পারমিতা পর্ব ৭

0
566

#পারমিতা
পর্ব—-০৭
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।

এরপর পারমিতার লাশ ভাইব্রেট হতে শুরু করলো।সবাই এই দৃশ্য দেখে বেশ ঘাবড়ে যায়।

পারমিতার মা আর দাদা বেশি ঘাবড়ে গেলেন।

—একি,কি হচ্ছে এগুলো,এগুলো কিভাবে হচ্ছে?

—-দেখুন একদম ভয় পাবেন না,,আমি তো আছি সাথে।।আমি দেখে নিচ্ছি ব্যপারটা।

—-কিন্তু মা,পরি চোখ মেলে আছে কিকরে,দেখো ওর সারা শরীর কাঁপছে,,এটা কিভাবে সম্ভব। আমরা আমাদের মেয়েকে এইভাবে দেখতে চাই নি,চাই নি এইভাবে দেখতে।

—-আমি আপনাদের মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি,কিন্তু কি আর করার আছে বলুন।পারমিতা মারা গিয়েছে এটা ধ্রুব সত্য,কিন্তু ওর মধ্যে নিজেকে সেভ করার বা কন্ট্রোল করার পাওয়ারটা এখনো আছে।সেই কারনে এরকম হচ্ছে।

—দেখুন বাবা,ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখো,ওর চোখের পাতা নড়াচড়া করছে, আমাদের পরি আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে,দেখুন।
ও মনে হয় কিছু বলতে চায় আমাদের,আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি।
(পারমিতার মা ওর দাদাকে উদ্দেশ্য করে বলে)

—একদম ঠিক ধরেছেন আপনারা,ও কিছু জানাতে চায় আমাদের,কিন্তু কোনো কারনে সেটা সম্ভব হচ্ছে না।

—কিন্তু সেটা কিকরে সম্ভব মা,আমাদের পরী তো সেই কতবছর আগেই মারা গেছে,আমরা আমাদের চোখের সামনে ওকে মরে যেতে দেখেছি।এখন কিনা..

—হ্যাঁ,পারমিতা মারা গেছে ঠিকই,কিন্তু ওর অনুভূতি শক্তি এখনো মারা যায় নি।ওর ইচ্ছা, আকাঙখা,অনুভূতি শক্তি এখনো জীবিত।এই ইন্দ্রিয়সমূহ ওকে জীবিত মৃতর মাঝখানে ফেলে রেখেছে।

—-আমি তোমার এতো ভারী ভারী কথার অর্থ বুঝতে পারি না মা,কিন্তু একটা জিনিস ঠিক বুঝতে পারছি আমাদের মেয়েটার সাথে নিশ্চয়ই খারাপ কিছু হয়েছে।ওর মৃত্যুটা স্বাভাবিক কোনো মৃত্যু ছিলো না।অন্যায় করা হয়েছে ওর সাথে!

—হ্যাঁ,আমি প্রথম থেকে সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করছি আপনাদের,কিন্তু ওর সাথে কে এমন একটা জঘন্য কাজ করলো,আর কেনই বা করলো।কি উদ্দেশ্যে ছিল তার?এই প্রশ্নের উত্তর একমাত্র পারমিতাই দিতে পারে,আর দিতে পারবে সেই অপরাধী,যে ওর মৃত্যুর জন্য দায়ী।

—-কিন্তু সেই অপরাধী কে,
কার জন্য আমাদের মেয়েটাকে অকালে পৃথিবী ছেড়ে…

বৃদ্ধর কথা শেষ হতে না হতেই একটা আর্তচিৎকারের আওয়াজ ভেসে আসলো,ছেদ পড়লো তার কথায়।

পারমিতার মা তাকে আর আকাঙখাকে ডেকে পারমিতার কাছে নিয়ে গেলো,এতোক্ষণে তারা দুজন কথা বলতে বলতে একটু দূরে সরে এসেছিলো।

—ম্যাডাম দেখুন,বাবা দেখুন।আমাদের পরীর চোখে পানি।ও কান্না করছে,দেখুন ও কান্না করছে।।

আকাঙখা লক্ষ্য করলো সত্যি পারমিতার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।জীবনে এই প্রথম কোনো লাশকে কান্না করতে দেখছে সে।
সারা গায়ে যেন একটা অদ্ভুত আলোড়ন হচ্ছে,মুহুর্তেই কাঁটা দিয়ে উঠলো।

—-এগুলো কি হচ্ছে বাবা,এই দৃশ্য আমি সহ্য করতে পারবো না,আপনি নিয়ে চলুন আমায় এখান থেকে।এর থেকে আমাদের এখানে না আসাই ভালো ছিলো,অন্তত এসব দেখতে হতো না।
(কেঁদে কেঁদে পারমিতার মা বলতে লাগলো)

পারমিতার মুখের দিকে তাকালে অবাক হতে হচ্ছে,একটা মৃত মানুষ, যার আত্মা কিনা তাকে ছেড়ে চলে গেছে, তার চোখ,তার চাহনি তার অবয়ব এখনো যেন কথা বলছে,তারা কিছু জানান দিতে চাইছে।

তবে এখন আর ওর শরীর আগের মতো ভাইব্রেট করছে না।একেবারে স্থির হয়ে আছে।

আকাঙখাও চাইছে না,পারমিতার পরিবারের লোকজন আর এখানে থাকুক,সত্যি মা,দাদা হয়ে এই দৃশ্য তাদের পক্ষে দেখা সম্ভব হচ্ছে না।তাছাড়া শুধু তারা নয়,পারমিতাও হয়তো কষ্ট পাচ্ছে।

—ঠিক আছে,আপনারা চলুন এখান থেকে, এরপরে যখন দরকার হবে আমরা আবার আসবো।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলাকে নিয়ে
আকাঙ্খা মর্গের বাইরে বেরিয়ে আসলো।

এদিকে হঠাৎ আরফানের ফোন :

—-হ্যালো,হ্যাঁ,আকাঙখা তুমি কোথায়?

—আমি হসপিটালে আছি।

—হসপিটালে আছো!এখন হসপিটালে কি করছো তুমি,,,আর সারা দিন কোথায় ছিলে??

—–একটা জরুরী কাজে শহরের বাইরে যেতে হয়েছিলো,তুমি বাসায় ফিরেছো?

—-আরে আমার কথা রাখো,জরুরী কি এমন কাজ ছিলো,একবার আমাকে বলার পর্যন্ত প্রয়োজন বোধ করলে না।

—তোমায় বলে কি করতাম?

—কি করতাম মানে কি,আমিও যেতাম তোমার সাথে।তারোপর সারাটা দিন ফোন অফ করে রেখেছো,টেনশন হয় না আমার।

—-আচ্ছা,এখন তো আমি এসে গেছি,টেনশন করতে হবে না,আর আমি একটা পার্সোনাল কাজেই গিয়েছিলাম,বুঝতে পারিনি এতটা লেট হয়ে যাবে।

—-পার্সোনাল কাজ,কিসের পার্সোনাল কাজ?

—কেন আরফান,আমার কি কোনো পার্সোনাল কাজ থাকতে পারে না,আর সেটা আমি তোমায় কেন শেয়ার করতে যাবো,তুমি তোমার সব কথা শেয়ার করো আমার সাথে?

—তুমি এভাবে কথা বলছো কেন আমার সাথে ,,, আচ্ছা যাই হোক,যা হয়েছে হয়েছে। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে এসো।আমি আজ নিজের হাতে রান্না করেছি।তুমি এলে দুজনে একসাথে খাবো।

আকাঙখা কোনোপ্রকার প্রসন্নতা বা আগ্রহ না দেখিয়ে ফোনটা কেটে দিলো।
আরফানকে নিজের থেকেও একদিন বেশি বিশ্বাস করতো সে,নিজের থেকে বেশী ভালোবাসতো,ইন ফ্যাক্ট এখনো বাসে।
কিন্তু আরফান ওর সাথে এমন একটা ব্যবহার করবে কিছুতেই মানতে পারছে না।।

পারমিতার ব্যাপারে সবকিছু খুলে বললে কি এমন হতো।শুধু আকাঙখা না আরফান ও যথেষ্ট বিশ্বাস করে,ভালোবাসে তার স্ত্রীকে, সম্মান করে।
তবে সে কেন সত্যটা স্বীকার করার সাহস পেলো না।ওর যে আগে একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিলো এটা স্বীকার করলে কি আকাঙখা কি ছেড়ে চলে যেতো তাকে।
দীর্ঘ আট বছর সংসার করার পরেও এতোটুকু সম্মান,বিশ্বাসের জায়গা তৈরী করতে পারলো না সে নিজের স্ত্রীর জন্য।

তার মানে কি এটা..আরফান পুরোপুরি বিশ্বাস করে না আকাঙখাকে।
কিন্তু বিশ্বাস ছাড়া কি ভালোবাসা সম্ভব। বিশ্বাস আর সম্মান না থাকলে কী কখনো ভালোবাসা তৈরী হতে পারে!

দিনে দিনে আরফানকে বড্ড অপরিচিত মনে হয় আকাঙখার,বর্তমান আরফানের সাথে তার পূর্বের আরফানের যেন মিল খুঁজে পাচ্ছে না কিছুতেই।দুজনের ভেতরে আকাশ পাতাল ব্যবধান।

আরফানের ওপর একরাশ অভিমান নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায় সে।

হঠাৎ মনে হলো কেউ জানি একটা আছে তার পিছনে।পা জোড়া স্থির হয়ে গেলো,মাথাটা ঘুরিয়ে পেছনের দিকে তাকায়।

—-কই কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না,মনের ভুল নয় তো।

আবারো সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করলো আকাঙখা।বৃদ্ধ লোক আর ভদ্রমহিলাকে একটা রুমে শিফট করে দেয়া হয়েছে। আপাতত তাদের ব্যাপারে কেউ কিছু জানবে না।

আবারো কিছু অসঙ্গতি লক্ষ্য করে আকাঙখা,কেউ পেছন থেকে ফলো করছে তাকে,কিন্তু ঘুরে তাকালেই কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

এটা নিছক মনের ভুল,নাকি অন্য কিছু বুঝতে পারছে না সে।

আকাঙখা আপন মনে দ্রুত হাঁটতে লাগলো,জায়গাটা একদম ভালো মনে হচ্ছে না তার জন্য।

অবশেষে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলো,
আকাঙ্খার নিজেই ড্রাইভ করে বাসায় ফিরতে হচ্ছে।আরফান আর সে সাধারনত একসঙ্গেই বাসায় ফেরে,তখন আরফান ড্রাইভ করে।।আজ আরফান আগেই বাসায় চলে গিয়েছে,অবশ্য সে আগে গিয়েছে এমন নয়,আকাঙখাই একটু বেশি লেট করে ফেলেছে।

আজ রাস্তাঘাট একদম ফাঁকা,যানবাহনের ভিড় নেই বললেই চলে।আপন মনে নিজের মতো করে ড্রাইভ করে চলছে সে।

হঠাৎ আবারো সেই অদ্ভুত অনুভূতিটা নাড়া দিয়ে উঠলো,বার বার মনে হচ্ছে কেউ তার পেছনে বসে আছে।ভয়ে ঘুরে তাকানোর সাহস হচ্ছে না।

আচ্ছা ব্যাকমিরর দিয়ে বরং দেখা যাক।কেউ আছে কিনা পেছনে।

আয়নার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই একটা অপ্রত্যাশিত জিনিস আকাঙখার মাথাটা ঘুরিয়ে দিলো,নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে।

গাড়ির পেছনের সিটে পারমিতার লাশ স্থির হয়ে বসে আছে!

আজ আর কোনো লুকোচুরি নয়,পারমিতা স্বয়ং নিজে থেকে এসেছে আকাঙখার কাছে।।
আজ সে হয়তো আগের বারের মতো পালিয়ে যাবে না।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here