বিরহ শ্রাবণ পর্ব ১০

0
974

#বিরহ_শ্রাবণ
#পর্ব_১০
#লেখিকা:সারা মেহেক

দূর হতে চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে শুনতে ক্রমশ সে শব্দ অতি নিকটে অনুভূত হলো। দেখলাম গেট হতে বেশ কয়েক কদম দূর থেকে কেউ একজন ছুটে আসছে। তার পিছে দা নিয়ে ছুটে আসছে গুটিকয়েক লোক। প্রত্যেকের জবানে হিং’স্র’মূলক বুলি। বুঝা যাচ্ছে লোকগুলো সামনের সেই মানুষটাকে মারতে ছুটে আসছে। এদিকে সেই মানুষটা প্রাণপনে দৌড়াচ্ছে। তার পরনের শার্ট র’ক্তে ভিজে জবজবে হয়ে আছে। এ দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠলাম আমি৷ কিন্তু জখম ব্যক্তিটির চেহারা যখন উপর হতে দেখলাম তখন যেনো আমার পুরো দুনিয়া চক্কর দিয়ে উঠলো। র’ক্তে জর্জরিত ব্যক্তিটি আর কেউ নয় বরং ভাইয়া। ভাইয়াকে এ অবস্থায় দেখে হাত বাড়িয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলাম আমি। অতঃপর নিজেকে আবিষ্কার করলাম বিছানার উপর।
চোখজোড়া মেলে চারপাশ একবার পর্যবেক্ষণ করে বুঝলাম সবটাই আমার স্বপ্ন ছিলো। তবে এ যে স্বপ্ন হয়েও বাস্তব ছিলো তা নিমিষের মাঝে উপলব্ধি করলাম আমি। ফলস্বরূপ নিজেকে আটকে রাখতে না পেরে জোরে জোরে কান্না শুরু করলাম। কেমন যেনো ভয়ে আমার পুরো শরীর শিউরে উঠছে। অনবরত ঘামছি আমি। হৃদপিণ্ড স্বাভাবিকের চেয়ে তুমুল জোরে দৌড়াচ্ছে যেনো! না চাইতেও বারবার চলমান দৃশ্যের ন্যায় ভাইয়ার ঘটনাটা চোখের সামনে ভাসছে।

অকস্মাৎ দরজা খুলে আমার রুমে প্রবেশ করলেন প্রত্যাশা আপু, প্রোজ্জ্বল ভাই ও মামি। প্রত্যাশা আপু আমাকে দেখেই দ্রুত আমার নিকটে চলে এলো। আপুকে কাছে পেয়ে আমি সাথে সাথে আপুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। আপু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে উদ্বিগ্ন ও কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” এই চন্দ্রিমা, চন্দ্রিমা? কি হলো হঠাৎ? এভাবে চিৎকার দিয়ে উঠলি কেনো? আর এভাবে কান্না করছিস কেনো? ”

আমি কোনো জবাব দিলাম না৷ বরং সশব্দে, ভীত অনুভূতি পুষে কাঁদতে লাগলাম। প্রোজ্জ্বল ভাই বললেন,
” আমার মনে হয় চন্দ্রিমা খারাপ স্বপ্ন দেখেছে আপু। জিজ্ঞেস কর ওকে। ”

প্রত্যাশা আপু পূর্বের ন্যায় মাথায় হাত বুলালো। তবে এবার উদ্বিগ্ন কণ্ঠে নয়, বরং নরম সুরে জিজ্ঞেস করলো,
” চন্দ্রিমা? তুই কি খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস?”

আমি কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়ালাম৷ আপু জিজ্ঞেস করলো,
” কি নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিস চন্দ্রিমা?”

আমি নিরুত্তর রইলাম। আপু পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
” চন্দ্রিমা? বললি না তো কি নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিস?”

কান্নার দমকে ঠিকমতো কথা বলা হয়ে উঠছিলো না আমার জন্য। তবুও বেশ কষ্টেসৃষ্টে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললাম,
” ভাইয়া। ভাইয়াকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম।”
এই বলে আমি পুনরায় কাঁদতে লাগলাম। আজ কিছুতেই আমি কান্না করা হতে নিজেকে বিরত রাখতে পারছি না৷ ভাইয়ার ঘটনাটা বার-বার মনে হানা দিচ্ছে।

আপু পূর্বের ন্যায় বললো,
” আচ্ছা, আচ্ছা। এবার চুপ কর সোনা। অনেক কেঁদেছিস। এতো কাঁদলে শরীর খারাপ করবে তো!”

আমাকে শান্ত করতে মামি এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত রাখলেন। স্পষ্ট অনুভব করলাম, উনি ভেজা কণ্ঠে বললেন,
” মা রে, এতো কাঁদিস না। তোর এই বুড়ো মামিকে দেখে কি একটুও মায়া হয় না? তোকে এভাবে কাঁদতে দেখলে যে আমার ভালো লাগে না। বুকটা ভার হয়ে আসে, গলা শুকিয়ে যায়। তুইই বল, বুড়ো বয়সে এতো চাপ আমি সহ্য করবো কিভাবে? আর কাঁদিস না মা। তোকে এভাবে দেখে আমার ব্লাড প্রেশার আবারো হাই হয়ে যাচ্ছে। ”

মামির শেষোক্ত কথাটি কান্নার মাঝেও আমাকে ভাবতে বাধ্য করলো। সত্যি আমার কারণে মামির শরীর খারাপ হয়ে গেলে তখন তীব্র অনুশোচনা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না আমার। এই ভেবে আমি আপুকে ধীরে ধীরে ছেড়ে দিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করলাম। মামি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে প্রশংসার সুরে বললেন,
” এই তো মা আমার সব কথা শুনে! আর কাঁদিস না। ওসব কথা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা কর চন্দ্রিমা। যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। চার বছর আগের ঘটনা নিয়ে এভাবে কাঁদলে কি চঞ্চল ফিরে আসবে? এর চেয়ে না কেঁদে জায়নামাজে বসে ওর জন্য দোয়া করলেও তো পারিস! এবার কান্না বন্ধ করে হাতমুখ ধুয়ে আয় একটু। তোর জন্য খাবার নিয়ে আসছি আমি। সন্ধ্যা হয়ে গেলো, অথচ এখনও দুপুরের ভাতটুকুও খাসনি।”

আমি মামির কথা শুনে কান্না থামাতে চেষ্টা করলাম। তবুও পুরোপুরি কান্না থামাতে পারলাম না৷ যতই ভাইয়ার কথা ভুলে থাকতে চাইছি ততই যেনো ভাইয়ার স্মৃতি আরো বেশি হানা দিচ্ছে আমায়!
বিছানায় নত মস্তকে বসে আছি আমি। চোখ দিয়ে নিঃশব্দে জল গড়িয়ে পড়ছে। কান্নার শব্দ না হলেও ফুঁপানোর শব্দ ঠিকই হচ্ছে। মামি এখনও দাঁড়িয়ে আছে। আমার এভাবে ফুঁপানো দেখে মামি নাখোশ কণ্ঠে বললেন,
” নাহ! মেয়েটা আমার কথা শুনে না। এখনও কেঁদে যাচ্ছে!”

মামির কথার প্রত্যুত্তরে আমি কোনোরকমে বললাম,
” আমি চেষ্টা করছি মামি। কিন্তু কান্না যে থামতেই চাইছে না!”

প্রোজ্জ্বল ভাই এবার বললেন,
” এ কোনো চেষ্টা হলো!”
এই বলে তিনি হাঁটু গেঁড়ে আমার সম্মুখে বসে পড়লেন। কিঞ্চিৎ মাথা উঁচু করে আড়চোখে দেখলাম উনায়। উনি নীরবে হাত বাড়িয়ে আমার থুতনি ধরে মাথা তুলে দিলেন। অতঃপর নাকমুখ কুঁচকে আফসোসমূলক শব্দ উৎপন্ন করে বললেন,
” নাহ! আর হলো না! কই ভাবলাম আপুর বিয়েতে ছেলে খুঁজে তোকেও আপুর সাথে পাঠিয়ে দিবো। কিন্তু তুই তো কান্না করে চোখমুখ ঢোল বানিয়ে ফেলেছিস!”

প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের মুখে বিয়ের কথা শুনে মুহূর্তেই ঝেঁঝে উঠলাম আমি। এতোক্ষণ ফুঁপালেও এবার কান্না শুরু করলাম। মামির দিকে চেয়ে অভিযোগোর সুরে বললাম,
” মামি! প্রোজ্জ্বল ভাই কি বলে! আমি বিয়ে করবো না কিন্তু! ”

আমার অভিযোগ শুনতে দেরি হলো কিন্তু প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের পিঠে ঘা বসিয়ে দিতে একটুও দেরি হলো না মামির। উনি আমায় সান্ত্বনা দিতে বললেন,
” এই দামড়ার কথায় কান দিস কেনো? ও বললেই কি হয়ে গেলো না কি! তোকে কি এভাবে যেন-তেন ছেলের সাথে বিয়ে দিবো? তোর জন্য তো খুঁজে খুঁজে হীরের টুকরো ছেলে বের করবো। ”

মামির এহেন কথা শুনে আমার দিকে চেয়ে ভ্রু নাচিয়ে হাসলেন প্রোজ্জ্বল ভাই। উনার এ কান্ড এবং মামির মুখে বিয়ের কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলাম আমি। তীব্র অভিযোগের সুরে বললাম,
” বিয়ের কথায় না বলার পরও আবার কেনো বিয়ের কথা তুলছেন মামি!”
এই বলে আমি অসহায় চাহনিতে প্রত্যাশা আপুর দিকে চাইলাম। আপু আমার পানে আদুরে চাহনিতে চেয়ে প্রোজ্জ্বল ভাই ও মামিকে বললো,
” শুধু শুধু মেয়েটাকে জ্বালাচ্ছো তোমরা। এবার যাও তো রুম থেকে। আমি ওর সাথেই আছি। মা, তুমি খাবার নিয়ে আসো। আর প্রোজ্জ্বলের বাচ্চা, তুই নিজের রুমে যা। সুযোগ পেলেই চন্দ্রিমার পিছে পড়া যেনো তোর মুদ্রাদোষ হয়ে গিয়েছে! আর যদি তোকে এমন করতে দেখেছি!”
এই বলে আপু আমার পাশে বসলো। মামি আমাদের এ কান্ড দেখে হাসতে হাসতে চলে গেলো। কিন্তু প্রোজ্জ্বল ভাই তখনও গেলেন না। উল্টো উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,
” বাড়িতে তোর সাপোর্টিভ মানুষের অভাব নেই। নে নে, কত সুযোগ নিবি নে। একদিন আমারও সুযোগ আসবে ম্যাডাম চাঁদ, চন্দ্রিমা। হুহ।”

এই বলে প্রোজ্জ্বল ভাই চলে গেলেন। উনি যাওয়ার পর আপুকে জিজ্ঞেস করলাম,
” নানু কোথায় আপু? দেখলাম না যে?”

” তুই উঠার কিছুক্ষণ আগেই দাদু পাশের বাড়িতে গিয়েছে। বান্ধবীর সাথে পান চিবুতে। যাওয়ার আগেই বলেও গিয়েছে, তুই উঠলেই যেনো ডাকি তাকে। কিন্তু তুই এমনভাবে উঠলি…. যাই হোক, হাত মুখ ধুয়ে আয় তুই। আমি নিচে গিয়ে খাবার নিয়ে আসি। ”
এই বলে আপু চলে গেলো। আমি ওভাবেই কিছুক্ষণ বসার পর ওয়াশরুমে গেলাম। ওয়াশরুমে গিয়ে নিজেকে শান্ত করে একদৃষ্টিতে আয়নার দিকে চেয়ে রইলাম৷ চোখের সামনে পুনরায় ভাসতে লাগলো অতিতের সেই স্মৃতিগুলো।

বাবা-মায়ের স্নেহের হাত মাথা থেকে সরে যাওয়ার পর আমার তৃতীয় স্নেহের হাত হয় ভাইয়া। ছোট থেকেই ভাইয়ার সাথে খুব মিল ছিলো আমার। ভাইয়াও আমাকে খুব আদর করতো। মা মারা যাওয়ার পর প্রথম প্রথম যখন মামাবাড়িতে আসি তখন ছোট্ট আমি নিজেকে সবসময় গুটিয়ে রাখতাম। সারাদিন ভাইয়ার শার্টের কোনা ধরে ভাইয়ার পাশে পাশে থাকতাম। ভাইয়াও আমাকে আগলে রাখতো।

চার বছর আগে, যখন আমি মাত্র ক্লাস নাইনে উঠি তখন ভাইয়া বিজনেস করার জন্য সুযোগ খুঁজছিলো। ভাইয়া চেয়েছিলো, মামার ছায়ায় আর না থেকে নিজে কিছু করে নিজের ও আমার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিবে। ভাইয়া তখন ভার্সিটির শেষ বর্ষে ছিলো। সেসময় আমাদের পাশের এলাকার এক লোকের কাছ থেকে অনেক টাকা ধার নিয়েছিলো ভাইয়া, বিজনেস করার জন্য। পরে অবশ্য জেনেছিলাম, ঐ লোকের মেয়েকে ভালোবাসতো বলেই ভালো বুঝে তার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিলো। যদিও লোকটি জানতো না ভাইয়া তার মেয়েকে ভালোবাসে। জানলে বোধহয় কখনো এতো টাকা ধার দিতো না।

সেই ধার করা টাকা নিয়ে ভাইয়া বিজনেস শুরু করে। কিন্তু ভাইয়ার এ টাকা ধার নেওয়ার ব্যাপারে বাড়ির কেউই জানতো না। যদিও সবাই জিজ্ঞেস করেছিলো টাকার ব্যাপারে। তখন ভাইয়া কোনো এক বন্ধুর কথা বলেছিলো।
বিজনেস শুরু করার পর প্রথম প্রথম কিছু লাভ হলেও পরে বিজনেসে বড় রকমের ধস নামে। ভাইয়া অনেক চেষ্টা করেও সে লোকসান ভরতে পারেনি। ওদিকে সেই টাকা সুদে আসলে পূর্বের চেয়ে অনেক গুন হয়ে গিয়েছিলো। এদিকে বিজনেসে লোকসান, ওপরদিকে পূর্বের চেয়েও দ্বিগুণ টাকা পরিশোধের চাপ, সব মিলিয়ে ভাইয়া অনেক চিন্তায় ছিলো। পরিস্থিতিও এমন ছিলো যে, এ ব্যাপারে বাড়ির কাউকে জানাতে পারেনি সে। আর বাড়িতে না জানানোর ব্যাপারটিই আমাদের সবার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায়।
সেদিন ভাইয়া ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরছিলো। পথে ঐ লোকের সাঙ্গপাঙ্গর সাথে ভাইয়ার একটু কথা কাটাকাটি হয়। ভাইয়া তাদের বলে, টাকা পরিশোধ করতে আরো সময় লাগবে। কিন্তু তারা শুনেনি। বরং ভাইয়াকে নানারূপ হু’মকিধা’মকি দিয়েছিলো। সেই দিনই বিকেলে ভাইয়া যখন এলাকার চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলো তখন আচমকা ভাইয়ার উপর আক্রমণ করে বসে ঐ লোকের সাঙ্গপাঙ্গরা। তাদের আক্রমণ ঘু’ষি মারার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো না। তারা নিজেদের সাথে রীতিমতো দা, রা’ম’দা নিয়ে এসেছিলো। এগুলো দিয়ে তখনই তারা ভাইয়ার উপর হা’মলা করে। নিজের প্রাণ বাঁচাতে ভাইয়া ওভাবেই ছুটতে ছুটতে বাড়ির কাছে চলে আসে। কিন্তু ঐ লোকগুলো ভাইয়াকে ছাড়েনি। বরং শেষ পর্যন্ত ভাইয়ার প্রাণ নিয়ে তবেই ক্ষান্ত হয়েছে। ভাইয়াকে মে’রে ফেলার এ দৃশ্য সেদিন বাড়ির ছাদ থেকেই দেখেছিলাম আমি। এসব দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমি বাকরুদ্ধ হয়ে ছাদেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। মুখ দিয়ে চিৎকার পর্যন্ত বের হচ্ছিলো না। পরে যখন নিজেকে ধাতস্থ করলাম, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। ভাইয়া ততক্ষণে বাড়ির সামনেই নিজের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে।
এলাকার চা দোকান হতে বাড়ি পর্যন্ত যতক্ষণ ভাইয়ার পিছে লোকগুলো ছিলো,ততক্ষণ ভাইয়াকে সাহায্য করতে কেউই এগিয়ে আসেনি৷ আসবেও বা কি করে, হাম’লা’কারীদের হাতে যে বিশাল বিশাল দা, রা’ম’দা ছিলো! এসব দেখে কে নিজের জানের কথা চিন্তা না করে অপরজনকে বাঁচাতে আসবে! অবশ্য তারা ভাইয়াকে সরাসরি না বাঁচিয়ে পুলিশকে খবর দিয়েছিলো। কিন্তু পুলিশ আসতে আসতেই হা’মলা’কারীরা নিজেদের কাজ সেরে পালিয়ে গিয়েছিলো। যদিও পরে তদন্তের মাধ্যমে তাদের ধরা হয়েছিলো। বর্তমানে তারা সবাই জেল খাটছে।
ভাইয়ার এ ঘটনার পর অনেকদিন পর্যন্ত এলাকার সবাই ভয়ে তটস্থ ছিলো। সন্ধ্যার পর কেউ বাড়ি থেকে সহজে বের হতো না। এ ঘটনা নিয়ে পত্রিকাতেও লেখালেখি হয়েছিলো। এ পুরো ঘটনা আমি শুনেছিলাম প্রত্যাশা আপুর কাছ থেকে।

সরাসরি চোখের সামনে ভাইয়ার খু’ন হতে দেখে আমি শকে চলে গিয়েছিলাম। কত রাত যে নির্ঘুম কাটিয়েছিলাম তা আমিই জানি। কিন্তু এভাবে নির্ঘুম রাত কাটানোর পর যা একটু ঘুম আসতো তাও দুঃস্বপ্নের কারণে ভেঙে যেত। এ ঘটনার পর পুরোপুরি সুস্থ স্বাভাবিক হতে কয়েক মাস সময় লেগেছিলো আমার। যদিও সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর মাঝে মাঝেই ভাইয়াকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম। তবে বিগত দু বছর যাবত এমন স্বপ্ন দেখা প্রায় শূন্যে নেমে এসেছিলো। কিন্তু আজ চোখের সামনে আবারো সেই মারামারি দেখে আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। ফলস্বরূপ হসপিটালেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলাম।

ভাইয়াকে নিয়ে চিন্তা করতে করতে বুক চিরে একরাশ দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। আয়নার দিকে চেয়ে বার কয়েক চোখের পলক ফেলে ট্যাপ ছেড়ে কয়েক বার মুখে পানির ঝাপটা নিলাম। ভালোভাবে মুখ ধুয়ে বেড়িয়ে এলাম ওয়াশরুম থেকে। বেরিয়ে দেখলাম আপু খাবার নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি গিয়ে বসতেই আপু নিজ হাতে আমাকে খাইয়ে দিলো।

—————-

আজ আপুর গায়ে হলুদ। বাড়ির বড় এবং একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে মামা বিয়ের আয়োজনে কোনো প্রকার কমতি রাখেননি। সাধ্যমতো বিয়ের প্রস্তুতি নিয়েছেন৷ বিয়ে উপলক্ষে পুরো বাড়ি সাজানো হয়েছে রঙবেরঙের মরিচবাতি দিয়ে। হলুদের জন্য প্যান্ডেল করা হয়েছে বাড়ির ছাদের উপর। আর বাড়িতে আগত মেহমানদের জন্য বাড়ির পিছনে রান্নাবান্নার আয়োজন করা হয়েছে। রান্নার কাজ করছেন শহরের পরিচিত কিছু বাবুর্চিরা।
মেহমানদের আনাগোনায় বাড়িতে তিল পরিমান মাথা গোঁজার ঠাঁই পাওয়া যাচ্ছে না। বৃষ্টি ও গরমের সংমিশ্রণে তৈরী আবহাওয়া ও অসংখ্য মেহমানদের উপস্থিতির ফলে পুরো বাড়িতে কেমন এক ভ্যাপসা গরমের আবহ সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যেই করতে হচ্ছে ছোটবড় নানা কাজ।

আপুর বিয়ে উপলক্ষে মামির বাবা বাড়ির সকল প্রকার আত্মীয়স্বজন এসেছেন। প্রায় প্রত্যেকের সাথে আছে ছোটবড় পিচ্চি বাচ্চা। বয়সে কম পিচ্চিবাচ্চারা পুরো বাড়িজুড়ে খেলাধূলায় মেতে উঠেছে। আর তুলনামূলক একটু বেশি বয়সী যারা আছে তারা হলুদের অনুষ্ঠানের সব গোছগাছে সাহায্য করছে আমাদের।
ডেকোরেটারের লোকজন প্যান্ডেল বসিয়ে চলে যাওয়ার পর প্রোজ্জ্বল ভাই, অভ্র ভাই ও এলাকার পরিচিত দুটো ছেলে মিলে ফুল দিয়ে প্যান্ডেল সাজাচ্ছে। প্যান্ডেল সাজাতে ব্যবহার করা হচ্ছে বাড়ির পিছনে অবস্থিত বিশাল চন্দ্রপ্রভা গাছের চন্দ্রপ্রভা ফুল, অলকানন্দা ও বাজার থেকে কিনে আনা গ্লাডিওলাস দিয়ে।
আমরা মেয়েরা হলুদের জন্য ডালা ও ক্ষীর সাজাতে ব্যস্ত। ক্ষীর সাজানোর এক পর্যায়ে আপু উপর থেকে আমায় কিছু কাজের জন্য ডাক দিলো। আপুর কাজ সেরে যখনই নিচে নামতে যাবো তখনই পিছন হতে অভ্র ভাই ডাক দিলেন৷ কোনোরূপ ভূমিকা ছাড়াই জিজ্ঞেস করলেন,
” হলুদের জন্য প্রত্যাশা আপুকে সাজাবে কখন?”

” আরেকটু পরেই যাবো। বিকেল তো হয়ে এসেছে। সন্ধ্যার মধ্যেই আপুকে সাজিয়ে উপরে নিয়ে আসবো। ”

” ওহ আচ্ছা। তোমরা মেয়েরাও কি প্রত্যাশার সাথে মিলিয়ে শাড়ি পরবে?”

” হ্যাঁ আমরাও শাড়ি পরবো। কিন্তু আপুর সাথে মিলিয়ে না। অন্য ডিজাইন আর কালারের শাড়ি পরবো। ডিপ পার্পেল কালারের শাড়ি পরবো আমরা মেয়েরা। আর আপনারা একই কালারের পাঞ্জাবি। কেনো, মনে নেই এটা?”

আমার কথায় অভ্র ভাই মাথা চুলকিয়ে বোকাসোকা হাসি হাসলেন। বললেন,
” ভুলে গিয়েছিলাম। আচ্ছা, শোনো চন্দ্রিমা। ”

” হ্যাঁ বলুন, অভ্র ভাই। ”

” এটা তোমার জন্য।”
এই বলে অভ্র ভাই পিছন হতে হাত বাড়িয়ে এক মুঠো চন্দ্রপ্রভা ফুল আমার সামনে তুলে ধরলেন৷ উনার হাতে এতো চন্দ্রপ্রভা ফুল দেখে থতমত খেলাম আমি৷ বিস্মিত কণ্ঠে বললাম,
” এতো ফুল দিয়ে আমি কি করবো! ”

অভ্র ভাই চট করে নিজের ভুল বুঝতে পেরে শুধরে নিয়েছেন, এমন ভঙ্গিতে বললেন,
” সরি সরি, শুধু তোমার জন্য না। তোমাদের জন্য। মানে তোমরা যারা শাড়ি পরবে তাদের জন্য। শাড়ি পরার পর মাথায় ফুল গুঁজে দিলে দেখতে সুন্দর দেখায়। ”

অভ্র ভাইয়ের এহেন কথা শুনে ভ্রু নাচিয়ে টিপ্পনী কেটে বললাম,
” কি খবর অভ্র ভাই! আপনার দেখি এসব ব্যাপারে ভালোই এক্সপেরিয়েন্স আছে! আপনার সেই স্বপ্নচারিণীকে কি শাড়ি পরে মাথায় ফুল গুঁজতে দেখেছিলেন না কি?”

অভ্র ভাই মুচকি হাসলেন। বললেন……..
®সারা মেহেক

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here