#মিঠা_রোদ
#পর্ব:১১
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া
“একজন বাচ্চা মেয়ে যে জন্মের আগেও আমাকে দৌড় করিয়েছে।যেদিন জন্ম নিলো সেদিনও কী নাকানিচুবানি না খাওয়ালো।আজ যখন কিশোরী তখন প্রেম প্রেম খেলায় সেই দৌড় করিয়ে নিচ্ছে।লিটল ডেভিল চেরি।বাট অলসো বিউটিফুল।”
ঘুমঘুম চোখে আহনাফ নিজের বাবার দিকে তাঁকালো।ব্যক্তিটা আয়নার দাঁড়িয়ে নিজের সঙ্গে কথা বলছে।অভ্যেসটা শাহ বংশের সব ছেলেদের রয়েছে।এমনকি আহনাফেরও।কবীরের উদ্দেশ্য সে শুধালো,
“লিটল ডেভিল চেরি কে আব্বু?”
“তুমি জেগে আছো এখনও?”
“নাহ।ঘুমিয়ে আছি।”
আহনাফ বালিশে মাথা রেখে কথাগুলো বলল।কবীর মিষ্টি হেসে নিজের ছেলের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো।দুজনের একই রকম পোশাক।এমনকি ঘুমানোর নিয়মও একই।
“আহনাফ,তুমি ঘুমালে এখন কে কথা বলছে?”
“আমি আব্বু।”
“তাহলে ঘুমালে কীভাবে?”
“ঘুমিয়ে তো।”
“কথাটি হবে ঘুমিয়ে ছিলাম।কিন্তু ঘুমটা ভেঙে গিয়েছে।বুঝলে?”
আহনাফ বাবার বুকে মাথা রেখে হ্যাঁবোধক দুলালো।কবীরের জীবনে একরাশ সুখ বলতে এই বাচ্চাটি আছে।
“আব্বু।একটা কথা বলি?”
“বলো।”
“আম্মুকে আজ আমি স্কুলে দেখেছি।”
“সত্যি?খেয়াল করে বলো দিশাকেই দেখেছো কীনা।”
“আম্মুকে দেখেছি।আইসক্রিমের সাথে।”
“ওকে।কী করছিলো সেখানে?তোমার সঙ্গে কথা বলেছে?”
“বলেনি।”
“তুমি ডেকেছিলে একবারও?”
“ডাকলে যদি বকে তাই।”
কবীরের ভেতর থেকে উষ্ণ শ্বাস বের হয়ে এলো।একজন সন্তান নিজ মায়ের সঙ্গে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে বকা খাবে এজন্য।মনে মনে দিশা নামক মানবীকে সে ধিক্কার দিলো।আরো কিছু জিজ্ঞেস করবে এর পূর্বে আহনাফের ভারী নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলো সে।
(***)
“মেয়ে কীরকম তাহিয়া?জানো তো একজনের বাচ্চা অন্য আরেকজন সহজে মেনে নিতে পারেনা।কবীরকে সঙ্গ দিতে গিয়ে আহনাফকে ভুলে যাবে এমন কাউকে চাইনা।”
কবীরের মা সেতুর কণ্ঠের প্রত্যেকটি শব্দে আশংকা প্রকাশ পেলো।বৃদ্ধ হওয়া চুলগুলোতে খুব নিঁখুতভাবে মেহেদী দেওয়া।চেহারা যে এককালে ভীষণ মায়াবী ছিল সেটা বেশ বোঝা যায়।তাহিয়া মাতৃমনকে আশ্বস্ত করে বলল ফোনের এপাশ থেকে বলল,
“চাচী, কলি আমার ফুফাতো বোন।মেয়েটা নিজেও জীবনে খুব সহ্য করেছে।এখন এসে সুখের মুখটা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।সে জানে দুনিয়া কতোটা কঠিন। ও জব করে এই বিষয়টা নিয়ে ভাবছেন আপনি?”
“না না।ওটা কোনো ব্যাপার হলো?এক কালে আমিও চাকরি করতে চেয়েছিলাম।কিন্তু নিবিড় পঙ্গু হয়ে জন্ম নেওয়ায় স্কুলের টিচার আর হতে পারলাম না।এরপর কবীর জন্ম নিলো তাড়াতাড়ি।তাই নিজ ছেলের বউদের সাথে আমি কখনো চাকরি নিয়ে ঝামেলা করিনা।দিশাও তো…।”
“বাদ দেন আন্টি।দিশার মতোন নয় কলি।খুব ভালো মেয়ে।কবীরের সাথে মানাবে।”
“তাহলে আসতে বলো তাদের।দেখা হোক দুই পরিবারের।”
“আপনি তারিখ জানালে।”
“একবার কবীরের বাবার সাথে কথা বলে জানাবো।তোমার মেয়ে কেমন আছে?”
“ভালো আছে।কবীরের সাথে অনেক ভাব জানেন।গতকাল রাতে সেই পুরোনো কবীরকে তোশার মাধ্যমে দেখেছি আমি।”
“তাই নাকী?কীভাবে?”
তাহিয়া হাসতে হাসতে পুরো বিষয়টি জানালো তাকে।কিন্তু হাসিতে মন থেকে যোগ দিতে পারলো না সেতু।কারণটা খুব স্বাভাবিক।কবীর এখন বয়সে বড় হয়েছে।তাছাড়া বাচ্চাদের সাথে খুব মায়া,মমতা নিয়ে কথা বলে। ষোল বছরের একজন মেয়েকে যদিও পুরোদস্তুর বাচ্চা বলা যায়না।তবুও কবীর হুট করে এমন মজা করেছে সেটা মেনে নেওয়া অনেকটা কষ্টকর।
(***)
তোশাকে নিয়ে বহুতল ভবনের ভেতরে ঢুকলো কবীর।জায়গাটিকে মেয়েটা চিনে।আটতলায় ফাইভ স্টার একটি রেস্ট্রুরেন্ট আছে।মায়ের সাথে কয়েকবার এসেছে সে।আজ তাদের ভালোবাসা -বাস্তবতা খেলার দ্বিতীয় পর্ব।তোশা নিজেকে মনে মনে সব ধরনের প্রশ্ন কিংবা পরিকল্পনার জন্য তৈরী রেখেছে।আজও তার ফোনের হোয়াটসঅ্যাপ কেউ কলে রয়েছে।যে তাকে ব্লুটুত কিংবা ম্যাসেজের মাধ্যমে সব দিক নির্দেশনা দিবে।লিফটে কবীর ও তোশার সঙ্গে আরো দুটো ছেলে প্রবেশ করলো।বয়স ২৩ এর আশেপাশে হবে।তাদের মধ্যে একজন তোশার গা ঘেঁষে দাঁড়াতে গেলে মেয়েটার কাঁধ ধরে টান মেরে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো কবীর।উষ্ণ দৃঢ় ছোঁয়ায় কেঁপে উঠলো মেয়েটা।
“মাস্ক পরে নাও তোশা।”
“কিন্তু কেন?আমরা তো লিফটে।”
“যা বলেছি সেটা করো।”
কবীরের কথামতোন মাস্ক পরে নিলো তোশা।সঙ্গে সঙ্গে লিফটের দরজা খুলে গেলো।মেয়েটির নরম হাত শক্ত করে ধরে আছে কবীর।যেন ছেড়ে দিলে হারিয়ে যাবে।পথিমধ্যে নিচুসুরে কবীর বলল,
“বড় হচ্ছো।নিজের ভালোমন্দ তো খেয়াল রাখতে পারো।ছেলেটা একটু একটু করে তোমার চুলে নাক ঠেকাতে গিয়েছিল।”
“সরি।”
“এখানে সরি বলার কিছু নেই।”
সবথেকে কর্ণারে সুন্দর একটি টেবিল পূর্ব থেকে কবীর বুক করে রেখেছিল।তোশাকে একদম নিজের পাশে এসে বসালো।কবীরের হাবভাব অনুধাবন করে তোশা যেন আকাশে প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে।
“কী খাবে বলো?এখানে ভালো সী-ফুড পাওয়া যায়।”
“লবস্টার,এবং অক্টোপাস।এই রেস্ট্রুরেন্টে এই ডিশগুলো খুব ভালো।”
কবীর বড় বড় করে তোশার দিকে তাঁকালো।লবস্টার মানা যায়,কিন্তু অক্টোপাস আশা করেনি সে।অর্ডার দেওয়ার পর কেঁশে গলাটা পরিষ্কার করে নিলো কবীর।
“আমার সাথে তাহিয়া আসতে দিলো?”
“বলেছি বান্ধুবীদের সাথে কেএফসি তে যাচ্ছি।”
“কেন?আমার কথা বলতে ভয় কী ছিল তোশামণি?”
আচমকা কবীরের করা প্রশ্নে থমকে গেলো তোশা।সত্যিই তো।মাকে যদি বলতো কবীরের সাথে বাহিরে যাচ্ছি তাহলে কী হতো?বিষয়টা নিয়ে মনে সংক্রিয়ভাবে উৎপন্ন ভয়টা নিয়ে মেয়েটির কপালে ভাঁজ পড়লো।
“এমনি বলিনি।কাল বের হওয়ার সময় বলবো।চলেন প্রতিযোগীতা শুরু করি।আজ না বলে কিছু পরীক্ষা করবেন না।”
তোশাকে ব্যঙ্গ করে কবীর বলল,
“না সেই সাধ্য আমার আছে?তুমি আজ কী করবে বলো।”
তোশা ঈষৎ লাজুকসুরে বলল,
“আমার জীবনের সবথেকে সুন্দর সুন্দর মুহুর্ত গুলোকে আজ দেখাবো আমি।”
“কেন?”
“নিজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে নিতে চাচ্ছি।”
কবীর পূর্ণ দৃষ্টি ফেললো মেয়েটির দিকে।বলতে গেলে তোশাকে সে এখন নারী হিসেবে দেখে।আজও সেটির ব্যতিক্রম নয়।কবীরের ইদানীং কেন যেন আবার আঠার বছরের সময়ে ফিরে যেতে মন চাচ্ছে।
“শুনেন কবীর।”
“আবার নাম ধরে ডাকলে।”
তোশা হেসে ফেললো।ব্যাগ থেকে ছোট এলবাম বের করে টেবিলে রাখলো।আজকে সেই ড্রেসটা পরে এসেছে যেটা কবীর কিনে দিয়েছিল।
“তোশা মণিকে এখন বড় বড় লাগছে।কাল শাড়ী পরেছিল তখনও বড় লাগলো।অথচ মায়ের সামনে বাচ্চাদের মতোন ফ্রক পরো।আবার বোকামো করো।কেন?”
“মা চায় সবসময় ছোট থেকে যাই এজন্য।শুনেন…।”
তোশার মুখে শুনেন ডাকটি বড় মধুর লাগছে কবীরের নিকট।
“এক মিনিট তোশা।আগে আমার কাজটি শেষ করে নেই।”
পকেট থেকে সুন্দর একটি স্বর্ণের লকেট বের করলো কবীর।মাঝখানে আবার প্লাটিনাম লাগানো।
“এসো পরিয়ে দেই।”
“আপনি এই গিফট কেন দিচ্ছেন?আমি নিবো না।”
“নির্বোধ লিটল চেরি।শুনো আগে।এই লকেটটি আজ আমার পরীক্ষার বস্ত।তুমি সুন্দর করে গলায় দিয়ে বাড়ীতে যাবে।এরপর সবাইকে দেখাবে।”
“হুম এতে লাভ?”
“গোপনে ডেকে এনে দিয়েছি সেটাও জানাবে।এমনকি নিজ হাতে পরিয়েছি তাও।”
“জানালান এরপর?”
“এরপর আমাকে রিয়াকশন বলবে।কে কী বলে?যদি কেউ বলে সুন্দর হয়েছে।তবে তুমি পাশ করে যাবে।আর যদি কেউ আমাকে তোমার প্রেমিক ভেবে বা গোপন সম্পর্কের কথা চিন্তা করে মুখে বিতৃষ্ণা ফুটিয়ে তুলে তবে তুমি হেরে যাবে।”
“কিন্তু কেউ তো এটাকে স্বাভাবিক নিবেনা।”
“তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক ভাবে নিবে মনে হয়?এটা তুমি তোমার মামিকে দেখাবে আগে।”
তোশাকে নিজ হাতে গলায় পরিয়ে দিলো কবীর।হঠাৎ করে মেয়েটা নিচু কণ্ঠে বলল,
“স্বাভাবিকভাবে কেউ নিবেনা যখন জানবে ঘুরতে নিয়ে গিয়ে এই উপহার দিয়েছেন।দেখা যাচ্ছে আপনি এমন কিছু করছেন যাতে আমার হেরে যাওয়া নিশ্চিত।”
কবীরের অধর একপাশে বাঁকা হলো।পুরু হাতের ত্বক দ্বারা মেয়েটির গালে স্পর্শ করলো।
“আমাদের একে অপরের ভালোবাসা দুই জনের জন্য লজ্জা ছাড়া কিছুই বয়ে আনবেনা।বিষয়টা শিখতে হবে তোমার বেবি গার্ল।”
চলবে।