সম্মোহন শেষ পর্ব

0
909

#সম্মোহন

“শেষ পর্ব”

ডাক্তার রাশেদ কথা শেষ করতেই সুরাইয়া বলে:

-মাই গুডনেস!! জাবেদের মধ্যে এর প্রায় সব ই ছিলো। কিন্তু আংকেল ও তো নিজে ডাক্তার। সাইক্রিয়াটিস না হলেও এই ব্যপারে ওর ধারণা থাকা উচিৎ। ও কেনো চিকিৎসা নেয়নি?

-হ্যাঁ ও ডাক্তার বলে ওর এইটা জানা উচিৎ। জানতোও হয়তো কিন্তু আসল সমস্যা হলো এই রোগে আক্রান্ত হবার পর এর এরা বুঝতে পারলেও চিকিৎসা নেবার আগ্রহ কাজ করে না। এত গুলো সম্পর্কে জড়িয়ে, প্রতারনা করে, নিজেও শান্তি পায়না। সবসময় ভেতরে ভেতরে একটা অপরাধবোধ কাজ করে। আর তাই বেশির ভাগ সময় উদ্বিগ্ন থাকে। হঠাৎ ই অন্যমনস্ক হয়ে যায় বা অবসাদগ্রস্ত থাকেন।

মীরা বলে:

-জাবেদ প্রায় ই এবসেন্স থাকতো। খুব ভালো সময় কাটানো যাবে এমন সময় ও হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে যেতো।

-হুম। এটা ওর সবসময় হতো।

অন্তরা বলে। অন্তরা আরো বলে:

-জানো মীরা তোমরা যখন কক্সবাজারে আসার জন্য প্ল্যান করছিলে আমার বুকের ভেতর মোচর দিয়ে উঠেছে বারবার। তোমার সাথে ওর বারাবারি রকমের মিথ্যে প্রেমাভিনয় দেখে আমার মাথায় খুন চেপে গেছিলো। তখন ই চাচ্চুকে বলি আমি খুন করতে চাই জাবেদকে। চাচ্চুকে বুঝাই ও বেঁচে থাকলে এরকম আরো অনেক মেয়ে ওর প্রেমের ফাঁদে পড়ে নিজের সম্ভ্রম হারাবে। তারপর যখন জাবেদ এই হোটেল বুকিং দিলো; আমি চাচ্চুকে আমার প্ল্যানটা জানাই

মীরা আর সুরাইয়া অবাক হয়ে প্রশ্ন করে:

-কি প্ল্যান?

-হোটেলটা যেহেতু আমাদের সুতরাং এখানে যে কোনো ধরনের ক্রাইম করা আমার জন্য সহজ ছিলো।

ক্রাইম করার কথা শুনে ওরা বুঝে নেয় জাবেদকে হয়তো মেরে ফেলা হয়েছে। মীরা আর সুরাইয়া কেঁদে ফেলে। জাবেদের মা আঁচলে মুখ ঢেকেই বসে আছে। অন্তরা কিছু বলে না। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে দুটোকে ডাকে। ওদেরকে ইশারা দিতেই ওরা পাশের রুমে চলে যায়। জাবেদের মা সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায় ভাবলেসহীন ভাবে। হাত পায়ে শক্তি নেই। আসাঢ় দেহে, উদাস দৃষ্টিতে জাবেদের মা অন্তরার পাশে এসে দাঁড়ায়। অতিরিক্ত স্বাভাবিক গলায় অন্তরাকে বলে:

-থাক মা যা হবার হয়ে গেছে। আমি আর শুনতে চাই না। আমার ছেলের লাশটা দাও। আমরা চলে যাই। ঢাকা তো আমাদের স্থায়ী ঠিকানা না। সন্ধ্যে হয়ে গেছে রাতেই ঢাকা রওনা দেই। সকালে গ্রামের বাড়ি গিয়ে ওকে দাফন করবো। দাও মা লাশ টা দাও। মেলা দেরি হয়ে যাচ্ছে।

অন্তরা বুঝতে পারে জাবেদের মা ধরে নিয়েছে জাবেদ মারা গেছে। এবং জাবেদের মা বুকে পাথর বেঁধে কথা গুলো বলছে। অন্তরা বলে:

– আন্টি আপনি বসুন। পুরো কথাটা না শুনলে বুঝবেন কি করে কি হয়েছে?

জাবেদের মায়ের মুখে কথা নেই। জাবেদের বাবা চুপ হয়ে গেছে আরো আগেই। অন্তরা আবার বলে:

-আমি প্ল্যান করি চাচ্চুকে নিয়ে। আর এই সব কাজ করতে আমাদের সাহায্য করে এই হোটেলের পাঁচজন কর্মচারী, সুরাইয়া আর রাশেদ আংকেল। তবে সুরাইয়া পুরোটা জানতো না। যাই হোক ভেবেছিলাম জাবেদকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিবো। কিন্তু তখন ই রাশেদ আংকেল নিষেধ করলো। আমি তখন বুঝতে পারিনি কি কারণে নিষেধ করেছে তবে এখন বুঝতে পারছি। তখন অবশ্য হাতে জানার মতো সময় ও ছিলো না। আংকেল বললো তাই সাথে সাথে এখানের কর্মচারীকে ফোন দিয়ে বললাম বিষ না মিশিয়ে কড়া ডোজের ঘুমের ঔষধ দিতে যাতে দুজনেই গভীর ঘুমে থাকে। আর তখন জাবেদকে সরিয়ে ফেলতে পারি আংকেলের কথা মতো। দিয়েছিলাম দুটোতেই। কিন্তু জাবেদ মিন্ট লেমনটা খেয়ে নিলেও মীরা পেপের জুস টা খেলো না বলে প্ল্যানটা একটু ঘেটে গেলো। আমাকে মেইল করতে হলো। সেসব ডিলিট করে মীরাকে ভয় দেখাতে হলো। সুরাইয়াকে পাঠিয়েছিলাম জুস খেয়ে মীরা ঘুমিয়ে যাবার পর মীরাকে কনভিন্স করে আমার কাছে নিয়ে যাবার জন্য। আর আমি ঘরে বসে সবটা পর্যবেক্ষণ করছিলাম।

এবার জাবেদের মা আবার ও খুব স্বাভাবিক গলায় আগের মতোই বললো:

-ওওও তাহলে মারোনি ওকে?

এবার ডক্টর রাশেদ বললেন:

-না মারিনি। তবে ওর বেঁচে থাকাটা মরে যাবার মতোই। ওকে আমি আমার সঙ্গে নিয়ে যাবো। ওর চিকিৎসা দরকার। যেখানে নিয়ে যাবো সেইটা ওয়ান কাইন্ড অব গ্রোভ। তবে কবর আর ঐ জায়গার মধ্যে পার্থক্য হলো ঐখানে গেলে সুস্থ হবার পর ফিরে আসার সম্ভাবনা আছে। আর কবর থেকে সেই সম্ভাবনা নেই।

-কি এমন চিকিৎসা আছে এটার?

-ধ্যান বা যোগাভ্যাস আর নানা রকম ওষুধপত্রের মাধ্যমে এই রোগের চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। তবে ওষুধপত্র ছাড়াও রেসিডেন্সিয়াল ট্রিটমেন্ট প্রোগ্রাম কগনিটিভ বিহেভিয়েরাল থেরাপি কাজে লাগিয়েও নিমফোম্যানিয়া বা স্যাটেরিয়াসিসের চিকিৎসা করা হয়। জাবেদের সাথে আমার কথা হয়েছে। ওর কথা শুনেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমার সাথে এসাইলেমে নিয়ে যাবো। আপনারা অনুমতি দিলে নিয়ে যেতে পারি।

মীরা বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বললো:

-কয়টা জাবেদকে এসাইলেমে নিয়ে গিয়ে সুস্থ করবেন? জাবেদের মতো পেসেন্টে এখন দুনিয়া ভরে গেছে।

-হয়তো সবাইকে পারবোনা। একজন কে দিয়ে শুরু তো করি। আমি তোমাদেরকে কিছু কথা বলতে চাই। দেখো সমাজে এরকম জাবেদের আসলেই অভাব নেই। কিন্তু আমাদের দেশে এই ধরনের সমস্যাকে সমস্যা ধরা হয়না। লোকে এদেরকে চরিত্রহীন, দুশ্চরিত্র, লম্পট এসব বলতেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আবার যাদের ভেতর এই সমস্যা আছে তারা জানেও না এটা একটা অসুখ। বরং তারা এনজয় করে ব্যপারটাকে। এদের একেক জনের একেকরকম টার্গেট থাকে। যেমন জাবেদ শিকার হিসেবে প্রথমেই টার্গেট করেছিলো এমন কিছু মেয়েকে যাদের পুরোনো ক্ষত আছে বা অর্থিকভাবে অস্বচ্ছল, অথবা দেখতে তথাকথিত সুন্দরী না, টিন এইজের মেয়ে, ডিভোর্সি, কিংবা অন্য কারুর ওয়াইফ এসব। কারণ এদেরকে বসে আনা খুব সহজ। এবং ছেড়ে আসলেও এরা মান সম্মানের কথা ভেবে কোনো স্টেপ নিবেনা। আমার কি ইচ্ছে করে জানো?? আমার ইচ্ছে করে আমি এসব মেয়েদের জন্য ট্রেনিং সেন্টার খুলি সেখানে পড়ানোর বিষয় হবে কোনো পুরুষ মানুষের আবেগী কথা বার্তা শুনেই তার প্রেমে পড়তে নেই। মেয়েরা নিজের কোথাও কোনো গ্যাপ থাকলেই এই ভুলটা করে। দুম করে একজনের মিষ্টি কথায় ভিঁজে যায়। এরা যাচাই করবার ও দরকার মনে করে না। আরে বাবা ক্ষুত ছাড়া কোনো মানুষ আছে নাকি?

এমন সময় সেই ছেলেদুটো একটা হুইল চেয়ার টেনে টেনে নিয়ে রুমের মধ্যে প্রবেশ করে। সে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে জাবেদ। ডাক্তার রাশেদ জাবেদের এই অবস্থা দেখে বলে:

-যে ঔষধ দিয়েছি তাতে আবার এভাবে নিস্তেজ হয়ে ঘুমানোর কথা না। যাই হোক আমি নিয়ে যাচ্ছি দেখা যাক কি হয়? সুস্থ হলে ফেরত পাবেন। আর না হলে আজীবন এসাইলেমেই থাকতে হবে।

তারপর কাকে যেনো ফোন করলেন গাড়ি রেডি করার জন্য। এবার বিদায় দেবার পালা। রুমে দাঁড়িয়ে আছে চারজন নারী। চারজনের ই পুড়ে যাচ্ছে জাবেদের জন্য। কেউই জানেনা জাবেদ আসলেও আর কোনোদিন ফিরবে কিনা! শুধু মীরা জানে আর মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে জাবেদ চলে যাবে পৃথিবী ছেড়ে। ভালোবাসতে বাসতে স্লো পয়জন খাইয়ে দিয়েছে জাবেদকে। জাবেদ টের ও পায়নি। মীরা বুঝে গেছিলো জাবেদ ওকে বিয়ে করবেনা। তারপর সুরাইয়ার কথাতেও বুঝেছিলো সুরাইয়া একা নয়। ওর সাথে এমন কেউ আছে যে সাধারণ কেউ নয়। মেধাবী মীরা এই সুযোগটাই কাজে লাগায়। জাবেদের যা কিছু হোক তার জন্য মীরা কোনভাবেই দায়ী হবেনা বুঝতে পেরেই কৌশলে স্লো পয়জনটা খাইয়ে দেয়। জাবেদকে দুজন লোক নিয়ে যাচ্ছে। আর মীরা চেয়ে চেয়ে চেয়ে দেখছে জাবেদের নাক, চোখ, মুখ, ঠোঁট! গতরাতেও এই মুখটার মায়ায় বুদ হয়ে ছিলো ও। টপ টপ করে জল গড়াচ্ছে মীরা চোখে! এত কিছু হয়ে গেলো। এত কিছু জানলো তবুও মীরা ভিঁজে যাওয়া ঝাপসা চোখে অপলক দেখছে জাবেদকে। এখনো জাবেদের মধ্যে কী অদ্ভুত সম্মোহনী মায়া!!!

“সমাপ্ত”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here