#মায়া
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-০২:
দুইদিন পর।
আজ সীমান্ত আর শুভ্রা তাদের সন্তানদের নিয়ে নতুন বাড়িতে উঠবে। দুদিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় সব জিনিসই তারা বিক্রি করে দিয়েছে। কারণ এসব সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে খরচ পড়বে সেই টাকাও সীমান্তের হাতে ছিলো না। তার চেয়ে এসব আসবাবপত্র বিক্রি করে কিছু টাকা তার হাতে এসেছে। আর নতুন বাড়িতে প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রও আছে। যদিও বেশ পুরোনো, তবুও চলবে তাদের। এই মুহূর্তে মাথায় একটা ছাদ পেয়েছে এতেই সন্তুষ্ট। এর বেশি কিছু আপতত তাদের লাগবে না।
গাড়িতে উঠার পর থেকে শুভ্রার কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে। মিসক্যারিজ হওয়ার পর থেকেই অনেকটা চুপচাপ হয়ে গেছে সে। ক্লান্তি এতো বেশি ভর করেছে যে, সে মাথাটি সীমান্তের কাঁধে ছেড়ে দেয়। অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে তাদের। কারণ জায়গাটা শহর থেকে অনেক দূরে।
ড্রাইভার: ভাইজান, আপনাদের কি কোনো আত্মীয় থাকে ওইখানে?
সীমান্ত: না। আমরা নতুন বাসায় উঠছি।
ড্রাইভার: সেই জায়গায় আবার নতুন বাসা? সবই তো পুরান। আচ্ছা, ভাইজান, সেই জায়গায় একটা বাড়ি আছে। ভূতের বাড়ি কয়। আপনারা সেইখানে যাইবেন না আবার। মানুষ খুন হইছে মেলা বছর আগে।
সীমান্ত অনেকটা ঘাবড়ে যায় কথাটি শুনে। কারণ বৃদ্ধ লোকটিও বলেছিলো তাকে। কিন্তু এসব ভূতে বিশ্বাস নেই তার। আর এই বিষয়ে শুভ্রাকেও কিছু জানায় নি সে।
মনকে শক্ত করে সীমান্ত বলল,
সীমান্ত: ভাই, আপনি গাড়ি চালান।
বিশ্বাস না থাকলেও অস্বস্তি লাগছে তার। নিরুপায় হয়েই উঠতে হচ্ছে এই বাড়িটিতে।
শহর ছেড়ে তারা আরেকটা রাস্তায় উঠলো। এখান থেকে শুরু হয় সেই মফস্বলে যাওয়ার পথ। রাস্তার দু ধারে গাছপালা। বিশাল খোলা মাঠ আর ছোট ছোট টিলা দেখা যাচ্ছে। শূন্য রাস্তায় শুধু তাদের গাড়ি ছাড়া, আর কোনো গাড়ি চোখে পড়ছে না। মানুষের তো কোনো আনাগোনাই নেই।
শুভ্রা চোখ বন্ধ করে ছিলো। হঠাৎ তার কানের কাছে অস্ফুটস্বরে একটি শব্দ হলো। শব্দটি তাকে কি বলেছে সে বুঝতে পারে নি। বয়স্ক মহিলার কন্ঠের স্বর মনে হয়েছে অনেকটা। চোখ খুলে দেখে সীমান্ত চোখ বন্ধ করে বসে আছে। শিশিরের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে বাইরের দৃশ্য দেখছে, আর শেফা বাবার কোলে ঘুমিয়ে আছে। কন্ঠটি মনের ভুল ভেবে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো শুভ্রা।
সীমান্ত গাড়ি অন্য একটা বাড়ির সামনে দাঁড় করালো। সে চায় নি ড্রাইভারটি জানুক তারা কোন বাড়িতে উঠছে। আর যাই হোক, শুভ্রা আর শিশির যদি এই বাড়ির অতীত জানে, তাদের মনের মধ্যে একটা ভয় সৃষ্টি হবে। আর মনের ভয় সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা। যদি কিছু নাও হয় তখনও এই ভয় তাদের মধ্যে আতংক সৃষ্টি করবে। আর যার ফলে তারা ভুল কিছু কল্পনা করবে সবসময়।
গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে দিলে ড্রাইভার চলে যায়। তারপর সীমান্ত ব্যাগ নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলো।
শুভ্রা: এখানে নামলে যে। বাসা কোথায়?
সীমান্ত: সামনে।
শুভ্রা: সামনে হলে আমরা এখানে কেন নেমেছি?
সীমান্ত: ড্রাইভারটিকে সুবিধার মনে হয় নি তাই। এইখানে মানুষজন কম। আমি না থাকলে তোমরা বাসায় একা থাকবে। তাই চাই নি কোনো ক্ষতি হোক।
শুভ্রা সীমান্তের কথা বুঝতে পেরে হাঁটা শুরু করলো। জায়গাটা খুব পরিচিত মনে হচ্ছে তার। কোথায় দেখেছে এই জায়গাটি ঠিক মনে করতে পারছে না শুভ্রা। রাস্তায় বৃদ্ধ লোকটির সাথে দেখা হয়ে যায় তাদের।
সীমান্ত: আসসালামু আলাইকুম চাচা।
বৃদ্ধ লোক: তোমরা চলে এসেছো? আমি লোক ডাকিয়ে বাড়িটি পরিস্কার করিয়েছি।
সীমান্ত: ধন্যবাদ, চাচা।
লোকটি শুভ্রার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
বৃদ্ধ লোক: তোমার স্ত্রী?
সীমান্ত: জি।
বৃদ্ধ লোক: আচ্ছা তোমরা যাও বাড়িতে। আমি আসবো দেখতে তোমাদের।
লোকটি থেকে বিদায় নিয়ে তারা চলে এলো বাড়িটির সামনে।
বাড়িটির মেইন গেইট ভাঙা। তালা লাগানোর উপায় নেই। খোলায় ছিলো অবশ্য। মেইন গেইটের সামনে খোলামেলা জায়গা আছে অনেকটা। বাম দিকে ঝোপঝাড় আর ডানপাশে অনেকগুলো গাড়ি পার্ক করা। গাড়িগুলো অনেক পুরোনো হয়ে গেছে। সেখানে অনেক বিছুটি জাতের গাছের জন্ম হয়েছে। বাড়িটির দেয়ালের ফাঁকে ফাঁকে জমেছে সবুজ শ্যাওলা। ছাদ থেকে নেমে গেছে লতা গাছ।
শুভ্রার খোলা চুলগুলো উড়ছে শীতল বাতাসে। এই শীতল বায়ু যেন বহু পরিচিত তার। বাড়িটির দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শুভ্রা। এক অদৃশ্য মায়া শুভ্রাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বাড়িটির ভেতরে। দরজার সামনে আসতেই দরজাটি নিজ থেকেই খুলে যায় হাত লাগানোর আগেই। সীমান্ত পেছনে থাকায় বিষয়টি খেয়াল করে নি। কিন্তু শুভ্রা খানিকটা অবাক হলো। তবুও সে সীমান্তকে কিছু বলে নি। ভেবে নেয় এটি তার মনের ভুল। হয়তো হাওয়া লেগে খুলে গেছে। আবার ভাবছে, এতো ভারী আর বড় দরজা এতো হালকা হাওয়ায় তো খুলে যাওয়ার কথা না।
শিশির ও শেফা নতুন বাসায় এসে খুব খুশি।
শিশির: বাবা, এতো বড় বাড়িতে আমরা থাকবো?
সীমান্ত: হ্যাঁ, বাবা।
শেফা এইপাশ থেকে ওইপাশ দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে।
সামনে বিশাল বড় বসার স্পেইস। কমপক্ষে, বিশজন মানুষের জায়গা হবে। বাম পাশে ডায়নিং, তার পাশে লাগানো বিশাল বড়ো রান্নাঘর। ডায়নিং আর বসার ঘরের মাঝামাঝিতে একটি সিঁড়ি দুতলায় চলে গেছে।
শুভ্রা সিড়ি বেয়ে উপরে উঠলো।
দুতলায় দশটি রুম। বাম ও ডান পাশে দুটি রুমের সাথে বড় বড় বারান্দা আছে চারটি। পেছনের দিকে আরো একটা বারান্দা। তার দুই পাশে দুটি সিঁড়ি চলে গেছে উপরে। শুভ্রার একটা বিষয় খুব অদ্ভুত লেগেছে। সেটি হচ্ছে, বামপাশের সিঁড়ি ঘরটা খোলা, কিন্তু ডানপাশে সিঁড়ি ঘরটি বন্ধ। তালা ঝুলছে গ্রিলে। শুধু একটি তালা না, উপর থেকে নিচ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি তালা ঝুলছে। সাথে মেটালের মোটা মোটা চেইন দিয়ে বাইরে শেষ আরেকটি বড়ো সড়ো তালা লাগানো হয়েছে। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে, সিঁড়িটি কাঠের কারুকাজ করা। এমন কি আছে ওখানে যার জন্য, এভাবে তালা লাগানো হয়েছে? শুভ্রা এসব ভাবতে ভাবতে পাশের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। কিন্তু ছাদে গিয়ে যা দেখলো তাতে সে আরো অবাক। সে ভেবেছিলো ডানপাশের সিঁড়িটি ছাদে চলে গেছে। কিন্তু ছাদে এমন কোনো সিঁড়ি দেখলো না। পুরো ছাদ খালি। ছাদটি খুব পরিস্কার। আশেপাশে হয়তো অনেক বাগান ছিলো। কিন্তু এখন কিছুই নেই। শুধু বড়ো বড়ো খালি টব দেখা যাচ্ছে। টবগুলো ঘাস আর আগাছায় ভরে গেছে।
বাড়িটি পুরো ঘুরে ফেলেছে শুভ্রা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই মায়া জন্ম নিয়েছে বাড়িটির প্রতি।
শুভ্রা ভাবছে, যার বাড়ি ছিলো সে হয়তো খুব যত্ন নিয়ে বানিয়েছিলো বাড়িটি।
সীমান্তের ডাকে ছাদ থেকে নামলো শুভ্রা।
সীমান্ত: বাড়ি পছন্দ হয়েছে?
শুভ্রা: খুব।
সীমান্ত: আমি ভাবছি কি, আমরা সবাই এক রুমেই থাকি। রুমগুলো তো খুব বড়ো বড়ো তাই। শিশির আলাদা না থাকুক। আর মাত্র কয়েক মাসের জন্যই তো।
শুভ্রা: ঠিক বলেছো। আমারও মন চাইছে না বাচ্চাদের আলাদা ঘরে রাখতে।
সীমান্ত: ডানপাশের ঘরটি আমার ভালো লেগেছে। বারান্দাও বড়ো আছে। আমরা ওই রুমটাতে উঠলে ভালো হয়।
শুভ্রা ঘরটিতে ঢুকলো। বিছানাটি অনেক বড়ো। চারজনের জায়গা হয়েই যাবে৷ পাশে একটা ড্রেসিং টেবিল। টেবিলের উপর প্রয়োজনীয় সব ব্যবহারের জিনিস। শুভ্রার চোখ পড়লো আলমারির দিকে। বিশাল বড়ো আলমারী। আলমারী খুলে সে আরো অবাক হলো। মেয়েদের কাপড় চোপড়। শুভ্রা আন্দাজ করতে পারলো কোনো কম বয়সী মেয়ের রুম ছিলো এটি।
শুভ্রা সীমান্তের কাছে এসে বলল,
শুভ্রা: সীমান্ত, শুনো।
সীমান্ত: বলো।
শুভ্রা: আচ্ছা, বাড়িটি কার? আর কয় বছরের পুরোনো?
সীমান্ত: অনেক বছরের হবে। কার বাড়ি কেউ জানে না।
শুভ্রা: এভাবে এতো বড় বাড়ি ফেলে কেউ চলে যায়? আর চলে গেলেও জিনিসপত্র নিয়ে যায় নি কেন? আলমারিতে সব কাপড় চোপড় পড়ে আছে।
সীমান্ত: এসব নিয়ে আমাদের ভাবার কি দরকার?
শুভ্রা: এই বাসায় এতো জিনিস, আর সবকিছুই খোলা। তালা দেওয়া নেই কোথাও। তবুও কোনো জিনিসই চুরি হয় নি। তোমার কি বিষয়টি অদ্ভুত লাগছে না? আর এসব জিনিস দেখে মনে হচ্ছে না শত বছর আগের। আধুনিকতার ছোঁয়াও আছে। যত্নের অভাবেই অনেকটা পুরোনো লাগছে।
হঠাৎ নিচ থেকে বৃদ্ধ লোকটির কন্ঠ শুনে তারা নিচে নেমে গেলো। তারা রুম থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই ইজি চেয়ারটি দুলতে লাগলো নিজ থেকে।
সীমান্ত : চাচা, আপনি এসেছেন? ধন্যবাদ সব পরিস্কার করার জন্য।
বৃদ্ধ লোক: তোমাদের কোনো অসুবিধা হলে জানাবে।
শুভ্রা: বাড়িটির মালিক কোথায় চাচা?
লোকটি কিছু বলতে যাবে, সীমান্তের চোখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বললো না এই বিষয়ে।
বৃদ্ধ লোক: মা, তাদের খবর জানি না। তবে একটা কথা অবশ্যই বলবো। এখানে, ব্যক্তিগত কোনো জিনিসে হাত দেবে না ভুলেও। আলমারিতে অনেক কাপড় আছে, অলংকারও থাকতে পারে, ওসব ধরবে না।
শুভ্রা: এই বাড়িতে এতো বছর কেউ নেই, কিন্তু একবারো কি চুরি ডাকাতি হয় নি?
বৃদ্ধ লোক: হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। আমি তো জানি না এই বাসায় কি কি আছে। তবে নাও হতে পারে। এতো কিছু আমি জানি না মা। আমার কাছে সবই অজানা।
শুভ্রা আরো কিছু বলতে যাবে সীমান্ত তাকে চুপ করিয়ে দেয়।
শুভ্রার মনে অনেক প্রশ্ন ভীড় জমছে। এই বাড়িটি খুব রহস্যময়। পার্কিং-এ এতোগুলো গাড়ি, তালা দেওয়া সিঁড়ি, আলমারি ভর্তি কাপড়চোপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিস। এতোটা অক্ষত কিভাবে থাকতে পারে এসব? এই বাড়ির ইতিহাস ঠিক কতো বছরের পুরোনো জানতে ইচ্ছে হচ্ছে শুভ্রার। এই রহস্যময় বাড়িটির প্রতি ধীরে ধীরে শুভ্রার মনে মায়া জন্ম নিচ্ছে।
চলবে–