মায়া,পর্ব:৩

0
2352

#মায়া
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-০৩:

গভীর রাত। চারদিকে ঘন অন্ধকার। নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে চারপাশ। নিঃশ্বাসের শব্দও কানে আসছে।
ঝোপঝাড় থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ। মাঝে মাঝে বাড়ির নিচ থেকে কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে।

সারাদিনের ব্যস্ততায় শুভ্রার খুব ক্লান্ত লাগছে। চোখ বন্ধ করলেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যাবে সে। কিন্তু শুভ্রার চোখ বন্ধ করার সাহস হচ্ছে না। মনে অজানা ভয় দানা বেঁধেছে। শুভ্রার মনে হচ্ছে, সে চোখ বন্ধ করলেই তাদের উপর বিপদ নেমে আসবে।

এদিকে সীমান্ত ঘুমের রাজ্যে চলে গেছে। শিশির আর শেফাও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সীমান্তের একটা অভ্যাস হচ্ছে, পুরো ঘর অন্ধকার করেই সে ঘুমোতে পারে। হালকা আলোও যদি তার চোখের উপর পড়ে, সে আর ঘুমাতে পারে না। যার ফলে কোথাও আলো না থাকায় রুমটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে আছে।

শুভ্রা এতোক্ষণ চোখ খোলা রেখেছিলো। কিন্তু আর পারছিলো না সে। তাই চোখের পাতা বন্ধ করলো। কিন্তু যেই সে চোখ দুটি বন্ধ করলো, তখনই তার কানে এলো ছাদে কেউ শব্দ করে হাঁটছে। শুভ্রা মুহূর্তেই চোখ খুলে শোয়া থেকে উঠে বিছানায় বসে পড়লো পা ঝুলিয়ে। তার পাশেই সীমান্ত ছিল। শুভ্রা সীমান্তের মুখের দিকে তাকালো। কিন্তু ঘন অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুধুমাত্র স্পর্শ করে সীমান্তের উপস্থিতি টের পাচ্ছে সে।
বিছানাটি মেঝে থেকে অনেকটা উপরে হওয়ায় শুভ্রার পা মেঝেতে লাগে নি। অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে সে। ছাদে হাঁটার শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না এখন। তাহলে কি এটি তার মনের ভুল ছিলো?

হঠাৎ তার পায়ে শীতল দুটি হাতের স্পর্শ অনুভব করে সে। ভয়ে শুভ্রা চিৎকার দিয়ে উঠলো। অদ্ভুত ব্যাপার হলো তার আওয়াজ সে নিজেও শুনতে পায় নি। শুভ্রা বুঝতে পেরে বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে লাইট জ্বালিয়ে দেয়। শুভ্রা খেয়াল করলো ভারী বাতাসের আনাগোনা নেই তবুও ইজি চেয়ারটি দুলছে। মনের মধ্যে সাহস এনে শুভ্রা ধীর পায়ে ইজি চেয়ারটির দিকে এগিয়ে গেলো। ইজি চেয়ারটিতে হাত দেওয়ার সাথে সাথেই শুভ্রা কিছু একটা দেখতে পেলো। মানুষের অবয়বের মতো অনেকটা। অবয়বটি এতো কম সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে যায় যে, সে বুঝে উঠতে পারে নি ভালোভাবে। ভয়ে শুভ্রা পিছিয়ে যাওয়ার সময় হোঁচট খেয়ে মেঝেতে পড়ে যায়। শব্দ শুনে সীমান্তের ঘুম ভেঙে যায় সাথে সাথে।

সীমান্ত: শুভ্রা। তুমি এখানে কি করছো? তুমি ঠিক আছো তো?

শুভ্রা: আমি ঠিক আছি।

সীমান্ত: কি হয়েছে শুভ্রা? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?

শুভ্রা: কেমন দেখাবে আবার। ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় হোঁচট খেয়ে পড়লাম। ব্যথা পেয়েছি অল্প একটু। এইটুকুই শুধু। তেমন কিছু হয় নি আমার, সীমান্ত।

সীমান্তের মুখের দিকে তাকিয়ে নির্দ্বিধায় মিথ্যে কথাটি বলল শুভ্রা। এই কয়েকমাসে অনেক ধকল গিয়েছে মানুষটির উপর। এমনকি তার মিসক্যারিজ হওয়ার পর আরো বেশি চুপসে গেছে সীমান্ত। নিজেকে অপরাধী ভেবে এসেছে এতোদিন। সীমান্তের ধারণা, সংসারের চিন্তায় শুভ্রা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এখন এই ঘটনাটি বলে সে নতুন করে আবার চিন্তায় ফেলতে চায় না সীমান্তকে। আর এটিতো তার মনের ভুলও হতে পারে। হয়তো ঘুমের তীব্রতার জন্য সে ভুলভাল দেখেছে।

রাতে আর ঘুম হয় নি শুভ্রার। সীমান্তের বুকে গুটিশুটি মেরে শুয়ে ছিলো শুধু।

সকালে সীমান্ত আর শুভ্রাকে ডাকলো না। নিজে নিজে নাস্তা বানিয়ে শেফা আর শিশিরকে একসাথে নিয়ে নাস্তা সেরে, কাজে চলে গেলো।

শিশির আর শেফা বাবা চলে যাওয়ার পর ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে ছিলো। শেফা আঁকিবুঁকি করছে খাতায়। আর শিশির মোবাইলে গেইমস খেলছিলো। আঁকিবুঁকি শেষ করে শেফা শিশিরকে দেখাতে গেলো।

কিন্তু শিশির পাত্তা না দিয়ে বলল,
শিশির: মা কে গিয়ে দেখা। আমি ব্যস্ত আছি।

শেফা মন খারাপ করে চলে যায়। এখনো গুছিয়ে কথা বলতে পারে না সে৷ কিন্তু সব কথায় বুঝে। শেফা সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকলো। এতো উঁচুতে সে কিভাবে উঠবে ভাবতে থাকলো। পেছনে ফিরে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আবার সামনে তাকালো। সিঁড়ির মেঝেতে হাত রেখে হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে থাকলো সিঁড়ি বেয়ে। এভাবে কখনো সিঁড়ি ভাঙা শেখায় নি তাকে তার বাবা-মা। কোলে কোলেই পার করেছে সিঁড়ি পথ। তাই অনেকটা ভয়ের ছাপ শেফার চোখেমুখে। কয়েকধাপ পার করার পর শেফা বুঝতে পারলো তার ড্রয়িংখাতা সিঁড়ির প্রথম ধাপেই পড়ে আছে। অসহায় ভাবে খাতাটির দিকে তাকিয়ে আছে শেফা।

হঠাৎ বাতাসের ধাক্কায় খাতাটি এক ধাপ, এক ধাপ করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে।
আর খাতাটি নিজে নিজেই শেফার কাছে আসছে, তাই সে খুশিতে সিঁড়িতেই লাফালাফি করছে। সাথে তার ভয়টিও উধাও হয়ে গেছে।

এদিকে বাসা থেকে বের হওয়ার আগে সীমান্ত ঘরের সব জানালা বন্ধ করে দিয়ে যায়। আর শিশির খুব ভালোভাবেই সামনের দরজাটা লাগিয়েছে বাবা যাওয়ার পর। তাই বাইরে থেকে হাওয়া আসার কোনো সম্ভাবনা নেই।
যদিও ড্রয়িংরুমে অনেকগুলো ফ্যান ঝুলে আছে। কিন্তু শিশিরের মাথার উপর একটি ফ্যান ঘুরছে শুধু। ফ্যানের স্থান থেকে সিঁড়ির দূরত্বও আছে বেশ। আর ফ্যানের হাওয়া এতো তীব্রও ছিলো না যে, সে একটি ভারী খাতাকে ধাপে ধাপে নিয়ে যেতে পারবে। এর মধ্যে অদ্ভুত কোনো শক্তির ছোঁয়া অবশ্যই থাকতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটি অবুঝ শেফা বুঝতে পারছিলো না।

খাতাটি শেষ ধাপ অতিক্রম করে শেফাকে ক্রস করে উপরে উঠতে থাকে। শেফাও খুব উৎসাহের সাথে খাতাটির পিছু পিছু ছুটতে ছুটতে উপরে উঠে আসে। সিঁড়ির পথ পার করার পর খাতাটি স্থির হয়ে যায়। শেফা এখন খাতাটি ঘুরে ঘুরে দেখছে। হয়তো ভাবছে, খাতাটি আর দৌঁড়াচ্ছে না কেন? মন খারাপ করে খাতাটির দিকে হাত বাড়িয়ে আস্তে করে ধাক্কা দেয়। কিন্তু এখনো স্থির হয়ে আছে তার ড্রয়িং খাতা।

মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সে। শেফার চোখে মুখে খাতাটির প্রতি বিরাট অভিমান জন্মেছে। কারণ কেউ তো খেলে না তার সাথে। শিশির সারাদিন মোবাইলে গেইমস খেলে, তাকে ধরতেও দেয় না মোবাইল। মা সারাদিন বাসার কাজ করে, আর বাবা সারাদিন বাইরে থাকে। তবে বাবা বাসায় ফিরলে তার সাথে অল্প একটু খেলে, কিন্তু তখন শেফার বড্ড ঘুম পায়। মাঝে মাঝে খেলতে খেলতেই বাবার কোলে ঘুমিয়ে পড়ে সে। আজ প্রথম সে খেলার সাথী পেয়েছে। আর সাথীটা তার প্রাণহীন ড্রয়িং খাতা।

প্রাণহীন খাতাটি কি শেফার অবুঝ মনের অভিমান ধরতে পেরেছে? হয়তো পেরেছে। তাই হাওয়া ছাড়াই আবার চলতে থাকলো। শেফার ঠোঁটের কোণে সাথে সাথে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। শেফা খাতাটির পেছন পেছন দুতলার প্রতিটি ঘরে ঘরে যায়। খাতাটি অদৃশ্য মায়ায় বেঁধে ফেলেছে শেফাকে, আর তাকে নিয়ে ছুটছে এ-ঘর ও-ঘর।
প্রতিটি ঘরের বন্ধ দরজা শেফার জন্য আপনা-আপনি খুলে যাচ্ছে। শেফার খিলখিলানো হাসি, উচ্ছাসে লাফিয়ে উঠা আর খুশিতে হাত তালি দেওয়ার গুঞ্জন যেন প্রাণহীন বাড়িটিকে জাগিয়ে তুলছে ধীরে ধীরে।

বৃদ্ধ লোকটি ঠিক ওই সময় বাড়িটির সামনে এসে দাঁড়ালো৷ তিনি দিনে কয়েকবার এই বাড়ির সামনে এসে ঘুরে যান। সীমান্ত আর শুভ্রা এই বাড়িতে আসার আগেও তিনি এমনটি করতেন। তিনি কেন বার বার ঘুরে এই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ান ব্যাপারটি সকলের অজানা।
সীমান্ত কাজে চলে যাওয়ার পর তিনি কয়েকবার ঘুরে এসেছেন বাড়ির সামনে থেকে। কিন্তু এবার এসে অনেকটা থমকে যান।

আজ ফ্যাকাশে বাড়িটি অনেকটা উজ্জ্বল লাগছে বাইরে থেকে। সূর্যের কিরণ এসে পড়েছে বাড়িটির গায়ে। একদম মাখা মাখা লাগছে দেখতে। যে কেউ দেখলে মায়ায় পড়ে যাবে হয়তো।

বৃদ্ধ লোকটির ঠোঁটের কোণে প্রসারিত হচ্ছে প্রশান্তির হাসি। ছলছল করে আসা চোখদুটি বাঁধ ভেঙে দিয়েছে। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো তার অশ্রু। আকাশের দিকে তাকিয়ে দুহাত তুলে কিছু চাইলেন হয়তো। হয়তোবা কিছু চাইলেন না।

শুভ্রার ঘুম ভাঙার সাথে সাথে হুড়মুড়িয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। পাশে স্বামী সন্তানদের না দেখতে পেয়ে অনেকটা ভয় পেয়েছে সে। রুমের দরজা খুলে দেখলো মেঝেতে বসে শেফা নিজের মনে কথা বলছে। শেফাকে দেখে অনেকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো শুভ্রা। শেফা মায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলো।

দৌঁড়ে মায়ের কাছে এসে বলল,
শেফা: মাম, আমান তাতে, কাতা কেলচে। ও অনিক বালো। আম একচি দে..বে?
শেফার কথার অর্থ ছিলো, মা আমার সাথে খাতাটি খেলেছে। খাতাটি অনেক ভালো। আমি অনেককিছু এঁকেছি, দেখবে?

শুভ্রা মাথা নেড়ে বলল,
শুভ্রা: হুম।

শেফা দৌঁড়ে খাতাটি নিয়ে এলো শুভ্রার কাছে। খাতাটিতে কাঁচা হাতে গীত নামটি লেখা।

শুভ্রা অবাক হয়ে তাকায় শেফার দিকে। শেফা এমনিতেই আঁকিবুঁকি করে৷ লিখতে শিখে নি এখনো। তাহলে এই নামটি কিভাবে লিখবে সে? আর শিশিরের লেখা খুব পরিস্কার৷ আর তার হাতের লেখাও শুভ্রা চেনে, তাহলে এটি কে লিখতে পারে?

শুভ্রা শেফার দিকে ঝুঁকে বলল,
শুভ্রা: মা, কে লিখেছে এটা?

শেফা মায়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মাথা দুলিয়ে বলল,
শেফা: কাতা।
যার অর্থ খাতাটি নিজেই লিখেছে।

শুভ্রা মেয়েকে কোলে নিয়ে নিচে নেমে শিশিরকে জিজ্ঞেস করলে শিশির বলল, সে কিছুই জানে না।

শুভ্রা: শেফা সিঁড়ি কিভাবে বেয়ে উঠলো?

শিশির: নিজে নিজেই উঠেছে হয়তো।

শুভ্রা: আর তুমি কি করছো?

শিশির মোবাইল পাশে রেখে চুপচাপ বসে পড়লো মাথা নিচু করে।

শুভ্রা: পড়াশোনা নেই তোমার? শেফা যদি সিঁড়ি থেকে পড়ে যেতো? তোমার বাবা আসলে বলবো আমি। সারাদিন গেইমস আর গেইমস।

শিশিরের প্রতি প্রচুর রাগ হয় শুভ্রার। কিন্তু আর কিছুই বলে নি তাকে।

রহস্যের মাঝেই সারাদিন পার করে দেয় সে। এখন শুধু রাত হওয়ার আগেই সীমান্ত বাড়িতে এসে পড়ুক, এই আশায় আছে।

চলবে–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here