#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা
৪.
মানুষের মৃত্যুর পর দিন গুলো বোধ করি দ্রুত অতিক্রম করে। সুদর্শন জমিদারের মৃত্যুর পর চলে গেলো চারদিন। আবার গ্রামের মানুষদের জন্য বিরাট খাবার দাবারের আয়োজন করা হলো। আজ বিহারিণী মহলে চুলাতে আগুন ধরানো হবে। সেই আয়োজনই চলছে অন্দরমহলে। দেখে বোঝার উপায় নেই যে এই বাড়িতে কেউ মারা গিয়েছে। মনে হচ্ছে যেন বাড়ির একমাত্র কন্যার বিয়ের আয়োজন। কী বিশাল করে শুরু হয়েছে সে আয়োজন!
অলকানন্দা ভর দুপুরে শাড়ির আঁচল মেলে মাটিতে শুয়ে আছে। সাদা শরীরে সাদা শাড়িটা যেন ভয়ঙ্কর রকমের সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। এর মাঝেই দরজায় কড়া নাড়লো কেউ। অলকানন্দার কূল বিহীন ধ্যানের সমাপ্তি ঘটলো কড়া নাড়ার শব্দে। সে উঠে বসলো। কণ্ঠ খানিকটা উঁচু করে প্রশ্ন করলো,
“কে?”
বাহির থেকে সাবধানী পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে এলো,
“অলকানন্দা, দোর খুলেন। আমি প্রসাদ।”
পরিচিত কণ্ঠ পেতেই অলকানন্দা উঠে দাঁড়ালো। তার ননদের স্বামী প্রসাদ সম্পর্কে তার ছোটো হলোও তাকে সবসময় নাম সম্বোধন করেই ডেকেছে। মানুষটার এক কথা, অলকানন্দা আমার বড্ড ছোটো, ওকে সম্বোধন করতে আমার বড়ো সংশয় হয়। যেহেতু প্রসাদ ভীষণ গম্ভীর ও রাগী সেহেতু তার মতের বিপরীতে গিয়ে কেউ আর মত প্রকাশ করেনি।
অলকানন্দা অলস পায়ে দরজা খুললো। দরজা খুলতেই প্রসাদের শুভ্র চেহারার বিন্দু বিন্দু ঘাম উঁকি দেওয়া দেখতে পেলো৷ খুব ব্যস্ত হয়তো লোকটা। অলকানন্দার দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিললো প্রসাদের। দু’জনই কিছুটা অস্বস্তিতে পড়লো। অলকানন্দা দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো, ছোটো কণ্ঠে বললো,
“আসুন ভেতরে।”
প্রসাদ ব্যস্ত পায়ে ভেতর ঢুকলো। সাবধানী চোখে চারপাশে একবার তাকিয়ে নিলো যা তার কঠোর স্বভাব-চরিত্রের সাথে একদমই বেমানান। অলকানন্দাও চারপাশ তাকালো, ক্ষীণ স্বরে বললো,
“কিছু দরকার?”
“আপনার তো ইস্কুলের কোনো খোঁজ খবর নেই। আগামী সপ্তাহে আপনাদের পরীক্ষা শুরু হবে।”
অলকানন্দা কথার বিপরীতে বড়ো বড়ো চোখে চাইলো। বিয়ের পর স্কুলের কথা সে প্রায় ভুলতেই বসেছে। শ্বশুর বাড়ির চাপে বই নিয়ে বসার কোনো সুযোগ হয়নি। কী পরীক্ষা দিবে সে! মাত্রই তো নতুন ক্লাসে উঠলো। নতুন বই তো তার বড্ড অপরিচিত। তার উপর বর্তমানে পরিবেশের অবস্থা যা, আদৌও সে পরীক্ষা দিতে পারবে কি-না সন্দেহ! নিজের ঝামেলা ভারাক্রান্ত জীবনের কথা ভাবতেই হতাশার শ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে।
অলকানন্দাকে চুপ থাকতে দেখে প্রসাদ আবার তাড়া দিলো। তাড়া দিয়ে বললো,
“কী করবেন ভাবছেন? বেশিদিন তো নেই।”
“আমি যে কিচ্ছুটি পারিনা। তার উপর এ বাড়ির মানুষদের তো দেখছেন, তারা দিবে যেতে!”
“আপনি তাদের কথা কেন ভাবছেন? বড়ো আশ্চর্যজনক তো! যারা আপনার কথা বিন্দুমাত্র চিন্তা করছে না তাদের নিয়ে আপনার চিন্তা?”
অলকানন্দা চুপ করে গেলো। ঠিক কি উত্তর দিবে তা ভেবে পেলো না সে। তাকে চুপ থাকতে দেখে কথা বললো প্রসাদ,
“আপনার ইস্কুলের পড়া পড়ানোর দায়িত্ব আমার। আপনি চিন্তা করবেন নে। আমি তো সে ইস্কুলেরই একজন মাস্টার। আপনার সকল পড়া আমি নিয়ে আসবো। চিন্তা করবেন না।”
প্রসাদের দিকে অলকানন্দা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকায়। প্রসাদকে সে বিয়ের আগে থেকেই চেনে। তারা স্কুলের শিক্ষক সে। বিয়ের পর সম্পর্কে হয়েছে ননদের স্বামী।
অলকানন্দা মুচকি হেসে বললো, “চির জীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।”
“আপনাকে সাদা শাড়িতে চক্ষু ঝলসে ছাঁই হওয়ার মতন সুন্দর লাগে তবে তার সাথে মনেহয় ভীষণ ভেঙে যাওয়া মানুষ। এই প্রথাটা পাল্টানোর উপায় নেই? সাদা’তে আপনাকে বড্ড বিষন্ন লাগে। অথচ আপনার চরিত্রের সাথে বিষন্নতা বড্ড বেমানান।”
প্রসাদ এক নিঃশ্বাসে কথা বলেই প্রস্থান নিলো। যেন কথা খানা বলার পর সে অলকানন্দার চোখে চোখ মেলাতে পারবে না। অলকানন্দাও ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো মানুষটা তাকে কী বলে গেলো!
_
বিশাল আয়োজন উঠোন জুড়ে। বিকেল নেমেছে ধরার বুকে। গ্রামের সকলের খাবার শেষ হওয়ার পর খাবার খেলো বাড়ির মানুষ, সব শেষে খাবার জুটলো অলকানন্দার ভাগ্যে। একটানা ফল খেতে খেতে মুখে অরুচি ধরে গেছে তার। তাও দিনে একটা কি দুটোর বেশি ফল পাওয়া যায় না। স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীদের বাকি জীবন নাকি সংযম করে কাটাতে হয়। আর সেজন্যই স্বল্প পরিমানে আহার করতে হবে।
আবারও অলকানন্দার ঘরের দোরে শব্দ হলো। বাহির থেকে তার ননদ মনময়ূরীর উচ্চ কণ্ঠ ভেসে এলো,
“এই যে বউরাণী, সারাদিন দোর দিয়ে রেখে কি করো? এমন তো না যে ঘরে স্বামী আছে তার সাথে সোহাগ করছো! দোর খোলো।”
অলকানন্দা দাঁড়িয়ে ছিলো তার নড়বড়ে জানালার কোণ ঘেঁষে। ননদের এমন তুচ্ছ ঠাট্টায় গা ঘিনঘিন করে উঠলো তার। তন্মধ্যে বাহির থেকে আবার হাঁক ছেড়ে ডাকলো মনময়ূরী,
“তাড়াতাড়ি দোর খুলে বাহিরে আসো দেখি, তোমার স্বামীর নামে যজ্ঞ হচ্ছে, সেখানে ডাকছে তোমাকে। তাড়াতাড়ি আসো। কাপড়টা বদলে শুদ্ধ বস্ত্র পড়ে আসবে। আমি যাই।”
অলকানন্দা চুপ করেই রইলো। যখন সে অনুভব করলো দরজার সামনে আর দাঁড়িয়ে নেই মেয়েটা, ঠিক তখনই সে দরজা খানা খুললো। এপাশ থেকে ওপাশ তাকালো। বাড়ির বউ, মেয়ে, ঝি হতে কারো দেখা পেলো না আশেপাশে। সাবধানী পায়ে বেরিয়ে গেলো সে। মনের মাঝে উত্তাল ঢেউ। একটা ভিন্ন কিছু করার ইচ্ছে তাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে।
_
সুদর্শনের মৃত আত্মার শান্তি লাভের আশায় বেশ ধুমধাম করে হচ্ছে যজ্ঞ। বাড়ির সকলের সে কি চিন্তা! সে কি উৎকণ্ঠা! যজ্ঞ যেন সুষ্ঠ ভাবে সম্পন্ন হয়, নাহয় ছেলেটার আত্মা যে শান্তি পাবে না। অথচ যে মেয়েটা বেঁচে রইলো বিধবা নামের অভিশাপ নিয়ে, তার আত্মার কোনো চিন্তাই যেন নেই কারো। সকলের ভাব এমন যে, স্বামীর সাথে সাথে মেয়েটাকে চিতায় চরায়নি এটাই তো অনেক।
যজ্ঞ প্রায় শেষেরদিকে। বড়ো বড়ো ব্রাহ্মণরা এক ধ্যানে যজ্ঞ করছে। অতঃপর আবারও যখন অলকানন্দাকে ডাকার কথা উঠলো তখনই বড়ো রাজপ্রাসাদের মতন বাড়িটার সামনের খোলা জায়গাটায় এসে দাঁড়ালো অলকানন্দা। চোখ ধাঁধিয়ে গেলো সকলের। গায়ের ভেতর যেন শিরশির করে উঠলো,ভয়ঙ্কর কোনো অস্তিত্ব। কেঁপে উঠলো উপস্থিত সকল মানুষজন।
স্তব্ধ পরিবেশে বজ্রপাতের ন্যায় চিৎকার করে উঠলো পুরোহিত। যজ্ঞ ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলো সে। দু’হাত তুলে বার বার করে বলতে লাগলো,
“ঘোর অমঙ্গল, ঘোর অমঙ্গল। সদ্য বেধবা মেয়েছেলে কিনা লাল বস্ত্র পরিধান করিয়াছে! হে ঈশ্বর, ক্ষমা করো তুমি এই পাপ। রুষ্ট হইও না ঈশ্বর, তুমি রুষ্ট হইও না।”
যজ্ঞ ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলো বাকি সদস্যরাও। লক্ষ্মীদেবী তো দৌড়ে এলেন অলকানন্দার নিকট। দুই হাত মুখের মাঝে চেপে ধরলেন অপ্রত্যাশিত ঘটনায়। স্তব্ধ ভঙ্গিতে বললো,
“ছেহ্ ছেহ্ বউ, এ কি অলক্ষ্মী কাজকর্ম! তুই বেধবা মেয়েমানুষ কিনা পড়েছিস লাল কাপড়! তোর ভয়ে কী একবারও বুক কাঁপলো না? আরে স্বামীটা খেয়েছিস চারটা দিনও তো হয়নি!”
অলকানন্দা যেন পাথর। লাল শাড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা জীবিত পাথর। ছুটে এলেন অলকানন্দার মা। মেয়ে জামাইয়ের যজ্ঞতে তিনিও উপস্থিত ছিলেন। মেয়ের এমন ভয়ঙ্কর কর্মকান্ডে বিস্মিত তিনি নিজেও। সে ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এলেন, মেয়ে হাত ধরে অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“মা, তোর স্বামী নেই আর। কার জন্য তুই এমন রঙিন কাপড় পড়েছিস!”
“কেনো মা? আমি নিজের জন্য কি এটা পড়তে পারিনা?”
“হায় হায় গো, এ মেয়ে তো দেখছি বংশটাকে নির্বংশ করে ছাড়বে। এই পাপ তো মরলেও যাবে না। ঠাকুরমশাই, আপনিই বিধান দেন, কী করতে হবে? এ মেয়ে উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। স্বামী মারা যাওয়ার পর সে অদ্ভুত কাজ করছে।”
নন্দন মশাই এর কথার বিপরীতে ব্রাহ্মণ মাথা নাড়ে। অলকানন্দার পা থেকে মাথা অব্দি চোখ বুলিয়ে বলে,
“ওকে ওর স্বামীর সাথেই দাহ্য করা উচিৎ ছিলো। ও স্বামী শোকে বোধহয় পাগল হইয়া গিয়াছে।”
“তাহলে এর থেকে বাঁচার কী উপায়?”
“তোমাদের এই পুত্রবধূকে ওর স্বামীর পাশেই দাহ্য করো। ও যে ঘোর অন্যায় করিয়াছে, জীবিত অবস্থায় ওর দেহে আগুন জ্বালিয়ে দিলেই সেই পাপ পুড়ে যাবে। নাহয় তোমার বংশের জন্য বিপদ ডেকে আনবে।”
পুরোহিতের কথায় উপস্থিত সকলের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। উদ্বেগ দেখা দিলো না অলকানন্দার দেহে। সেও যেন দেখতে চায়, রঙিন হওয়ার জন্য তাকে কতটুকু পুড়তে হবে।
চলবে….