#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৪৮
জাওয়াদ জামী
” তোর বাপের ভুঁড়ির দিনদিন উন্নতি হচ্ছে, বুঝলি? কেম্নে কি! আমি হাজার খেয়েও এক ইঞ্চি ভুঁড়ি বাড়াতে পারিনা, কিন্তু তোর বাপ একবেলা খেয়েই ড্রামের মত ভুঁড়ি হয়েছে, ভাবা যায়! ” সিক্তার রুমে এসে বিছানায় বসতে বসতে বলে আনান।
” তুমি আবার শুরু করেছ! আর একবার যদি আমার বাবাকে নিয়ে কিছু বলেছ, তবে ভালো হবেনা বলছি। ”
” তুই কি করবি রে! ভুঁড়িয়াল বাপের মেয়ে। তোদের দৌড় আমার জানা আছে। তোর বাপের পেট ভর্তি ভুঁড়ি, আর তোর মাথা ভর্তি ব্রেইনের পরিবর্তে ভুঁড়ি গিজগিজ করছে। ”
” আনাইন্না রে, তুই যদি এবার না থামিস, তবে তোর সাথে ব্রেকআপ। সারাজীবনের জন্য তোর এই বাড়িতে আসার পথ রুদ্ধ করে দিব। ”
আনানের জন্য এই কথাটুকুই যথেষ্ট। চুপসানো মুখে তাকিয়ে থাকে সিক্তার দিকে।
” তুই আর তোর ভাই দুজনেই হিটলারের বংশধর। তোদের মনে দয়ামায়া কিচ্ছু নেই। এভাবে ব্রেকআপের কথা শুনলে আমার বুকের ভিতর হাতুড়ির ঘা পরে। কিন্তু তুই যদি এসব বুঝতি। ”
” এতই যদি কষ্ট পাও, তবে আমার বাবাকে নিয়ে এমন কথা বল কেন? গুরুজনকে সম্মান করতে জানোনা। ”
আনানের মুখের দিকে তাকিয়ে সিক্তার খুব খারাপ লাগে। বেচারার ব্রেকআপের কথা শুনেই চোখমুখ কালো হয়ে গেছে।
সিক্তা কিছু না ভেবেই টুপ করে আনানের কপালে চুমু দিয়েই, দৌড়ে রুম থেকে পালায়।
আনান সিক্তার এমন কান্ডে হতভম্ব হয়ে গেছে।
সিক্তা যে এমন কিছু করতে পারে তা ওর কল্পনায় ছিলনা।
” বাছা, আনান। এ কি হলো তোর! প্রেমিকার ঠোঁটের ছোঁয়া আকস্মিকভাবে পেয়ে গেলি! সাধু বাছা, সাধু। আহা, এমন প্রেমিকা যেন বাংলার ঘরে ঘরে হয়। ” আনান বুকে হাত দিয়ে ধপ করে সিক্তার বিছানায় শুয়ে পরে।
স্যারের ফোন পেয়ে তাহমিদ সন্ধ্যার পরে মেডিকেলে গিয়েছিল। ওর বাসায় ফিরতে রাত হয়।
কুহুকে ফোন করে জানিয়েছিল, ওর আসতে রাত হবে। ওর অপেক্ষা না করে কুহু যেন খেয়ে নেয়।
তাহমিদ মেডিকেলের কাজ শেষ করে, স্যারের সাথে তার বাসায় যায়। সেখানে রাতের খাবার খেয়েই তবে বাসায় ফিরে।
তাহমিদ রুমে এসে দেখল কুহু ঘুমিয়ে পরেছে। সে আর কুহুকে না জাগিয়ে, ফ্রেশ হয়ে এসে, কুহুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পরে।
মাঝরাতে ঘুম ভাঙ্গলে কুহু নিজেকে তাহমিদের বুকে আবিষ্কার করে। ওর ঘুম ঘুম চেহারায় হাসির রেশ ফুটে ওঠে। সে নিজেও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার প্রানপ্রিয় মানুষকে।
ভোরের আলো ফুটতেই তাহমিদ আর আনান বেরিয়ে পরে ফুলতলার উদ্দেশ্যে। তারা সকাল দশটার মধ্যেই ফুলতলা পৌঁছাতে চায়। আজ সন্ধ্যায় তাহমিদকে মেডিকেলে যেতে হবে, তাই ওরা ভোরেই যাত্রা শুরু করেছে।
দৃষ্টি ঘুম থেকে জেগে ফোনের দিকে নজর যেতেই দেখল, সবুজের অনেকগুলো ম্যাসেজ।
সবুজ বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে ওকে। সাইলেন্ট থাকায় দৃষ্টি বুঝতে পারেনি।
সবুজ ওকে কোন ম্যাসেজে ফোন রিসিভ করতে বলেছে। কোন ম্যাসেজে ওকে অ’শ্লী’ল গা’লি দিয়েছে। কোন ম্যাসেজে দৃষ্টির বাবাকে গালি দিয়েছে। আবার কোন ম্যাসেজে মামলা তুলে নিতে বলেছে।
এতসব ম্যাসেজের মাঝে একটা ম্যাসেজ দৃষ্টির মনোযোগ আকর্ষন করে। ম্যাসেজটায় একটা লিংক দেয়া। দৃষ্টি কৌতুহলী হয়ে লিংকে ক্লিক করে।
সকালে কায়েসের ঘুম ভাঙ্গলো ফোনের রিংটোনের শব্দে। সে ফজরের নামাজ আদায় করে আবার ঘুমিয়েছিল। কয়েকদিন থেকে চিন্তায় ঘুম আসেনা, বিধায় ফজরের নামাজের পর আবার ঘুমায়।
কায়েস চোখ কচলে, ফোন হাতে নিয়ে দেখল আননোন নম্বর থেকে ফোন এসেছে।
কায়েস ফোন রিসিভ করেই বুঝল সবুজ ফোন দিয়েছে।
” এই, জা’নো’য়া’র, তোকে আমি ফোন দিতে নিষেধ করেছি এটা তোর মাথায় থাকেনা? এখন তোর জন্ম নিয়ে আমার সন্দেহ হচ্ছে। আর যদি তুই আমাকে ফোন করিস তবে আমি পুলিশের কাছে যাব। ” কায়েস ঘৃণার সাথে বলে উঠে।
” আব্বে শা’লা, তোর সাথে কথা বলার জন্য আমি পস্তাচ্ছিনা বুঝলি? আমি তোকে একটা কথা জানাতে ফোন দিয়েছি। তোর ফোনে দেখ একটা ভিডিও পাঠিয়েছি। শালা শু’য়ো’র, তোর মুখে থুথু মারি শা’লা। ফোন রাখ শা’লা। ” সবুজের কথা শুনে কায়েস স্তম্ভিত। কোন মানুষ এতটা বেয়াদবও হতে পারে!
কায়েস ফোনের ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে একটা ভিডিও পায়। কোন কিছু না ভেবেই ক্লিক করে ভিডিওতে।
শিউলি ঘরে এসে দেখল কায়েস বিছানায় মাথা নিচু করে বসে আছে।
সে বেশ কয়েকবার ডাকলেও কায়েস সাড়া দেয়না।
শিউলি চিন্তায় অস্থির হয়ে কায়েসের শরীরে ঝাঁকুনি দিয়ে ডাকে। কায়েস শুধু চোখ তুলে তাকায়। শিউলিকে কিছুই বলেনা।
শিউলি কায়েসের এমন ব্যবহারে ভয় পাচ্ছে।
তার একসময় নজর যায় কায়েসের হাতে থাকা ফোনের দিকে। সেখানে কোন একটা ভিডিও চলছে।
শিউলি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ফোন হাতে নেয়। ভিডিওর দিকে চোখ যেতেই তার হাত-পা কাঁপতে থাকে।
” শিউলি, দৃষ্টি কোথায়? এই মুহূর্তে আমারদের মেয়েটার পাশে থাকা দরকার। তুমি তারাতারি ওকে ডাক দাও। ” কায়েস অনেকক্ষন পরে ধাতস্থ হয়ে শিউলিকে বলে।
কিন্তু সে যতই নিজেকে শক্ত দেখাক না কেন ভেতর থেকে সে ভেঙে পরেছে। মনে হচ্ছে তার বুকের পাঁজরে কেউ যেন পে’রে’ক মে’রে’ছে।
কায়েস কয়েকবার বললেও শিউলির ওঠার নামই নেই। এসব কি দেখল সে! তার মেয়ের জীবনটা যে নষ্ট হয়ে গেল।
সে নিজে মেয়ের ভালোবাসাকে সাপোর্ট দিয়েছিল। আজ কি তার কারনেই মেয়েটার এই দুর্দশা?
” কি ব্যাপার, শিউলি! তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছনা? তুমি এখনই দৃষ্টিকে ডাক। ” কায়েসের ধমক শুনে শিউলি উঠে ধীর পায়ে দৃষ্টির রুমের দিকে যায়।
শিউলি ধীরে ধীরে দৃষ্টিকে ডাকছে। তার শরীরে একফোঁটা শক্তিও অবশিষ্ট নেই।
শিউলি বেশ কয়েকবার দৃষ্টিকে ডাকে। কিন্তু দৃষ্টি কোন সাড়া দেয়না। শিউলি ভাবল দৃষ্টি বোধহয় এখনও ঘুমাচ্ছে।
এদিকে সকাল দশটা বেজে গেছে সেই খেয়াল শিউলির নেই। শিহাব এসে মায়ের কাছ থেকে খাবার চাচ্ছে। কিন্তু শিউলি এখন পর্যন্ত রান্নাই করেনি।
কায়েস ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখল শিউলি এখনো দৃষ্টিকে ডাকেনি। এতে কায়েসের ভিষণ রা’গ হয়। সে শিউলির দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে, নিজেই যায় দৃষ্টিকে ডাকতে।
অনেকক্ষন ডাকার পরেও যখন দৃষ্টি দরজা খোলেনা, তখন কায়েস ভয় পায়। সে জোড়ে জোড়ে দরজা ধাক্কাতে থাকে। এত ডাকার পরেও যখন দৃষ্টি দরজা খুললনা, কায়েস তখন শিহাবকে সাথে নিয়ে অনেক কষ্টে দরজা ভেঙে ফেলে।
ঘরে ঢুকেই ওরা সবাই স্তব্ধ হয়ে ফ্যানে ঝু’ল’ন্ত দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকে।
সম্বিৎ ফিরলে শিউলি চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। কায়েস ধপ করে মেঝেতে বসে পরে। আর শিহাব ভয়ে কাঁপছে।
শিউলির চিৎকার ঘরের চার দেয়ালের মাঝেই আছড়ে পরে। বাইরে থেকে কেউই জানতে পারলনা, নিজের স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকার হয়ে এক কিশোরী নিজের জীবনের অধ্যায়ের ইতি টেনেছে।
কায়েস মেঝের সাথে সেঁটে গেছে। সে দাঁড়ানোর শক্তি হারিয়েছে। শিউলি চেষ্টা করছে মেয়েকে নামানোর, কিন্তু সে ব্যর্থ হয়। এরপর ছুটে যায় কায়েসের কাছে।
” ও, দৃষ্টির আব্বু। তুমি আমার মাইয়ারে নিচে নামাওনা। আমার মাইয়ার কষ্ট হইতাছে, তুমি দেখতাছো না। আমার মাইয়াডা মইরা যাবো তো। তুমি এত নি’ষ্ঠু’র কেন? ” এই কথা বলেই শিউলি জ্ঞান হারায়।
কায়েস একবার মেয়ের দিকে আরেকবার শিউলির দিকে অসহায়ের মত তাকায়।
শিহাবের যখন হুঁশ আসে তখন ও দৌড়ে বাবার রুমে এসে, বাবার ফোন নিয়ে তাহমিদকে ফোন করে।
ওরা যখন ফুলতলার রাস্তায় ঢুকেছে তখনই কায়েসর ফোন আসে। তাহমিদ শ্বশুরের নম্বর দেখে রিসিভ করে।
” আসসালামু আলাইকুম, বাবা। আমরা আর কিছুক্ষণ পরেই বাড়িতে পৌঁছে যাব। ”
” ভা..ভাইয়া, আমি শিহাব। তুমি তারাতারি এস। ” কাঁপা কাঁপা গলায় এতটুকু বলেই শিহাব ফোন কেটে দেয়।
তাহমিদ কপাল কুঁচকে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে।
” কি হয়েছে, ভাই? তোমাকে এমন চিন্তিত লাগছে কেন? মামা ফোন করেছিল? ”
” নাহ্। শিহাবের ফোন ছিল। কিন্তু ও কিছুই বললনা। শুধু তারাতারি যেতে বলল। কি হয়েছে বলতো? শিহাব তো এরকম করেনা। ”
কথা বলতে বলতে তাহমিদ কায়েসের ফোনে ফোন দেয় । কিন্তু কয়েকবার ফোন করার পরও কেউ রিসিভ করেনা। এবার তাহমিদের ভয় হচ্ছে।
আরও পনের মিনিট পর ওরা কায়েসের বাড়ির সামনে আসে। ড্রাইভার কয়েকবার হর্ন দেয়। অনেকক্ষণ পর শিহাব এসে দরজা খুলে দেয়।
ওরা দুজন শিহাবের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারে কিছু একটা ঘটেছে।
শিহাবও কিছু না বলে দৌড়ে ঘরের দিকে যায়। তাহমিদ আর আনানও শিহাবের পিছুপিছু যায়। দৃষ্টির ঘরে ঢুকেই ওরা যেন জমে যায়।
শিউলি মেঝেতে জ্ঞান হারিয়ে পরে রয়েছে। কায়েস স্থীর হয়ে বসে রয়েছে। আর সামনেই ফ্যানে ঝু’ল’ছে দৃষ্টি ।
” ভাই, জলদি পুলিশকে ফোন কর। ” আনান ব্যস্ত হয়ে যায় মামা-মামীকে নিয়ে।
তাহমিদ এক পা দু পা করে এগিয়ে আসে দৃষ্টির দিকে।
” আরেকটু সময় অপেক্ষা করতে পারলিনা! আমি তোকে বলেছিলাম, আজকেই আসব। কিসের এত তাড়া ছিল তোর? আমি কুহু, বড়মাকে কি জবাব দিব! তোর বাবা-মা’কে কেমন করে সামাল দিব? এতটা অধৈর্য্য হলি কেন! ” তাহমিদের চোখে পানি।
হাতের উল্টোপিঠে পানি মুছে ফোন করে বড়মার কাছে। তাকে জানায় যত তারাতারি পারুক ফুলতলা আসতে।
চলবে…