জুজুবুড়ি শেষ পর্ব

0
545

#জুজুবুড়ি
#শেষ_পর্ব
লেখা-সোয়েব বাশার

আব্বু যদি একটা দিনের জন্যও আগের মতো হয়ে যেতেন, আগের মতো সেই খোলামেলা, হাসিখুশি মানুষটি, তবে হয়তো আমাদের পরিস্থিতিটুকু এতোটা ঘোলাটে হয়ে উঠতো না। আম্মু আব্বুকে বলতেন এই বাড়ির ভূতুড়ে কাহিনী। আব্বু সেদিনই আমাদের নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতেন। সেই অভিশপ্ত ভয়ানক ঘটনাগুলো থেকেও আমরা মুক্তি পেতাম চিরদিনের জন্য।

কিন্তু, অবস্থাটা সেরকম ছিলো না। বাবার ইনসিকিউরিটি আর তার সাথে ঝগড়ার জন্য আম্মু বাবাকে আন্টির কথাগুলো বলতে পারলেন না। এর বদলে , আম্মু ইদ্রিস নানাকে খবর দিলেন। ইদ্রিস নানা ছিলেন আম্মুর ছোট চাচা। অত্যন্ত জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। অনেক কিতাব পড়া ছিলো তার। যেকোন সমাবেশে তার বক্তব্য সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতো। অনেক হোমড়া-চোমড়া লোকদের সাথেই তার যোগাযোগ ছিলো। অথচ তার মনে কোনো অহংকার ছিলো না। সবসময় আমাদের খোঁজখবর নিতেন, মাঝেমাঝে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতেন।

ইদ্রিস নানা যেদিন আমাদের বাড়িতে এলেন, সেদিন ছিলো শুক্রবার। দুপুরবেলা। জুম্মার নামাজের পর তিনি আমাদের বাড়িতে এলেন। বাবা সেদিন বাড়িতেই ছিলেন। বাবাকে বলা হয়েছিলো নানা কেবল আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। কেন যে এসেছেন, তার আসল কারণটা তাকে বলা হয়নি।

নানা এর আগে আমাদের সেই বাড়িতে আসেননি। বাড়িতে ঢুকেই তিনি বললেন, ‘মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেলো। এমনটা তো হয় না। তোমাদের কি কোনো সমস্যা হচ্ছে এই বাসায়?’

মা তখন নানাকে সব কথাই বললেন। বাবাও চুপচাপ শুনলেন সব আমাদের সাথে বসে। নানা সব কথা শুনে বললেন, ‘তোমরা কাজটা ঠিক করোনি ‌‌। আরো আগেই তোমাদের এ বাসা ছেড়ে দেবার দরকার ছিলো। আমি আমার সারা জীবনে আরো অনেক অলৌকিক ঘটনা দেখেছি সত্যি, কিন্তু এতো বড় ধরনের ঘটনা কোথাও দেখিনি। তোমরা কি আজকেই এই বাড়িটা ছাড়তে পারবে?’

মা তাকালেন বাবার দিকে। বাবা একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘একটা বাড়ি পছন্দ হয়েছে, কিন্তু ওই বাড়িটা খালি হতে আরো পনের দিন লাগবে‌। এখন মাসের মাঝামাঝি তো‌, এজন্য কোনো খালি বাসাও পাওয়া যাচ্ছে না।’
নানা বললেন, ‘ঠিক আছে। আরো পনের দিন তোমাদের এ বাসায় থাকতে হবে‌। এ পনেরদিনে কি ঘটে যেতে পারে বলা যায় না। আমি আজকে একটা ব্যবস্থা করে দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবো। যদি ব্যবস্থাটা কাজে লাগে তো ভালো। যদি না লাগে, তবে কিন্তু তোমাদের এ বাসায় থাকা ঠিক হবে না এক মিনিটের জন্যও। তোমরা কি রাজি?’
মা সাথেসাথেই মাথা নাড়লেন, রাজি। বাবা যেন কতো কি চিন্তা করছিলেন। কিন্তু না রাজি হয়ে তো উপায়ও ছিলো না। এখন কোনো ব্যবস্থা না নিলে, সত্যি যদি খারাপ কিছু হয়ে যায় এই পনেরদিনের মধ্যে, তখন কি হবে?

ঠিক হলো, ব্যবস্থা নেয়া শুরু হবে মাঝরাতে।এতোগুলো ঘটনা যখন কেবল মাঝরাতেই ঘটেছে, তার মানে সেই অশুভ শক্তি রাতেই প্রকট হয়, সূর্যের আলোতে বা সন্ধ্যায় তার বিরুদ্ধে কিছু করে লাভ নেই। এসব ক্ষেত্রে নাকি অশুভ শক্তি যখন প্রকট হয়, তখনই ব্যবস্থা নিতে হয়, নইলে তাকে পুরোপুরি নির্মূল করা যায় না।

মাঝরাতের পর আমাদের কাজ শুরু হলো। আমাদের ড্রয়িংরুমটা তখন লোকে-লোকারণ্য। এ বাড়িতে জ্বীন ঝাড়া হবে এমন একটা কথা কেন যেন সন্ধ্যার পরই লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছিলো, রাতেই আশেপাশের পাড়া প্রতিবেশীরা এসে ভীড় করেছিলো আমাদের বাড়িতে। এর মধ্যে ইদ্রিস নানার নাম অনেকে শুনেছিলেন,কেবল তাকে চোখের দেখা দেখতে এসেছিলেন অনেকে। লোকজনের ভীড়ে ঘরটা গমগম করছিলো‌। নানা বললেন, ‘আমি কাজ শুরু করার পর যেন কেউ শব্দ না করে। কারো যদি মনে হয় এখানে চুপচাপ বসে থাকতে পারবেন না, তবে তিনি যেন চলে যান। নইলে কারো কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে আমাকে কিন্তু দায়ী করতে পারবেন না।’
নানার কথা শুনে কেউ চলে গেলো না ঠিক, তবে ঘরটা একদম নিশ্চুপ হয়ে গেলো। এতোজন লোক সব নিঃশ্বাস আটকে যেন বসে রইলো সেখানে। মহিলারা বসেছিলেন ভিতরের ঘরটায়। তাদের ঘর থেকে হালকা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিলো, তবে সেটা আমাদের কাজে তেমন বাধা দিলো না।

নানা তার কাজ শুরু করলেন। বাড়ির সমস্ত লাইট বন্ধ করে একটা মোমবাতি জ্বালালেন। সেই মোমবাতিটা রাখা হলো ঘরের মেঝেতে। রিমু আর নানা মেঝেতে আসন করে বসলেন। রিমু ভয় পাচ্ছিলো, তাই আম্মু বসলো তার সাথে। আব্বু একটু দূরে সোফায় বসে রইলেন।

নানা দোয়াদরুদ পড়তে লাগলেন।

সময় বইতে লাগলো। তেমন কিছুই হচ্ছিলো না। শুধু রিমুর একটু ঘুম পাচ্ছিলো হয়তো, সে ঝিমুচ্ছিলো। ঘরের লোকরা অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছিলেন কিছু না হওয়াতে। ঘরের মধ্যে একটু একটু গুঞ্জন শুরু হলো। সে শব্দ বাড়তে লাগলো আস্তে আস্তে।
আর তখনই ব্যাপারটা ঘটলো।
নিভে গেল মোমবাতিটুকু।
আর যে অন্ধকারে ঘরটুকু ছেয়ে গেলো, সে অন্ধকারের মাঝে কার যেন আর্তনাদ আমাদের সবার বুক কাঁপিয়ে দিলো।
অন্ধকারে নানার চিৎকার শোনা গেলো, ‘খবরদার, শব্দ করবেন না কেউ।’
কিন্তু সে কথা কি কেউ শোনে? ঘরের সবাই তখন ভয়ে আর্তনাদ করা শুরু করে দিয়েছে।
নানা আবার গর্জে উঠলেন, ‘সবাইকে না থামতে বললাম? নইলে কিন্তু এবার সবার বিপদ হবে। এই ঘর থেকে কেউ বেঁচে ফিরতে পারবেন না।’
নানার ধমকে কাজ হলো। সবার গুঞ্জন এক নিমিষে থেমে গেলো।

নানা আবার দোয়া-দরুদ পড়তে লাগলেন। আবার সেই চিৎকার, এবার আরো তীক্ষ্ণ, আরো কাছে। আমরা সবাই ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলাম‌। কেবল নানাকেই মনে হলো শান্ত। তিনি একদম ঠান্ডা কণ্ঠে বললেন, ‘কে তুই? কি চাস?’
প্রথমে কোন কথা নেই। এরপর কে যেন ফ্যাসফ্যাসে টানা কণ্ঠে বললো, ‘মেয়েটাকে লাগবে।’
‘একে তুই পাবি না।’
‘আমি ওকে নেবোই।’
‘দেখি, কিভাবে নিস।’
বলেই নানা কিছু একটা ছুঁড়ে দিলেন রিমুর দিকে। আমাদের চোখে তখন অন্ধকার সয়ে এসেছিলো, তাই আবছাভাবে সব কিছু দেখতে পারছিলাম। রিমুর গায়ে জিনিসটা ছুঁড়ে দিতেই সেই তীক্ষ্ণ চিৎকার শোনা গেলো, মনে হলো রিমুই বুঝি চিৎকার করছে, কিন্তু কণ্ঠটা তো তার নয়। হঠাৎই রিমু উঠে ছুটে গেলো নানার দিকে, দুটো হাত উঠিয়ে চেপে ধরলো নানার গলা, দুজন মানুষ দুদিক থেকে টেনেও রিমুকে সরাতে পারছিলো না। নানা আবার জিনিসটা ছুঁড়ে দিলেন রিমুর দিকে, রিমু ছিটকে দূরে সরে গেলো। এবার রিমুর শক্তিও যেন কমে এসেছে, চুপচাপ বসে কেমন যেন ঝিমুতে লাগলো সে।
নানা আবার চিৎকার করে বললেন, ‘তুই ওকে কিছুতেই নিতে পারবি না। চলে যা এখান থেকে, এখনই চলে যা‌।’
আরো কি কি কথা বলতে লাগলেন নানা, আমার কানে গেলো না। মানুষজন আবার ফিসফিস করা শুরু করেছে। একসময় দেখলাম, রিমু ঘুমে ঢলে পড়লো। নানা বললেন, ‘লাইট জ্বালাও, এবার ঘর বন্ধ করতে হবে।’
লাইট জ্বালানো হলো। নানা ঘুরে ঘুরে বাড়ির প্রতিটা কোণায় গিয়ে দোয়া পড়তে লাগলেন। শেষ কোণাটুকুতে দোয়া পড়ে তিনি সোফায় এসে বসলেন। হাসিমুখে বললেন, ‘আর কোন ভয় নেই।’

সবার যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। ঘরে একটা দমবন্ধ পরিবেশ হয়ে পড়েছিলো, সে পরিবেশটা কেটে গেলো খুব দ্রুতই। মানুষজন আবার কথা বলা, হাসাহাসি শুরু করলো। রিমু ঘুমিয়ে পড়েছিলো, নানা মাকে বললেন ওকে ভেতর ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিতে। ওর উপর বেশ ধকল গেছে, এখন যাতে লম্বা একটা ঘুম দেয়। ওকে যেন কেউ বিরক্ত না করে।
মা রিমুকে ভিতর ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিয়ে আসলেন।

লোকজন এবার নানার কাছে ভীড় করলো। সবার নানারকম জিজ্ঞাসা, অনুরোধ সব বলতে লাগলো নানার কাছে। নানাও হাসিমুখে তার উত্তর দিতে লাগলেন‌। নানার ধৈর্য দেখে আমার অবাক লাগলো। এতো ভয়ংকর একটা কাজের পর একটুও ক্লান্ত না হয়ে কি সুন্দর সবার সাথে গল্প করে যাচ্ছেন। উল্টো বাবাকে মনে হচ্ছে ক্লান্ত। তিনি আগে থেকে যেমন সোফায় বসেছিলেন, তেমনিভাবেই সোফাতে বসে রইলেন।

আমি আবার নানার দিকে মনোযোগ দিলাম। মন দিয়ে নানার কথা শুনছি। কি অসাধারণভাবে তিনি ধর্মের কঠিন কথাগুলো মানুষকে সহজভাবে বলে চলেছেন।

তখনই, ঘরে যেন বাজ পড়লো। সকলের কথা থেমে গেল একসাথে।

আমি দেখলাম, রিমু এসে দাঁড়িয়েছে ঘরের মাঝে। তার চোখদুটো এখনো বন্ধ, যেন ঘুমের ঘোরে আছে সে। তার মুখটা ঘরের সেই কোণটার দিকে ফিরানো, যেই কোণটার দিকে তাকিয়ে একটা মেয়ে মারা গিয়েছিলো।

সেই কোণটার কাছে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে আমি আগে কখনো দেখিনি। তার সারা শরীর কালো কাপড়ে ঢাকা। কেবল মুখটা খোলা। সেই মুখে ভয়ানক হাসি। তার চোখটা ঘুরছিলো সবার ওপর। রুমের সবাইকে দেখে নিচ্ছিলো সে।

রুমে মানুষদের আর্তনাদ শুরু হয়ে গেছে। এই মহিলাকে চিনতে পেরেছেন তারা। ইনি সেই, যিনি অনেক বছর আগে এ বাসায় থাকতেন। যার দুটো মেয়ে মারা যাবার পরও আবার ফিরে এসেছিলো। যাকে এ বাড়িতেই মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

রুমের আলো ততক্ষণে নিভে গেছে। অশুভ এক অন্ধকারে ছেয়ে গেছে আমাদের রুমটা।

মানুষজন ততক্ষণে দরজা খুলে পরিমরি করে ছুটতে শুরু করেছেন। এতো লোকে ভরা রুমটা নিমিষে শূন্য হয়ে পড়লো। খোলা দরজা দিয়ে পাশের বাড়ির বিদ্যুতের হলুদ আলো লম্বাটে হয়ে পড়ছিলো আমাদের ঘরের ভেতর। তাতে দেখলাম, রিমু টলমল পায়ে হেঁটে চলেছে। যেন ঘুমের ঘোরে হাঁটছে সে।‌‌‌‌‌ রিমু হেঁটে যাচ্ছে সেই অভিশপ্ত অন্ধকার কোণটার দিকে। যে কোণটা এখন ভীষণ অন্ধকার। কিন্তু আমি জানি, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে কেউ।

ইদ্রিস নানা তখন দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘সিমা (আমার মায়ের নাম) জামাইকে নিয়ে দ্রুত বাইরে আয়।’
মা দাঁড়িয়ে আছেন। বুঝতে পারছেন না কি করবেন। অন্ধকারে বিকট এক হাসির শব্দ শুরু হয়েছে। নিচের তলায় মানুষের হুটোপুটির শব্দ শোনা যাচ্ছে, যে যেভাবে পারছেন পালাচ্ছেন এই বাড়ি ছেড়ে। কারণ সবাই জানেন, হাতে বেশি সময় নেই।

নানা আবার চিৎকার করে উঠলেন, ‘সিমা, জলদি চলে আয়। তোর মেয়েকে আর বাঁচাতে পারবি না, ও আর তোদের মেয়ে নেই। ওকে বাঁচাতে গেলে তোরা সবাই মারা পড়বি। আয়, জলদি বাইরে আয়।’
মা তখনও দাঁড়িয়ে। হয়তো কি করবেন বুঝতে পারছেন না। সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যই বুঝি বাবাকে খুঁজলেন।‌‌‌‌‌ কিন্তু কোথায় বাবা?

আমরা সবাই অবাক হয়ে দেখলাম, বাবা অন্ধকার থেকে ছুটে গেলেন রিমুর দিকে। ওকে জাপটে ধরে বসে রইলেন। মেয়েকে তিনি কিছুতেই ছাড়বেন না কোন অশুভ শক্তির কাছে। বাবার চোখে পানি। বিড়বিড় করে মেয়ের কানে কথা বলছেন তিনি, যেন ক্ষমা চাচ্ছিলেন তার কাছে।

মা এটুকু দেখেই আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘তুই তোর নানার সাথে নিচে চলে যা। আমি আর তোর আব্বু রিমুকে নিয়ে এরপর আসবো।’
নানা ধমকে উঠলেন, ‘আরে বোকা, ওর কাছে যাসনা। ও তোদের সবাইকে মেরে ফেলবে‌। এখনও সময় আছে, তাড়াতাড়ি জামাইকে নিয়ে চলে আয়।’

মা নানার কোনো কথা শুনলেন না। বাবার পাশে গিয়ে রিমুকে জড়িয়ে ধরলেন, এরপর ধাক্কা দিতে লাগলেন আস্তে করে, যেন রিমুর ঘুম ভাঙাতে চাচ্ছেন। নানা আর আমি অবাক হয়ে আব্বু আম্মুকে দেখছি, কতোদিন তাদের একসাথে দেখিনি এভাবে। খুব ছোটবেলায়, আমরা যখন সকালে স্কুলে যেতে চাইতাম না, ঘুমিয়ে থাকতাম বিছানায়, তখন আব্বু আম্মু দুজন এভাবে একসাথে এসে ডেকে ডেকে আমাদের ঘুম ভাঙাতেন। আজও তারা দুজন সেভাবেই রিমুর নাম ধরে ডাকছেন জোরে জোরে।

ততক্ষণে মহিলাটির হাসির শব্দে প্রকম্পিত হচ্ছে ঘর।

হঠাৎ দেখলাম, রিমু নড়ছে, যেন ওর ঘুম ভাঙছে‌। চোখ পিটপিট করে অবাক হয়ে সে আব্বু আম্মুকে দেখছে। আব্বু আম্মুকে সেও অনেকদিন এভাবে একসাথে দেখেনি। আব্বু আম্মু ভেজা চোখে জড়িয়ে ধরলেন রিমুকে।

অন্ধকারে সেই মহিলার আর্তনাদটাও বদলে গেছে। যেন কোনো কিছু না পাওয়ার কষ্টে, যন্ত্রণায় ভীষণ দুঃখে চিৎকার করছে সে।

শেষকথা

আমরা সেদিনই সেই বাড়িটা ছেড়ে দিয়েছিলাম। মাসের মাঝামাঝি বলে বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়নি, তবে বাবার এক বন্ধুর বাসায় সাবলেট হিসেবে ছিলাম সেই পনেরদিন। এরপর আরেকটা ছোটবাসায় ভাড়া উঠলাম।

বাবা আর নতুন চাকরি পাননি। সেই ছোট চাকরি আর টিউশনি করেই আমাদের সংসার চলছিলো। বাবা আগের মতোই সকালে যেতেন, রাতে আসতেন। কিন্তু আমাদের কোনো দুঃখ ছিলো না। আমরা আবার আগের বাবাকে ফিরে পেয়েছিলাম। যে বাবা হাসিখুশি, যার সাথে মন খুলে কথা বলা যায়। যিনি শত ব্যস্ততার মাঝেও বাড়ি ফিরে ঘন্টাখানেক গল্প করেন ছেলেমেয়েদের সাথে।

এরপর বাবার প্রমোশন হলো। তার বেতন বাড়লো কিছুটা। আমাদের সংসারেও একটু স্বচ্ছলতা এলো। আমাদের স্কুল শেষ হলো, কলেজ শেষ হলো। একসময় গ্রাজুয়েশনও কমপ্লিট করলাম। আমার একটা চাকরি হলো। রিমুরও বিয়ে হয়েছে, দুবছর আগে। গত মাসে ওদের সংসারে নতুন অতিথি এসেছে। ফুটফুটে, সুন্দর, মিষ্টি একটা মেয়ে।

ঐ বাড়িটার খবর আর নেওয়া হয়নি। আর কখনো যাইনি ঐ বাড়িতে। আমরা চলে আসার দিন তিনতলা বাড়িটার প্রত্যেকটা ভাড়াটিয়া বাড়ি ছেড়ে দিয়েছিলেন। বাড়িটা একদম খালি হয়ে গিয়েছিলো। এরপর হয়তো আবার নতুন ভাড়াটিয়া এসেছেন ঐ বাড়িতে। সময়ের সাথে সাথে তো সবাই সবকিছু ভুলে যায়। ঐ বাড়িতে যে কি সব ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছিলো, হয়তো মনেই নেই কারো।

তবে কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা ঘটনা পড়লাম। একটা তিনতলা বাড়ির গল্প। বাড়িটা টঙ্গিতে। বাড়িটার প্রত্যেকটা ঘরে ভাড়াটিয়া থাকেন, শুধু একটা ঘর বাদে। সেই ঘরটি তালাবদ্ধ হয়ে পড়ে আছে অনেকদিন। তবে অনেক সময় মাঝরাতে, যখন চারদিক নীরব নিস্তব্ধ হয়ে থাকে, তখন সেই ঘর থেকে নাকি কোনো এক মহিলার আর্তনাদ শোনা যায়। কারো যেন পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় সেই শূন্য ঘরটা থেকে। কেন, কেউ জানে না…

(সমাপ্ত)

তারিখ- ১২ মার্চ ২০২৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here