ্ছেন, আপনিও তো বেধবা। চলুন আজ দু’জন একসাথে পুড়বো। আসেন পিসিমা, আসেন। আজকে কাকাবাবু আর ঠাকুর মশাইয়ের সব পূন্য করে দিয়ে যাবো। আসুন।”
লক্ষ্মী দেবী ভীত হলেন। দ্রুত ছুটে চলে গেলেন। আজ অলকানন্দাকে ভীষণ ভয় লাগছে তার। মেয়েটা যেমন, যা তা একটা কিছু করে ফেলতে পারে।
অলকানন্দা ব্রাহ্মণ ঠাকুর আর নন্দন মশাইয়ের দিকে তাকাতেই তারা গম্ভীর পায়ে হেঁটে চলে গেলেন। অলকানন্দার এতক্ষণে ঠোঁটে খেলতে থাকা হাসির রেখা হ্রাস পেলো। বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। আজ সে জেগে ছিল বলে বেঁচে গেল, যদি ঘুমিয়ে থাকতো তবে তো তার এ ঘুম আর কখনোই ভাঙতো না! নিজের এত সৌভাগ্য দেখে কান্না পেল অলকানন্দার। দৈর্ঘ্যের হিসেবে ছোটো জীবনটার দুঃখের প্রস্থতা এত বেশি কেন! অলকানন্দার দীর্ঘশ্বাস কেবল গাছপালাকে নিবিড় ভঙ্গিতে ছুঁয়ে দিলো। এছাড়া আর তেমন কোনো হেলদোল হলোনা বোধকরি। বিধবা তো, তাদের আবার কষ্ট গুলো কাউকে স্পর্শ করতে পারেনা। প্রকৃতি সে অধিকার দেয়নি।
_
সকাল হতেই শুদ্ধ বস্ত্র পড়ে তৈরী অলকানন্দা। আজ সে স্কুল যাবে। আজ থেকে তার পরীক্ষা শুরু। যদিও সে জানেনা আদৌও তাকে যেতে দেওয়া হবে কি-না তবুও সে অনির্দিষ্ট একটা আকাঙ্খা নিয়ে তৈরী হলো। জীবনে এগুতে হলে এটার বিকল্প যে নেই!
অলকানন্দার শুভ্র দেহে শুভ্র শাড়িখানা বেশ সুন্দর লাগছে। তার উপর কপালের মাঝ বরাবর একটা চন্দনের ফোঁটা আঁকা। যেন নীল আকাশের বুকে প্রকৃতির ভুলে চাঁদ উঠেছে। ঘন পাপড়ি বিশিষ্ট নয়নযুগলে সবসময় যেন খেলা করছে একটা কৌতুক হাসি। ঠোঁট জুড়ে গোলাপি আভা। যেন দীপ্তি ছড়াচ্ছে তার শরীর!
অলকানন্দার ঘর থেকে বের হওয়ার মুহূর্তেই ঘরে উপস্থিত হলো মনময়ূরীর স্বামী প্রসাদ। সাদা পাঞ্জাবি পড়া লোকটাকে খারাপ লাগছে না দেখতে। বরং ভীষণ সুন্দর লাগছে। সে ঘরে প্রবেশ করেই গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
“সব পড়েছিলেন তো?”
অলকানন্দা আঁচল টেনে ঘোমটা দিলো। উপর-নীচ মাথা নাড়িয়ে বলল,
“পড়েছি।”
“পারবেন? না পারলে আমি আছি।”
‘আমি আছি’ কথাটার মাঝে অলকানন্দা যেন ভরসা খুঁজে পেলো। অনুভব করলো খুব কাছের কেউ তাকে আশ্বস্ত করছে। মানুষটাকে বড্ড আপন আপন লাগে কেন? এই এত আপন লাগার কারণ কী! অলকানন্দা উত্তর খুঁজে পায়না। উত্তর খুঁজতেও চায়না। পরিবেশের বিপরীতে থাকা অনুভূতিকে প্রশ্রয় দেওয়া জীবনের সবচেয়ে বড়ো পাপ।
“সাদা শাড়ি আপনার পড়তেই হয়? এটা পরে নিজেকে বিধবা নামক দুর্বল খোলসে আটকে রাখার কোনো কারন কী আছে?”
প্রসাদের এত গাম্ভীর্যের সঙ্গে করা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায়না অলকানন্দা। সাদা শাড়ি পড়তে একবারেই তার খারাপ লাগছে তেমনটা না। যার মন বিষাদে আক্রান্ত তার কাছে লাল আর সাদা দু’টোই কেবল রঙ মাত্র। তাদের বিশেষ কোনো সত্তা নেই।
কিন্তু প্রসাদের প্রশ্নের বিপরীতে ঘরের দরজা থেকে একটা গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে এলো,
“সাদা কী কেবল বিধবাই বোঝায়? অথচ পবিত্রতার প্রতীক সাদা! মাস্টারমশাই কী সেটা জানেনা? মাস্টারমশাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গির বদল প্রয়োজন। অলকানন্দাকে বিধবা নামক শেকল আঁকড়ে ধরতে পারবে না কখনো, তাই সাদাটা তার জন্য কেবল শান্তি আর পবিত্রতাই বহন করে। ভাবনা বদলালেই তো বাঁচা যায় তবে কেন অশান্তি?”
অলকানন্দাসহ অবাক হলো প্রসাদ। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে শ্যামলা বর্ণের মায়া মুখের একজন পুরুষ। ঠোঁট জুড়ে হাসির রেখা। অলকানন্দা ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইলো। সে নিজের মস্তিষ্কে অনেক জোর প্রদান করেও মনে করতে পারলোনা এই পুরুষের ঠিকানা, পরিচয়। প্রসাদ অবাক কণ্ঠে বললো,
“নবনীল যে!”
নবনীল নামের ছেলেটা হেলতে দুলতে ঘরে প্রবেশ করলো। অলকানন্দার অবাক দৃষ্টির বিনিময়ে বলল,
“আমায় চিনছেন না তো রমণী? আমি আপনাকে দেখেছিলাম লাল টুকটুকে নতুন বউয়ের আবরণে। সেদিনও আপনার কপালে চন্দন লেপটানো ছিলো। তারপর কেটে গেলো বায়ান্ন দিন। আজ আপনার লাল সাজ আর রঙিনতা সাদায় ঢেকেছে। তবে আজও কপালে চন্দন আঁকা! সেদিনও মুগ্ধ হয়েছে ছিলাম আজও মুগ্ধ হলাম।”
#চলবে