#চাঁদের_কলংক ( ১১)
#রেহানা_পুতুল
শয়ন সপাটে দরজা খুলে ফেলল।
দু’পা এগিয়ে রুমে ঢুকল। চোখ লাল করে ধমকে উঠল তন্দ্রাকে। বলল,
” রাতের আঁধারে যে বাইরে বের হতে পারে। দুঃসাহসের মতো কাজ করতে পারে। বিদুৎতের আলোয় তাকে ভয় পাওয়া মানায়? ”
তন্দ্রা ভ্যাবাচেকা খেয়ে উঠলো। ঝিমানো চোখে পিটপিট করে চাইল শয়নের দিকে।
শীতল গলায় বলল,
” কি বললেন বুঝিনি? ”
” ন্যাকামি হচ্ছে! বুঝনি নাহ! জাস্ট ডিজগাস্টিং!”
” আমি ডিজগাস্টিং বলেইতো আপনার থেকে দূরে চলে গিয়েছি। বাবা আদেশ করল। তাই আসলাম। নয়তো ভুলেও আপনার দুয়ারে আমার পা পড়তনা। মনে রাখবেন।”
শয়ন জবাব না দিয়ে ভারি ভারি পা ফেলে রুম থেকে বের হয়ে গেল। কারণ তন্দ্রার কথা একবর্ণ ও মিথ্যে নয়। চেয়ারম্যান কামরুল মির্জাই তাকে আনিয়েছে নিজের সুবিধার্থে।
মনটা আবারো নীল বেদনায় ছেয়ে গেল তন্দ্রার। এফোঁড়ওফোঁড় করে চিন্তা করেও কোন কূল কিনারা করতে পারলনা। শয়ন কি আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ল নাকি। কেন বলল অমন কথা। আবার বাবাও সেদিন অমন কিছু বলল।
এমনিতেই দুঃশ্চিন্তায় রাত হলেও ঘুম আসেনা। ভাবতেই দুচোখে যেন অমানিশার অন্ধকার নেমে এলো তন্দ্রার। আদিলের ফোনের মেসেজ ও ভিডিও ক্লিপ না জানি প্রকাশ হয়ে যায়।
অনেক ক্ষুধা লেগে গেল। তাই মন না চাইলেও রাতে খেতে হলো তন্দ্রার। খেয়ে শায়নার সাথেই ঘুমিয়ে গেল। শয়নের মা বাবা সেটা জেনেও চুপ করে রইল। তারা সময়ের উপর ছেড়ে দিয়েছে। তাদের অগাধ বিশ্বাস সময় আবার বিয়ের আগের জীবনের মতো শয়ন ও তন্দ্রাকে এক করে দিবে। মিলিয়ে দিবে।
শায়নাও মনে মনে তাই ভাবে। আবারো ভাই ভাবির প্রেমাঙ্গন মুখরিত হবে আলুথালু ভালোবাসায়।
আজ সকাল থেকেই কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটাভুটি চলছে। রুদ্ধশ্বাসকর টানা উত্তেজনা বিরাজ করছে মির্জা পরিবারের সবার মাঝে। কামরুল মির্জা একবার বের হয়ে নিকটস্থ কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করে আসলেন। শয়ন পিতার জন্য সকাল থেকেই কেন্দ্রে কেন্দ্রে ছোটাছুটি করছে। সবদিকে বিশেষ নজর রাখছে। কোন কারচুপি যেন না হয়। দৌড় ঝাঁপে তার সাথে ছিল এলাকার কিছু বন্ধু। বাবাকে ফোন করে করে আপডেট জানাচ্ছে।
তন্দ্রা জোহরের নামাজের মোনাজাতে নিজের জন্য ও শশুরের জন্য স্রস্টার কাছে প্রার্থনার হাত তুলল। উনার সম্মান যেন অক্ষুণ্ণ থাকে। সবকিছু যেন আগের মতো হয়ে যায়। নিজেকে যেন স্রস্টা আরো ধৈর্যশীল করে তোলে। সে শশুর,শাশুড়ীকে নিজের বাবামায়ের মতই ভালোবাসে। শ্রদ্ধা করে। শায়নাকে ভালবাসে বোন তনুর মতই।
রেজাল্ট ঘোষণা হলো অবশেষে। প্রতিদ্বন্ধীর সাথে প্রায় হারতে হারতে বরাবরের মত উল্লসিত ধ্বনিতে ঘোষণা হলো সাবেক চেয়ারম্যান কামরুল মির্জার নাম। রাস্তায় দলে দলে মিছিল শুরু হলো কামরুল মির্জার নামে বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে।
ঘরের সবাই কামরুল মির্জাকে জড়িয়ে ধরলো। আনন্দাশ্রু সবার চোখে। তন্দ্রা রুমের দরজা বন্ধ করে ঝটপট একটি সুতী শাড়ি পরে হালকা সেজে নিল।
শাশুড়ী রাতেই বলে দিয়েছে, এনাউন্সমেন্ট শুনেই শাড়ি পরে রেডি হয়ে যেও। লোকজন আসবে। তোমাকে হয়তো দেখতে চাইবে।
তন্দ্রা হাসি হাসি মুখে ছুটে এসেই,
‘ বাবা কংগ্রাচুলেশনস ‘ বলে শশুরকে পা ছুঁয়ে সালাম দিল। তার দেখাদেখি শায়নাও সালাম দিল বাবাকে। তিনি তন্দ্রা ও শায়নাকে বুকের দুপাশে জড়িয়ে নিলেন । মাথায় আশির্বাদের পরশ বুলিয়ে দিলেন। তন্দ্রার মন ভালো হয়ে গেল। মাথায় এই মুহুর্ত শুধু উপস্থিত আনন্দের উপচানো সুখ। কর্পূরের ন্যায় উড়ে গেল নিজের নিজের সমস্ত অভিমান,অনুযোগ, দুঃখ।
আনন্দে গদগদ কন্ঠে শাহিদা বেগম বললেন ,
” এই বৌমা পারলে তুমি আর শায়না রান্নাঘরে যাও। সব প্রস্তুতি আগে থেকেই নেওয়া আছে। এখন শুধু রান্না হবে। শেফালীর সাথে কালুর মাও আছে রান্নাঘরে। আমি আসতেছি। শয়ন ফোন দিয়ে বলছে। তার সাথে যে কজন ছিল। সবাই রাতে আমাদের বাসায় খাবে। দুধ চা হবে ত্রিশ চল্লিশ কাপের হিসেবে। ”
” আমরা যাচ্ছি মা । এই রাই আয় জলদি। মা আপনি চিন্তা করবেন না। টাইমলি সব ঝটপট হয়ে যাবে। ”
তন্দ্রা চঞ্চল পা দুটো বাড়াতেই শাহিদা বেগম ফের ডাকলেন,
” তোমার না কাল পরিক্ষা? আবার ক্ষতি হবেনাতো পড়ার?”
” না মা। মাস্টার্সে পড়ার তেমন চাপ নেই। পুরাই বিন্দাস। ”
হেসে উঠল শাশুড়ী বউ দুজনেই। তন্দ্রা রান্নাঘরে যেতে যেতে তার মা বোনকে ফোন করে জানাল, তার শশুর এবারও চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছে। তারা অনেক খুশি হলো শুনে। ঢাকায় তার বাবাকে জানিয়ে দিল। তার বাবা তার থেকে লাইন কেটেই বেয়াইকে অভিনন্দন জানালেন।
মির্জা পরিবারের হেঁসেলে বিশাল আয়োজন চলছে রান্নাবান্নার। তন্দ্রা রান্নাঘরে গিয়েই শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে নিল। আজ যেন শাড়ি পরে ফিটফাট হয়ে থাকে। শেফালি, পাশের বাড়ির কালুর মা চাচী,তন্দ্রা,শায়না মিলে নানান হাসি তামাসায় কাজ করে যাচ্ছে। মির্জা পরিবারের যে কোন আয়োজনেই দরিদ্র কালুর মা এগিয়ে আসে কাজ করতে। সবার বিশেষ পছন্দ তাকে।
রান্না ভাগে ভাগে হচ্ছে। দালানের ভিতরের রান্নাঘরে দুই গ্যাসের চুলার এক চুলায় গরুর মাংস। অন্য চুলায় দুই কেজি ওজনের ভাতের হাঁড়িতে দুধ চা হচ্ছে।
পিছনের উঠানের পাশে অবস্থিত রসুইঘরে মাটির তিন চুলায় হচ্ছে ভাত,মুগ ডাল, মুরগী ভুনা। শায়না টুকটাক কাজগুলো করছে ছুটাছুটি করে।
সন্ধ্যা বিদায় নিয়ে রাতের শুভ আগমন ঘটেছে। বিশাল হলরুমে বসে রাজনৈতিক বিষয়ে নানান খোশ আলাপে মত্ত সবার প্রিয় আস্থাভাজন মধুপুর গ্রামের চেয়ারম্যান কামরুল মির্জা। সবার উষ্ণ ভালোবাসায়,শ্রদ্ধায়, নানান ফুলের ডালিতে সিক্ত হচ্ছেন তিনি।
শয়ন এলো দলবলসহ। হাতে বিশাল গোলাপ ফুলের তোড়া। এটা সে স্পেশালভাবে অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নিয়েছে।
বাবার দিকে এগিয়ে ধরল শত গোলাপ দিয়ে তৈরি ফুলের ডালিটা।
” বাবা কংগ্রাচুলেশনস। ”
ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কেঁদে ফেললেন তিনি। পিঠ চাপড়ে দোয়া করলেন পুত্রকে।
উঠানে লাইটের আলোয় মিছিল করা লোকজন দাঁড়িয়ে আছে ফুলের মালা নিয়ে। তিনি বের হয়ে গেলেন তাদের সাথে।
এই তোরা বস। আমি আসছি বলে শয়ন রান্নাঘরের দিকে গেল। বিদুৎ চলে গেল হঠাৎ। চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল। তন্দ্রা উঠান পার হয়ে ঘরের দোরগোড়ায় পা রাখতেই শয়নের গায়ের সাথে ধাক্কা খেল।
” ওমা! কে?” বলে চমকে গেল।
অমনি নিমিষেই শয়ন মোবাইলের ফ্ল্যাশ অন করল। সোজা তন্দ্রার মুখের উপরে ধরল। তন্দ্রা দেখল শয়ন। চোখ বন্ধ করে ফেলল আলো সইতে না পেরে। শয়ন মাথা ঝুঁকে লাইটের আলো তন্দ্রার পায়ের পাতার উপরে ফেলল। সেই আলো শাড়ির উপর দিয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে লাগল। তন্দ্রার গলার নিচে এসে থেমে গেল আলোটা। শয়নের ভিতরটা জ্বলে উঠল বেগুনি রঙের শাড়ি পরিহিত তন্দ্রার পাগল করা রূপ দেখে। তার একান্ত ইচ্ছে ছিল বিয়ের প্রথম রজনী সবার চেয়ে আলাদা করে কাটাব। যেন স্মৃতিতে সোনালী অধ্যায় হয়ে থাকে জনমভর। অথচ সান্নিধ্যই মেলেনি কপালে।
পুরো দরজা দখল করে দাঁড়িয়ে আছে শয়ন। মুখে কিছুই বলছেনা। তন্দ্রার বুকের উপর নেশাতুর চোখে চেয়ে আছে।
” সরে দাঁড়ান বলছি। আমি ভিতরে যাবতো। দুধ চা উপছে পড়ে যাচ্ছে বোধ হয়।”
বিরক্তি নিয়ে বলল তন্দ্রা। শয়ন তা বুঝতে পারল।
” আমাকে দেখলেই ছল করে ভয় পাওয়ার ভান করা! বিরক্তি প্রকাশ করা! সমস্যা কি তোমার?”
শাসনের সুরে অধিকার দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো শয়ন।
তন্দ্রা দৃঢ়চিত্তে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলল,
” আপনার সাথে কোন কথা বলার রুচিবোধ আমার নেই। আমার জীবন থেকে তিন অক্ষরের শয়ন নামটি বিয়েরদিন রাতেই চিরতরে মুছে ফেলেছি। আমি এখানে আছি কেবল বাকি সবার সম্মান রক্ষার্তেই। জেনে রাখুন। আমি আত্মনির্ভরশীল মেয়ে। পরনির্ভরশীল নই। কারো মুখাপেক্ষী নই। আমার থেকে দূরে থাকবেন সবসময়।”
শয়ন সরে দাঁড়ায়। নিজের হাতের পাঁচ আঙ্গুল মুঠি করে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে। তন্দ্রা পাশ ঘেঁষে চলে যায়।
জেনারেটরে সব লাইট জ্বলে উঠল। শয়ন নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। উত্তেজিত না হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল গভীর আক্ষেপ নিয়ে। একটি সিগারেট জ্বালিয়ে দুই ঠোঁটের মাঝে পুরে দিল।
শব্দ করেই বলল,
” যার তরে করি চুরি, সেই বলে চোর। হায়রে তন্দ্রা।”
চলবেঃ ১১ শেয়ার ও মন্তব্যর আশাবাদী)