#মায়া
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-০৪:
ঘড়ির কাটা বারোটা ছুঁইছুঁই। সীমান্ত এখনো বাসায় আসে নি। শেফাকে ঘুম পাড়িয়ে শুভ্রা সীমান্তের নম্বরে কল দিলো। কয়েকবার রিং হওয়ার পর সীমান্ত কল রিসিভ করলো।
শুভ্রা: সীমান্ত, তুমি ঠিক আছো তো? এতোবার কল দিলাম! ধরছো না কেন?
সীমান্ত: ব্যস্ত ছিলাম। বরং আমি এখনো ব্যস্ত আছি।
শুভ্রা: রাত বারোটা বেজে গেছে। ঘড়ি দেখেছো?
সীমান্ত: আমি যেই দোকানে কাজ নিয়েছি, ওদের ফ্যাক্টরিতে আজ নাইট ডিউটি পড়েছে। অনেক কাজ এখানে। সামলাতে সামলাতে ভোর হয়ে যাবে। আমি হয়তো সকালে আসবো।
শুভ্রা: এই বাড়িতে দুইটা বাচ্চা নিয়ে একা থাকবো আমি?
সীমান্ত: শুভ্রা, তুমি কি ভয় পাচ্ছো?
শুভ্রা জানে সীমান্তের জন্য এখন তার কাজগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই মুহূর্তে কাজ ফেলে বাসায় চলে আসার অর্থ চাকরি সংকটে পড়া।
কিন্তু শুভ্রা সকালের ঘটনার পর মনে মনে সত্যিই ভয় পাচ্ছে, তবুও এক রাতেরই তো ব্যাপার। সীমান্তকে তার ভয়টা বুঝতে দেওয়া যাবে না।
শুভ্রা: না, না ভয় পাবো কেন? আসলে এতো বড়ো বাড়ি, হঠাৎ কেউ যদি ঢুকে পড়ে!
সীমান্ত: দরজা, জানালা সব ভালো করে আটকে দাও। রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ো। আমি সকালেই চলে আসবো। এখন আমি রাখছি। নিজের খেয়াল রেখো।
শুভ্রা কল কেটে পুরো বাড়িটির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। আজকে যেন বাড়িটি খুব ভয়ংকর লাগছে তার কাছে। হয়তো তার মনের ভুল।
শুভ্রা, দরজা জানালা ভালো মতো বন্ধ আছে কিনা দেখে রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। লাইট অফ না করেই শুভ্রা শেফা আর শিশিরকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
হঠাৎ প্রচন্ডভাবে বিছানাটা কেঁপে ওঠায় শুভ্রার ঘুম ভেঙে গেলো। পাশ ফিরে দেখলো শেফা ঘুমিয়ে আছে, কিন্তু শিশির পাশে নেই। শুভ্রা তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে পুরো রুমে শিশিরকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু কোথাও শিশিরকে পেলো না। ওয়াশরুমে গিয়ে দেখলো, কিন্তু শিশির সেখানেও নেই।
শুভ্রা মনে মনে অনেক ভয় পাচ্ছে। তাই শেফাকে কোলে নিয়েই রুম থেকে বের হলো। নিচে নেমে দেখলো শিশির টিভি দেখছে। শিশিরকে দেখে শুভ্রার মন শান্ত হয়ে গেলো।
শুভ্রা রেগে গিয়ে বলল,
শুভ্রা: তুমি এখানে কি করছো? এত রাতে কেউ টিভি দেখে? এই মুহূর্তে তোমার ঘুমানো উচিত। আজ তোমার বাবা নেই তাই তুমি যা ইচ্ছে তাই করছো?
শিশির: মা, বিশ্বাস করো আমি নিজেও জানিনা আমি এখানে কিভাবে এলাম! আমি শব্দ শুনে বিছানা ছেড়ে উঠি। মনে হয়েছে, বাবা রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। দরজার সামনে দাঁড়াতেই দরজা আপনা আপনি খুলে যায়। আমি তোমাকে ডাকতে চেয়েছিলাম কিন্তু কিছু বলতে পারছিলাম না। তারপর ছাদের ঐদিকে বাবার কন্ঠের স্বর শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু আমি যেই ছাদের দিকে যাওয়া শুরু করলাম তখনই ড্রইংরুমের সবগুলো বাতি জ্বলে উঠলো, একে একে সবগুলো ফ্যান ঘুরতে শুরু করলো। তারপর টিভিটাও চালু হয়ে গেল। আমি তাই নিচে এলাম দেখতে। নিচে এসে দেখলাম এখানে কেউ নেই। তাহলে, সবকিছু নিজ থেকে কিভাবে চলছে?
শিশিরের কথাটি শুনে শুভ্রা মনে মনে অনেক ভয় পেয়ে যায়। তবুও শিশিরের মন ভোলানোর জন্য বলল,
শুভ্রা: ওসব কিছুই না। ইলেক্ট্রিসিটি লাইনে কোনো সমস্যা হয়েছে হয়তো। তাই একটা সুইচেই সব গুলো চলছে।
কথাটি বলে সুইচ বোর্ডের দিকে এই আশা নিয়ে তাকালো, হয়তো তার মনের ধারণা ঠিক হবে। কিন্তু শুভ্রার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো, যখন দেখলো সুইচবোর্ডে সব গুলো সুইচ চালু আছে।
কারণ শুভ্রার স্পষ্ট মনে আছে, সে শুধু একটা সুইচ অন রেখেছিলো, যাতে পুরো ঘর অন্ধকার হয়ে না যায়। এতোগুলো লাইট আর ফ্যান তো সে ভুলেও চালাবে না। তবে কিভাবে সম্ভব এটি?
একে একে শুভ্রা আবার সবগুলো ফ্যান আর লাইটের সুইচ অফ করে দিলো, শুধুই একটি অন রাখলো।
টিভির দিকে তাকিয়ে শুভ্রা আরো অবাক হলো। তার স্পষ্ট মনে আছে, টিভি অফ করে টিভির মেইন লাইনও সে বন্ধ করে দিয়েছিলো। এইটা অন্তত সে ভুলে যায় নি। আর মেইন লাইনও অনেক উঁচুতে, যা শিশির ধরতে পারবে না। আরো এক ধাপ অবাক হয়েছে টিভির উপরে টিভির রিমোটটি দেখে। কারণ সে উপরেই উঠিয়ে রেখেছিলো রিমোটটি। আর শেষ চ্যানেলটি শুভ্রাই দেখছিলো। কিন্তু এখন যে চ্যানেলটি চলছে এটি কার্টুনের চ্যানেল। তবে কি আপনা-আপনি চ্যানেল পরিবর্তন হয়ে গেছে?
এবার শিশিরের দিকে তাকিয়ে শুভ্রা অনেকটা ভয় পেয়ে যায়। খুব অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে শুভ্রার দিকে। যেন প্রচুর বিরক্ত তার উপর। কিন্তু এমন চাহনিতে সে কখনো তার মায়ের দিকে তাকায় নি। শিশির শুভ্রাকে প্রচুর ভয় পায়, আর সম্মানও করে। এই চাহনিতে ভয় তো নেই, বরং সম্মানের ছিঁটেফোঁটাও খুঁজে পাচ্ছে না শুভ্রা।
শুভ্রার মনে হলো তার পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। শীতল হাওয়া তার কানের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। শুভ্রা একেবারেই জমে গেছে। ভয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না তার মুখ দিয়ে। একটুপর কানের কাছে কেউ তাকে কিছু বলা শুরু করলো, ভাষাটা আন্দাজ করতে তার বেশি সময় লাগে নি। সেও ফিসফিসানি শব্দগুলো অনুসরণ করে, শিশিরকে না ধরেই শেফাকে কোলে নিয়ে খুব জোরে জোরে আয়াতুল কুরসি পড়তে শুরু করলো। হ্যাঁ, তার কানের কাছে এসে কেউ একজন আয়াতুল কুরসি পাঠ করছিলো। আর শুভ্রা সেটিই অনুসরণ করেছে।
আচমকা শিশির দৌঁড় দিলো। সে উপরে চলে যাচ্ছে সিঁড়ি বেয়ে। শেফাকে নিয়ে শিশিরের পেছনে দৌঁড়াতে খুব কষ্ট হবে শুভ্রার। তাই শেফাকে সোফায় শুইয়ে দিয়ে, শুভ্রা শিশিরের পেছন পেছন ছুটলো।
শিশির দৌঁড়ে সেই তালাবন্ধ সিঁড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর গ্রিল ধরে টানাটানি শুরু করে দেয়, যেন সব শক্তি দিয়ে সে এই তালাগুলো আজ ভেঙে ফেলবে। শুভ্রা শিশিরের শক্তির সাথে পারছে না। অনেক কষ্টে শিশিরকে টেনে তার হাত দুটি গ্রিল থেকে ছাড়িয়ে আনলো, তারপর শিশিরকে জড়িয়ে ধরে আবার আয়াতুল কুরসি পড়া শুরু করলো শুভ্রা৷ একটা সময় শিশির শান্ত হয়ে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়লো। শিশিরকে রুমে শুইয়ে দিয়ে শুভ্রা শেফাকে আনার জন্য নিচে নামলো।
তখনই হঠাৎ ছাদে খুব লাফালাফির শব্দ শুরু হয়ে যায়৷ ঘরের লাইটগুলোও একবার জ্বলছে আরেকবার নিভে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, অনেকগুলো কালো ছায়া ঘরের মাঝে দৌঁড়াচ্ছে। শুভ্রার মাথাটি খুব ঘুরছে এই মুহূর্তে। শিশিরের পেছন পেছন দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে তার সব শক্তি শেষ হয়ে গিয়েছিলো। চোখের সামনে এখন সব অন্ধকার হয়ে আসছে। শেফার শরীরের ভরও যেন তুলতে পারছে না শুভ্রা।
সবকিছুর মাঝেও শুধু একটি জিনিসই মাথায় ঘুরছে শুভ্রার, তার বাচ্চাদের কোনো ক্ষতি হবে না তো! ভাবতে পারছে না এসব আর। শেষমেশ শরীরের ভর ছেড়ে দেয় শুভ্রা। কিন্তু মাটিতে পড়ার আগেই কারো স্পর্শ পায় সে। শুভ্রা চোখ খুলতে পারছে না কিন্তু অনুভব করছে শীতল দুটি বাহু জড়িয়ে রেখেছে তাকে আর শেফাকে। ভাসিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাদের। তারপর আর কিছুই মনে নেই তার।
সকালে ঘুম ভেঙে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সব কিছুই ঠিক। শেফা আর শিশির তার পাশেই ঘুমিয়ে আছে। তাহলে কাল যা দেখেছিলো সব কি স্বপ্ন ছিলো? বিছানা ছেড়ে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো। দরজাটা ঠিক যেভাবে বেঁধেছিলো সেইভাবেই বাঁধা আছে। তবুও গতকাল রাতের ঘটনাকে শুভ্রা স্বপ্ন ভাবতেই পারছে না। এতোটা জীবন্ত স্বপ্ন সে আগে কখনো দেখে নি। কতোবার সে স্বপ্ন দেখেছিলো, কিন্তু ঘুম ভাঙার পর বুঝতে পেরেছিল এটি স্বপ্ন। কিন্তু এবারের ঘটনাটি কিছুতেই স্বপ্ন মনে হচ্ছে না তার।
সীমান্ত ফোন দিয়ে জানায় সে গাড়িতে উঠেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে বাসায় চলে আসবে। তারপর শুভ্রা সকালের নাস্তা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এরইমধ্যে শিশির আর শেফা ঘুম থেকে উঠে পড়লো। তারাও ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলে বসলো।
শুভ্রা ভাবছে গতকাল রাতের ঘটনাটি কি শিশিরকে জিজ্ঞেস করে দেখবে?
দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে শুভ্রা শিশিরকে জিজ্ঞেস করল,
শুভ্রা: শিশির গতকাল রাতে তুমি নিচে নেমেছিলে? তোমার বাবা এসেছিলো?
শিশির: কই নাতো! আমি তো ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। বাবা এসেছে? দেখছি না যে।
শুভ্রা: তুমি রাতে নিচে যাও নি? আমাকে বললে না, তোমার বাবার শব্দ শুনেছো!
শিশির: না, মা। নিচে নামলে তোমাকে বলে যেতাম না? আর আমার তো কিছু মনে পড়ছে না। বাবা তো কাল রাতে আসবে না বলেছে। আর তারপর তো আমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
শুভ্রা আর কোন প্রশ্ন করেনি শিশিরকে।
স্বপ্ন ভেবে শুভ্রা জোর করে গতকাল রাতের ঘটনাটি মন থেকে বের করে দেয়। শুভ্রা ভাবছে, সে হয়তো গতকাল সকালে যা হয়েছে তা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো তাই এমন স্বপ্ন দেখেছে।
এদিকে সীমান্ত বাড়িতে ঢুকার সময় বৃদ্ধ লোকটি তড়িঘড়ি করে তার দিকে এগিয়ে গেলো।
লোকটির বিমর্ষ চেহারা দেখে সীমান্ত বলল,
সীমান্ত: কি হয়েছে চাচা? আপনার শরীর ভালো তো?
বৃদ্ধ লোক: তুমি কাল রাতে বাড়িতে ছিলে না?
সীমান্ত আমতা-আমতা করে বলল,
সীমান্ত: কাজ ছিলো তো। কেন চাচা? কোনো সমস্যা?
বৃদ্ধ লোক: বাবা, কাজ গুলো দিনে সেরে ফেলো। আর কাজ যদি বেশি হয়, বাসায় কাউকে রেখে যাবে। এতো বড়ো বাড়ি। একা একটি মেয়ে, দুটি বাচ্চা নিয়ে। বিপদ আসলে?
সীমান্ত: ধন্যবাদ চাচা। পরের বার খেয়াল রাখবো।
সীমান্ত চলে যাওয়ার পর বৃদ্ধ লোকটি মিনমিন করে বলতে লাগলো।
বৃদ্ধ লোক: তাকে আটকাতে হবে। এভাবে জাগিয়ে দেওয়া যাবে না। নয়ত সব শেষ হয়ে যাবে। সব শেষ হয়ে যাবে।
চলবে–