#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা
৫.
নন্দন মশাই, লক্ষ্মীদেবীর ঠোঁটের কোণ ঘেষে লুটোপুটি খাচ্ছে ক্ষীণ হাসির রেখা। ষোলো বর্ষীয়া মেয়েটার অস্তিত্ব পুড়ানোর মাঝেই যেন তাদের সব সুখ। পৃথিবীর সবচেয়ে তৃপ্তিকর ব্যাপার বোধহয় এটা। আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে উলুধ্বনি দেওয়া শুরু করলো বাড়ির মেয়ে দু’জন। যেন পুরোহিতের বিধান তাদেরকে স্বর্গে পৌঁছে দিবে। যজ্ঞ যেহেতু বিরাট ধর্মীয় কাজ সেহেতু সেখানে কিছু পরিচিত মানুষ এবং আত্মীয় স্বজনও ছিলো। মুহূর্তেই কথাখানি ছড়িয়ে পড়লো গ্রাম জুড়ে। সতীদাহ প্রথাটা বিলুপ্ত হয়েছে সেই কোন যুগে, এতবছর পর আবার সেই প্রথা দেখতে পাবে ভেবে মানুষের আনন্দ উল্লাসের সীমা রইলো না। সবটাই চুপ করে দেখলো অলকানন্দা। তার নিরবতা হয়তো বলল, সে পৃথিবীর মানুষের পৈচাশিক সুখ হৃদয় ভরে দেখতে চায় অথচ মুখে ফুটলো না সে বুলি।
প্রথম প্রতিবাদী কণ্ঠ জেগে উঠলো সুরবালার। ঘোর প্রতিবাদ করে বলল,
“এ হয় না ঠাকুরমশাই। মেয়েটার জীবনটা কতটুকুই বা? ষোলো পেরিয়ে এখনো তো সতেরোতেও পরেনি। জীবন কতটুকু দেখেছে সে! এটা কোনো বিধানই হতে পারে না।”
সুরবালার প্রতিবাদে খেপে গেলেন ঠাকুরমশাই। ছিঃ ছিঃ করে বললেন,
“আপনি তো সুদর্শন জমিদারের মাতা, জননী, তাই না? আপনি কেমন করিয়া আপনার পুত্রের এমন অমঙ্গলে ইতিবাচক মত প্রকাশ করিতেছেন? আপনার এ কেমন দুঃসাহস!”
সুরবালা অলকানন্দার পাশে এসে দাঁড়ালো, শক্ত কণ্ঠে জবাব দিলো,
“আমার ছেলের মঙ্গল আমি অবশ্যই চাই তবে কারো অমঙ্গল করে না। আমার পুত্রবধূ প্রয়োজন পড়লে এখনই পোশাক বদলে আসবে তবুও অমন বিধান আপনি দিবেন না।”
“যে অন্যায়টি ঘটিয়া গিয়াছে তার ক্ষমা হয়না, মাতা। এবং সতীদাহ করাটা কতটা পুণ্যের আপনি তাহা যদি জানিতেন তবে আর অমত পোষণ করিতেন নহে।”
পুরোহিতের কথায় কিছুটা বোধহয় দমে গেলেন সুরবালা। তার আর প্রতিবাদী কণ্ঠ ভেসে এলো না। যতই হোক, পাপ পুণ্যের ভয় তো সকলেরই থাকে। সে আর প্রতিবাদ না করে বরং সাবধানী কণ্ঠে অলকানন্দাকে বলল,
“বউ, এখনই কাপড়খানা বদলে এসো।”
সুরবালার এই আদেশটি যেন পরম অবহেলায় ঝেড়ে ফেলে দিল অলকানন্দা। বরং ক্ষীণ স্বরে বলল,
“আমি লাল রঙের কাপড়টাই পড়ে থাকবো, মা।”
সুরবালা অবাক হলেন। বিস্মিত হলো উপস্থিত সকলে। মেয়েটা যে একদম উচ্ছন্নে গিয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। পুরোহিত ধমকে উঠলেন,
“এই কন্যার শাস্তি হতেই হবে অবশ্যই। স্বামীহারা নারীর এমন ইচ্ছে বড়ই আশ্চর্যজনক। আমার বিধানই ধার্য করা হইলো। এই মেয়েকে খু্ব শীগ্রই চিতায় উঠানোর ব্যবস্থা করা হোক।”
“আপনার মা-ও তো জীবিত আছে ব্রাহ্মণ ঠাকুর, তবে নাহয় প্রথাটা সেখান থেকেই শুরু হোক?”
এতক্ষণ পর অলকানন্দার শব্দরা হামাগুড়ি খেয়ে পড়লো সকলের মাঝে। কাজ করলো বিস্ফোরণের ন্যায়। পুরোহিত হয়তো কল্পনাতেও এমন কোনো কথা আশা করেননি। তার চোখে-মুখেই ফুটে ওঠে সেই অনাকাঙ্খিত কথার তুমুল বিস্ময়তা। অথচ অলকানন্দার ঠোঁটে রহস্যের হাসি। হাসি দেখা দিল দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তার ননদের স্বামী প্রসাদের ঠোঁট জুড়ে।
পুরোহিত হোঁচট খেলেন। হতভম্ব কণ্ঠে সংশয় নিয়ে জবাব দিলেন,
“কি!”
“বিধবাকে চিতায় চড়ালে যদি পুণ্য অর্জন করা যায় তবে সেটা আপনার ঘর থেকেই নাহয় শুরু করুন। আপনার মায়ের থেকে?”
পুরোহিত থমকালেন সাথে চমকালেনও। যুক্তিতে হেরে গিয়ে বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন। মূর্খদের বরাবরই কাজ এমন, তারা যখন যুক্তিতে হারে তখন চিৎকার করে জিততে চায়। পুরোহিতও সেই সংজ্ঞার বাহিরের নয়।
পুরোহিত চেঁচিয়ে বললেন,
“তোমার তো দুঃসাহস কম নহে! তুমি আমার শ্রদ্ধেয় মাতাজির সাথে তোমার তুলনা করিতেছ? আমার পিতাশ্রী মারা যাওয়ার পর হইতেই মাতা চলে গিয়াছেন তীর্থক্ষেত্রে। সারাজীবন অতিবাহিত করেছেন পবিত্র সেই তীর্থক্ষেত্রে। আর তুমি স্বামীর মৃত্যুর চতুর্থ দিনের মাথায় লাল বস্ত্র ধারণ করিয়াছ! এত বড়ো ধর্মবিরোধী কাজ করিয়াছ। অথচ তোমার চোখে দেখা মিলিতেছে না কোনো শোক তাপের। তুমি কী জানোনা? বিধবার ধর্ম শ্বেত বস্ত্র আর নিরামিষ আহার? সংযত করিতে হবে তাহার চিত্ত! তবে কোন অধিকারে তুমি এমন করিয়াছ? ধর্মকে নাশ করিতে চাও! এমন পাপ করেছ যার শাস্তি অব্দি পৃথিবীতে নেই। অথচ তুমি হেয়ালি করিতেছ!”
অলকানন্দা হাসল। সে হাসিতে দুলে উঠলো তার লতার মতন অঙ্গখানি। লাল শাড়ির আঁচলটা ঘুরাতে ঘুরাতে বলল,
“কোন ধর্মগ্রন্থে লিখা আছে বিধবার ধর্ম শ্বেত বস্ত্র আর নিরামিষ আহার! আমাকেও একটু জানান।”
পুরোহিত আমতা-আমতা করলেন। কথা ঘুরানোর জন্য নন্দন মশাইয়ের দিকে তাকিয়ে জ্ঞানীদের মতন গম্ভীর স্বরে বলল,
“আপনি কী বলিবেন নন্দন মশাই? আমার বিধান কী আপনিও অস্বীকার করিবেন?”
“না না, কখনোই না।”
নন্দন মশাইয়ের তৎক্ষণাৎ উত্তরে হেলদোল দেখালো না অলকানন্দা। যেভাবে নিস্তব্ধতা নিয়ে এখানে এসেছিল সেভাবেই নিস্তব্ধতা ঠেলে চলে গেলো এখান থেকে। সবাই যেন হতভম্ব হয়ে গেলো। মেয়েটা মোটেও এত গা ছাড়া ছিলো না। হুট করে কীভাবে মেয়েটার এত পরিবর্তন হলো তা নিয়েই জল্পনা কল্পনা চললো আকাশ সমান। পুরোহিত বুঝলো তার এমন যুক্তিহীনতা চলবে না এখানে তাই চুপিসারে যজ্ঞটা সেরে ফেললো। কিন্তু মনে মনে কৃত্রিম পুণ্যের লোভ তাকে তাড়িয়ে মারছে।
_
অলকানন্দা জানালার কোল ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে বিকেলের কথা ভাবতেই। ভাগ্যিস তার মনের ভেতরের ভয়টা তখন মুখ লুকিয়ে ছিল। নাহয় কেমন হতো গতি! আগুনেই লিখা ছিল সমাপ্তি। ছোটো মেয়েটার চিত্ত ক্লান্ত হয়ে এলো। লড়তে লড়তে ক্লান্ত সে। দৌড়ঝাঁপ, পড়াশোনা, সাঁতার কাটা যার জীবনের প্রধান কাজ ছিল সে কিনা আজ স্বামীর চিতার আগুনের তাপে ঝলসে যাচ্ছে!
অলকানন্দা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ঘরের ভেতর লন্ঠনের আলো মিটমিট করে জ্বলছে। বাহির থেকে ভেসে আসছে কানাকুয়োর করুণ স্বর। বোধহয় তারও স্বামী মরেছে, চিতায় উঠেছে তার সকল সুখ। হয়তো সেই শোকেই কাঁদছে কানাকুয়ো। অথচ অলকানন্দার ভাগ্য কেমন! একটু মন খুলে কাঁদারও সুখ তার নেই।
ভাবনার মাঝেই অলকানন্দার দরজায় করাঘাত পড়লো। নিস্তব্ধতার মাঝে সে শব্দে কেঁপে উঠলো অলকানন্দা। ভয় কমানোর জন্য বুকে থুথু দিলো অতঃপর কণ্ঠ উঁচুতে তুলে জিজ্ঞেস করলো,
“কে!”
“বউ, দোর খোলো।”
নিজের শাশুড়ির কণ্ঠ পেতেই অলকানন্দার মন শান্ত হলো। বিকেলে অবশ্য মানুষটার আদেশ সে অমান্য করেছিল কিন্তু তার যে এ বাড়িতে সবচেয়ে ভরসাস্থল এটাই তা কি সে জানেনা! অলকানন্দা আঁচলটা টেনে বাহুতে তুললো অতঃপর ধীর গতিতেই দরজা খুললো।
পুত্রবধূকে দরজা খুলতে দেখেই সুরবালা চোখ-মুখ শক্ত করে তাকালেন। কঠিন মুখেই অলকানন্দার ঘরে ঢুকলেন। সবটাই নিবিড় চোখে পরখ করলো অলকানন্দা। তাকে এতদিন সাথ দেওয়া মানুষটাও যে আজ তার উপর রুষ্ট তা তার বুঝতে অসুবিধা হলোনা। তবুও সে ধীর কণ্ঠে বললো,
“কিছু বলবেন, মা?”
“তুমি কী কাউকে পছন্দ করো, বউ?”
শাশুড়ির আকস্মিক এমন প্রশ্নে হতবিহ্বল হলো অলকানন্দা। ফ্যালফ্যাল চেয়ে থেকে বললো,
“কি বলছেন, মা!”
“যা বলছি তার সরাসরি উত্তর দেও, বউ। আমার ছেলে মারা গিয়েছে আজ চারদিন। তুমি চুল কাটবে না বলেছো আমি মেনেছি। তুমি বাঁচতে চেয়েছো, আমি মেনেছি। কিন্তু আজ! আজ তুমি এটা কী করলে বউমা? মাত্র চারদিনেই বুঝি হাঁপিয়ে গেলে সাদা কাপড়ে? কই আমিও তো বাঁচতে চেয়েছি কিন্তু কখনো তো মনে হয়নি রঙিন কাপড় পড়লেই আমি বেঁচে থাকবো। তবে তোমার এমন ভ্রমের কারণ কী?”
“আমি তো বেঁচে থাকার জন্য পড়িনি। আমি ভালো থাকার জন্য রঙিন কাপড় পড়েছি, মা!”
“সাদা কাপড়ে ভালো থাকা যায়না?”
“হয়তো ভালো থাকা যায় কিন্তু কতটুকু ভালো আছি সেটা দেখানো যায়না।”
“বউ, আমার ছেলেটার সাথে একটা মাস ছিলে তুমি। এক মাসে তিরিশ (ত্রিশ) টি দিন। তার জন্য নাহয় কমপক্ষে একটা মাসেই শোক পালন করতে। অথচ তুমি চারটা দিনেই হাঁপিয়ে গিয়েছ। ভালো কী একটুও বাসোনি?”
“কাকে ভালোবাসবো, মা? আপনার ছেলে কখনো আমাকে ভালোবেসেছিল? কেবল রাত্রি হলেই যার মনে পড়তো নিশি যাপনের জন্য তার ঘরে একটা বউ আছে, সে মানুষটার ভেতর বাহির কিছুই যে আমাকে ছুঁতে পারেনি, মা।”
সুরবালার কোমল মন হুট করে যেন শক্ত হয়ে গেলো। হুট করেই সে কর্কশ কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“তাহলে তুমি রঙিন বস্ত্রই পড়বে?”
“হ্যাঁ।”
“তবে এ বাড়ি তোমাকে ছাড়তে হবে, বউ। যতই হোক, আমার মৃত ছেলের স্ত্রী রঙিন কাপড় পড়ে আমার সামনে হেঁটে বেড়াবে আর আমি তা দু-চোখ ভরে দেখবো সেটা সম্ভব না। এক্ষুণি তুমি বাড়ি ছাড়বে। রঙিন বস্ত্র পড়ো তবে বাড়ির বাহিরে গিয়ে।”
#চলবে