তুমি অতঃপর তুমিই পর্ব:-১৪

0
2237

তুমি অতঃপর তুমিই
৩২
Taniya Sheikh

মাথার উপর টিমে টিমে তারা জ্বলা আকাশ। ভরা পূর্ণিমার রাত। ঝিঁঝি পোকারা ডেকে চলছে অবিরাম। শানের বুকে মাথা রেখে বসে আছে ইমা ছাঁদে,দোলনার উপর। অদূরে যতদূর চোখ যায় বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি তারপরেই ঝোপঝাড়। তারমধ্যে বুনো গাছের সারি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। জোস্না নেমেছে সেখানে। জোনাকিপোকা জ্বলছে আর নিভছে। চোখের সাথে সাথে মনটাও জুড়িয়ে আসে। থেকে থেকে দমকা বাতাসে ইমার শরীর সংকুচিত হয়। গুটিশুটি মেরে আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে শানের বুকে। শান দু’হাতে পরম ভালোবাসায় আঁকড়ে ধরে আছে। এক একবার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, কপালে আলত করে ঠোঁটের উষ্ণ পরশ দেয়৷ ইমার ভালো লাগে তখন। বিড়াল ছানার মতো নড়েচড়ে আবার চুপ হয়ে যায়।

” ইমা।”

” হুম।”

” চলো রুমে যাই।”

” কেন?” ইমা মুখ তোলে। শান ওর নাকে আলতো চুমু দিয়ে বলে,

” নাকটা পর্যন্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। অসুখ করবে তো এভাবে বাইরে রাত কাটালে।”

ইমা আয়েশ করে বুকে মাথা রেখে মৃদু হাসে।

” না, অসুখ করবে না। আপনি আছেন না! আপনি পাশে থাকতে আমার কিছু হবে না।”

” এতো বিশ্বাস?”

” হুমম। অনেক।”

” যদি এই বিশ্বাসের মর্যাদা না রাখি আমি?”
ইমা হঠাৎ নীরব হয়ে যায়। শান ঠোঁট কামড়ে শব্দ করে শ্বাস নেয়-ছাড়ে। বলে,

” কী হলো, জবাব দিলে না যে?”

ইমা সরে বসে। একদৃষ্টে সামনের আকাশে চেয়ে আছে। শান অপলক দেখছে ইমাকে। পূর্ণিমা চাঁদের আলোয় বিধৌত ইমার মুখশ্রী। প্রেগন্যান্সির সময় নাকি মেয়েদের সৌন্দর্য অন্যরকমের আলো ছড়ায়। শানের মনে হয় এ আলো পূর্ণিমার আলোর চেয়েও সুন্দর। ইমার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু আগে বলা কথাগুলো ভুলে গেল। ইমা কিন্তু ভুললো না। মেয়েরা অনেক কিছুই সহজে ভোলে,আবার অনেক কিছুই আমৃত্যু ভোলে না। ইমা দৃষ্টি ঘুরিয়ে শানের দিকে তাকায়। পরস্পরের চোখে হারায় কিছুক্ষণ। ইমা চোখ নামিয়ে নিতেই শানের তন্ময়তা কাটে। ইমা ধড়া গলায় বলে,

” আমি জানি আমি ভুল করেছি। আমার উচিত ছিল আপনার মুখোমুখি হওয়া কিন্তু পরিস্থিতি আমাকে সে অবসর দেয়নি। হয়তোবা আমি নিজেও নিজেকে সেটা দিতে চাইনি।” ইমা চোখ তুলে তাকায়। শান স্থির দৃষ্টিতে ওকে দেখছে। ইমার চঞ্চল চোখ দু’টো কেমন জ্বলতে লাগে। ইমা ঢোক গিলে বলে,

” আমরা যতই বলি এই করব, সেই করব কিন্তু দেখা যায় উপযুক্ত সময়ে কিছুই করা হয়না৷ প্রিয় মানুষ কষ্ট দিলেও মুখ ফুটে সম্মুখে দাঁড়িয়ে তাকে কিছুই বলা হয়না। অভিমান কণ্ঠরোধ করে দেয়। একমন তাকে কষ্ট দেবে বলে স্থির করলেও আরেকমন চায় সে ভালো থাকুক। আমার ক্ষেত্রে এমনটাই হয়েছে। আমি আপনাকে ঘৃণা করব স্থির করেও দিনকেদিন আরও বেশি ভালোবেসেছি। আপনার শূন্যতায় রাতের পর রাত কেঁদেছি। যদিও আমি তখন জানতাম আপনি আমাকে ঠকিয়েছেন,আমার,,,!” ইমার কণ্ঠস্বর কেঁপে ওঠে। শান অবিচলিতভাবে বসে আছে সামনে। ইমা নিজেকে সামলে নাক টেনে লম্বা শ্বাস নেয়। তারপর আবার সামনের তারাভরা আকাশটার দিকে তাকায়। মৃদু হেসে বলে,

” আপনি যদি আমাকে মেরেও ফেলতেন তবুও আমার মন আপনাকেই ভালোবাসত, শান। ভালোবাসা এমনই হয়। ভালোবাসলে ঘৃণা করা যায়না,অভিমান করা যায় শুধু। তবে হ্যাঁ, ঠকালে বিশ্বাস শব্দটা আর অবশিষ্ট থাকে না। বিশ্বাস ছাড়া ভালোবাসা কেবল শব্দ মাত্র। ভালোবাসার নামে তখন প্রহসন হয়। কারো প্রহসনের পাত্রী হবার আগে মৃত্যু শ্রেয় মনে করি।” ইমা মুখ ফিরিয়ে নিতেই বুকে টেনে নেয় শান।

” আমি মরে গেলেও জানবে এ দেহের শেষ অংশটুকু মাটিতে মিশে যাবার আগেও তোমাকে স্মরণ করেছে,তোমাকে ভালোবেসেছে। আমার অজান্তেই যে কষ্ট তোমাকে আমি দিয়েছি তার প্রায়শ্চিত্ত আমি কী করে করব? কী করে নিজের মনকে শান্তি দেবো,স্বস্তি দেবো? আমি নিজেকে কথা দিয়েছি সরল পথে চলব, কিন্তু কী করে? আমার আশপাশটা গরলে ভরা। আমি সেসব এড়িয়ে যেতে পারি না৷ আশপাশের জঞ্জাল আপনা আপনিই সরে না। সেটা সরাতে হয়। নয়তো বাড়তে বাড়তে সবকিছু নোংরা করে দেয়।”

ইমা অশ্রুসিক্ত মুখতুলে বলে,

” এসব কেন বলছেন?”

শান ইমার চোখ- মুখ মুছে বলে,

” সব বলব তোমাকে। তার আগে কথা দাও দুঃশ্চিন্তা করবে না।” ইমা সামান্য মাথা নাড়ায়। শান ওর মাথাটা বুকের উপর রেখে হাত বুলায়। জোনাকিরা এসে ভীর করে চারপাশে। শান কথা শেষ করতেই ইমা ভীত চোখে তাকায়। দু’হাতে জোনাক বন্দি করে মুঠোটা ইমার মুখের সামনে এনে বলে,

” আলোটুকুকে কিছুসময়ের জন্য ঢাকতে চাই। তারপর ঠিক এভাবেই আলোয় আলোয় ভরিয়ে তুলবো ভুবন তোমার- আমার।” শান মুঠো খুলে জোনাকিপোকা ছাড়ে। আলোকিত করে তোলে জোনাকিপোকারা চারপাশ। ইমার কোলে মাথা রেখে শান বলে,

” জীবনে অনেক কিছু সয়েছি মুখ বুঝে, আর না। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করলে সেটা বাড়তেই থাকে। এড়িয়ে গিয়েও তা থেকে নিস্তার পাওয়া যায়না।” শান থেমে আবার বলে,” অতীত অন্যায়ের সব আমি শুধরাতে পারব না তবে যতটুকু পারা যায় তার চেষ্টা করব। চেষ্টা করব আমাদের ভবিষ্যতে সুন্দর করার। তোমার সাহায্য ছাড়া যা সম্ভব না,ইমা।”

মনে মনে ইমা চিন্তিত হলেও শানকে অভয় দেয়,সাহস যোগায়। পরদিন সকাল, সকাল ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে ওরা।

ইমরোজের পরিবারের ভীষণ পছন্দ হয়েছে রাত্রিকে। ছেলের নিষেধ উপেক্ষা করে আমেনা বেগম আংটি পড়িয়ে পাকা কথা দিয়ে এসেছেন। বাসায় এসে এ নিয়ে খুব কথা কাটাকাটি হয়েছে মা -ছেলের মধ্যে। ইমরোজ স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে এ বিয়ে সে করবে না। আমেনা বেগম চড়া গলা জিজ্ঞেস করেছেন,” কেন করবি না? তুই তো কথা দিয়েছিলি বিয়ে করবি বলে।তাহলে এখন কেন এমন করছিস?” এখানে কথা শেষ হতে পারত কিন্তু রাগের বশে আমেনা বেগম হঠাৎই বলে বসলেন,

” জানি তো কেন এমন করছিস!”

ইমরোজ যেন চমকে তাকাল মায়ের কথার ধরন শুনে। কঠিন দৃষ্টিতে চেয়ে প্রশ্ন করল,

” কেন করছি?”

আমেনা বেগম পুত্রের মুখ চেয়ে হঠাৎই শান্ত হয়ে যান। কী বলতে কী বলে ফেলছিলেন ভাবতেই চুপসে যান। আমেনা বেগম যেমন ছেলের মুখ দেখে মনের খবর বলতে পারেন,ইমরোজও ঠিক তাই। সে মায়ের হঠাৎ চুপসে যাওয়াটা স্বাভাবিক ভাবে নিল না। মনে যা আছে তা তো সে প্রকাশ করেনি তবে কেন সে কথা উঠবে? যা মনের এককোনে দাফন করে ফেলেছে তাকে এরা কেন খুঁড়ল? রাগে মুখ রক্তিম হয়ে ওঠে। শান্ত, গম্ভীর প্রকৃতির ইমরোজ অশান্ত হয়ে ওঠে। রাগে ঘনঘন নিঃশ্বাস পড়ে। কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না যেন। সামনে রাখা এন্টিকের ভাজটা তুলে আছাড় মারল।সাথে সাথে টুকরো টুকরো হয়ে সেটা ছড়িয়ে পড়ে লিভিং রুমে। আহসান সাহেব,আশা হতবিহ্বল। আমেনা বেগম নত মুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন৷ ইমরোজ চলে যায়। ভাজ ভাঙার বিকট শব্দ শুনে পাশের রুমে শুয়ে থাকা আশার বাচ্চা মেয়েটা ভ্যা ভ্যা করে কান্না জুড়ে দিল। আশা ছুটে যেতে যেতে মা’কে উদ্দেশ্য করে বলল,
” সবাই শুধু আমার ভাইটাকে ব্যথা দিতে মুখিয়ে থাকে।” আমেনা বেগম ব্যথিত চোখে মেয়ের যাওয়ার দিকে একবার তাকিয়ে স্বামীর দিকে তাকান।স্ত্রীর উপর রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রুমে চলে যান আহসান সাহেব। স্বামী যেতেই উু উু করে নাক টেনে টেনে আমেনা বেগম বলেন,

” হ্যাঁ, আমি তো ইমরোজের শত্রু। সবাই এখন আমাকেই দোষ দাও। আমার কী কষ্ট হয়না ওর মুখ দেখলে। মায়ের মন তোমরা কী বুঝবে?”

আমেনা বেগম যাওয়ার আগে হবু পুত্রবধূ রাত্রিকে ছেলের মোবাইল নাম্বার দিয়ে এসেছিল। ওর কাজিনরা মিলে রাতে খুব করে ধরেছে কল করার জন্য। রাত্রির খুব লজ্জা করছে, সে না,না করছে। ওর এক কাজিন এজন্য কটাক্ষ করে বলল,

” অনার্স শেষ করবি দু’দিন পর এখনো তোর লজ্জা গেল না। তোর মতো এমন ব্যাকডেটেড মার্কা মেয়েকে তারা পছন্দ করল কিভাবে বুঝলাম না।” রাত্রির এই কাজিনটা প্রচন্ড হিংসুক প্রকৃতির। পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তার সাথে বোনের বিয়ে হবে এ যেন কিছুতেই হজম হচ্ছে না৷ রাত্রি সুন্দরী শিক্ষিতা হলেও অতোটা আধুনিক ধাঁচের মেয়ে নয়। সব কাজিনদের যেখানে গণ্ডা,গণ্ডা ছেলেবন্ধু, মেয়েবন্ধু সেখানে ওর হাতেগোনা দু-একজন মেয়ে বান্ধবী আছে। জন্ম থেকে ঢাকা থেকেও স্কুল,কলেজ ভার্সিটি ছাড়া আর কোথাও চেনে না সে। তার গণ্ডির বাড়ির চারদেয়ালেই সীমাবদ্ধ। এসব কারনেই কাজিনরা সুযোগ পেলেই ওকে ছোট করে,মজা করে। আর আজ তো সুযোগটা সোনায় সোহাগা। এক কাজিন জোর করে মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে কল লাগিয়ে দিল। ও পাশে কয়েকবার রিং হতেই ইমরোজ রিসিভ করে। রাত্রির এক কাজিন নিজেকে রাত্রি বলে পরিচয় দিল। পাশে দাঁড়ান রাত্রি লজ্জায় লাল হয়ে আছে। বুক ধুকপুক করছে ওর৷ সব কাজিনরা গোল হয়ে বসে লাউডস্পিকার দিয়ে শুনতে লাগল। ইমরোজ জানে না তার হবু স্ত্রীর নাম। যাকে বিয়েই করবে না বলে ভেবেই নিয়েছে তার নাম জানার আবশ্যকতা আছে কী! সে সোজাসাপ্টা জবাব দিল এ নামের কাওকে সে চেনে না। রাত্রির কাজিনরা ধরে নিল হবু জিজু বউয়ের সাথে মস্করা করছে। সরাসরি রাত্রি এবং তার সম্পর্কের কথা বলে হবু স্ত্রীর নাম না জানায় তিরস্কারের সুরে কথা বলল। ইমরোজ এবার বুঝতে পারল। একটু আগের ঘটনায় মেজাজ এমনিতেও খারাপ তার উপর এই মেয়ের তিরস্কারে চটে গেল। রাত্রি ভেবে ওর কাজিনকে সরাসরি বলে দিল,সে এমন অভদ্র, গায়ে পড়া মেয়েকে বিয়ে করবে না। রাত্রি যেন তার পরিবারকে এ বিষয়ে জানিয়ে দেয়। ইমরোজ কল কেটে দেয়৷ কাজিনরা মুখ চাওয়া- চাওয়ি করে আস্তে করে উঠে চলে যায়। রাত্রির কান্না পায়। কী এমন বলেছে ওর কাজিনরা! একটু দুষ্টুমিই করেছিল না হয়। তারজন্য এমন ব্যবহার! কিছুক্ষণ পরই আত্মীয় স্বজনরা জেনে গেল রাত্রির হবু বর রাত্রিকে কী বলেছে। এতোদিনের ভালো মেয়েটাকে সবাই আজ করুনার চোখে,বাঁকা চোখে দেখছে। রাত্রির বাবা- মা মেয়েকে বকেছে। তাঁদের ধারণা দোষ রাত্রিরই। সব দোষ মাথায় নিয়ে সেদিন কেঁদে কেঁদেই পার করেছে রাত্রি।

মানুষের শক্তি ক্ষণস্থায়ী। এই আছে তো এই নেই। তা স্বত্বেও মানুষের অহংকারের শেষ নেই। বোধবুদ্ধির কথা না হয় বাদই দিলাম। যেখানে নিঃশ্বাসের বিশ্বাস নেই সেখানে পাপের পর পাপ করেও কারো ভেতর মৃত্যু ভয় জাগে না,জাগে না পরকালের চিন্তা। মাহিবের গুলি লাগা পা-টা ক্রমেই শুকিয়ে যাচ্ছে। যথাসাধ্য চিকিৎসা করানোর পরও কোনো উন্নতি ঘটছে না। হুইলচেয়ারের সাহায্যে নড়াচড়া করতে হচ্ছে এখন। পৃথিবীর বুকে দাপিয়ে বেড়ানো মাহিব খান আজ চলতে-ফিরতেও পারছে না সাহায্য ছাড়া৷ এতোকিছুর পরও লোভ,লালসা কিছুমাত্র কমেনি। কেউ যথার্থ বলেছে, ইল্লত যায় না ধুলে,স্বভাব যায় না মলে। নিজের এই পরিণতি জন্য সামিরাকে দোষী করে মাহিব। আর তাই মৌ-কে নয় সামিরাকে এখন চায় সে। এই অক্ষম জীবনটা সামিরাকে পেলেই সাচ্ছন্দ্যে কেটে যাবে। কিন্তু সামিরা তাকে মানবে কেন? সামিরাকে নিজের করতে প্লান কষে ভেতরে ভেতরে। পথের কাঁটা শানকে সরাতে পারলেই সামিরা ওর। এদিকে মৌ-কেও এতোদিন বউ করবে বলে স্বপ্ন দেখিয়েছে। মেয়েটার হাবভাবও ভালো ঠেকছে না। কেমন সাধারণ মেয়েদের মতো বিহেভ করছে ইদানীং৷ মাহিবের মনে হয়,মৌ সহজে হয়তো ছেড়ে যাবে না। সুতরাং ওকেও রাস্তা থেকে সরাতে হবে। এই সময় যদি শামীমটা পাশে থাকত! মাহিবের মনটা কেমন অসহায়বোধ করে। সাথে সাথে সেটা নিভে গিয়ে একরাশ ক্ষোভ জন্মে ইমরোজের উপর৷ মৌ-কে দিয়েও যখন কিছু করা গেল না তবে অন্য পথ ধরতে হবে। সবকিছু ভেসে যাওয়ার আশঙ্কায় মাহিব যেন বদ্ধপাগল হয়ে ওঠে। টিকে থাকার জন্য সব ধ্বংস করতে রাজি সে।

মৌ অনেকক্ষণ ইতস্তত করে শেষমেশ চিঠিটা ডাকবাক্সে ফেলল। কেউ দেখার পূর্বেই দ্রুত পদে সেখান থেকে চলে এসে গলির ভেতর হাঁটতে শুরু করে। কিছুদূর গিয়ে ওর মনে হয় চিঠিটা ডাকবাক্সে না ফেললেই ভালো হতো। ইমরোজ কী ভাববে! সে তো আর মৌকে ভালোবাসে না। ভালোবাসা! তার যোগ্যতা কী ইমরোজের মতো মানুষের ভালোবাসা পাবার। একটা খারাপ মেয়েলোক। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে যে সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছে ঐ পশুটার কাছে। মৌ-র চোখ জ্বলে। আস্তে আস্তে চোখের কোনায় জল জমা হয়। আবার পিছনে ঘুরে দাঁড়ায়। চিঠিটা যে করেই হোক নিয়ে আসতে হবে। মৌ আবার ইমরোজের বাসার দিকে হাঁটে।

শান ইমাকে ইমরোজের বাসায় রাখার জন্য এসেছে। ইমরোজের সাথে ওর এ বিষয়ে কথা হয়েছে। ইমরোজই ইমার নিরাপত্তার কথা ভেবে এখানে রাখার পরামর্শ দেয়। আমেনা বেগম, আহসান সাহেব শানকে সন্তান তুল্য জ্ঞান করেন। ইমাকে পেয়ে তারা ভীষণ খুশি। ইমারও ভালো লাগে এদের৷ আশার মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করছিল ইমা। আঙ্কেল আন্টির সাথে কথা শেষ করে শান আশার রুমে টোকা দিতেই আশা অভিমানি কণ্ঠে বলে,

” আসেন মহারাজা শান নিহান খান। আজকাল আপনার দেখা তো দূরের কথা খবরটাও পাইনা। এতো পাষাণ তুমি শান ভাই।”

শান ওর মাথায় হালকা চাপড় মেরে ইমার পাশে গিয়ে বসে। আশা ঠোঁট উল্টে ইমাকে বিচার দেয়। ইমার কাঁধে থুঁতনি ভর দিয়ে বাচ্চাটার গালে আলতো আদুরে পরশ দিতে দিতে শান বলে ,

” এক বাচ্চা মা হয়েও তোর ফাজলামি কমে নাই দেখছি।”

” আর আপনি এক বাচ্চার মামা,আরেক বাচ্চার হবু বাবা হয়েও ভাব নেওয়া কমান নাই।” শান হতবুদ্ধি হয়ে ইমার মুখের দিকে তাকাতেই আশা ফিক করে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

” ইমা ভাবি ইউ আর গ্রেট। তোমার ওয়াও মার্কা ডায়লগ শুনে আমার শান ভাই টাস্কি খেয়ে গেছে। আম্মু, ও আম্মু তোমার ছেলের বউ তো মার্কামারা।” আশা রুমে ছেড়ে বেরোতেই শান ইমার গাল টেনে ধরে,

” ওর সামনে ওটা বললে কেন?”

” আহ! লাগছে শান, গাল ছাড়েন ।”

” না, আমার মান ইজ্জতের ফালুদা বানিয়ে ছাড়েন বললেই কী ছেড়ে দেবো?” ইমার কোলের বাচ্চা সহ জড়িয়ে ধরে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। ইমার শরীরে সুরসুরি দিতে দিতে অস্থির করে তোলে। ইমা হাসতে হাসতে কোলের বাচ্চাটাকে সাবধানে দূরে শুইয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,

” শান করছেন কী? আপনি ভুলে গেছেন আমি প্রেগন্যান্ট?”

” না,ভুলিনি৷ এই এক কথা বলে পার পাবা না। আশার সামনে ওটা কেন বললে? সরি বলো।”

” না,সরি বলব না। যা সত্যি তাই বলেছি। ভাবে বাঁচেন না আবার বললে দোষ।” শান সুরসুরি থামাতেই ইমা জোরে জোরে হাঁফায়। ইমার গাল চেপে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে শান বলে,

” ভাব দেখাই? ” ইমা মাথা নাড়িয়ে” হ্যাঁ”বলে ঠোঁট টিপে হেসে। শান মুখ নামাতে নামাতে বলে,

” আবার বলো।”

পরিস্থিতি সুবিধাজনক না বুঝে ধাক্কা দিয়ে শানকে সরিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,

” আশা দেখো তোমার ভাই কী করে।”

” এই,এই চুপ।” শান ইমার মুখ চেপে ধরতেই ইমা ভ্রু নাচায়। শানের গলা জড়িয়ে ধরে চোখ পিটপিট করতেই সমস্বরে দু’জনই হেসে ওঠে পাশাপাশি শুয়ে। কিছুসময় পর শান হাসি থামিয়ে ইমার হাসতে থাকা মুখটা দিকে তাকিয়ে আছে৷ এক হাতে ভর দিয়ে কাঁত হয় ইমার দিকে। ইমা তাকাতেই ইমার গলায় মুখ লুকিয়ে দু’বাহুতে জড়িয়ে ধরে বলে,

” তোমাকে ছেড়ে কী করে থাকব আমি,ইমা!” ইমার হাস্যোজ্জ্বল মুখে সাথে সাথে একরাশ বিষন্নতার ছায়া ভর করে। দু’জনের কেউ আর কথা বলে না৷ পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে শুয়ে থাকে নীরবে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here