তুমি অতঃপর তুমিই
৩৩
Taniya Sheikh
গেটের সামনে আসতে আসতে ঘেমে নেয়ে একাকার মৌ-র শরীর। বার বার এদিক -ওদিক তাকাচ্ছে। না কেউ নেই আপাতত। যা করার দ্রুত করতে হবে। কিন্তু এই ডাকবাক্স থেকে চিঠি বের করবে কী করে? বোকার মতো কাজ করেছে সে। না ভেবেই চিঠিটা ফেলা ঠিক হয়নি। না ভেবে কথাটা সম্পূর্ণ সঠিক নয়। দিনরাত এক করে ভেবে সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল। তবে এখন কেন সেই সিদ্ধান্ত ভুল মনে হচ্ছে? মাথা কাজ করছে না। এতোটা অস্থিরতা মাহিবের কাছে প্রথমবার গিয়েও হয়নি। একটা গ্রাম্য মেয়ে ছোটো বোনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নোংরা হতেও পিছপা হয়নি। প্রতিশোধের আগুনে সকল বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছিল। নয়তো বার ডান্সার হয়ে অশালীন নৃত্য, অন্য পুরুষের চোখের সামনে মাহিবের বিছানা সঙ্গী হওয়া এসব কী বিবেকসম্পন্ন কেনো নারী করতে পারত? মৌ করেছে। প্রতিটি মুহূর্ত নিজেকে ধিক্কার দিত। ক্রমেই খারাপের সংগতে থেকে খারাপেই ওর সাচ্ছন্দ্য হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ মনটা কেন এই বিপত্তি ঘটাল? কেন ইমরোজকে ভালো লাগল ওর? কোনো কিছুতেই শান্তি নেই,স্বস্তি নেই। আগে ভাবতো মরলেই সব শেষ হবে। এখন ভাবছে মরণেও কিছু শেষ হবার নয়। শুকনো কাঠি বাক্সের মুখের ফাঁকা জায়গায় ঢুকিয়ে কয়েকবার ব্যর্থ চেষ্টা করল। একটার পর একটা বোকামি করে যাচ্ছে মৌ। চোখের জলে মুখ ভিজে যাচ্ছে। সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে ওর।
” তুমি!”
পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে মৌ চমকে তাকায়। আহসান সাহেব মসজিদে যাবেন বলে বেরিয়েছিলেন। মৌকে গেটের সামনে দেখে প্রথমে চিনতে পাননি। চেনামাত্রই হাসি মুখে এগিয়ে এসে বলেন,
” মা, মৌ। বাইরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? আসো,আসো। তুমি কী বলতো? এভাবে হুট করে চলে যেতে পারলে? আমরা কী খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছিলাম মা তোমায়?”
” না,না! আঙ্কেল এসব কী বলছেন?” মৌ নত মুখে বলে। আহসান সাহেব এগিয়ে এসে মৌ-র মাথায় হাত দিয়ে বলে,
” কী হয়েছে রে মা?”
মৌ চোখ তুলে তাকাতে পারে না। ফুঁপিয়ে ওঠে। সংকোচ ভুলে আহসান সাহেবকে জড়িয়ে ধরে। আহসান সাহেব কী বুঝে কিছুক্ষণ চুপ থাকেন। তারপর মৌ-র মাথায় হা বুলিয়ে বলেন,
” আমার ছেলেটা একটু রাগী হলেও মানুষ হিসেবে খাঁটি সোনা। বাবা বলে বলছি না। সত্যিই ও ভালো মনের মানুষ। রাগ করিস না ওর উপর। ফিরে আয় মা।”
মৌ এবার শব্দ করে কেঁদে ওঠে। মুখ তুলে বলে,
” ও আঙ্কেল, আঙ্কেল মানুষের জীবন এতো জটিল হয়ে যায় কেন? কেন সহজকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না সবসময়?”
” কী হয়েছে রে মা? বল আমাকে।”
” কিছু না।” মৌ চোখ মুছে সরে দাঁড়িয়ে বলে,
” এই ডাকবাক্সে আমার একটা চিঠি আছে, ইমরোজের জন্য। ওটা আপনি আগামীকাল প্রত্যুষের আগে ইমরোজের হাতে দেবেন না। ভালো থাকবেন আঙ্কেল। পারলে অপরাধ মার্জিনা করবেন এই পাপী মেয়েটির।”
মৌ মুখে ওড়না ঢেকে ছুটে চলে যায় আহসান সাহেবের সামনে থেকে। যতক্ষণ দৃষ্টি সীমার সামনে থেকে মৌ অদৃশ্য হয়নি আহসান সাহেব হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে ছিলেন। ঘুরে ডাকবাক্সের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন,
” বাপের কাছে মেয়ে কখনো পাপী হয়না রে পাগলি!” কথাটা বলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
আমেনা বেগম আজ শানকে যেতে দিতে নারাজ। তার কথা রাখতেই আজকের দিনটা শান থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ইমা খুশি হয়। শান নিজেও খুশি। ইমার কাছ থেকে দূরে যেতে মন সায় দিচ্ছে না ওর। এদিকে না গেলেও নয়। রাতে খেয়ে দেয়ে কিছুক্ষন গল্প করল সবাই মিলে। ইমা -শানের জন্য ইমরোজের রুম গুছিয়ে দিলেন আমেনা বেগম। ইমরোজ আজ ফিরবে না। কাজের অজুহাত দেখিয়ে আজ শানের সম্মুখে আসবে না সে। আর সবার মতো শান যদি ওর মুখটা দেখে সব বুঝে ফেলে! এই মুহূর্তে নিজের সমস্যা জানিয়ে ডিস্টার্ব করতে চায় না শানকে। তাই তো নির্ঘুম বসে রইল সেই পার্কটাতে। যেখানে প্রথম মৌ-র সাথে বসেছিল। অনুভূতিরা সবকিছু এলেমেলো করে দিচ্ছে। মৌ কে ভুলতে পারছে না। কৈশোরের আবেগের মতো প্রবল হয়ে উঠেছে মৌকে ঘিরে সকল অনুভূতি।
রাত সবে আটটা। ইমা শানের বাহুতে মাথা রেখে বুকে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। ইমার চুলে বিলি কাটতে কাটতে শান বলে,
” একদম চিন্তা করবে না। আমি প্রতিদিন কল করব। নিয়মিত ডাক্তারের কাছে যাবে,ঠিকমতো খাবার খাবে আর একদম পাকামি করবে না কোনো বিষয়ে। আন্টি যা যা বলবে তাই করবে। আমি যদি শুনেছি নিজে নিজে কোনো পাকামো করেছ?,,,,”
ইমার কান্না শুনে শান থেমে যায়। শানকে দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে ইমা। ইমার কান্না দেখে শানেরও কান্না পায়। নিজেকে কোনোমতে সামলে বিরক্তি ঝেড়ে বলে,
” আবার শুরু হলে? কত করে বুঝাচ্ছি এভাবে কাঁদবে না।”
ইমা থামে না। শানের চোখ ভরে আসে। চট করে সেটা মুছে ইমাকে কাছে টেনে কপালে চুমু দেয়। দু’হাতে ইমার চোখ- মুখ মুছে বলে,
” তুমিই তো এখন আমার শক্তি, সাহসের উৎস। সেই তুমিই যদি এভাবে ভেঙে পড়ো তবে আমি কিভাবে লক্ষ্যে পৌঁছাব? আমাদের তো এক হয়ে কাজটা করতে হবে, বলো?”
” কিন্তু আমার যে ভয় করে!”
” কিসের ভয় পাগলি?”
” আপনাকে হারিয়ে ফেলার ভয়। ও যদি আপনাকে আমার কাছে আর না আসতে দেয়? আপনি জানেন না শান, এ’কবছরে আমি কতটা অসহায় জীবনযাপন করেছি আপনাকে ছাড়া। আপনি জানেন না স্বামী ছাড়া একা একটি মেয়ের জীবনে কত ঘাত-প্রতিঘাত আসে। আপনি জানেন,,,” ইমার ঠোঁটে আঙুল রাখে শান,
” হুশশশ! আমি জানি। এমন কিছুই আর হবে না প্রমিজ। শান আমৃত্যু তোমাকে ছাড়বে না। তবে তুমি যদি বার বার অবিশ্বাস করো তাহলে আর কি!”
শান অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিতেই ইমা গলা জড়িয়ে ধরে,
” না, আর এমন করব না।”
” সত্যি তো!”
মুখ নামিয়ে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে। শান মুচকি হাসে। ইমার মাথাটা বুকে লুকিয়ে মাথায় চুমু খায়। তারপর বলে,
” আমি সুযোগ পেলেই চলে আসব তোমার কাছে।”
দু’জনই চুপ করে থেকে পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। অনন্ত কাল এভাবে একে অপরকে দেখেও বুঝি কাটিয়ে দিতে পারবে ওরা। রাত ন’টার দিকে শানের মোবাইল রিং হয়। পাশ ফিরে মোবাইল হাতে তুলতেই মুখটা কঠিন হয়ে ওঠে। ইমা তাই দেখে জিজ্ঞেস করে,
” কে?”
শান মোবাইল ঘুরিয়ে স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নাম দেখায়” সামিরা”। সহসা জ্বলে ওঠে ইমার চোখ। তীব্র কণ্ঠে বলে,
” এই কুত্তি, মাছের ঘেলু খাওয়া ছেমরি কল দিছে কেন? একটা রাতও কী দেবে না আমাদের একসাথে থাকতে!মন তো চায় ওরে কেটে কুঁচি কুঁচি করে লবন, মরিচ মাখিয়ে রোদে শুকায়। তারপর গুঁড়ো করে হাওয়ায় ভাসিয়ে দেই। বজ্জাতের উপরের বজ্জাত।” শানের হঠাৎই হাসি পায় ইমার গালাগালি শুনে। এই ইমা যতোই বলুক সে এই করবে না,সেই করবে না৷ শানতো ইমাকে চেনে। অতি আবেগে মাথা ঠিক থাকে না ওর। যতোই ওয়াদা করুক সব ভেস্তে যায় ঐ সময়। চিন্তা হয় ইমাকে নিয়ে। ইমার ঠোঁটে হাত চেপে ইশারায় চুপ করতে বললেও ইমা রাগে বিড়বিড় করে বকে সামিরাকে। শান কল রিসিভ করে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে,
” হ্যাঁ, সামিরা।”
” কোথায় তুমি শন?”
” এই তো বনানীর বাসাতেই।”
” কী বলো! কিন্তু আমি যে গত কয়েকদিন ধরে খুঁজেও তোমাকে সেখানে পেলাম না। অ্যাপার্টমেন্টের দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করতেই বলল,তুমি নাকি সেই লকডাউনের আগে থেকেই এখানে নেই।”
শান চোখ বন্ধ করে খুলে বলে,
” ওহ,হ্যাঁ। দারোয়ান ঠিকই বলেছে। সে’সময় আমি আশুলিয়াতেই ছিলাম। এই আজই এখানে এসেছি।”
” তুমি আশুলিয়াতে ছিলে, অথচ আমাকে কেন বলোনি? আমিও তোমার সাথে ঐ’কদিন একান্তে কাটাতাম। আই মিস ইউ শান।” বিষন্ন শোনায় সামিরার গলা। শান ইমার দিকে তাকিয়ে কথা ভুলে যায়। ইমা চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছে। সামান্য কথাই তো বলছে তাতেই এতো রাগের কী হলো? শান ভ্রুকুটি করে ইমাকে দেখছে। সামিরার ডাকে সম্বিৎ ফেরে।
” শান।”
” হ্যাঁ, বলো।”
” তুমি কী ব্যস্ত?” পাশে ইমা চোখের ইশারায় শানকে হ্যাঁ বলতে বললেও শান না বলে সামিরাকে। আর ঠিক তখনই ধিড়িম করে কিল বসিয়ে দেয় শানের বুকের উপর ইমা। শানের গলায় আহ! শব্দ অস্ফুটে বেরিয়ে আসতেই সামিরা চিন্তিত স্বরে বলে,
” কী হলো?”
” আর বলো না। মশা এমন জোরে বুকে কিল দিয়েছে!” ইমার গাল টেনে ধরতেই ইমা ঠোঁট উল্টায়।
” মশা কিল দিয়েছে! কী বলছ বলো তো?” সামিরা বলল। শান নিজের কপাল চাপড়ে ফের ইমার কপালে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলে,
” না, মানে। মশা কামড় দিয়েছে। আচ্ছা সামিরা কাল দেখা হবে এখন রাখছি।” ইমা গাল ফুলিয়ে বসে আছে। শান ওকেই দেখছিল। ওর দিকে এগিয়ে বসে কল কাটবে তখনই সামিরা বলল,
” শান,শান।”
” বললাম তো কাল দেখা হবে। রাখি।”
” শান আমি আসছি তোমার ফ্লাটে এখন।”
” হোয়াট! এখন। নো,নো।” সামিরা কল কেটে দেয়। শান ইমার দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় বলে,
” দিলে তো ওর মনে সন্দেহের বীজ বুনে। এখন কী হবে?”
” কী আর হবে? যান আপনার সামিরার কাছে।” মুখ ফুলিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে ইমা। রাগে শরীর জ্বলছে ওর। অনেকক্ষণ রাগে বিড়বিড় করে। ভেবেছিল শান রাগ ভাঙাতে আসবে। কিন্তু কই সে! ইমা ঘাড় ঘুরাতেই দেখে শান পোশাক পড়ে রেডি হচ্ছে। দ্রুত বিছানায় উঠে বসে ইমা। কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,
” বলেছি বলে কী সত্যিই চলে যাচ্ছেন ওর কাছে?”
” রাগ করে না লক্ষী বউ আমার। এছাড়া উপায় নেই। তুমি ফিরেছ এ’কথা কিছুতেই জানানো যাবে না ঐ উন্মাদিনীকে। তোমার এবং আমাদের অনাগত বাচ্চার সুরক্ষার জন্য এটা আমাকে করতেই হবে। ভালো থেকো। রোজ কল করব। আসি।” ইমাকে জড়িয়ে আদর করে উঠে দাঁড়াতেই ইমা হাত টেনে ধরে,
” শান প্লিজ যেয়ো না।”
শান এগিয়ে এসে ইমার কপালে চুমু দিয়ে বলে,
” প্লিজ বোঝো আমাকে। বিশ্বাস রাখো সব ঠিক করে ফিরে আসব।” শান দরজায় এসে আবার ঘুরে দাঁড়ায়। ইমার কান্নাসিক্ত মুখের দিকে তাকাতেই ওর ভীষণ কষ্ট হয়। সেই কষ্ট লুকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
” আজকের রাত আমার কাছে বিশেষ। কেন জানো? কারণ আজ আমাকে তুমি ” তুমি” করে সম্বোধন করেছ। এই রাতের জন্য হলেও আমি তোমার কাছে ফিরব ইমা, ইনশাআল্লাহ।”
শান চলে যায়। সেদিকে অপলক চেয়ে চেয়ে কাঁদে ইমা। অভিমানে বুক ভারী হয়ে ওঠে। আমেনা বেগম এসে সান্ত্বনা দিয়ে নিয়ে গেলেন আশার রুমে। আশা অনেক কথায় বলল যার একটাও শুনল না ইমা। নীরবে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদল সারাটি রাত।
পানির ঝাপটা মুখের উপর পড়তেই চোখ মেলল মাহিব। মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে। দু-টো পা হাতুড়ির বাড়িতে থেঁতলে গেছে। ব্যথায় গোঙানি বের হচ্ছে গলা দিয়ে। সামনে হাতুড়ি হাতে দাঁড়িয়ে হাসছে মৌ। এই মৌ-কে মাহিব চেনে না। যদি ঘূর্ণাক্ষরেও মৌ-য়ের আসল রূপ বুঝতে পেত, তবে আজ এদিন দেখতে হতো না। এতো অসহায় হতো না এই তুচ্ছ নারীর সামনে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে চেঁচিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল দেয় মৌকে সে। ভালোবাসার দোহায় দিয়ে তিরস্কার করে। মৌ অবিচল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে সেসব শোনে। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে যায় রুমের বাইরে। যখন ফেরে হাতে দু’গ্লাস ওয়াইন। মাহিব তীক্ষ্ণ চোখে গ্লাস দু’টো দেখছে। বা’হাতের গ্লাসটা মাহিবের সামনে রেখে অন্যটা হাতেই রাখল মৌ। মাহিবের দিকে তাকিয়ে চোখ-মুখ শক্ত করে হাতের গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে হাতুড়ি তুলে নিল। মাহিব ভয়ার্ত স্বরে চেঁচাতে লাগল,
” না, না মৌ, না।”
এই আর্ত অনুনয় মৌ শুনল না। পাগলের মতো হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করছে মাহিবকে। শরীরের বিশেষ বিশেষ স্থান থেঁতলে দিয়েছে হাতুড়ির আঘাতে। রক্তে শরীর ভিজে গেছে। গলা স্বর নেমে গেছে। কথা বলতে পারছে,শরীর অসাড় হয়ে পড়েছে মাহিবের। মৌ ওর হাতের বাঁধন খুলে চুল মুঠ করে টেনে ধরে বলে,
” কিরে কুত্তার বাচ্চা, কেমন লাগছে? মেয়ে দেখলেই হুশ থাকে না। শুতে ইচ্ছা করে? তারপর মন ভরে গেলে খুন করে পথ থেকে সরিয়ে দিস। কথা বল। বলিস না কেন কথা? তোর জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে ফেলব কথা না বললে।” মাহিব অসহায় চোখে আর্তি জানায়। মৌ ওর মুখ বরাবর হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি দিতেই দাঁত ভেঙে,ঠোঁট কেটে রক্তে ভরে যায়। তাতেও থামে না মৌ। রক্তের নেশা পেয়েছে আজ ওর। মৌ বলে,” আমি আজ নিঃস্ব, রিক্ত৷ সব তোর জন্য। তোর কারনে নিজের উপর ঘেন্না হয় আমার। তুই আমাকে ছুঁয়েছিস এই হাতে। ভাবলেই কী করতে ইচ্ছা যে করে।” রাগে পাগলের মতো হাঁটে মাহিবের সামনে। থেমে আবার ঝুঁকে পড়ে মাহিবের দিকে,” আমার বোনকে মেরেছিল এই হাতে, তাই না? আমার বোন কে জানিস তো? আয়ুশী।মনে পড়েছে? তোর এই হাত আমি রাখব না মাহিব খান।” হাতের হাড্ডি গুঁড়ো,গুঁড়ো হয়ে না যাওয়া অব্দি হাতুড়ি চালায় মৌ। হাঁফাতে হাঁফাতে বলে,” কী ভেবেছিলি? ইমরোজকে আমি মারব। তারপর আমাকে তুই মারবি তাই না?” মাহিব অজ্ঞান হয়ে গেছে৷ মৌ -র হুশ নেই। ও বলেই চলেছে।”ইমরোজকে আমি মারব না। ওর দিকে যে চোখ তুলে তাকাবে তাকেও বাঁচতে দেবো না। ও আমার। ইমরোজ আমার। আমার বাবা- মা,আয়ুশীর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করব আমি। আর তারপর ইমরোজ আমার হবে। আমার!” অচেতন মাহিবকে জাগাতে ব্যর্থ হয়ে টেবিলে রেখে দেওয়া ওয়াইনের গ্লাসটা তুলে নিল। মুখে ছুড়ে মারতেই মাহিব চোখ মেলল। মুখ বিকৃত করে মৌ বলল,” শেষ বার মদের স্বাদ গ্রহণ কর,নে।” গ্লাসের বাকিটুকু জোর করে মাহিবকে পান করাল।
মুমূর্ষু অবস্থা মাহিবের। ঐ অবস্থায় রাত্রির অর্ধেক পর্যন্ত মৌর অত্যাচার সহ্য করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। মৌ হাঁফাতে হাঁফাতে বসল মাহিবের সামনের চেয়ারে। নিজেকে আজ বড্ড অচেনা মনে হচ্ছে। যেন কোনো পিশাচী শক্তি ভর করে ওর উপর। গলাটা শুকিয়ে আসে এতোক্ষণে। মাহিবের সামনে থেকে চট করে গ্লাসটা তুলে নেয়। ঢকঢক করে সেটা গলায় ঢেলে তৃপ্তির হাসি হাসে। সম্মুখে মাহিবের বিভৎস লাশটা মৌকে শান্তি দেয়। উঠে গিয়ে খাবার গরম করে প্লেটে নিয়ে আবার ফিরে আসে। লাশটার দিকে চেয়ে চেয়ে খায় আর বলে,
” তোর মৃত্যু আরো ভয়াবহ হতে পারত কিন্তু কী আর করার! আমার যে খুব তাড়া। ইমরোজকে আমি অপেক্ষা করাতে চাই না৷ অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যা হয় হোক! ইমরোজকে আমার চা-আ-য়।” মৌ-র গলা জ্বলে। পেটে অসহনীয় ব্যথা শুরু হয়। খুঁক খুঁক করে কাশে। কিছুক্ষণ পর গলা দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসতে দেখে হুশ ফেরে। চোখ ঘুরিয়ে টেবিলে রাখা গ্লাসটার দিকে তাকায়। হায়ঃহায়ঃ করে ওঠে। একি করেছে হুশ হারিয়ে! যে গ্লাসে মাহিবের জন্য বিষ মিশিয়ে এনেছিল তাই পান করে নিল সে। মৌ ছুটে বেরোতে চায় কিন্তু সহসা পারে না। সামনে অন্ধকার হয়ে আসে। মোবাইল খুঁজতে থাকে। সেটাও মেলে না। বহুকষ্টে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে পড়ে। রাতের শেষাংশ। শুনশান নীরবতা চতুর্দিকে। জনমানবহীন শহরের পথে কাতর হয়ে অস্ফুটে সাহায্য চাচ্ছে। বাঁচার সাধ তাকে মরতে দিতে চায় না। বাঁচার আকুতি জানায় শূন্যে চেয়ে। সেই আকুতি ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসে চারপাশের আঁধারের সাথে।
চলবে,,,