#জুজুবুড়ি
#২য়_পর্ব
লেখা- সোয়েব বাশার
মা পরদিন বাবাকে রিমুর কথা বলতে পারলেন না। বাবা শুনতেই চাইলেন না। কেবল চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘তাহলে তুমি বলতে চাও, আমার মেয়ে পাগল?’
মাও ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন, ‘তা বলবো কেন? আমি বলতে চাইছি রিমু আমাদের এখনকার অবস্থা সহ্য করতে পারছে না। ওকে আমাদের দুজনেরই সাপোর্ট দেয়া দরকার।’
‘কিসের সাপোর্ট? সোজা কথাই বলো, আমাদের টাকা পয়সা নাই দেখে তোমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে।’
বাবার ইনকাম যে কমে গেছে, এই নিয়ে বাবা প্রচন্ড ইনসিকিউরিটিতে ভুগতেন। কেউ তার মনমতো কথা না বললেই বাবা ভাবতেন, তার ইনকাম নিয়ে খোঁটা দেয়া হচ্ছে। আমরা সেজন্য বাবার সাথে কথা বলার সময় বেশ হিসেব করেই বলতাম।
বাবার ঐ উল্টোপাল্টা কথা শুনে মা তাকে আর কিচ্ছু বললেন না। আমি মাঝখানে একবার আম্মুকে আমার সেই রাতে দেখা মুখটার কথা বলতে গিয়েছিলাম, আম্মু রেগে গিয়ে বললেন, ‘তোর আব্বুকে বল, যা।’
আমার কথাটাও না বলাই রয়ে গেলো। রিমুকে জিজ্ঞেস করে কোনো লাভ হলো না। রাতের কথা তার মনে থাকে না।
সেই রাতের পর বেশ কিছুদিন সব ঠিক ছিলো। অস্বাভাবিক কিছু আর হয়নি। এরপর একরাতে রিমু আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে বললো, ‘ভাইয়া, আমার খুব ভয় লাগছে।’
আমি ঘুম ঘুম চোখে বিরক্তমুখে বললাম, ‘আমাদের এতোদিন ভয় দেখিয়ে এখন তোর নিজের ভয় লাগছে? ঘুমা।’
আমার ধমক শুনে রিমু কিন্তু থামলো না। একইভাবে ভয় পাওয়া গলায় বললো, ‘ভাইয়া, দরজার সামনে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে।’
আমার ঘুম ছুটে গেলো। তাকিয়ে দেখি, সত্যি তাই। ড্রয়িংরুমে কমলা রঙের যে ডিমলাইট জ্বলছিলো, তার আলোয় একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। আলোর বিপরীতে দাঁড়িয়েছিলেন বলে তার মুখটা ছায়ায় ঢাকা ছিলো, দেখতে পারছিলাম না।
আমরা দু’জনেই চিৎকার করে উঠলাম। মহিলাটির তখনই সরে যাওয়ার কথা। কিন্তু সে সরলো না। তীব্র আতঙ্ক নিয়ে আমরা দেখলাম, সে ছুটে আসছে আমাদের দিকে।
সেসময়ই দরজায় আরেকজনের অবয়ব দেখলাম আমরা। আম্মু। আমাদের চিৎকার শুনে এসেছেন। কিন্তু লাভ কি? তিনি কি ঐ মহিলাকে দেখতে পারবেন? নাকি সেদিনের মতো মহিলাটি তার অদেখা রয়ে যাবে?
মহিলাটি রিমুর দিকের বিছানার সাইডে দাঁড়িয়েছেন। হঠাৎ করে সে রিমুর এক হাত চেপে ধরলো। রিমু চিৎকার করে উঠলো। সাথে আম্মুর আর্তনাদ শোনা গেলো, ‘কে? কে ওখানে?’
মা তাড়াতাড়ি রুমে ঢুকে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিলেন। আমরা দেখলাম, মহিলাটি নেই, যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছেন ধোঁয়ার মতো।
আম্মু তেমনই ভয় পাওয়া গলায় বলতে লাগলেন, ‘কে, কে ছিলো ওখানে? কোথায় গেলো ও?’
আমি বুঝলাম, এবার মহিলাটিও দেখা দিয়েছেন মাকে। কিন্তু, সে কে, তার কোন উত্তর কি আছে আমাদের কাছে?
সে রাতে, আরো একটা বাজে ঘটনা ঘটলো। মা আব্বাকে ঘুম থেকে উঠিয়েছিলেন ঘটনাটা বলার জন্য। না ওঠালেই ভালো করতেন। বাবা প্রচন্ড রেগে গেলেন ঘটনাটা শুনে। চিৎকার করে বলতে লাগলেন আমাদের সবার মাথাই খারাপ হয়ে গেছে। আব্বু আম্মুর মাঝে সে রাতে খুব বাজে একটা ঝগড়া হয়ে গেলো। আম্মু বললেন, আমাদের নিয়ে তিনি চলে যাবেন অন্য জায়গায়।
আম্মু আমাদের নিয়ে অন্য জায়গায় চলে গেলেন না ঠিক, তবে বাড়ির পরিবেশ শান্তও হলো না। আব্বু আম্মুর মাঝে কথা একদমই বন্ধ হয়ে গেলো। বাবা সকালে বাইরে যান, রাতে বাড়িতে ফেরেন। মা ভাত বেড়ে রাখেন। বাবা ভাত খেয়ে চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়েন। সেসময়টায় মা থাকেন আমাদের সাথে। বাবা ঘুমানোর অনেকক্ষণ পর মা যান বাবার পাশে ঘুমাতে। বাবা-মার মাঝে এতোটা দূরত্ব আমরা কখনো দেখিনি। আমাদের প্রচন্ড খারাপ লাগতো তখন। মনে হতো, আমরা এক অন্ধকার সময়ে চলে এসেছি। তার থেকে আলোয় যাওয়ার পথ হয়তো আর নেই।
এরমধ্যেই একদিন একজন মহিলা এলেন আমাদের বাড়িতে। তাকে আমরা চিনি না। সেদিন ছিলো শুক্রবার, বাবা গিয়েছিলেন টিউশনিতে। মা মহিলাটিকে ঘরে এনে বসিয়ে বললেন, ‘আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।’
মহিলাটি বললেন, ‘চেনার কথা নয়। আমি আপনার আগে এ বাড়িতে ভাড়া থাকতাম।’
মা উনার জন্য নাস্তা বানিয়ে নিয়ে এলেন। খেতে খেতে তিনি বললেন, ‘আপনাদের পাশের বাড়ির শায়লা আপার সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো, তাই একটু দেখতে এসেছিলাম তাকে। তার সাথে দেখা করার পর মনে হলো আপনার সাথেও দেখা করে যাই। মনে হলো, আপনাকে ব্যাপারটা জানানো দরকার।’
‘কি ব্যাপার?’
‘আপনার ছেলে-মেয়ে আছে?’
‘হ্যাঁ। এক ছেলে, এক মেয়ে।’
‘আপনি কি বাড়িতে কোনো ভূতুড়ে ব্যাপার লক্ষ্য করেছেন এই কয়দিনে?’
মা কোনোরকম রাখঢাক না করেই বললো, ‘হ্যাঁ, অনেক অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে আমাদের বাড়িতে। এজন্য খুব অশান্তিতে আছি আমরা।’
আন্টি বললেন, ‘দেখেন, এসব ব্যাপার কাউকে বলাও যায় না, কেউ বিশ্বাস করে না। কিন্তু নিজের চোখে দেখেছি, তা অবিশ্বাস করি কি করে?’
‘কি হয়েছে, বলুন তো প্লিজ।’
আন্টিটি তখন এক ভয়ংকর গল্প শোনালেন। এ বাড়িতে প্রথম যে ভাড়াটিয়া ছিলেন, তার ছিলো দুই মেয়ে। একদিন রাস্তা পার হতে গিয়ে দুই মেয়েই বাসচাপায় মারা যান। মহিলাটির আর কেউ ছিলো না, তার স্বামী মারা গিয়েছিলেন আরো একবছর আগে, পরিবারেও হয়তো তেমন কেউ ছিলো না। মহিলাটি একদম পাগলের মতো হয়ে গেলেন দুই মেয়েকে হারিয়ে। সারাদিন বাসায় থেকে কান্নাকাটি করতেন, আশেপাশের সবাই সান্ত্বনা দিতো তাকে প্রথম প্রথম, কিন্তু যখন দেখতে পেলো মহিলাটির দু:খ-বিলাপ কমছেই না, উল্টো বাড়ছেই দিনে দিনে, তখন তারাও তার কাছে আসা কমিয়ে দিলেন। কয়দিনই বা একজনকে সান্ত্বনা দেয়া যায়?
তবুও এরমধ্যে বেশ কয়েকজন মহিলাটির বাড়ির ঠিকানা নিয়ে তার আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু কেউ রাজি হয়নি তাকে ফিরিয়ে নিতে। শেষমেষ মহিলাটি একাই এখানে থাকা শুরু করেন। মহিলাটির কোনো আয়-রোজগার ছিলো না, পড়ালেখাও বেশি ছিলো না, আশেপাশের সবাই মিলে তাকে একটা সেলাই মেশিন কিনে দিয়েছিলো, তা দিয়েই হালকা-পাতলা দরজির কাজ করে তিনি দিন কাটাচ্ছিলেন।
এরমধ্যেই তিনি একদিন বলতে শুরু করলেন, তার মৃত দুই মেয়ে তার কাছে ফিরে এসেছে।
প্রথমে লোকজন ভেবেছিলো মেয়েদের শোকে মহিলার হয়তো নতুন কোনো পাগলামি শুরু হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পরই অদ্ভুত কিছু ব্যাপার চোখে পড়লো সবার। মহিলাটির বাড়ির ভেতর থেকে বাচ্চাদের হাসির আওয়াজ পাওয়া যায়। সন্ধ্যায় সব বাসায় আলো জ্বললেও মহিলাটির বাড়িতে আলো জ্বলে না, পুরো রাত তিনি অন্ধকারে থাকেন। মহিলার নিচের তলায় যারা থাকেন, তারা মাঝরাতে ওপরের তলায় কারো দৌড়াদৌড়ির আওয়াজ পান।
মহিলাটির পাশের বাসার লোকজন একদিন মহিলাটির বাড়িতে যান কোন কাজে। গিয়ে দেখেন, বাড়ির মেঝে আর দেয়ালজুড়ে অদ্ভুত অদ্ভুত সব আল্পনা আর নকশা কাটা। মহিলাটি কালো জাদুর চর্চা করছেন।
কথাটা ছড়িয়ে পড়তে একটুও সময় লাগলো না। বাড়িওয়ালা এসে মহিলাটিকে শাসিয়ে গেলেন, আগামীকালের মধ্যেই বাড়ি ছাড়তে হবে।
সেরাতে ভয়ানক এক চিৎকারে সবার ঘুম ভাঙলো। চিৎকার এসেছে মহিলাটার বাসা থেকে। সবাই গিয়ে অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কালো, ডাকাডাকি করলো, কিন্তু মহিলাটি দরজা খুললেন না। শেষমেষ দরজা ভাঙা হলো। সেখানে যারা যারা ছিলেন, প্রচন্ড ভয় নিয়ে দেখলেন, মহিলাটি মেঝেতে পড়ে আছেন, মৃত। তার চোখটি খোলা, মুখটি খোলা। প্রচন্ড এক যন্ত্রণার ছবি ফুটে উঠেছে মুখে। মুখটা এতোটাই খোলা, যে চোয়ালের হাড় ভেঙে পড়েছে তার সাথে।
তিনি কেন মারা গিয়েছিলেন, কেউ জানতে পারেনি।
বাড়িটি খালি পড়েছিলো অনেকদিন। এরপর, সময়ের সাথে সাথে সেই ভয়ানক ঘটনাটাও সবার মনে ফিকে হয়ে এলো, বাড়িটাতেও নতুন ভাড়াটিয়া এলো। সেই ভাড়াটিয়ার পরিবারে একটা মেয়ে ছিলো, ছোট্ট ফুটফুটে মিষ্টি এক মেয়ে। সেই মেয়ে এখানে আসার কয়েকদিন পর থেকে হঠাৎ ভয় পেতে শুরু করলো। সে বলতো, সে জুজুবুড়িকে দেখতে পায়, সেই বুড়ি তাকে কোথাও নিয়ে যেতে চায়। তার বাবা মা মেয়ের কথা প্রথমে গুরুত্ব দিতো না, ভাবতো ছোট মানুষ, হয়তো নিজের বানানো কোনো ভূতের গল্প বলছে। তদের ভুল ভাঙলো, যেদিন মেয়েটাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেলো বাড়িতে। রাতে সবাই ঠিকঠাক ঘুমিয়েছিলো, সকালে উঠে আর মেয়েকে বিছানায় পায়নি তারা। খুঁজতে খুঁজতে এই ড্রয়িংরুমেই মেয়েটাকে ওরা দেখতে পায়। মেয়েটা ঐ কোণটার দিকে তাকিয়ে মেঝেতে পড়ছিলো। যতক্ষণে ওর বাবা-মা ওকে দেখতে পায়, ততক্ষণে সব শেষ।
আন্টির গল্পের এ অংশটুকু শুনে আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। আমাদের ড্রয়িংরুমের যে কোণটার কথা আন্টি বললেন, সেটাকে আমি খুব ভালো করে চিনি। প্রথম রাতে রিমু এক কোণটাতেই কাউকে দেখতে পেয়ে ভয় পেয়েছিলো খুব।
(আগামী পর্বে সমাপ্য)
তারিখ- ১১ মার্চ ২০২৩