#সম্মোহন
পর্ব-চার
লেখা: সাঈদা আম্বিয়া সুলতানা
মীরা নিজের গায়ে চিমটি কাটে। ব্যথা পাচ্ছে। হাতের আঙুলে কামড় দেয় এবারেও ব্যথা পাচ্ছে। তারমানে তো স্বপ্ন নয়। হ্যলুসিনেশন হলে কী সেইটা মীরা এত তারাতারি বুঝতে পারতো? সাহস সঞ্চয় করে মীরা উঠে দাঁড়ায়। এলোমেলো ভাবে এগুতে থাকে জাবেদের দিকে। কিছু যদি জাবেদকে না ও বলে তবুও এই মুহূর্তে জাবেদকে ডাকতে হবে। কারণ মীরা ভয় পাচ্ছে। কেউ বাইরে যেতে বললেই বাইরে কেনো যাবে? সাত পাঁচ ভেবে মীরা জাবেদকে ডাকতে যায়। বেডের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই আবার মেসেজ আসে।
“মীরা; হি ইজ নো মোর, বাঁচতে চাইলে যা বলেছি তাই করো। নইলে তুমিও বাজে ভাবে ফেঁসে যাবে।”
মীরার হাত থেকে মোবাইল ফোন মেঝেতে পড়ে যায়। কানে বাজতে থাকে “হি ইজ নো মোর”। মীরার হাত পা ততক্ষনে মীরার কন্ট্রোলের বাইরে। থরথর করে কাঁপছে। চোখে অন্ধকার দেখছে। মাথার ভেতর তীব্র একটা ঝাঁ ঝাঁ করা ব্যাথা। মীরার মনে হচ্ছে এই কথাটা ওর মাথার মগজ ছিদ্র করে কলিজাতে গিয়ে খুবলে খাচ্ছে হৃদপিন্ডের মাংস গুলি। বুকের ভেতর হাতুরি পেটাতে থাকে। নড়বার শক্তি নেই। অপলক তাকিয়ে থাকে জাবেদের মুখের দিকে। ঐ তো ঘুমোচ্ছে জাবেদ। কত মায়া ঐ মুখটাতে। কী করে ও মরে যেতে পারে?
তৎক্ষনাৎ মনে হয় সবটা জানা দরকার। বাইরে আলো ফুটছে। মীরা দৌঁড়ে নিচে যায়। রিসিপশন থেকে সুরাইয়ার রুম নাম্বার জিগেস করতেই রিসিপসনিস্ট একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে বলে:
-আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।
-আমার জন্য কেনো?
-এই কাগজটা দেবার জন্য। আর এটা বলার জন্য যে সুরাইয়া ম্যাম আজই চেক আউট করেছে।
মীরা অবাক হয়ে তাকায় লোকটার দিকে। চিরকুটটা তড়িঘড়ি করে খুলে। তাতে লেখা:
“জানতাম এখানে আসবে। টাইম ওয়েস্ট না করে বাইরে চলে যাও, কোনো রকম চিৎকার চেঁচামেচি করো না। তোমার ভালোর জন্যেই বলছি। কথা না শুনলে এরপর তুমি বিপদে পড়লে আমার কিছুই করার থাকবেনা।”
মীরা চিরকুট পড়া শেষ করে রিসিপশনের লোকটাকে কিছু জিগেস করার আগেই তাকিয়ে দেখে লোকটা ওখানে নেই। অন্য একজন ভেতরে ঢুকছে।। মীরা আতঙ্কিত হয়ে ঐ লোকটাকে জিগেস করে:
-এখানে এক মিনিট আগে যিনি ছিলেন উনি কোথায় গেলো?
-জানিনা তো ম্যাম। এখানে এখন আমার ডিউটি। আপনার কোনো হেল্প লাগবে?
মীরা বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে ওর সাথে! কপাল কুঁচকে চিন্তিত, ভয়ার্ত মুখে “না ঠিকাছে” বলে দৌঁড়ে রুমের দিকে যায়। আতঙ্কে লিফটে না চেপে মীরা সিঁড়ি দিয়ে দৌঁড়ে দৌঁড়ে উঠছে। কয়েকজন লোক খুব ধীর গতিতে নামছে সিঁড়ি দিয়ে। দুই তিনজন একসাথে ঝটলা বাঁধিয়ে নামার কি আছে মীরা বুঝতে পারেনা। এরা পুরো সিঁড়িটা ব্লক করে ফেলেছে। মীরা ফাঁক বের করে ওখান দিয়েই দৌঁড়ে উঠে। কারণ দাঁড়াবার মতো ধৈর্য্য এই মুহুর্তে নেই। তাড়াহুড়োতে মীরা একজনের সঙ্গে ধাক্কা খায় কিন্তু সরি ও বলতে পারেনা। রুমে ঢুকে মীরার চোখ ছানাবড়া। বেডটা তো ফাঁকা। বেডে জাবেদ নেই। একটু আগেই তো ছিলো। ভুল করে অন্য রুমে চলে আসেনি তো? কিন্তু ওদের ব্যাগ তো ঠিকি আছে। ভয়ে কষ্টে মীরা চিৎকার করার ও সাহস পাচ্ছেনা। জাবেদের জন্য বুকটা ছিড়ে যাচ্ছে। কোথায় গেলো জাবেদ মাত্র কয়েক মিনিটে? ইচ্ছে করছে জাবেদকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে থাকতে। ভয় পাচ্ছে মীরা। জাবেদ বাথরুমে যায়নি তো? চেক করে দেখে নেই। মীরার হঠাৎ মনে হয় জাবেদ ওর সাথে মজা করছে নাতো! মীরা চিৎকার করে:
“জাবেদ হয়ার আর ইউ?”
“আর ইউ লিসনিং মি?”
“জাবেদ আ’ম স্কেয়ার্ড, প্লিজ মজা করোনা”
“জাবেদ”?
কোনা সাঁড়া শব্দ নেই। বেডের কাছে গিয়ে মীরা অক্ষত অবস্থায় জাবেদের তিনটা মোবাইল ফোন পায়! এসব যদি জাবেদের কাজ হয় তাহলে ফোনগুলো রেখে ও চলে যাবে কেনো? মীরা হাঁপাতে হাঁপাতে দ্রুত সব গুছিয়ে নেয়। মনে মনে ভাবছে জাবেদ এখানে নেই। ওর ফোনগুলো পড়ে আছে। ওর জামা কাপড় ও সব ই পড়ে আছে রুমেই। বাইরে গেলে তো আর সেন্ডো গেঞ্জি গায়ে চাপিয়ে যাবে না। উৎকন্ঠা নিয়ে আস্তে আস্তে নিচে নেমে যায় মীরা। এতগুলো লাগেজ নিয়ে হোটেল থেকে মীরা একা বেরুচ্ছে কিন্তু কেউ আটকাচ্ছেনা বা কিছু জানতে চাইছে না তাহলে কি জাবেদ চেক আউট করেছে? নাহ্ এত কিছু ভাবতে পারছেনা। হোটেল থেকে বেরুতেই হঠাৎ সুরাইয়ার সেই লাল রং এর গাড়িটা দেখতে পায়। কাছে যেতেই দরজাটা খুলে যায়। আর সুরাইয়া হাত বাড়িয়ে দেয়। আগের মতোই ছোট স্কার্ভে মুখ ঢেকে বড় একটা সানগ্লাস পরে গাড়ির ভেতর বসে আছে। এবারে সুরাইয়ার আপাদমস্তক গোলাপী কাপড়ে ঢাকা। সুরাইয়া নিজেকে লুকোবার ভঙ্গিতে একটু রেগে বলে:
-মীরা গাড়িতে উঠুন কুইক। আপনি এত বোকা কেনো? আবার উপরে উঠতে গেলেন কেনো?
সুরাইয়াকে বেশ উদ্বিগ্ন লাগছে। মীরার বুকের ভেতর এক পৃথিবী শুন্যতা খাঁ খাঁ করছে। জাবেদ কোথায় গেলো? আর কী কোনোদিন দেখতে পাবেনা? তখন ও মীরার গলায়, পিঠে জাবেদের ভালোবাসার চিহ্ন! মীরা উপায়ান্তু না পেয়ে সুরাইয়ার বাড়িয়ে দেয়া হাতে হাত রাখে। ভেতরে সুরাইয়া ছাড়া আরো একটা মেয়ে। পুরো শরীর বোরখায় ঢাকা। বিষয়টা খেয়াল করলেও মাথা ঘামায় না বরং খুব অস্থির হয়ে সুরাইয়াকে জিগেস করে:
-আমার জাবেদ কোথায়? ওর সাথে কি করেছেন আপনারা?
পাশে বসে থাকা বোরখা পরা মেয়েটা নেকাপ সরাতেই মীরা চমকে যায়। সে নিকাপ সরিয়ে বলে:
-বেশি বুঝো মেয়ে? তুমি উপরে উঠতে গেলা কেনো আবার?? তাও সিঁড়ি দিয়ে?
মীরা হা করে চেয়ে আছে, এই মহিলাকে তো সে আগেও দেখেছে। কিন্তু কোথায়? মনে করতে পারছেনা। মীরা কপাল কুঁচকে বলে:
-আমি কিছু বুঝতে পারছিনা। জাবেদ কোথায়?
-সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় দেখোনি তোমার জাবেদকে?
-মানে জাবেদ বেঁচে আছে? কোথায় আছে আমার জাবেদ। ওকে নিয়ে আসুন! প্লিজ!
বোরখা পরা মেয়েটা সুরাইয়াকে বলে:
-ওকে তুমি বলোনি কিছু? এত অস্থির কেনো ও? এই বয়সটাই এমন। শরীরের মধ্যে যৌবন টগবগ করে। যার তার প্রেমে অন্ধ হয়ে যায়।
সুরাইয়া জবাব দেয়:
-সুযোগ পেলাম কোথায়?
মীরা রেগে গিয়ে বোরখা পরা মহিলাকে বলে:
-আপনি বাজে কথা বলছেন কেনো? কে আপনি??সুরাইয়া আপনি সব জানেন! আপনি আমাকে বলুন জাবেদ কোথায়? আর আপনি তো বলেছিলে আমাকে অনেক কিছু বলার আছে! কিন্তু এসব কি??
– মীরা আপনি সব ই জানতে পারবেন একটু ধৈর্য্য ধরুণ। আমিও জানিনা ওর খবর। জানেন জাবেদের জন্য আমার ও খুব দুঃখ হচ্ছে! আফটার অল আই অলসো লাভড হিম। ওর মতো কেউ হয় ই না।
-স্টপ ইট সুরাইয়া! জাবেদ শুধু আমাকে ভালোবাসে! আপনি জাবেদকে পাবার জন্য আমাকে ওর জীবন থেকে সরিয়ে দিচ্ছেন? আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? জাবেদ কোথায়? গাড়ি থামান আমি জাবেদের কাছে যাবো!
বলতে বলতে মীরা সেন্সলেস হয়ে যায়।
যখন জ্ঞান ফিরে মীরা একটা বাসায়। বাসাটা বেশ পরিপাটি। কিছুক্ষনের জন্য মীরার ব্রেইন একদম ফাঁকা। ও বুঝতে পারে না কোথায় আছে। কোথায় ছিলো। মিনিট খানেক পর ই মনে পরে জাবেদের কথা। জাবেদ জাবেদ বলে চিৎকার করতেই সুরাইয়া দৌঁড়ে আসে।
-মমতাজ ফুপু? কিচেনে গরম দুধ রাখা আছে নিয়ে এসো।
মীরার কাছে গিয়ে বসে সুরাইয়া। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। এখন সুরাইয়াকে একদম পরিপক্ক লাগছে। দুধের গ্লাসটা হাতে নিয়ে মমতাজ দাঁড়িয়ে। মমতাজকে যেতে বলে সূরাইয়া মীরাকে উঠতে বলে। বাধ্য মেয়ের মতো মীরা উঠে বসে। সুরাইয়ার চোখের কোনে জল। ভাঙ্গা গলায় বলে:
-এখন কেমন লাগছে মীরা?
-ভালো। মাথাটা ব্যথা করছে।
-দুধটা খেয়ে নিন। আমি ঔষধ দিচ্ছি ঠিক হয়ে যাবে।
-এটা আপনার বাসা?
-না!
-তাহলে?
-অন্তরা আপুর বাসা।
-অন্তরা কে?
-এত চাপ নিয়েন না তো। সময় মতো সব জানতে পারবেন। ভয় নেই। আপনি নিশ্চিত থাকুক আপনার কোনো ক্ষতি হবে না। নিন ঔষধটা খেয়ে নিন। তারপর দুপুরের খাবার খেয়ে একটু রেস্ট নিলেই ভালো লাগবে।
মীরা দুধ খেয়ে নিয়ে শান্ত গলায় বলে:
-আপনি আমার বোনের মতো। আমাকে বলুননা আপনারা জাবেদের সাথে কি করেছেন?
-আমি কিছু করিনি। তবে সম্ভবত ও আর বেঁচে নেই!
মীরা যেনো আরো শান্ত হয়ে যায়। গ্লাসটা হাত থেকে টেবিলে রেখে বলে:
-দিন ঔষধটা।
সুরাইয়া মমতাজকে পানি আনতে বললে মীরা বলে:
-লাগবেনা। আমি একটা শাওয়ার নিবো। আমাকে একটু একা ছেড়ে দিবেন?
-শিওর। টেক ইউর টাইম।
মীরা পানি ছাড়াই ঔষধটা গিলে খেয়ে নেয়। তারপর বাথরুমে ঢুকে সমস্ত কাপড় ছেড়ে শাওয়ারের নিচে চুপ করে বসে থাকে। হাজারটা প্রশ্ন মীরার মাথায় তখন ও ঘুরছে। কিন্তু কিচ্ছু জানার ইচ্ছে আর নেই। সব প্রশ্ন জাবেদকে ঘিরে ছিলো। সেই জাবেদ বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে এটাই যখন অনিশ্চিত তাহলে কি হবে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে!!
চলবে…