#বিরহ_শ্রাবণ
#পর্ব_১১
#লেখিকা:সারা মেহেক
অভ্র ভাই মুচকি হাসলেন। বললেন,
” দেখেছিলাম। তবে অনেক আগে। এজন্য তাকে আবারো এ রূপে দেখার ইচ্ছা আছে। ”
আমি আর কিছু বলতে যাবো, কিন্তু এর পূর্বেই নিচ থেকে নানু ডাকলো আমায়। ফলে অভ্র ভাইয়ের সাথে চলমান কথোপকথন মাঝ পথে ফেলেই ফুলগুলো নিয়ে নিচে ছুটলাম। অভ্র ভাই পিছন হতে গলা উঁচিয়ে বললেন,
” সবাইকে কিন্তু দিয়ে দিও ফুলগুলো।”
আমিও নিচে নামতে নামতে বললাম,
” আচ্ছা, দিয়ে দিবো। ”
——-
হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য আমাদের উপর অর্পিত কাজের পাট চুকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে আমার রুমে চলে এলাম। রুমে ঢুকেই উপস্থিত জনগণকে দেখে ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেলাম। পাশের বাড়ির সব মামি, খালা, তাদের ছোট বড় পিচ্চিবাচ্চা দিয়ে আমার রুমটা সাক্ষাৎ মাছের বাজার হয়ে গিয়েছে। এ মুহূর্তে এ রুমটা আমার রুম নয়, বরং লোকে-লোকারন্যময় একটা বাজার মনে হচ্ছে! আমি হতবাক দৃষ্টিতে আমার পুরো একবার নজর বুলিয়ে নিলাম। দেখলাম, বাচ্চাকাচ্চারা নিজেদের মতো বালিশ ছুঁড়াছুঁড়ি করছে, রুমের এই জিনিস, ঐ জিনিস নাড়ছে, তা দিয়ে খেলছে। এর মধ্যে দেখলাম, জয়নব মামির চার বছরের ছেলে আমার টেবিলে উঠে অভ্র ভাইয়ের দেওয়া একটা শোপিস নিয়ে খেলছে। ওর হাতে সেই শোপিসটা দেখা মাত্র আমার নিঃশ্বাস যেনো গলার কাছে আটকে গেলো। আমার জন্মদিন উপলক্ষে অভ্র ভাইয়ের দেওয়া সবচেয়ে পছন্দের একটা উপহার সেই শোপিসটা। এই শোপিসের কিছু হলে নির্ঘাত এই বাচ্চাকে কিছু করে ফেলবো আমি!
বাচ্চাটা শোপিস নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। দেখে মনে হচ্ছে, এখনই খেলার ছলে আমার শখের শোপিসটা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলবে। এই মনে হতে, বাচ্চাটা কিছু করার পূর্বেই আমি দ্রুত এগিয়ে বাচ্চাটার হাত থেকে শোপিসটা নিয়ে নিলাম। অমনিই বাচ্চাটা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না শুরু করে দিলো। ওর কান্না দেখে আমি দ্রুত শোপিসটা আড়ালে লুকিয়ে জয়নব মামিকে ডাক দিয়ে বললাম, উনার ছেলেকে নিয়ে যেতে। টেবিলে উঠে আমার বইয়ের উপর হা’ম’লা চালাচ্ছে বলে।
জয়নব মামি উনার ছেলেকে নিয়ে খাটে বসে আবারো সবার সাথে গল্পে মশগুল হলেন। এ মুহূর্তে তাদের গল্পের আসর দেখে মনে হচ্ছে, উনারা নয়, বরং আমিই আমার রুমে মেহমান হয়ে পা রেখেছি। বিয়ে বাড়িতে এই এক ঝামেলা!
আমি শোপিসটা আলমারির মধ্যে রেখে জয়নব মামিকে বললাম,
” মামি, আপনারা একটু অন্যরুমে যাবেন? আমি রেডি হবো যে তাই বলছিলাম আরকি…. ”
জয়নব মামি এক গাল হেসে বললেন,
” আমরা থাকতেই রেডি হও। সমস্যা কোথায়?মামিরাই তো বসে আছে। কোনো ছেলে নেই তো আর৷ ”
আমি খানিক বিরক্ত বোধ করলাম। তবে তা আড়ালে রেখে বললাম,
” এভাবে সবার সামনে রেডি হতে একটু লজ্জা করে মামি। আপনারা অন্য রুমে গিয়ে বসুন না প্লিজ। ”
জয়নব মামি আরোও কিছু বলতে নিলে উনার শাশুড়ী উনাকে থামিয়ে বললেন,
” আচ্ছা চন্দ্রিমা। তুমি রেডি হও। আমরা অন্য রুমে গিয়ে বসি। ”
এই বলে ঐ নানু নিজে উঠে গেলেন এবং রুম হতে বাকি সবাইকেও নিয়ে গেলেন। সবাই যেতেই আমি রুমে দরজা লাগিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এখন পুরো রুমটা দেখে মনে হচ্ছে, হ্যাঁ, এটা আমারই রুম। তবে বড্ড অগোছালো। যা দেখতে মোটেও দৃষ্টি সহনীয় নয়। এজন্য রেডি হওয়ার পূর্বে পুরো রুমটা আগের মতো গুছিয়ে নিলাম। এরপর আলমারি থেকে হলুদের জন্য ডিপ পার্পেল রঙের শাড়িটা বের করে নিলাম। তবে শাড়ি পরার পূর্বে মুখ ধুয়ে মেকআপ করে নিলাম। অতঃপর মেকআপ শেষে শাড়ি পরা শুরু করলাম। আর এই শাড়ি পরতে গিয়েই বাঁধলো যত বিপত্তি। শাড়ি ঘুরিয়ে আঁচল কাঁধের উপর নেওয়ার পর কুঁচি করতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হলাম। দীর্ঘ দশ কিংবা পনেরো মিনিটের প্রচেষ্টায় যখন কু্ঁচি করে গুঁজলাম তখন বাঁধলো আরেক বিপত্তি। শাড়ি পুরোপুরি পরা না হতেই কে যেনো দরজায় টোকা দিলো। প্রথম প্রথম ভাবলাম, হয়তো কোনো বাচ্চা দুষ্টুমি করেছে। কিন্তু নিমিষের মাঝেই অনবরত কড়াঘাতের ফলে বুঝতে বাকি রইলো না, বাইরে কোনো বাচ্চা নয়, বরং বড় কেউ আছে।
আমি কোনোমতে শাড়ি উঁচু করে ধরে একটুখানি দরজা খুলে বাইরে উঁকি দিলাম। অমনিই পাঞ্জাবি পরে তৈরূ হওয়া প্রোজ্জ্বল ভাইকে দেখে ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনি এখানে কেনো?”
প্রোজ্জ্বল ভাই আশেপাশে কেমন এক সতর্ক দৃষ্টি বুলাচ্ছিলেন। আমার প্রশ্ন শুনে চট করে আমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” একটু রেস্ট নিবো। ”
এই বলে কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে চেয়ে রইলেন। উনার এ চাহনি উপেক্ষা করে বললাম,
” তো নিন। আমার রুমে নক করছেন কেনো?”
আমার গলার স্বর বোধহয় একটু জোরেই শোনা গেলো। ফলে প্রোজ্জ্বল ভাই ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে সতর্ক কণ্ঠে বললেন,
” আস্তে কথা বল। আশেপাশে অনেক মানুষ আছে। ”
প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের সতর্ক করে দেওয়ায় পরিস্থিতি আমলে নিয়ে গলার স্বর কিছুটা নিম্নে এনে বললাম,
” আচ্ছা, আস্তে কথা বলছি। কিন্তু আপনি আমার রুমে নক করছেন কেনো?”
প্রোজ্জ্বল ভাই সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে দরজা ঠেলে আমার রুমে ঢুকতে নিলেন। কিন্তু শাড়ি পুরোপুরি না পরতে পারায় নিজের সর্বশক্তি দিয়ে উনাকে দরজা ঠেলতে বাঁধা দিলাম। তীব্র অভিযোগী কণ্ঠে শক্ত গলায় বললাম,
” আমি শাড়ি পরছি তো! এর মাঝে আপনি কেনো ঢুকবেন? আগে আমি রেডি হয়ে নেই, তারপর আসুন। ”
এই বলে দরজা আটকে দিতে চাইলাম। কিন্তু প্রোজ্জ্বল ভাই হাত দিয়ে তা ঠেকিয়ে আমায় আপাদমস্তক একবার দেখে নিলেন। অতঃপর বললেন,
” মিথ্যে বলিস না। আমি তো দেখছি, তুই পুরোপুরি রেডি হয়ে আছিস। ”
এই বলেই প্রোজ্জ্বল ভাই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়লেন। এবার চেষ্টা করেও উনাকে বাঁধা দিতে পারলাম না আমি৷
রুমে ঢুকেই দরজায় সিটকানি দিয়ে আমার দিকে চাইলেন। নিষ্পলক কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে চেয়ে বললেন,
” তুই তো রেডিই হয়ে আছিস!”
এ মুহূর্তে উনাকে আমার রুমে প্রবেশ করতে দেখে মেজাজ গরম হয়ে এলো। ফলস্বরূপ রাগত স্বরে বললাম,
” আপনি আমার রুমে এসেছেন কেনো? আপনার রুম কি নেই?”
” আমার রুম আছে। তবে আজকের জন্য মনে হয় সেই রুমটা আমার না। এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি, কাজ করার কারণে পিঠে প্রচণ্ড ব্যাথা করছিলো। ভাবলাম,রুমে গিয়ে একটু শুয়ে রেস্ট নেই। কিন্তু রুমে ঢুকতেই দেখি মায়ের একগাদা আত্মীয়স্বজন বসে আড্ডা দিচ্ছে। খাটে, চেয়ারে কোথাও বসার জায়গা নেই। কোন এক পূর্ব পুরুষের মামা,খালু হ্যানত্যান, আরো কতো কি এসেছে! এতো আত্মীয়স্বজন আমার নানী কোথা থেকে পয়দা করেছে আল্লাহ মালুম!”
এই বলতে বলতে উনি আমার খাটে বসে পড়লেন। অতঃপর আমার দিকে অসহায় চাহনিতে চেয়ে বললেন,
” তুই তো জানিস চন্দ্রিমা, আমার পিঠের ব্যাথা কত ভয়ানক পর্যায়ে চলে যায়! এজন্য একটু রেস্ট নিতে এসেছি। ”
বলেই উনি আমার অনুমতি ব্যতিত শুয়ে পড়লেন। উনার পিঠ ব্যাথা সম্পর্কে পূর্ব জ্ঞান থাকায় ইচ্ছা সত্ত্বেও উনায় নাকচ করতে পারলাম না আমি৷ তবে জিজ্ঞেস করলাম,
” বাড়িতে আর কোনো রুম ফাঁকা ছিলো না?”
প্রোজ্জ্বল ভাই এতোক্ষণে পায়ের উপর পা তুলে দিয়েছেন। আমার প্রশ্ন শুনে সিলিং এর দিকে চেয়ে বাম হাত মাথার নিচে রাখলেন। অতঃপর বললেন,
” ছাদ থেকে এসে দেখলাম, আমার রুমে এ অবস্থা। তাহলে নির্ঘাত আপুর রুমেও এমন অবস্থা হবে। তোর রুমের দরজা আটকানো দেখে ভাবলাম, বোধহয় তোর রুমটা ফাঁকা আছে। এজন্যই চলে এলাম। আর কষ্ট করে নিচেও নামিনি এ কারণে।”
প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের সহজ সরল স্বীকারোক্তি আমি মেনে নিলাম ঠিকই। তবে আরেকটি বিষয় আমায় ভাবতে বাধ্য করলো। উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনি সরল মনে এসেছেন আমার রুমে রেস্ট নিতে। তার উপর আমি রুমে একা। এটা যদি এখানে কেউ জানতে পারে, তাহলে কি হবে ভাবতে পারছেন?”
আমার প্রশ্নটা উপযুক্ত শোনালেও প্রোজ্জ্বল ভাই এতে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। বরং নিশ্চিন্ত কণ্ঠে বললেন,
” জানবে কিভাবে? না তুই বলবি, না আমি বলবো। আর আমি রুমে ঢুকার আগেই দেখে এসেছি, আশেপাশে কেউ নেই। তুইও বের হওয়ার আগে দেখে নিস। ”
প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের এরূপ কথাবার্তা শুনে এবার আমি হাল ছেড়ে দিলাম। বুঝলাম, নানা প্রশ্নের জালে উনাকে ফাঁসালেও উনি বের হবেন না। অগত্যা সে চেষ্টা বাদ দিয়ে আমি আয়নার দিকে ঘুরে তাকালাম।
আয়না হতে খাটের উপর প্রোজ্জ্বল ভাইকে সরাসরি দেখা যাচ্ছে। উনি পাশ ফিরে এদিকেই তাকিয়ে আছেন। একে তো রুমে উনার একলা উপস্থিতি, উপরন্তু আয়নার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকা! সব মিলিয়ে অপ্রস্তুতকর এক পরিস্থিতিতে পতিত হয়েছি আমি। তবুও সময় স্বল্পতার কারণে প্রোজ্জ্বল ভাইকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে ড্রেসিং টেবিল হতে একে একে চুড়ি ও কানের দুল নিয়ে তা পরে নিলাম। অতঃপর দ্রুততার সহিত চুল আঁচড়িয়ে খোঁপা করে নিলাম। এবার পালা আসলো, শাড়ির কুঁচি ঠিক করার, যা এতোক্ষণ অব্দি করিনি আমি৷
একবার মাথা নিচে ঝুঁকিয়ে শাড়ির কুঁচি দেখে নিলাম। জামদানি শাড়ি হওয়ায় নিচের দিকের কুঁচিগুলো বড্ড অগোছালো হয়ে আছে। এ দেখে হতাশার নিঃশ্বাস ছাড়লাম। এ মুহূর্তে একা হাতে নিচের কুঁচি ঠিক করবো কি করে এই ভেবে কান্না পেলো। তবে নিজেকে শক্ত করে প্রলম্বিত প্রশ্বাস টেনে নিয়ে নিচের দিকে ঝুঁকলাম, কুঁচি ঠিক করার জন্য।
আমাকে কুঁচি ঠিক করতে দেখে প্রোজ্জ্বল ভাই জিজ্ঞেস করলেন,
” কি করছিস ওভাবে?”
আমি নিজের কাজে ব্যস্ত থেকে ছোট্ট করে জবাব দিলাম,
” কুঁচি ঠিক করছি। ”
আমার জবাব দিতে দেরি হলো। তবে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের বিছানা হতে উঠে আসতে দেরি হলো না। উনি এসেই মেঝেতে দু হাঁটু গেঁড়ে আমার কুঁচি ধরে বললেন,
” দেখি মাথা উঁচু কর। আমি ঠিক করে দিচ্ছি। ”
অকস্মাৎ এভাবে প্রোজ্জ্বল ভাইকে দেখে কিয়ৎ সময়ের জন্য বিমূঢ় হয়ে এলাম। তবে দ্রুততার সহিত নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
” না না প্রোজ্জ্বল ভাই। আমি নিজেই ঠিক করছি। আপনি রেস্ট নিন।”
প্রোজ্জ্বল ভাই ছোট্ট এক ধমক দিয়ে বললেন,
” এতো কথা বলিস কেনো? দেখলাম তো, এক হাতে কত ঠিক করতে পারছিস! আমি হেল্প করছি। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক। ”
প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের কথায় আমি নীরবে দাঁড়িয়ে রইলাম। দেখলাম, গভীর মনোযোগের সহিত উনি নিচের কুঁচিগুলো সমান করছেন। মিনিট পাঁচেকের চেষ্টায় উনি কুঁচিগুলো সম্পূর্ণ ঠিক করে উঠে দাঁড়ালেন। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছেড়ে মুচকি হেসে বললেন,
” নে। ঠিক করে দিলাম কুঁচি। এবার তো তুই রেডি, তাই না? যা আপুর রুমে যা। আমি একটু রেস্ট নেই।”
আমি মৃদু হেসে উনাকে বললাম,
” থ্যাংক ইউ প্রোজ্জ্বল ভাই। ”
প্রোজ্জ্বল ভাই মুচকি হাসলেন। তবে মুহূর্তে ভ্রু জোড় কুঁচকে আমার দিকে চেয়ে বললেন,
” চন্দ্রিমা? তোর মনে হয় না, তোর হলুদের লুকে কিছু একটা কমতি আছে?”
প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের অনুসন্ধানী কণ্ঠের প্রশ্নে আমি আয়নায় একবার নিজেকে দেখে নিলাম। শাড়ি, চুড়ি, কানের দুল, মেকআপ, সবই তো আছে। তাহলে কিসের কমতি? আমি প্রোজ্জ্বল ভাইকে জিজ্ঞেস করতেই উনি কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে চেয়ে রইলো। বললো,
” এক সেকেন্ড দাঁড়া এখানে। আমি বুঝতে পারছি কিসের কমতি আছে। ”
এই বলেই উনি আমার টেবিলের এক কোনায় রাখা চন্দ্রপ্রভা ফুলের এক গুচ্ছা, যেটা আজ দুপুরে আমি নিজ হাতে ছিঁড়ে এনে রেখেছিলাম, সেটা নিয়ে আমার নিকটে এসে দাঁড়ালেন। অতঃপর আমার পিছে গিয়ে খোঁপায় এক গুচ্ছ চন্দ্রপ্রভা ফুল গুঁজে দিয়ে হাসিমুখে বললেন,
” নাউ ইউ লুক পারফেক্ট। এটারই কমতি ছিলো।”
এই বলে উনি আমার সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন। ঠোঁটে বিস্তৃত হাসি এনে বললেন,
” ডিপ পার্পেল রঙের শাড়ির সাথে খোঁপায় হলুদ চন্দ্রপ্রভায় তোকে ভালোই মানাচ্ছে চন্দ্রিমা। ”
এই বলে মুহূর্তেই ভ্রু উঁচিয়ে সন্দেহজনক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
” তুই কি দিনদিন সুন্দর হয়ে যাচ্ছিস নাকি?”
প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের এহেন প্রশ্নে খানিক লজ্জা পেলেও তা আড়াল করলাম। বললাম,
” আপনার চোখে সমস্যা হয়েছে প্রোজ্জ্বল ভাই। আপনি ডাক্তার দেখান৷
আমি আপুর রুমে যাচ্ছি। আপনি একটু রেস্ট নিন। ”
এই বলে আমি দরজা খুলতে নিলেই প্রোজ্জ্বল ভাই পিছন হতে এসে আমার মাথার উপর দিয়ে দরজায় হাত রাখলেন। সতর্ক কণ্ঠে বললেন,
” এতো তাড়াহুড়ো করিস কেনো? আগে দেখেনে, বাইরে কেউ আছে নাকি? এখনই তো হুটহাট বাইরে বের হয়ে একটা স্ক্যান্ডেল বাঁধিয়ে ফেলতি!”
উনার কথায় নিজের ভুল বুঝতে পেরে জিব কাটলাম। অতঃপর প্রোজ্জ্বল ভাই দরজা হতে হাত সরিয়ে নিতেই খানিক দরজা খুলে বাইরে উঁকি দিলাম। দেখলাম, বাইরে বাচ্চাকাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি করছে। আর মাত্রই প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের রুম থেকে কেউ বের হয়ে নিচে যাচ্ছে। তা দেখে আমি দ্রুত রুম হতে বের হয়ে দরজা আটকিয়ে দিলাম। আমি বের হতেই ওপাশ হতে প্রোজ্জ্বল ভাই রুমের সিটকানি লাগিয়ে দিলেন। আমাকে এভাবে রুম হতে বেরিয়ে যেতে যে কেউ দেখেনি তা ভাবতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম।
প্রত্যাশা আপুর রুমে এসে দেখি, আপুর ফ্রেন্ডরা আপুকে রেডি করিয়ে দিয়েছে। ফর্সা গায়ে হলুদ জামদানি, হাতে, কানে, গলায় তাজা রজনীগন্ধা ও লাল গোলাপের মালায় আপুকে ভীষণ সুন্দর লাগছে!
আমাকে দেখে আপু মুচকি হাসতে আমিও ফিরতি হাসি দিলাম। আপুর নিকট এগিয়ে বললাম,
” তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে আপু। তোমার এ সৌন্দর্য দেখে আমি স্পিচলেস। না জানি, শাহাদ ভাইয়ার অবস্থা কি হবে!”
আমার কথা শুনে আপু লাজুক হাসলো। বললো,
” তোকেও কম সুন্দর লাগছে না। বিশেষ করে খোঁপায় ফুলটা মানিয়েছে দারুণ। ”
খোঁপার ফুলের কথা বলতেই আমার দৃষ্টি চলে গেলো আপুর ড্রেসিং টেবিলে রাখা চন্দ্রপ্রভা ফুলগুলোর উপর, যা অভ্র ভাই আমাকে দিয়েছিলেন। ফুলগুলো দেখে আপুকে জিজ্ঞেস করলাম,
” খোঁপায় ফুল দাওনি আপু?”
” কিভাবে দিবো? মাথায় যে আধ ঘোমটা দিয়েছি।”
” ওহ হ্যাঁ। ঘোমটা দিলে আর ফুলের দরকার কি। কিন্তু আরো ফুল যে ছিলো, এতো ফুল গেলো কোথায়?”
” এই যে, আমার ফ্রেন্ডরা কিছু নিয়েছে, আর যারা শাড়ি পরেছে তারা নিয়েছে। ”
আপুর এ কথা শুনে আমি চন্দ্রপ্রভা ফুলগুলো নিয়ে আপুকে বললাম,
” এগুলো শুধু শুধু নষ্ট হবে কেনো? আমার খোঁপার অন্য পাশে এগুলো গুঁজে দাও। ”
আপু আমার হাত থেকে ফুল নিয়ে আমার খোঁপার ওপর পাশে গুঁজে দিলো। এর মাঝে আমি জিজ্ঞেস করলাম,
” শারমিন আপু আসবে না?”
” হ্যাঁ। আসছে ওরা। খালাকে ফোন দিয়েছিলাম, বললো, শারমিন বিকালেই অফিস থেকে ফিরেছে। একেবারে রেডি হয়েই ফিরবে।”
” ওহ আচ্ছা। ”
শারমিন আপু, প্রোজ্জ্বল ভাই ও প্রত্যাশা আপুর একমাত্র খালার দুমাত্র মেয়ে। শারমিন আপু ছোট, আর আপুর এক বড় বোনও আছে যার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এ মুহূর্তে সেই আপু স্বামী সন্তানসহ আমেরিকায় আছে। আর শারমিন আপু এখনও অবিবাহিত। বর্তমানে আপু একটা ফুড প্রোডাক্ট কোম্পানিতে জব করছে। বয়সে শারমিন আপু আর প্রোজ্জ্বল ভাই সমবয়সী।
খোঁপায় ফুল গুঁজে দেওয়া শেষ হতেই আমি আয়নায় এক নজর নিজেকে দেখে নিলাম। সত্যিই, এ রঙের শাড়ির সাথে খোঁপায় চন্দ্রপ্রভা ফুলটা মানিয়েছে ভালো। আমি কয়েক সেকেন্ড নিজের দিকেই চেয়ে রইলাম। অবচেতন মনে চট করে একটা বিষয় খেলে গেলো, আমার খোঁপায় এক পাশে অভ্র ভাইয়ের দেওয়ার ফুল এবং অপর পাশে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের গুঁজে দেওয়া ফুল!
®সারা মেহেক( গল্প সম্পর্কে মন্তব্য করে আমাকে উৎসাহ করেন না কেনো🥺। আমি যে মাঝে মাঝে নিরুৎসাহিত হয়ে যাই!)
#চলবে