#ঢেউয়ের_স্রোতে_নিবিড়
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
#পর্ব-৭
রিয়া ছুটে চলে আসে লাইব্রেরির সামনে। এক্সাম শুরু হতে এখনো অনেক দেরি। ঊর্মিও তার পেছন পেছন এই দিকটায় ছুটে আসে। রিয়া তাকে দেখা মাত্রই জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। ঊর্মি তাকে কিছুক্ষণ কান্না করার সুযোগ দেয় এরপর তাকে সামলে নেয়। আর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে…
–খুব ভালোবাসিস নির্ঝরকে? বিয়ে করতে পারবি?
–বিয়ে!
–হ্যাঁ বিয়ে। তুই শুধু একবার বল বাকিটা আমি ম্যানেজ করে নেবো।
–ওকে পাওয়ার জন্য আমি সব কিছু করতে রাজি।
রিয়াকে বুঝিয়ে ক্লাসে নিয়ে আসে। ওদের দেখে নির্ঝর জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে তবে ঊর্মি বিষয়টাকে এড়িয়ে যায়। এক্সাম শুরু হলে ওরা ভালো ভাবেই এক্সাম দেয়। ওরা পাঁচজন একসাথে পরীক্ষা দিয়ে বের হয়। ঊর্মি শাওনকে বলে রিয়াকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসতে। রিয়ারও মনটা ভালো নেই তাই সে ঊর্মির কথা মতো শাওনের সাথে চলে যায়। রাহাত আর নির্ঝর একসঙ্গে কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে, সাথে ঊর্মিও আছে। এখানটায় মূলত ঊর্মিই ওদের দাঁড় করিয়ে রেখেছে। নির্ঝরের কথা গুলোও তো তার জানা প্রয়োজন। কোনো রকম ভনিতা ছাড়াই নির্ঝরকে জিজ্ঞেস করে…
–রিয়াকে পছন্দ করিস?
ঊর্মির কথার মানেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না নির্ঝর তবুও তার কথার প্রত্যুত্তরে সে বলে…
–রিয়া আমার খুব ভালো বন্ধু। বন্ধু হিসেবে আমি তাকে পছন্দ করি।
–রিয়া তোকে ভালোবাসে। ওর বাসা থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। দুদিন পর হয়তো ছেলেপক্ষ এসে কাবিনও করিয়ে যাবে।
ঊর্মির কথা শুনে রাহাত যেন আকাশ থেকে পড়ে। রিয়া নির্ঝরকে ভালোবাসে এই কথাটা কখনো জানতেই পারলো না ওরা। নির্ঝরের মাঝে এর কোনো রকমের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। সে স্বাভাবিক ভাবেই বলে….
–ভালো ছেলে হলে বিয়ে করে নেবে। এতে সমস্যা কোথায়?
–আরে ব্যাটা রিয়া তোকে ভালোবাসে তাহলে অন্য কাউকে কিভাবে বিয়ে করবে?
রাহাতের কথা শেষ হতেই ঊর্মি এক বার নির্ঝরকে দেখে রাহাতের দিকে তাকিয়ে দুজনের উদ্দেশ্যে বলে….
–তাহলে প্রিয় বান্ধুবীর বিয়ে খাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে যা তোরা।
রাহাত আর নির্ঝর দুজনেই একবার একে অপরকে তো আরেকবার ঊর্মিকে দেখছে। এরই মাঝে ওর ফোনে নিবিড়ের টেক্সট আসে। সে তার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে। ঊর্মি ওদের দুজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিবিড়ের কাছে চলে আসে। নিবিড় তখন বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। হয়তো ঊর্মির আসার অপেক্ষার প্রহর গুনছে সে। ঊর্মিকে দেখা মাত্রই কিঞ্চিৎ হাসি ফুটে তার মুখপানে। ঊর্মি নিবিড়ের কাছেই এগিয়ে যায়। নিবিড় তাকে হেলমেটটা এগিয়ে দেয়। সে হেলমেটটা পড়ে নিবিড়কে বলে….
–যাওয়া যাক?
–হুম!
দুজনে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে পড়ে। অন্যদিকে দিকে নির্ঝর আর রাহাত একটা চায়ের দোকানে এসে বসেছে। রাহাত কল করে শাওনকেও এখানে ডেকে নেয়। দোকানে আট নয় বছরের বাচ্চা ছেলেটা মাটির কাপে করে তিন কাপ চা দিয়ে যায়। এখানে ওরা প্রায়শই আসে। বাচ্চা ছেলেটা দোকানদারের ছেলে। রাহাত আর শাওন নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বললেও নির্ঝর একেবারেই চুপ করে মাটির ছোট্ট কাপটার দিকে দৃষ্টি সংযত করে রেখেছে। নির্ঝর, শাওন আর রাহাতের বন্ধুত্ব স্কুল জীবন থেকে। কলেজের প্রথম দিন রিয়া যখন ঊর্মির জন্য ক্লাসে বসে অপেক্ষা করছে তখন রাহাতের সাথে তার প্রথম আলাপ হয়। ভুল করে সেদিন ওদের বসার জায়গায় রিয়া বসেছিলো। তবে ঊর্মি আর রিয়ার সাথে ওদের প্রথম বন্ধুত্ব হয় কলেজের নবীন বরণের দিন। এরপর থেকে ওদের পাঁচজনের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। অনার্স ভর্তি হবার পর থেকে নির্ঝর একটু একটু করে ঊর্মিকে পছন্দ করতে শুরু করে। কখনো মুখ ফুটে বলার সাহস হয়ে ওঠেনি। হুট করে একদিন জানতে পারে ঊর্মি নিবিড়কে পছন্দ করে। এই পছন্দটাই একটু একটু করে ভালোবাসায় রূপ নিতে থাকে। নির্ঝরের চেয়েও কিছু করতে পারে না। তারপর একদিন ঊর্মি এসে জানায় নিবিড়ের সাথে তার বিয়ে হয়ে গেছে। খবরটা শোনা মাত্রই যেন সে আকাশ থেকে পড়ে। সে ভাবতেও পারেনি, হঠাৎ করেই ঊর্মির বিয়ে হয়ে যাবে। হয়তো ঊর্মির প্রতি তার অনুভূতি গুলো শুধুমাত্র মোহ ছিলো যা সময়ের সাথে সাথে একটু একটু করে হারিয়ে গেছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে নির্ঝর। পরিবারে বড় ভাই, ভাবী আর তার মা। বড় ভাই-ই তাদের সমস্ত খরচ বহন করে। সেও টিউশনি আর পার্টটাইম জব করে কিছু টাকা লেখাপড়ায় আর তার মায়ের হাতে তুলে দেয়। এ সমাজে বেকার ছেলেদের পথচলা যে কতটা কঠিন এটা নির্ঝর বেশ ভালো বুঝতে পারে। রিয়া যে তাকে পছন্দ করে এটা সে অনেক আগে থেকেই বুঝতে পারতো৷ তার প্রতি রিয়ার অনুভূতি গুলো অজানা নয় তবুও খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি সে। নির্ঝর তার জীবনে বন্ধুর মতো বন্ধু পেয়েছে। যারা প্রত্যেকটা মুহুর্তে তার পাশে থেকেছে। কিছুতেই এ বন্ধুত্ব সে নষ্ট হতে দিতে পারবে না।
ঘন্টাখানেক ধরে ঊর্মি বারান্দায় দাঁড়িয়ে কারো সাথে কল এ কথা বলছে৷ নিবিড় বিছানায় বসে থেকে বারবার সেদিকেই উঁকিঝুঁকি মা’রছে। দুপুরের খাবার খেয়ে রুমে এসেই সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা জুড়েছে৷ এদিকে নিবিড় যে তার জন্য অপেক্ষা করছে তার কোনো খেয়ালই নেই ঊর্মির। এরই মাঝে পূর্ণ আর পুষ্প দৌঁড়ে আসে ওদের ঘরে। নিবিড়কে বসে থাকতে দেখে ওরাও তার কাছে যায়। নিবিড় দুটোর গাল টেনে দিতেই দুটোতে খিলখিল করে হেসে দেয়। ঊর্মি ঘরের ভেতরে আসতেই দেখে নিবিড় পূর্ণ আর পুষ্পকে কোলে নিয়ে বসেছে। তাকে দেখা মাত্রই নিবিড় বলে….
–প্ল্যান করা হয়েছে?
–হুম!
কথাটা বলা শেষ হতেই পুষ্প এসে ঊর্মিকে জড়িয়ে ধরে। ঊর্মি তাকে সাথে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসায়। পুষ্প তার কাছে বায়না ধরেছে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে। সে ওদের কাল ঘুরতে নিয়ে যাবে বলে জানায়। কাল ঘুরতে যাবে শুনে দুজনে খুব খুশি হয়ে যায়। দুজনে লাফাতে লাফাতে ঘরে থেকে বেরিয়ে যায়। ঊর্মি বারান্দা থেকে নিজের সাথে করে আনা নিবিড়ের শার্ট গুলোকে বিছানায় বসেই ভাজ করতে থাকে৷ এরপর সেগুলোকে আলমারিতে তুলে রেখে এসে বিছানায় বসতেই তার মোবাইল বেজে ওঠে। স্ক্রিনে “আন্টি” নামটা জ্বলজ্বল করছে। তৎক্ষনাৎ সে কল রিসিভ করে। অপর প্রান্ত থেকে রিয়ার মা তড়িঘড়ি করে জানান “রিয়া অনেকগুলো ঘুমের ঔষধ একসাথে খেয়ে নিয়েছে। উনারা সবাই এখন তাকে নিয়েই হসপিটালে রওনা দিচ্ছেন।” কান্না করার ফলে ঠিক ভাবে কথাও বলতে পারছেন না তিনি। ঊর্মি উনাকে জানায় সে যত দ্রুত সম্ভব হসপিটালে পৌঁছাচ্ছে। কল কেটে দিয়ে নিবিড়ের পাশে বসে বলে….
–চলুন আমাদের যেতে হবে।
তাড়াতাড়ি করে বোরকা আর নেকাব পড়ে তৈরি হয়ে নেয়। এরই মাঝে সে খবরটা রাহাতকে জানিয়ে দেয়। রাহাত জানায় ওরা তিনজন যত দ্রুত সম্ভব হসপিটালে আসছে। কল কেটে দিয়ে ঊর্মি নিবিড়ের সাথে বেরিয়ে পড়ে। করিডোরের বাইরে রিয়ার বাবা মা দুজনেরই আছেন। রিয়ার মা শাহিদা খান প্রচন্ড কান্না করছেন আর বারবার একই কথা বলে যাচ্ছেন….
–আজ তোমার জন্য আমার মেয়ের এই অবস্থা। মেয়ে তো বলেছে সে নির্ঝরকে ভালোবাসে তবুও তুমি তাকে জোর করলে বিয়ের জন্য৷
শাহিদা খানের এমন বি’লা’প শুনে রাশেদ খান উনার সামনে এসে বলেন….
–আমি কি জানতাম, রিয়া এমন একটা কাজ করে ফেলবে। এখন এই দোয়া করো যাবে আমাদের মেয়েটা সুস্থ হয়ে ওঠে।
উনাদের কথার মাঝেই ঊর্মি আর নিবিড় ছুটে আসে। ঊর্মিকে কাছে পেয়ে শাহিদা খান হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দেন। নিবিড় গিয়ে রাশেদ খানকে সামলাচ্ছে। রাহাত আর শাওন তড়িঘড়ি করে করিডোরের সামনে আসে। ওরা এসেই আগে রিয়ার অবস্থার কথা জানতে চায়। ঊর্মি ওদের জানায় এখনো ডক্টর বের হয়ে আসেনি। ঊর্মি দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরাতেই দেখতে পায় কিছুটা দূরে নির্ঝর দাঁড়িয়ে আছে। চুল গুলো উসকোখুসকো হয়ে রয়েছে। চোখ গুলো কেমন ফোলা ফোলা। হয়তো রিয়ার জন্য কান্না করেছে। তাকে দেখেই ঊর্মি মনে মনে কিছু একটা ভেবে হেসে দেয় তবে সেটা লোকচক্ষুর আড়ালে। এ হাসি অন্যকেউ দেখতে না পেলেও নিবিড় ঠিকই দেখতে পেয়েছে। কিছুক্ষণ পর ডক্টর আসলে জানায় যে, রোগী এখন বি’প’দ মুক্ত আছে। এক মুহুর্তে যেন রাশেদ খান আর শাহিদা খান সমস্ত চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে যান। একমাত্র মেয়ে উনাদের। তার কিছু হয়ে গেলে কি নিয়ে বাঁচতেন উনারা! মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করেই তো মানিক নামের ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করেছিলেন। ভালো পরিবার, ছেলে ব্যবসায়ী আবার দেখতে শুনতেও সু’ই’সা’ই’ড করার মতো অবস্থা না। ছেলে যথেষ্ট ভদ্র। আজকালকার দিনে ভদ্র ছেলে পাওয়াই দুষ্কর। আর উনাদের খুব পছন্দই হয় ছেলেকে৷ রিয়া যখন তার বাবাকে নির্ঝরের কথা জানায় তখন তিনি রাগ করে মেয়ের গালে একটা থা’প্প’ড় মা’রেন। তাইতো এতো কিছু হয়ে গেলো।
কিছুক্ষণের মাঝেই ওরা সবাই কেবিনে প্রবেশ করে। রিয়া তখন চোখ বন্ধ করে ছিলো। তার মা মাথায় হাত দিতেই সে চোখ মেলে তাকায়৷ রিয়া দেখে তার বাবা-মা, ঊর্মি, নিবিড়, রাহাত, শাওন আর নির্ঝর এখানেই আছে সবাই। মেয়েকে জাপ্টে ধরে বসে থাকেন শাহিদা খান। অন্য পাশে রাশেদ খান বসেছেন। সবাই কিছুক্ষণ ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে কেবিন থেকে বের হয়ে আসে৷ ঊর্মিই তাদেরকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলেছে। রিয়ার কাছে শুধুমাত্র ঊর্মি আর নির্ঝরই আছে। সবাই তার সাথে কথা বললেও নির্ঝর একটা শব্দও করেনি। সারাক্ষণ অন্যদিকে মুখ ফিরে ছিলো। ঊর্মি এসে রিয়ার বাম হাতে একটা চিমটি কা’টে। ইশারায় কিছু একটা বলে যা নির্ঝরের দৃষ্টির আড়ালে৷ এরপর সে বলে…..
–জানিস আমি কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
ঊর্মির কথা শোনা মাত্রই নির্ঝর আর নিজেকে আর আটকে রাখতে পারে না। রিয়ার কাছে এসে ঠাস করে একটা থা’প্প’ড় মা’রে। রিয়া ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকায়। এভাবে হুট করে থা’প্প’ড় খেতে হবে তা সে ভাবতেও পারেনি। থা’প্প’ড়টা খুব একটা জোড়ে লাগেনি তার। তবুও ন্যাকা স্বরে বলে….
–তুই আমাকে মা’রলি?
–একশো বার মা’রবো হাজার বার মা’রবো। তুই ম’রতে কেন গিয়েছিলি?
–জানি না!
নির্ঝরকে আর কোনো কথা বলতে না দিয়ে, রিয়ার সাথে কিছু কথা রয়েছে এই বলে ঊর্মি তাকে কেবিন থেকে বের করে দেয়। নির্ঝর বেরিয়ে যেতেই ঊর্মি দরজাটাকে আটকে রিয়ার কাছে এসে বলে….
–তোকে আমি শুধু ঘুমোনোর নাটক করতে বলেছিলাম।
–আসলে আমার দুদিন ধরে ঘুমই হচ্ছিলো না তাই একটা খেয়ে নিয়েছিলাম।
–তাহলে আন্টি কেন বললো, তুই নাকি পুরো পাতাটাই শেষ করে দিয়েছিস?
–বাকি গুলো তো আমি টয়লেটে ফেলে দিয়েছি।
এই কথা বলে দুজনেই হাসতে শুরু করে। রিয়ার চোখে এখনো ঘুমে টলমল করছে৷ ঊর্মি তাকে আবার বলে….
–ডক্টর আঙ্কেল যদি আমাদের পূর্ব পরিচিত না থাকতো তাহলে কে’স খেয়ে যেতাম।
–সে আর বলতে!
–আচ্ছা শোন! তুই এখন ঘুমা। আমি বাইরে গিয়ে একটা ব্যবস্থা করে আসি।
কেবিন থেকে বের হয়ে ঊর্মি করিডোরে আসে। সবাই তার দিকেই তাকায়। সে নির্ঝরের হাত ধরে রিয়ার বাবা মায়ের সামনে দাঁড় করায়৷ ঊর্মি একবার নিবিড়কে দেখে। সে তাকে ইশারায় আশ্বাস দেয় যে, সে তার পাশেই আছে। নির্ঝর তাকে দেখছে, হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে ঊর্মি কি করতে চাইছে!
চলবে?…….