#পারমিতা
পর্ব—০৮
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।
ভয়ে গাড়ির স্টিয়ারিংটা ছেড়ে দিলো আকাঙখা,সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তার পেছনে পারমিতা বসে আছে।
এরপর সে একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করে।গাড়ি নিজে থেকেই সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।ভয়ে হাত পা কাঁপতে লাগলো তার।
—-একি,তুমি।তুমি এখানে কিকরে এলো, কিকরে এলে বলো।
পারমিতা নির্বাক।সে আপন মনে বসে আছে।শুধু আকাঙখার দিকে তাকিয়ে আছে।
–কি হলো, কথা বলছো না কেন,আর এটা তুমি আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছো।উত্তর দাও আমার কথার।কি হচ্ছে এসব।
আকাঙখার কোনো কথাই কানে তুলছে না পারমিতা।
গাড়ি পারমিতার বাসার রাস্তা ছেড়ে অন্য একটা রাস্তা ধরলো,তারপর উল্টোদিকে ছুটতে থাকে।
—আরে কি হচ্ছে এটা,কেন এমন করছো আমার সাথে।ছেড়ে দাও আমায়।দয়া করে ছেড়ে দাও,দেখো আমি তো কোনো অন্যায় করি নি তোমার সাথে।কেন আমার পেছনে পড়ে আছো। কি চাও আমার থেকে তুমি।
পারমিতা তখনো নিস্তব্ধ।সে কোনো কথাই বলছে না।শুধু নিথর দেহ নিয়ে সিটের ওপর বসে আছে।
—এই তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো,এভাবে গাড়ি চলতে থাকলে এক্সিডেন্ট করে বসবে কিন্তু।গাড়ি থামাও বলছি,থামাও বলছি।
আকাঙখা দেখছে পারমিতা তার কোনো কথা কানেই তুলছে না,এদিকে গাড়ি আপন মনে ছুটেই চলছে।
গাড়িটা শহর থেকে পারমিতার শহরের দিকে ছুটতে লাগলো।আকাঙখা রিতীমত অবাক হয়ে যায়।তবে এবার সে আর চিৎকার চেঁচামেচি করলো না,নিজেকে যথাসম্ভব সংযত রাখার চেষ্টা করছে!
পারমিতা তার নিজের এলাকার দিকে নিয়ে যাচ্ছে আকাঙখাকে,নিশ্চয়ই তার কোনো না কোনো কারণ আছে।
আকাঙখাকে ক্ষতি করার থাকলে পারমিতা অনেক আগেই করতে পারতে।বরং চুপ থেকে দেখা যাক ঠিক কি কি করতে চলছে পারমিতা।
ইতিমধ্যে ভয়ে প্রচন্ড ঘেমে গেছে আকাঙখা,এতো ভয় সে তার জীবনে পায় নি।কিন্তু সত্যের মুখোমুখি হতে হলে ভয়কে তো জয় করতেই হবে।পারমিতা নিজে থেকে কিছু করতে চাইছে, তাকে বাধা দেয়া একদম ঠিক হবে না।
গাড়ি চলতে চলতে একটা রাস্তার মোড়ে গিয়ে থামলো,আরে এই পথ ধরেই তো আকাঙখা সকালবেলা পারমিতার বাড়িতে গিয়েছে,কিন্তু কি এমন আছে এই জায়গায়,আর পারমিতা এখানে থেমেই বা গেলো কেন?
গাড়ি পুরোপুরি থামতেই ভেতর থেকে নেমে আসে আকাঙখা,রাস্তায় পা দিয়েই দেখতে পায় অপর পাশে পারমিতা দাঁড়িয়ে আছে।
ঘড়িতে তখন প্রায় দুইটা বাজে,
এই সময়ে এই রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায় বললেই চলে।
ফাঁকা রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে দুজন নারী।
দুজন দুজনের মুখোমুখি।
কারো মুখে কোনো কথা নেই,
প্রথমে আকাঙখা মুখ খুললো :
—-তুমি আমায় এই জায়গাটায় কেন নিয়ে আসলে?আচ্ছা কি এমন আছে এখানে খুলে বলো আমায়,,,কি চাইছো তুমি,তুমি কি কিছু বলতে চাও আমায়?
একটা লাশের সাথে কথা বলছে,এটা ভাবতেই আকাঙখার আতংকে গলা জড়িয়ে আসছে, তবুও অনেক কষ্টে নিজেকে ম্যানেজ করে নিচ্ছে সে।জীবনে এমন ভয়ানক আর কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে জাস্ট কোনোদিন ভাবতে পারে নি সে,এটা অকল্পনীয় তার কাছে।
—এই যে জায়গাটা দেখতে পাচ্ছো,আজ থেকে ঠিক নয় বছর আগে এই জায়গায় মৃত্যু হয়েছে আমার!
(পারমিতা প্রথমবারের মতো তার মুখ খুললো,তবে ওর কন্ঠস্বর টা সম্পূর্ণ অন্যরকম লাগছে,কোনো সাধারন মানুষের গলার আওয়াজ মনে হচ্ছে না।বেশ অন্যরকম আর ভয়ংকর সুন্দর।এমন কন্ঠ আগে কখনো শুনেনি আকাঙখা,তার ভয়ও লাগছে একপ্রকার,আবার এক প্রকার ভালোলাগাও কাজ করছে।
বড্ড অদ্ভুত ব্যাপার)
—হ্যাঁ,আমরা জানি আজ থেকে নয় বছর আগে তোমার মৃত্যু হয়েছে,আর আমি এটাও জানি বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে তোমার।।কিন্তু তোমার তো বিয়ে হচ্ছিলো,আমার জানামতে তুমি সেজেগুজে পার্লার থেকে ফিরছিলে।তো এরমধ্যে হঠাৎ কি এমন ঘটে গেলো যার কারনে তোমায়?
—-হ্যাঁ,ঐ দিন আমার বিয়ে ছিলো।আরফানের সাথে বিয়ের বিয়ে হবার কথা ছিলো আমার। কনে সাজার জন্য পার্লারে আসি আমি।পার্লারে এসে নিজের মনের মতো সাজলাম।কোথাও কোনো কার্পন্যতা ছিলো না।কারণ সেই দিন আমার দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন পরিনতি পেতে যাচ্ছিলো,নিজের ভালোবাসাকে আপন করে পাবার স্বপ্ন,তার সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন।এক রাশ আনন্দ আর বুক ভরা আশা নিয়ে পার্লার থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
আকাঙখা হা করে পারমিতার কথাগুলো শুনছে।
—তারপর কি হলো?
—রাত তখন আটটা বাজে।গাড়িতে ড্রাইভারের সাথে আমি একাই ছিলাম।এদিকে বিয়ের আসরের সবাই একের পর এক ফোন দিয়ে তাড়া দিচ্ছিলো,যাতে আমি যথোদ্রুত সম্ভব বিয়ের আসরে পৌঁছে যাই।আরফান ও বার বার ফোন দিচ্ছিলো আমায়।
এরপর হঠাৎ একটা খটকা লাগতে শুরু করে আমার কাছে,আমার মনে হলো গাড়ির ভেতরে আমি একা নই,অন্য কেউ আছে।তারা আমার পেছনেই আছে।
আমার সন্দেহ ক্রমশ বাড়তেই থাকে।আমি ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলি এটা পরখ করতে যে সত্যি গাড়িতে কেউ আছে কিনা।
ড্রাইভার গাড়ি থামাতে যাবে ঠিক তখন দুটো লোক পেছন থেকে আমার মুখ চেপে ধরে,মূহুর্তে হতভম্ব হয়ে যাই আমি।কোথা থেকে কি হয়ে যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
লোকদুটো ড্রাইভারকে পিস্তল দেখিয়ে গাড়ি না থামানোর জন্য অর্ডার করে,ড্রাইভার ভয়বশত তাদের কথা শুনতে বাধ্য হয়।
লোকদুটো জোর জবরদস্তি করে আমার সাথে, আমি ছাড়ানোর অনেক চেষ্টা করলেও তাদের সাথে একা কিছুতেই পেরে উঠতে পারি নি।
একপর্যায়ে তারা আমায় টেনে পেছনের সিটে নিয়ে যায়।
আমি চলন্ত গাড়ি থেকে ঝাঁপ দেবার অনেকবার চেষ্টা পর্যন্ত করি,কিন্তু তাদের কাছে পরাজিত হই বার বার।
—আচ্ছা,লোকদুটো কারা ছিলো,তুমি কি তাদের চেহারা দেখতে পাও নি,তাদের চিনতে পেরেছিলে কি?
—না,আমি তাদের চিনতে পারি নি।আগে কখনো তাদের সাথে দেখা হয় নি আমার। এরপর লোকদুটোর কাছে একটা ফোনকল আসে।তারা ফোন রিসিভ করে।
তাদের খুব কাছাকাছি থাকার কারনে ফোনের অপর পাশের কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম।
সেই লোকটা ফোন করে শুধু একটা কথা জিজ্ঞাসা করে যে তাদের কাজ শেষ হয়েছে কিনা।পতুত্ত্যরে তারা জবাব দেয়,একটু পরেই শেষ হবে,আর সে যেন টেনশন না করে।
—একটা একটা কথা বলো প্লিজ,তুমি নিশ্চয়ই ফোনে তার ভয়েজটা শুনতে পাচ্ছিলে।।ভয়েজ শুনে কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছিলে কি?কে হতে পারে সে?
—হ্যাঁ,আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম,আর কন্ঠস্বরটা তখন বেশ পরিচিত অনুভুত হয় আমার কাছে। মনে হচ্ছিলো এই কন্ঠস্বর যেন আমার বহুদিনের চেনা।আমিও আগেও বহুবার শুনেছি তার কথা।সে আমার খুব কাছের কেউ।
—-চেনা কন্ঠস্বর!কিন্তু কে ছিলো সে?
তুমি নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পেরেছিলে কিছু!বলো আমায়,কে ছিলো সে,কে ফোন করে তোমায় খু ন করার আদেশ দিলো!তোমার এতো বড়ো ক্ষতি কে চাইতে পারে,আর কেন?কি উদ্দেশ্য তার।
—আগে আমায় আমার কথা শেষ করতে দাও, সব খুলে বলবো তোমায় আমি।তারপর লোকদুটো একটা শিশি বের করলো।
আমি বুঝতে পারলাম ওটা কোনো বিষের শিশি ছিলো।
শিশিটা বেশ ছোট,ভেতরে মাত্র কয়েক ফোঁটা বিষ হবে,বুঝতে পারি বেশ মারাত্মক এই বিষ।
একটা লোক আমায় গাড়ির সিটের সাথে চেপে ধরে,অন্যজন জোর করে সেই শিশির বিষ জোর করে আমার মুখের ভেতরে দেবার চেষ্টা করে।
আমি নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করি।এদিকে পিস্তলের ভয়ে ড্রাইভার লোকগুলোর কমান্ড ফলো করতে থাকে।আমায় একটা নির্জন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হলো।
চলবে……