চাঁদের কলংক পর্ব ১০

0
1396

#চাঁদের_কলংক ( ১০)
#রেহানা_পুতুল
গাঁয়ের উঁচু নিচু মেঠোপথ মাড়িয়ে মাত্রই ঘরের দোরগোড়ায় পা রাখল তন্দ্রা। বিষম খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল ঠিক তেমনি,পথ হারা পথিক যেমন তার সামনে কাউকে আচম্বিতে পেয়ে যায় পথের দিশারি হিসেবে।

শায়নার উল্লসিত মুখ দর্শনেই তন্দ্রার খরতাপে পোড়া মনটা প্রশান্তিময় হয়ে হৃদপিণ্ডটা যেন বিশালাকার হয়ে গেল।

“চাইয়া দেখো কে এসেছে। তোমার ননদিনী রাই।”

কথাটি বলেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল শায়না। গলা পেঁচিয়ে ধরল তন্দ্রার। বাকহীন তন্দ্রার দু-চোখ হতে নিরবে অশ্রুস্রোত বইতে লাগল। ওরা তাকে এতটা ভালোবাসে সব জেনেও। এতটা গুরুত্ব দেয়। এতটা মর্যাদা দেয়। অথচ নিজের একান্ত মানুষটার কাছে স্বপ্নের রাতেই সে প্রত্যাখ্যাত হলো অবহেলায় অনাদরে।

” ননদ ভাবি দাঁড়িয়ে গল্প জুড়ে দিলে হবে? খেতে হবেনা? যা মা ফ্রেস হয়ে নে। শায়না মা সহ একসাথে ভাত খাবি। ”

” যাচ্ছি মা। এই রাই তুমি থাক। তনুর সাথে গল্প করো। তনুটা কই গেল।”

“আমি এইযে। এখানে। একমাত্র বেয়াইনের জন্য বিছুটি পাতা আনতে গেলাম। আমার বোনকে বেশি জ্বালালে এই বিছুটি পাতা গায়ে ঢলে দিব। প্রতি সেকেন্ডের জন্য হাতের ব্যস্ততা বেড়ে যাবে। ”
দুষ্টমিষ্ট ছলে বলল তনু।

” আমাকে না লাগিয়ে তোমার একমাত্র দুলাভাইকে লাগিয়ে দেখ। বুঝবে মজা তখন।” হেসে বলল শায়না।

” বেশী মজা চাইনা আমি। অল্প মজা চাই।
এখন আসো বেয়াইন তুমি ভাত কয়টা খাই।”

” ভালই কথার ফোঁড়ন কাটতে পার তুমি তনু বেয়াইন।”

এভাবে নানান হাসি তামাসায় ওরা সবাই দুপুরের খাওয়া খেয়ে নিল শেফালিসহ। শাহিদা পুত্রবধূকে আনতে মেয়েকে একা পাঠান নি। সাথে শেফালিকে দিয়েছেন।

” তন্দ্রা তোর পরিক্ষা কেমন হলো? শায়না মা তোকে নিতে আসল যে।”

” পরিক্ষা ভালো হয়েছে মা। আর শায়না শোন, পরিক্ষা আজই মাত্র শুরু হলো। কিভাবে যাব?”

” ওহ হো। দাঁড়াও আব্বুকে জানাই। আরেহ সামনের সপ্তাহে নির্বাচন। আব্বু জয়ী হলে বাসায় মানুষের ঢল নামবে জোয়ারের মতন। তখন কেউ কেউ তোমাকে দেখতেও চাইবে। যারা আব্বুর ঘনিষ্ঠজন। সেজন্যই ওই সময় তোমার থাকা জরুরী। তোমার লাভ ও হবে তখন। ক্যাশে ক্যাশে ভরে যাবে তোমার দুইহাত। আমাকে ভাগ দিও। ”

” আচ্ছা পেলে দিব। প্রমিজ।”

” এই আন্টি। আপনি কিন্তু আমার রাজ সাক্ষী রইলেন। ”

রাহেলা মুচকি হেসে দিয়ে, আচ্ছা মা।

শায়না ফোন দিয়ে তার বাবাকে বিষয়টা জানাল। তিনি পুত্রবধুর সাথে কথা বলতে চাইলেন। তন্দ্রা সালাম দিয়ে পরিক্ষার বিষয়টা জানাল স্বশুরকে।
তিনি ক্ষণ ভেবে অধিকারসুলভ ভঙ্গিতে বললেন,
” তুমি এক কাজ করো। ভোটের আগের দিন চলে এসো। বাকি পরিক্ষাগুলো এখান থেকেই গিয়ে দিতে পারবে। ”

তন্দ্রা আমতা আমতা করে বলল,
” বাবা আমাদের বাড়ি থেকেই দূর ক্যাম্পাস। আপনাদের বাড়ি থেকেতো আরো বেশি দূর। ”

” গাড়ি করে যাবে তখন। গাড়ি আছে কেন। প্রয়োজনের জন্যইতো। ”

“আচ্ছা বাবা তাই হবে। ”

সেদিন সন্ধ্যায় শায়না ও তন্দ্রা চলে গেল। শায়নার খুউব মন চেয়েছিল ভাবি ও বেয়াইনের সাথে মজা মাস্তি করবে। কিন্তু শেফালী একা যেতে পারবেনা। আবার তার ও কলেজ খোলা। এক ঝাঁক মন খারাপ নিয়ে সে চলে গেল।

ভোটের আগেরদিন বিকেলে তন্দ্রা রিকশায় করে শয়নদের বাড়ি চলে গেল। উঠানে রিকসার বেলের আওয়াজ শুনেই,
ভাইজান, খালাম্মা,খালু,দ্যাখেন কে আইল। আমাগো ভাবিজান। আসেন ভাবি আসেন। বলে শেফালী উৎসুক মুখে সবাইকে ডাকল।

শয়নের মা বাবা খুশি খুশি মনে ঘরের বিশাল হলরুমে এগিয়ে এলো। রাজনৈতিক পরিবার। রাতদিন মানুষের আনাগোনা। তাই হলরুম সেভাবেই তৈরি করেছে চেয়ারম্যান। তন্দ্রা ঘরে ঢুকেই পা ধরে সালাম দিল শশুর শাশুড়ীকে। তারা দুজনেই বুকে জড়িয়ে নিলেন তন্দ্রাকে।

এই শেফালি। ঠান্ডা পানি দিয়ে শরবত গুলে দে বৌমাকে। হাঁক দিয়ে বললেন শাহিদা বেগম।

” মা আগে রুমে গিয়ে বোরখা খুলি। পরে শরবত খাই। আমি ভার্সিটি থেকে এসেছি। পরিক্ষা ঘন্টাখানিক আগেই শেষ হলো। বাড়ি থেকে দুপুরের আগেই বের হয়েছি। ”

” ওহ আচ্ছা। যাও যাও। রুমে যাও। বোরকা খোল মা।”

তন্দ্রা শায়নার রুমে ঢুকল। শায়না নেই। নিজের সাথে থাকা সবকিছু শায়নার টেবিলেই রাখল।

শয়ন নিজের রুমে ঘুমিয়ে ছিল। শেফালির দরাজ কন্ঠ আর অন্যদের হুলস্থুল কাণ্ডে তার ঘুম ছুটে গেল। সে অসহ্য সুরে আস্তে করে বলল,
সবাইর এমন ভাব। যেন স্পেশাল কেউ এসেছে। হুহ! আরামের ঘুমটাই হারাম করে দিল।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। সোনালী সূর্যটা অস্তমিত যাবে যাবে ভাব। সারা আকাশজুড়ে রক্তিম আভা। যেন স্রস্টার নিপুণ হাতের তুলিতে আঁকা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্ম। মাথা তুলে মুগ্ধ নয়নে আকাশের দিকে চাইল তন্দ্রা। দোতলা খোয়াড়টাতে রাজহাঁস ও মুরগী ঢোকানোয় ব্যস্ত শেফালি। তাকে থেকে থেকে সাপোর্ট দিচ্ছে শাহিদা বেগম।একজনে পেরে উঠেনা এই বিচ্ছুর দল হাঁসমুরগীর সাথে। কামরুল মির্জা ও আজ বাড়িতে। বের হয়নি। বাজারের পরিবেশ থমথমে। তিনি পত্রিকা পড়ছেন সোফায় হেলান দিয়ে। শায়না পাশের বাড়ি থেকে এলো। সে বাড়ির হেলেনা তার ক্লাসমেট ও বেস্টফ্রেন্ড। পিছন থেকে তন্দ্রার দু-চোখ বন্ধ করে চেপে ধরলো শায়না।

” কেমন আছ রাই? দেখলে বাবার আদেশ পালন করলাম। এসেই পড়লাম। ”

” বাহ। ধরতে পারলে তাহলে। আর সেজন্য তোমাকে উম্মাহ। যাই হাত মুখ ধুয়ে আসি। ”

” মা আমার বেশ কাহিল লাগছে। আমি রেস্ট নিতে যাই একটু?”

অনুগত স্বরে অনুমতি চাইল তন্দ্রা।

” আজব মেয়েতো। এটা অনুমতি নিতে হয়? যাও। এক্ষুনি যাও। ”

স্মিত হেসে তন্দ্রা শায়নার রুমে গিয়ে গা এলিয়ে দিল। খানিক সময়ের ভিতরের ঘুমের ঘোরে তলিয়ে গেল সে।

শয়ন রুম থেকে বের হয়ে চোরাচোখে এদিক সেদিক দেখে নিল তন্দ্রাকে দেখা যায় কিনা। সেও তার সামনে পড়তে অনিচ্ছুক। তন্দ্রার উপরে অসম্ভব রকমের ক্ষোভ রা’গ এখনো পুষে আছে তার মনে। থাকাটাও অমূলক নয়। যদিও তন্দ্রার উপর ভুল বোঝার প্রবণতা শেষ হয়ে গেল। তার ধারণা ছিল সে বাইরে চলে যাওয়ার পর আদিলের সাথে তন্দ্রার ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। তা না হলে আদিল এমন কাজ কিভাবে করল। কিন্তু সেই রাতের ঘটনায় বুঝতে পারল তন্দ্রা সত্যি সত্যিই আদিল ধারা রেপ হয়েছে।

তবুও তন্দ্রার আরো পানিশমেন্ট হওয়া উচিত। শয়ন তাকে বারবার বলার পরেও আদিলের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে চলেনি। শয়নের কথাকে সে তুড়ি মেরে উড়িয়ে বেলুনের মতই।

শয়ন ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসল হাই দিতে দিতে।বাকিরাও বসা। নাস্তা খেতে খেতে টিভিতে খেলা দেখছে।

” বউ এসেছে। দেখেছিস?” নরম গলায় বলল শাহিদা বেগম।

” দেখার কি। বহু দেখেছি। দেখতে দেখতে দেখার চোখ পঁচে গিয়েছে।”

” কথা বললেই ক্ষেপে যাস। তোর যা ইচ্ছা তাই কর। যা বউ শায়নার রুমে ঘুমিয়ে আছে। বের করে দে। ”

অভিমানী আর মেজাজ দেখিয়ে বলল শাহিদা বেগম।

শয়ন মায়ের পাশে এসে বসল। মাকে জড়িয়ে ধরল। শান্ত গলায় বলল,
” রাগ করো কেন মা। ওর কিছু শিক্ষা হওয়া উচিত। তোমরা কি মনে করো ওর কোন ভুল নেই? ধোয়া তুলসীপাতা সে? আর আমিই পঁচা বেলপাতা? ”

” বউর যদি কোন ভুল থেকেও থাকে। তার শাস্তি সে অলরেডি পেয়ে গিয়েছে। তুই দিয়ে ফেলছিস। বাসর হয়নি। কথা বন্ধ তোর সাথে। এতদিনে একটা ফোন ও দেসনি। আর কি বাকি রেখেছিস। এবার আস্তে আস্তে ইজি হয়ে যা বলছি। সে মেয়ে মানুষ। ভয়ে লজ্জায় তোর সামনেও পড়তে চাইবেনা। তোর এগিয়ে যেতে হবে বাবা। সংসারে স্বামী স্ত্রীর অমিল থাকলে আল্লাহর রহমত নাযিল হয়না। বরকত আসেনা কিছুতে। এটা আমার কথা নয়। কোরান হাদীসের কথা। ”

” সময় লাগবে মা। চাপ সৃষ্টি করবানা প্লিইজ।”

কামরুল মির্জা এদের মা ছেলের কথায় চুপ হয়ে ছিল এতক্ষন। কারণ সেও কিছু বলে ছেলের মাথা বিগড়ে দিতে চায়না। রাত পোহালেই ভোট। তার কাছে এই মুহুর্তে এটাই সবচেয়ে ইম্পর্টেন্ট।

রাত দশটা বাজে। শয়ন বোনের রুমের সামনে গেল কোন প্রয়োজনে। আস্তে করে চাপানো দরজা ফাঁক করলো। ডিম লাইটের হলুদ আলো জ্বলছে। দেখল তন্দ্রা এখানেই তন্দ্রাঘোরে ডুবে আছে দুই হাঁটু ভাঁজ করে।

শয়ন বুকের উপর দুইহাত ভাঁজ করে একটু দাঁড়াল। এক পায়ের উপর আরেক পা পেঁচানো। চোখে মুখে দারুণ কাঠিন্যতা। গম্ভীর চাহনি। নিজের অজান্তেই দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে গেল ঘুমন্ত তন্দ্রার মায়াবি মুখখানির উপরে। যেন কোন রূপকথার স্বপ্নচারীনি স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে।

হঠাৎ তন্দ্রার ঘুম ছুটে গেল। আড়মোড়া ভেঙ্গে দরজার ফাঁকে চোখ যেতেই ভয়ে চাপাস্বরে বলে উঠল।

“কে ওখানে! কে? ”

শয়ন সপাটে দরজা খুলে ফেলল। দু পা এগিয়ে রুমে ঢুকল। চোখ লাল করে ধমকে উঠল তন্দ্রাকে।
বলল,
রাতের আঁধারে যে একা বাইরে বের হতে পারে। দুঃসাহসের মতো কাজ করতে পারে। বিদুৎতের আলোয় তাকে ভয় পাওয়া মানায়? নাকি ন্যাকামো সাজা হচ্ছে?

চলবেঃ ১০( শেয়ার ও মন্তব্যর আশাবাদী)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here