চাঁদের কলংক পর্ব ১২

0
1392

#চাঁদের_কলংক ( ১২)
#রেহানা_পুতুল
জেনারেটরে সব লাইট জ্বলে উঠল। শয়ন নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। উত্তেজিত না হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল গভীর আক্ষেপ নিয়ে। একটি সিগারেট জ্বালিয়ে দুই ঠোঁটের মাঝে পুরে দিল।
শব্দ করেই বলল,
” যার তরে করি চুরি, সেই বলে চোর। হায়রে তন্দ্রা।”

একে একে কয়েকটি সিগারেট ছাইঁ করে ফেলল শয়ন। মাথা গরম হয়ে গেলেই তার আশ্রয় নিতে হয় সিগারেটের ধোঁয়ার মাঝে।

এদিকে শাহিদা বেগমের পূর্ণ তদারকিতে রান্না শেষ হয়ে গেল। গরুর মাংস আর পোলাওর সুঘ্রাণে আশপাশ ম ম করছে। রাত বেড়ে গিয়েছে। আজ উৎসবমুখর পরিবেশ মির্জা পরিবারের প্রতি দেয়ালে দেয়ালেও। শয়ন তার সাথের ছেলেদের নিয়ে ডাইনিংয়ে এসে খেয়ে নিল। পরে হলরুমে গিয়ে বসে চা খেয়ে নিল।

কামরুল মির্জা এলেন বাসায়। সাথে ছিল কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি। তিনি ভিতরে গিয়ে পুত্রবুধকে নিয়ে আনলেন সাথে করে। তন্দ্রা মাথায় আঁচল দিয়ে সবাইকে বিনম্রভাবে সালাম দিল। তারা কেউ কেউ সে কিসে পড়ে, ক্যারিয়ার প্ল্যান কি? এসব জিজ্ঞেস করল। তন্দ্রাও হাসিমুখে তাদের উত্তর দিল। তারা সবাই তন্দ্রাকে সালামি দিল। তন্দ্রা আপত্তি করলেও নিতে হলো শশুরের আদেশ পেয়ে।

তন্দ্রা শাশুড়ীর কাছে চলে গেল রান্নাঘরে। শায়না তার হাতের দিকে চাইল।
জ্বলজ্বল চোখে বলল,
” এই দেখি। ওরে আম্মু দেখো। ভাবির মুঠোভর্তি শুধু টাকা আর টাকা। আম্মু প্লিজ আমাকে কোন চেয়ারম্যানের ছেলের সাথে বিয়ে দিও। তাহলে আমিও এমন ক্যাশ পাব। তা সখী ট্রিট কবে দিচ্ছ? ”

পিছন দিয়ে শায়নার চুলের ঝুঁটি ধরে টান দিল শয়ন।
চোখ কড়মড়িয়ে বলল,
” পড়াশোনার নাম নেই। শুধু বিয়ে দাও। বিয়ে দাও। তোর বিয়ের বয়স হয়েছে?”

” ধুর। তুমি যাওতো ভাইয়া। নারীদের মাঝে তোমার কি চাই। ফাউল একটা । কবে আমি বিয়ে দাও বিয়ে দাও বলছি। ভাবির হাতে দেখ এক ঝলক। ট্রিট নিবা নাকি ?”

শয়ন লুকানো চোখে তন্দ্রার হাতের দিকে চাইল। দেখল অনেক টাকা। শায়নাকে বলল,
” হুম নিবতো দিলে। গুনে দেখ কত হয়েছে। তারপর আমাকে দিয়ে দিস।”
বলেই শয়ন চলে গেল।

” ভাবি যাকে দিবে সেই নিবে। ভাবি দেখি গুনতো কত টাকা।”

আমি মাকে দিব। মা নেন বলে তন্দ্রা।টাকাগুলো মেলে ধরলো শাহিদা বেগমের সামনে।

” পাগলি মেয়ে। আমি কি করব। তুমিই পেয়েছ। এই টাকার মালিক তুমি। আর মন চাইলে তোমার বোনসহ সবাইকে একদিন ট্রিট দিও। ”

তন্দ্রা কাজ সেরে শায়নাকে নিয়ে রুমে চলে আসল। খাটের উপরে টাকাগুলো মেলে রাখল। শায়না গুনে দেখল দশহাজার টাকা।

তন্দ্রা হেসে বলল,
” তুমি সেদিন যখন বলছ। আমি বিশ্বাসই করিনি। আজ দেখি তোমার বলাই সত্যি।”

শয়ন দরজার ফাঁক দিয়ে তন্দ্রাকে দেখল। কি উচ্ছ্বাসভরা আনন্দ দিয়ে কথা বলছে শায়নার সাথে। উফফস! শাড়ি পরা তন্দ্রাকে এত মোহনীয় লাগছে। একশো দোযখের আগুনে শয়নের হৃদয়টা পুড়ে খাঁক হয়ে যাচ্ছে।

তার মন বলে উঠল,
মেয়েদের স্বামীর সাথে থাকে মধুর সম্পর্ক অন্যদের চেয়ে। আর এখানে হলো তার বিপরীত। স্বামীর সাথে মন্দ। সবার সাথে ভালো। এরে বলে কপাল। চিড়িয়াখানার বিরল আকর্ষণীয় প্রজাতি পাখির মতো মতো দূরে দূরে থেকে ফাঁকফোকর দিয়ে দেখতে হচ্ছে তাকে।

পরেরদিন সকালে তন্দ্রা জামাকাপড় পরে তৈরি হয়ে নিল। এক টুকরো কেক আর এক গ্লাস পানি খেয়ে নিল। ভারি নাস্তা খেতে ইচ্ছে করছেনা এই মুহুর্তে। আজ পরিক্ষা সকালের দিকে। বের হয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে শাশুড়ির কাছে বলতে গেল তন্দ্রা। তিনি দাঁড় করালেন তন্দ্রাকে।

পুত্রকে ডাক দিলেন তার রুমের সামনে গিয়ে।
” কি মা? ঘুম পুরোয়নিতো আমার।”

” বাবা বৌমাকে ভার্সিটি নিয়ে যা গাড়ি করে৷ নয়তো দেরি হয়ে যাবে রিকসায় করে যেতে। ওরতো আজ পরিক্ষা। ”

” আজবতো মা। কি একটা আবদার নিয়ে এলে। আমি পারবনা। যাও।”

” তোর বাবা বলছে তোকেই নিয়ে যেতে।”
এটা শুনেই আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসল শয়ন।
” আসছি যাও।”

শয়ন ফ্রেস হয়ে একটি জিন্সের সাথে কালো শার্ট পরে নিল হাতা ফোল্ড করে। এলোমেলো চুলগুলোকে হাতদিয়েই একটু ঠিক করে নিল। উঠানে বের হয়ে গাড়িতে উঠে বসল। তন্দ্রা পিছনের সিটে বসে পড়ল। শাহিদা বেগম গাড়ির সামনে গিয়ে ছেলেকে বললেন,
” বাবা পরিক্ষা শেষ হলে একবারেই নিয়ে আসিস বউকে। নয়তো তোর বাবা রাগ করবে।”

শয়ন চোয়াল শক্ত করে মায়ের দিকে চাইল। কিছু বললনা পিছনের সিটে বসা তন্দ্রা শুনে যাবে বলে। শাহিদা বেগম মুচকি হাসলেন।

পুরো পথ শয়ন ও তন্দ্রা কোন কথা বললনা৷ গাড়ি গিয়ে থামল তন্দ্রার ভার্সিটির বিশাল মাঠের একপাশে। তন্দ্রা বেরিয়ে গেল পরিক্ষা দিতে। এরপরে শয়ন পায়ে হেঁটে চলে গেল পাশের একটি হোটেলে। নাস্তা খেয়ে চা খেয়ে নিল আরাম করে সময় নিয়ে। ফের মাঠে চলে গেল। সবুজ ঘন ঘাসের উপরে বসল একটি গাছের সাথে হেলান দিয়ে। ফোন দিল তার বাবাকে।

” হ্যালো..কিরে শয়ন কোন সমস্যা? ”

” তেমন সমস্যানা বাবা। একা বসে আছি। তাই ভাবলাম তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি।”

তিনি হেসে বললেন,
” কিই কথা। বাসায় এসে বলতে পারবিনা?”

” নাহ। তখনতো তন্দ্রা থাকবে। সমস্যা।”

” ওহ। আচ্ছা বল।”

” আচ্ছা বাবা আমি না হয় তন্দ্রাকে পছন্দ করেছি বয়সের দোষে। আবার ভেবনা তার মানে আমার অনুভূতি ভুল বা মিথ্যে ছিল। কিন্তু তুমিও কেন তাকে পছন্দ করেছে পুত্রবধূ করার জন্য?
ঠিক এই কারণটাই জানতে আমার ইচ্ছে করছে বাবা।”

” এতদিন পরে আজ আচমকা এটা জানতে চাওয়ার কারণ?”

“কারণ আমি একটু ইজিভাবে চলার চেষ্টা করছি তার সাথে। কিন্তু সে সেগুন কাঠের মতো মজবুত হয়ে আছে। গতরাতে ও আমাকে দেখেই কঠিন গলায় জানিয়ে দিল তার থেকে যেন দূরে থাকি। এবার বুঝ। ”

” ওহ এই বিষয়। এত বড় ঝড় বয়ে গেল জীবনে। সময়তো লাগবেই। এত উত্তেজিত হসনা। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। ”

” তোমার পছন্দ করার কারণটা শুনতে চাই।”

” শোন। আমার মায়ের অর্থাৎ তোর দাদীর বাল্য বিয়ে ছিল আমার বাবার সাথে। স্বভাবে আমার মা ছিল ভীষণ রকমের চটপটে আবার অভিমানী। আহ্লাদীপানা,হ্যাংলামি, হেয়ালিপানায় ভরপুর ছিল মা। সুযোগ পেলেই পেয়ারা গাছে চড়ে পেয়ারা পাড়তেন।আম গাছে চড়ে কাঁচা আম পেড়ে খেতেন। টমেটো ক্ষেতের ভিতরে বসে পাকা টমেটো খেতেন লবন মরিচ মিশিয়ে। এক্কাদোক্কা, বউচি,লুডু,কানামাছি,রুমাল চুরি খেলতেন আমার অবিবাহিত চাচাতো বোনদের সাথে। পুকুরে গোসল করতে গেলে সাঁতরে ওপাড়ে চলে যেতেন। বর্ষাকালে আমাদের ঘরের পাশের সব ক্ষেত ডুবে টইটম্বুর হয়ে যেত। নৌকায় করে শাফলা তুলতেন মজা করতে করতে। বাগানে বাগানে ঘুরে বেড়াতেন।

বিয়ে হয়েছে। স্বশুর শ্বাশুড়ি আছে। স্বামী আছে। সংসার আছে। সন্তান আছে। এসব যেন মনেই থাকতনা মায়ের। অল্প বয়সেই মা হয়ে যায়। আমি ছিলাম মায়ের বড় সন্তান। তাই মা আমারও খেলাধূলার সঙ্গী হয়ে উঠে। আমিতো ছোট ছিলাম। বুঝতামনা। মায়ের এসব কিছু আমার খুব ভালো লাগত। আমিও অপার আনন্দ পেতাম।
আমার আব্বা ছিলেন রাশভারী প্রকৃতির লোক। দাদাও তাই ছিলেন। দাদী ছিল বউকে দাসীর নজরে দেখা মানুষ। আব্বা রেজিস্ট্রার অফিসে চাকরি করতেন। সকালে বেরিয়ে যেতেন। শেষ বিকেলে বাড়ি ফিরতেন। আমার দাদী আব্বার কাছে মায়ের নামে একগাদা নালিশ করতো দুই একদিনে বাদেই।

আব্বার শাসনের মাত্রা তীব্রগতিতে বাড়তে থাকে মায়ের উপর। তবুও আমার অল্প বয়েসী মা বধু জীবনে অভস্ত হতে পারেনি। বিশ বছর বয়সেও আনতে পারেনি ত্রিশ বছর বয়সের ভারীক্কিভাব। দাদা টুকটাক বুঝাতেন দাদীকে। আব্বাকে। বলতেন বয়সতো দস্যিপানার। সময় হলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আব্বা যতই শাসন করুক মা ভারি হয়ে চলতে পারেনা। আব্বা অতিষ্ঠ হয়ে যায় দিনেদিনে দাদীর কাছে মায়ের বিরুদ্ধে নালিশ শুনে শুনে । শাসনের ধরন চেঞ্জ করল আব্বা। মায়ের গায়ে হাততোলা শুরু করলো। এভাবে একদিন মাকে খাটের খুঁটির সাথে বেঁধে রেখে বেদম মারে আব্বা। মায়ের ফর্সা শরীরে লাল লাল ছোপ ছোপ দাগ পড়ে যায়। আমি মাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদি বাঁধন খুলে দেওয়ার জন্য। কেউই শুনলনা সেদিন আমার আর্তচিৎকার।

আমার দাদী মরিচ লাল চোখে আব্বাকে বলছে,এই বেয়াদবকে তালাক দিয়ে দে। দুই বাচ্চার মা হয়েছে। তবুও এমন বেহায়াপানা অসভ্যতামি বন্ধ হয়না। এটা কি তার বাপের বাড়ি না মামুর বাড়ি যে মনমতন চলব। অবোধ আমি তখন মনে মনে বলতাম আমার মা খারাপ কি করছে।

মা আর কখনো এমন গাছে চড়বেনা। পুকুরে সাঁতার কাটবেনা। এক কথায় ঘরে বসে থাকবে মাথায় ঘোমটা টেনে। এমন স্বীকারোক্তি নিয়েই সেদিন রাতে মায়ের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়।

সকালে আমিসহ সবাই ঘুম থেকে উঠে দেখি মা নেই। নেই। কোথাও আমার মা নেই। কিছুক্ষণ খোঁজার পর আমাদের রসুই ঘরের পিছনে আম গাছের ডালের সঙ্গে মায়ের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার হয়। চিরদিনের জন্য আমি হয়ে যাই মা হারা এক অসহায় শিশু। ”

কথাগুলো শয়নের কাছে বলতে বলতে কামরুল মির্জার গলা ধরে গেল। শয়ন ফোনের ওপাশ থেকে ভেজা কন্ঠে বলল,
” থাক বাবা আরকিছু বলতে হবেনা। আমি স্যরি খুব। দাদী যে এভাবে মারা গিয়েছে এটা জানতাম না আমি। জানতাম মারা গিয়েছে। এইই।”

কামরুল মির্জা আবার বলতে লাগলেন,
” শেষ করি। শোন। যেদিন বিলের মধ্যে বৌমাকে শাফলা তুলতে দেখি। মুহুর্তেই আমার মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। ভালো লেগে গেল। মনে হলো এই মেয়েটাতো মনে হয় আমার মায়ের মতই চঞ্চল। এই মেয়ে বিয়ের পরেও এমন চলবে। আর হয়তো পরিণতি হবে ঠিক আমার মায়ের মতই। বুকের ভিতর মোচড় খেয়ে উঠল। আমার শিশুমনে তখন মায়ের ওসবকে দোষ বা ভুল মনে না হয়ে আনন্দ কাজ করতো। সেই ছাপ এখনো আছে। তাই তখনি চিন্তা করলাম এই মেয়েকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাব। যেভাবে ইচ্ছা চলবে। আমি চেয়ারম্যান। কেউই কিছু বলার সাহস দেখাবেনা। একটা মেয়ে স্বামীর সংসারে এভাবে চললে সমাস্যাটা কোথায়। এটা আমি আজও বুঝিনা। ”

শয়ন বাবাকে শান্তনা দিয়ে ফোন রাখল।
গরম লাগছে। তাই উঠে গিয়ে গাড়ির ভিতরে বসল এসি অন করে। লো ভলিউমে বেস্ট অফ রবীন্দ্র সংগীত ছেড়ে দিল।
” ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে, আমার নামটি লিখো তোমার মনের ও মন্দিরে..”

শয়ন গাড়ির সিটে মাথা হেলান দিয়ে গান শুনছে। দৃষ্টি মাঠের দিকে। চেয়ে দেখল তন্দ্রা বিশাল মাঠের এক পাশ ধরে দুজন মেয়ে ফ্রেন্ডের সাথে হেসে হেসে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে।

শয়ন একাকী নিরবে বলল,
আমার বালিকা। তুমি কি সত্যিই সারাজীবন দূরেই থাকবে ওই দূর আকাশের চাঁদের মতো? তবে কি আমি কেবলই চেয়ে চেয়ে দেখেই যাব তোমাকে।

চলবেঃ ১২ (শেয়ার ও মন্তব্য’ র আশাবাদী)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here