জুজুবুড়ি পর্ব ১

0
810

#ভৌতিক
#জুজুবুড়ি
#পর্ব_১

আব্বুর চাকরিটা চলে গিয়েছিলো হঠাৎ করেই। আমরা তখন বেশ ছোট। আমি আর আমার ছোটবোন রিমু দুজনেই স্কুলে পড়ি, মা পুরোদস্তুর গৃহিণী। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন বাবা। সেসময় জিনিসপত্রের দামও বাড়ছিলো হু হু করে। আমাদের চারজনের সংসার চালাতে বাবাকে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছিলো।

বাবা ব্যাংকের সেভিংস ভাঙলেন। কিন্তু তা দিয়ে আর কতোদিন চলবে? একটা চাকরি না পেলে সেই বাজারে একটা সংসার চালানো কোনোভাবেই সম্ভব না। বাবা পাগলের মতো চাকরির চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু পাচ্ছিলেন না।

বাবা তখন বেশ পাল্টে গেছেন আগের থেকে। তার মেজাজ সবসময় খিটমিটে থাকে। কারণে-অকারণে আমাদেরকে খুব বকাঝকা করেন। যে আব্বু-আম্মুকে সারাজীবনে আমরা কখনো ঝগড়া করতে দেখিনি, তারা তখন প্রত্যেকদিন ঝগড়া করতেন। আমাদের খুব খারাপ লাগতো। মাকে দেখতাম মাঝেমাঝে চুপিচুপি কাঁদতেন। বাড়ির পরিবেশ দিনকে দিন অশান্ত হয়ে উঠছিলো।

সেসময়ই একদিন আব্বু বাড়ি এসে বললেন, বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। এমন একটা কিছু যে হবে, আমরা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। ২০০৫ সাল তখন, মিরপুরের সাড়ে সাত হাজার ভাড়ার ফ্ল্যাটটা একটা আয়-রোজগারহীন পরিবারের জন্য একদম বিলাসিতা। অথচ সেই ফ্ল্যাট, সেই মিরপুর নিয়ে আমাদের কত স্মৃতি। আমরা জন্মেছি সেখানে, বড় হয়েছি সেখানে। সবকিছু ছেড়েছুড়ে একদিন চলে যেতে হলো। আমি আর রিমু কাঁদছিলাম, মা-ও চোখ মুচ্ছিলেন একটু পরপর। অথচ বাবা ছিলেন নির্বিকার।উনার মুখ দেখে মনের অবস্থা একটুও বুঝতে পারছিলাম না আমরা। কিন্তু তার মনে কি কোনো কষ্ট জমা হয়নি সেদিন? বাবাদের এতো কঠিন হতে হয় কেন?

আমাদের নতুন ঠিকানা হলো টঙ্গি। সেখানে ছোটখাটো একটা বাড়িতে উঠলাম আমরা। বাবা সেখানে একটা চাকরি পেয়েছিলেন। বেতন বেশি নয়, কোনোরকম কায়ক্লেশে চলা যায়। আমি আর রিমু সেখানে নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। আমাদের নতুন জীবন শুরু হলো। সে জীবন দারিদ্রের।

সেসময়টায় আমি ক্লাস সিক্সে উঠেছি, আমার ছোটবোন রিমু ক্লাস থ্রিতে। ওখানে স্কুলে ভর্তি হয়ে নতুন বন্ধু বানাতে আমার খুব সমস্যা হচ্ছিলো‌। আমিও তখন একদম চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলাম। কারো সাথে মিশতাম না , কথা বলতাম না। ক্লাস শেষে একেবারে বাসায় চলে আসতাম। ঐ সময় সবাই স্কুল ছুটির পর কোচিং করতে যেতো এখানে ওখানে, আমার পক্ষে তা সম্ভব ছিলো না। যতটুকু পড়তাম, নিজে নিজেই পড়তাম। রিমুকে আম্মু পড়াতো। সারাদিন চাকরির পর আব্বু যেতেন টিউশনি করাতে, ফিরতে ফিরতে রাত্রি দশটা এগারোটা বেজে যেতো। আমাদের দিনগুলো এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো।

এরমধ্যেই একটা ভয়ের ব্যাপার শুরু হলো। রিমু কাকে যেন দেখতে পাচ্ছিলো বাড়িতে। আমাদের বাড়িটা ছিলো দু-রুমের। আমরা আসার আগে এ বাড়িটা অনেকদিন খালি পড়েছিলো, কেন কে জানে। আশেপাশের ভাড়াটিয়ারা বলতেন এই বাড়ির আগের ভাড়াটিয়া নাকি অনেক উল্টোপাল্টা জিনিস দেখতেন, তাই বাড়ি ছেড়ে চলে যান। এরপর কোনো ভাড়াটিয়া সহজে উঠতে চাইতেন না এ বাসায়। বাড়িওয়ালা ভাড়া কমিয়েও এই বাড়ি ভাড়া দিতে পারছিলেন না। ব্যাপারটা হয়তো সত্যি, কারণ আশেপাশের সব বাসার চেয়ে আমাদের বাসার ভাড়া কম ছিলো। এসব শোনার পর আম্মা একদিন বলেছিলেন আব্বুকে বাসায় মিলাদ পড়িয়ে রাখতে, আব্বু উত্তর দিয়েছিলেন, ‘সময় নেই’। সময় আসলে ছিলোও না। আব্বু সারাদিন তো ব্যস্তই থাকতেন, শুক্রবার দিনটাও তাকে বাড়ির বাইরে থাকতে হতো। তবে আরো একটা কারণ ছিলো মিলাদ না পড়ানোর। টাকা ছিলো না। সংসারের সব খরচ তখন পাই টু পাই হিসেব করে করা হতো, মিলাদের জন্য টাকা বরাদ্দ করা সম্ভব হয়নি তখন।

এর কিছুদিন পরই, আমাদের বাসায় সেই অদ্ভুত ঘটনাগুলো ঘটা শুরু হয়।

প্রথম যেদিন ঘটনাটা ঘটলো, সেদিন ছিলো মঙ্গলবার। পরদিন স্কুল, তাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙলো মাঝরাতে। দেখলাম, আমার পাশে রিমু নেই।

আমাদের বাসায় দুটো রুম। একরুমে আমি আর রিমু, আরেক রুমে আব্বু আম্মু থাকতেন। রিমু ছিলো খুব ভীতু স্বভাবের, রাতে বাথরুম লাগলেও সে আমাকে উঠিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে যেত।‌‌‌‌‌ওকে বিছানায় না দেখে তাই একটু খটকা লাগলো। আমি রুমের বাইরে বেরুলাম ওকে খুঁজতে।

আমাদের রুমের বাইরে ছোট একটা জায়গা, এটাকেই আমরা ড্রয়িংরুম বানিয়েছিলাম। রুম থেকে বের হয়ে দেখি, রিমু ওখানে চুপচাপ হাঁটু গেড়ে বসে আছে। ওর দৃষ্টি ঘরের অন্ধকার কোণটার দিকে।
আমি ওর সামনে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম, ‘রিমু। ওদিকে তাকিয়ে কি দেখছিস?’
রিমু আমাকে দেখে ভয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো, ‘ভাইয়া, ওখানে কে যেন আছে।’
আমি অন্ধকার কোণটার দিকে তাকালাম। কেন জানি না, ঘরের অন্য অন্ধকার কোণ থেকেও ও জায়গাটা আরো বেশি অন্ধকার লাগছিলো।রিমুর বলার ধরণটাও এমন ছিলো যে, আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। ভয়ে চিৎকার করে ডাকলাম আব্বু আম্মুকে।

আব্বু রুম থেকে বেরিয়ে রাগী গলায় বললেন, ‘কি হয়েছে?’
আমি বললাম, ‘রিমু ওখানে যেন কাকে দেখতে পেয়েছে।’
আব্বু প্রচন্ড জোরে একটা ধমক দিয়ে বললেন, ‘রাতে উঠে ফাজলামি শুরু করেছিস? যা, এক্ষুনি ঘুমাতে যা।’
আমরা আর রিমু একটা কথাও না বলে ঘুমাতে চলে গেলাম। সকালে উঠে আমি রিমুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুই ওখানে কি দেখেছিলি রাতে?’
রিমু আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো, ‘মনে নাই।’

রিমু খুব ভালো ছাত্রী ছিলো। আগের স্কুলে মোটামুটি এক থেকে তিনের মধ্যে ওর রোল থাকতো, নতুন স্কুলেও প্রথম সাময়িক পরীক্ষা দিয়ে ও টিচারদের নজরে পড়ে গিয়েছিলো। ও পড়ালেখায় আমার চাইতে খুব মনোযোগী ছিলো, আমি পড়ার মাঝে হাবিজাবি জিনিস চিন্তা করলেও ওকে দেখতাম একমনে পড়তে। আমরা একসাথেই পড়তাম। একদিন পড়তে পড়তে দেখি, ও পড়া থামিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, ‘কি হয়েছে?’
ও বললো, ‘ওখানে এক মহিলা দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকছিলো।’
আমি একটু অবাক হলাম। কাউকে তো দেখিনি। নাকি হাবিজাবি চিন্তার মাঝেই কেউ আসছিলো, খেয়াল করিনি। মা আমাদের নাস্তা নিয়ে ঘরে এলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘মা, কেউ এসেছিলো?’
মা বললেন, ‘হ্যাঁ, তোর শায়লা আন্টি এসেছিলো।’ শায়লা আন্টি আমাদের পাশের বাসায় থাকেন। রিমু তো উনাকে চেনেন। তাহলে কেবল মহিলা বললো কেন?

সেইরাতে কেমন হাসির শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। দেখি, রিমু ঘুমের মধ্যে হাসছে। চারদিক নীরব, নিস্তব্ধ, অন্ধকার, এর মাঝে একটা বাচ্চার হাসি যে কি পরিমাণ ভয়ংকর হতে পারে, আমি বোঝাতে পারবো না। রিমু আগে কখনো এমন করেনি।তাড়াতাড়ি ওকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বললাম, ‘তুই হাসছিস কেন?’
ওর ঘুম পুরোপুরি কাটেনি, ঘুম জড়ানো গলায় বললো, ‘উনি অনেক মজার গল্প বলছে।’
‘উনি কে?’
রিমু জবাব দিলোনা। ওর হাসি থেমে গেছে। ঘুমে তলিয়ে গেছে সে।

আমার খুব অদ্ভুত লাগছিলো ব্যাপারগুলো। একদিন মাকে বললাম সবকথা। মা কথাগুলো পাত্তা না দিয়ে বললো, ‘বাচ্চারা ওরকম করেই।’ আমি মাকে বোঝাতে পারলাম না, রিমু আগে কখনো এমন করেনি। ইদানিং কেবল এই ব্যাপারগুলো হচ্ছে।

কিছুদিন পর, আম্মু একরাতে ঘুম থেকে উঠেছেন। বাথরুম সেরে এসে পানি খাবার সময় তিনি টের পেলেন, আমাদের রুম থেকে ফিসফিস কথা বলার আওয়াজ। তখন রাত দুটো বাজে, আম্মু ভাবলেন আমরা দুজন রাত জেগে গল্প করছি। বেশ রাগ নিয়েই তিনি আমাদের রুমে এলেন আমাদের বকতে। আমাদের পুরো বাড়িতে শুধু ড্রয়িংরুমেই একটা ডিমলাইট জ্বলতো, তার আবছা আলো বাদে পুরো বাড়িতে আর কোনো আলো ছিলো না। ডিমলাইটের সেই আবছা আলোয় তিনি দেখলেন, রিমু বিছানার ওপর বসে জানালার দিকে তাকিয়ে কারো সাথে কথা বলছে‌।

আম্মু বেশ ভড়কে গেলেন। চিৎকার করে বললেন, ‘এই রিমু, এই। তুই কি করছিস?’
রিমু জানালা থেকে চোখ সরিয়ে আম্মুর দিকে তাকালো। ওকে দেখে মনে হলো কেমন ঘোরের মধ্যে আছে। আম্মু আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘এই রিমু‌। কথা বলছিস কার সাথে?’
রিমু কোনো উত্তর দিলো না। শুয়ে পড়লো চুপচাপ। মা ওর কাছে এসে দেখলেন, রিমু অঘোরে ঘুমাচ্ছে।

আম্মু সেদিন বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। সারারাত তিনি ঘুমাতে পারেননি। আমার কথাগুলোও সেদিন গুরুত্ব পেয়েছিলো তার কাছে। মা ভেবেছিলেন, এই হুট করে নতুন জায়গায় আসা, নতুন স্কুল, নতুন পরিবেশ, বাবার আচরণের পরিবর্তন, সবকিছু তার ছোট্ট মেয়েটার মনে খুব চাপ তৈরি করেছে। এই চাপ মেয়েটা নিতে পারছে না। তাই এমন অস্বাভাবিক কাজ করা শুরু করেছে। তিনি ঠিক করলেন, এ ব্যাপারে বাবার সাথে পরদিনই কথা বলবেন। এ ব্যাপারগুলো এমন হেলায় ছেড়ে দেওয়া যায় না।

কিন্তু মা একটা জিনিস বুঝতে পারেননি। সে রাতে শুধু রিমু না, আমিও জেগে ছিলাম। রিমুর কথা শুনে আমার ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিলো। রিমু কথা বলছিলো জানালার দিকে তাকিয়ে, তাই আমার চোখও চলে গিয়েছিলো জানালায়‌।

মা ওটাকে জানালায় দেখতে পাননি। কিন্তু আমি দেখেছিলাম।

আমাদের বাড়িটা তিনতলার ওপর। জানালার ওপাশ থেকে কেউ মুখ দেখাতে চাইলে তাকে নিচের তলার জানালার সানসেটের ওপর দাঁড়াতে হয়। কিন্তু আমাদের নিচের তলার জানালায় কোন সানসেট ছিলো না। সুতরাং, কাউকে যদি আমাদের জানালার ওপাশে দাঁড়াতেই হয়, তবে তাকে দাঁড়াতে হবে শূন্যের ওপর, বাতাসে ভাসতে ভাসতে। যেটা একদমই অসম্ভব।

অথচ, সেই নিস্তব্ধ অন্ধকার রাতে আমি একটা মুখ দেখতে পেয়েছিলাম জানালার ওপাশে।
ভীষণ ভয়ংকর একটা মুখ।

(চলবে)

লেখা- সোয়েব বাশার
তারিখ- ১০ মার্চ ২০২৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here