চাঁদের কলংক পর্ব ৫

0
1598

#চাঁদের_কলংক ( ৫)
#রেহানা_পুতুল
শয়ন মনে মনে বলল,
“তোর নামেই বাঁধি ঘর,করি একা বাস।
তুই আমার স্বর্গসুখ , বন্ধু তুই দীর্ঘস্বাস।”

কলেজে ক্লাসের ফাঁকেই তন্দ্রা চিন্তা করে বসল,কথাটা ওভাবে বলা ঠিক হয়নি। ভেবেই গোপনে জিভে কামড় বসিয়ে দিল। এদিকে শয়নের মাথায় অনবরত চরকির মতো ঘুরপাক খাচ্ছিল ওই একটিই বাক্য।
তন্দ্রার বলা ” আমি বাঁচিয়ে তুলব।”

আনন্দে আত্মহারা শয়ন। জীবনের প্রথম অনুভূতি। প্রথম ভালোলাগা। প্রথম কারো হাতের ছোঁয়া। বেসামাল হয়ে গেল। চিন্তা করলো, আমি বাইরে চলে যাব মাস্টার্স করার জন্য। তখন তন্দ্রা থাকবে আমার চোখের আড়ালে। আদিলের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়বে। ভুলে যাবে আমার কথা। বাবাকে দিয়ে কথা পাকা করিয়ে রাখি।

শয়ন মাকে দিয়ে বাবাকে বলল তন্দ্রার কথা।
একদিন পর তার মা জানাল,
” তোর বাবা নাকি হালকাভাবে তার বাবার মাথায় বিষয়টা দিয়ে রাখছে। তারপর ও তুই বাইরে গিয়ে যখন আসার সময় হবে। তখন ফাইনাল করবে কথাটা। ”

শয়ন মাকে জড়িয়ে ধরে স্বস্তির নিঃস্বাশ ছাড়ে।

তন্দ্রার সাথে কলেজে আসা যাওয়ার পথে মাঝে মাঝে কথা হয় শয়নের। সময়ে অসময়ে জোর করে তন্দ্রার হাতে ছোট ছোট উপহার ধরিয়ে দেয়। শয়নের প্রতি তন্দ্রার ভালোলাগা বাড়তে থাকতে ধীর গতিতে। মন হয় উচাটন। সব যেন তার কেমন কেমন লাগে। পরিনতি কি হবে ভেবে আবার চুপসে যায় রোদে পড়া লতার ন্যায়। কারণ তার বাবার সাথে শয়নের বাবার আলাপের বিষয়টা এখনো তার কান অবধি পৌঁছায়নি।

দিন গড়িয়ে যায়। বছর ঘুরে বছর এলো। তন্দ্রা সেকেন্ড ইয়ারে উঠে গেল। আদিল বলি বলি করেও তন্দ্রাকে বলতে পারেনা পছন্দের কথা। ভাবে পরে যদি অনেক দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। পাছে যতটুকু কাছে পায় তাও পাবেনা৷ যেভাবে তন্দ্রা আদিল ভাই আদিল ভাই বলে সম্বোধন করে। সেখানে কিভাবে কি বলি। কলেজ পাশ করার পর একবারে বিয়েই করে ফেলব। তারপরেই না হয় প্রেমটা করব।

শয়ন বাইরে চলে যাবে। ডেট ফাইনাল।
শেষবারের মতো তন্দ্রার সাথে এক ভরদুপুরে দেখা করল। স্থানটি ছিল তাদের গ্রমের বকুলতলা। শয়ন কিছু বকুল ফুল কুড়িয়ে নিল। তন্দ্রার হাতে দিয়ে বলল,
” আমরণ পাশে রবে। কথা দাও। চোখের আড়াল হলে মনের ও আড়াল করে দিবেনাতো বালিকা?”

তন্দ্রা ফিক করে হেসে ফেলে। শয়নের উড়ন্ত চুলগুলো নিজের সরু আঙুলগুলো দিয়ে এলোমেলো করে দিয়ে বলে,
” আমি বুঝি এখনো বালিকা? দুদিন বাদে ভার্সিটিতে যাব।”

” হুম বালিকাই। তোমাকে দেখেছি আমি ওই বয়সেই। তাই এখনো বালিকাই মনে হয় আমার তোমাকে।”

” আচ্ছা অপেক্ষা করব। দেখা যাবে আপনিই বিদেশী মেয়েদের পেয়ে আমাকে ভুলে যাবেন। ”
চোখ নামিয়ে জানায় তন্দ্রা।

শয়ন হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে আলতো করে বুলিয়ে নেয় তন্দ্রার কমলা রাঙা বাম গালটাকে।

দুহাত দিয়ে তন্দ্রার দুগাল চেপে ধরে। দৃষ্টির সাথে দৃষ্টি এক করে বলে,
” তোমাকে ভোলার চেয়ে মরণ ও সহজ। মরণের অভিশাপ দিয়ে দাও।”

” দূর! কি বাজে বলছেন। ”

এভাবে বহুসময় নানান খুনসুটি আর সুখ স্বপ্ন জাগানিয়া আলাপনে মগ্ন ছিল তন্দ্রা ও শয়ন নামের দুজন মানব মানবী। বসন্তের শুকনো ঝরাপাতাগুলোকে মচমচ শব্দে মাড়িয়ে চলে গেল দুজন দুজনের গন্তব্যে।

বিদেশে পাড়ি জমানোর আগে একদিন বিকেলে শয়ন আদিলের সাথেও দেখা করল। প্রাসঙ্গিক আলোচনার মাঝেই বলে উঠে শয়ন।
” আমি তন্দ্রাকে ভালোবাসি। তুই খেয়াল রাখিস ওর।”

আদিল ভ্রুকুটি করে হেসে উঠে। কটাক্ষ করে বলে,
” শেয়ালকে বলছিস মুরগী পাহারা দিতে।”

” মানে?”

” ভেরি সিম্পল। ওকে আমি বিয়ে করব। ওর খেয়াল রাখবই। পাশাপাশি উপভোগ ও করব। ”

শয়ন ক্ষে’ পে যায়। চড়া গলায় বলে উঠে,
” খবরদার আদিল। তন্দ্রার হাতেও যদি তোর টাচ লাগে। আমি তোর সেই হাত কেটে ফেলব।”

আদিল ক্রোধান্বিত হয়ে যায়।
” এ দেখি ঘরের বিলাই দুধ পায়না। বাইরের বিলাই খেতে চায় কাণ্ড। শোন শয়ন, তন্দ্রার উপর আমার অধিকার আছে। তাদের সবার ভালো মন্দ খোঁজ খবর নিই কি এমনি এমনি। আমি তন্দ্রার কমনীয় শরীরের প্রতিটি লোমকূপের গোড়ায় গোড়ায় গভীরভাবে টাচ করব। পারলে ঠেকাস।”

শয়ন গালি দিয়ে আদিলের গলা চেপে ধরে। আদিল গোঙানো কন্ঠে মনে করিয়ে দেয়,
” তুই চেয়ারম্যান কামরুল মির্জার একমাত্র ছেলে। ভুলে যাস কেন। সামনে ইলেকশন আসতেছে।”

শয়ন আদিলের গলা ছেড়ে দেয়। দপদপ পায়ে বাড়ি চলে যায়। এবং তার এক সপ্তাহ পরেই শয়ন উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে কানাড়ায় পাড়ি জমায়। চাইলেই আদিলকে আর কিছুই করতে পারেনি শয়ন। পায়ে বেড়ি পরা বন্দী মানুষের মত কেবলি ছটপট করেছে।

শয়ন বাইরে থেকেও নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছে তন্দ্রার সাথে। প্রেমের বিরহতেও এত পোড়া সুখ। শয়ন আগে উপলব্ধি করতে পারেনি। তন্দ্রাও প্রতিক্ষার প্রহর গুনছে প্রতিটি দিন।
তন্দ্রার কাছে আদিলের বিষয়ে অনেক কিছুই বলেছে শয়ন প্রত্যক্ষভাবে। যতটুকু সম্ভব দুরত্ব মেনে চলতে অনুরোধ করেছে। কিন্তু আদিল সম্পর্কে তন্দ্রা নেগেটিভ কিছুই কানেই নেয়নি। ভাবল শয়নের প্রেমিক মন। তাই অল্পতেই জেলাস হওয়াটাই স্বাভাবিক।

দেখতে দেখতে দুই বছর ঘনিয়ে এলো। তন্দ্রা অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে উঠে গেল। শয়ন দেশে আসার তিনমাস আগে আনুষ্ঠানিকভাবে তন্দ্রার পরিবারের সাথে শয়নের পরিবারের কথা পাকাপোক্ত হয়। এটা স্বাভাবিকভাবেই জেনে যায় আদিল। তার মাথায় র’ ক্ত উঠে যায়।

সেও পরিবার দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। সেই প্রস্তাব নাকচ করে দিতে বাধ্য হয় তাহের উদ্দীন। চিন্তিত সুরে উনি আদিলের পরিবারকে জানায়,

” আমি চেয়ারম্যান কামরুল মির্জাকে কথা দিয়েছি আরো বহু আগেই। আপনারা আগে বলেন নি কেন? এখন এটা কিছুতেই বদলে ফেলা যাবেনা। ”

আদিল দেখা করে তন্দ্রার সাথে। অধিকারসুলভ ভঙ্গিতে বলে,
” আমি তোকে ভালোবাসি বিয়ে করতে চাই। তুই রাজী থাকলে আমি তামাম দুনিয়া এক করে দিব। যে কোন পরিস্থিতি ফেইস করতে পাব। তুই শুধু একবার রাজী হয়ে যা।”

” এটা মরে গেলেও সম্ভব না আদিল ভাই। আমি আপনাকে অন্যচোখে দেখিনি কখনো। প্লিজ আপনি শান্ত হোন।”

” তুই দেখি নিমক হারাম রে। খাস একজনের গুন গাস আরেকজনের। ” উত্তেজিত গলায় বলল আদিল।

” শিক্ষিত হয়ে আপনি অশিক্ষিত ছেলের মতো আচরণ করেন কেন আদিল ভাই। মনের উপর জোর খাটানো যায়?”

” তুই একটু মন দিলেই আমার দিকে মন বসে যাবে। ”

” অসম্ভব। আমি শুধু শয়নের বউ হবো। আর কারো নয়। আমার সবকিছু শুধুই শয়নের জন্য।”

” তুই দেখিস। আমি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করব। তখন আমার কাছে তোকে বিয়ে দিতে বাধ্য হবে তোর বাপ মায়।”

ঠান্ডা মেজাজে কথাগুলো বলেই আদিল চলে যায়।

তন্দ্রার ভীষণ মন খারাপ হয়। সব সময় আতংকে থাকে। আদিল কখন তার পরিবারের কি ক্ষতিটাই না করে বসে। নাকি বাবার, তনুর কোন ক্ষতি করে। শত দুঃশ্চিন্তায় দিবানিশি পার হয় তন্দ্রার। অতি সাবধানী হয়ে চলাফেরা করে সে।

এদিকে আদিল ও দমে যাওয়ার পাত্র নয়। তন্দ্রাদের পাশাপাশি ঘরের এক ছেলেকে বলে রাখে। যেন তন্দ্রা একা হলেই তাকে খবর দেয়। সেই পরিবারের সাথে তন্দ্রার বাবার মনোমালিন্য চলছে ভিটেজমি নিয়ে। তাই সেই ছেলে এমন লোভনীয় প্রস্তাব আনন্দের সাথেই লুফে নেই। পকেটবন্দী হয় কিছু চকচকে নোটও।

_________

সময়টা চৈত্রের মধ্যদুপুর। মাথার উপরে গনগনে সূর্যের তেজময় আলো। শাখায় শাখায় পাখিদের কূজন নেই। রঙিন প্রজাপতিগুলো আজ আর ছোটাছুটি করছেনা। নেই কোন উতলা বাতাস। চারপাশের প্রকৃতি রাজ্যের আলস্যতা নিয়ে নিস্তেজ হয়ে আছে৷

বাইরে থেকে এসেই একা ঘরে তন্দ্রা আয়নার সামনে দাঁড়ায়। পিনপিনে পাতলা শাড়িতে নিজের অঙ্গসৌরভে নিজেই মোহিত। পিছন দিয়েই আদিল অতি সন্তপর্ণে তাদের ঘরে প্রবেশ করল। সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে দিল ভিতর থেকে। তন্দ্রা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে আৎকে উঠে। চিৎকার দিতে গিয়েও পারেনা। তার আগেই তন্দ্রার মুখ চাপা পড়ে যায় আদিলের বলিষ্ঠ হাতের তালুর নিচে।

চলবে ঃ ৫ ( শেয়ার ও মন্তব্য কাম্য। 💚)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here