#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৩৪
জাওয়াদ জামী
ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো কুহুর। ঘুমঘুম চোখে রিসিভ করে ফোন। অপরপ্রান্তে কে রয়েছে তা দেখলনা।
” আসসালামু আলাইকুম। ”
” ওয়ালাইকুমুসসালাম। এখনো ঘুমিয়ে আছিস, মা? ”
বাবার আওয়াজ পেয়ে সজাগ হয়ে গেছে কুহু।
” বাবা, তুমি! কেমন আছো, বাবা? তোমার শরীর ঠিক আছে? ” একসাথে প্রশ্নগুলো করে কুহু৷
” আমি ঠিক আছি, মা। তোকে কতদিন দেখিনা। সেইযে আমাকে রেখে গেলি, আর আসলিনা। তোকে দেখবার জন্য মনটা ছ’ট’ফ’ট করছে। ”
” আমি বাড়িতে কয়েকদিনের মধ্যেই যেতে চাচ্ছিলাম। পরীক্ষা শুরু হলে, আর যেতে পারবনা। তাই ভেবেছি পরীক্ষার আগেই তোমাকে দেখে আসব। শিহাবকে কতদিন দেখিনি। ও ভালো আছে, বাবা? ”
” হ্যাঁ, মা, ও ভালো আছে। তুই কবে আসবি? কার সাথে আসবি? ”
” সিক্তা বারবার যেতে চাচ্ছিল। এবার ওকে নিয়েই যাব। কালকে ক্লাস করেই, বুধবার রওনা দিব। ”
” তুই এই কয়টা দিন ফুপুর কাছেই থাকতি। পড়াশোনাও ভালো হত। তিনবেলা নিয়মিত খেতে পারতি। ”
” ফুপু, খাবার রান্না করে দিয়েছে। বুধবার পর্যন্ত অনায়াসে চলে যাবে। তাই খাওয়ার সমস্যা হয়না। ”
” বুধবার সকাল সকাল রওনা দিস, মা। আর এসেই যাওয়ার কথা বলবিনা। কয়েকটা দিন থাকবি। আসার সময় বই নিয়ে আসবি। ”
” আচ্ছা, বাবা। এবার গিয়ে কয়েকদিন থাকব৷ তুমি সাবধানে থেক। নিয়ম করে ঔষধ খেও। এখন রাখছি, বাবা। ”
” আচ্ছা, মা। তুই ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করিস। ”
বাবার সাথে কথা বলে কুহুর মন প্রশান্তিতে ছেয়ে যায়। গ্রামে যাওয়ার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকে।
তাহমিদ সেই কখন থেকে কুহুর কোচিংয়ের পাশের দোকানে বসে আছে। তবুও মেয়েটার দেখা নেই। গত চারদিন সে ঢাকায় ছিলনা। মেয়েটাকে চারদিন ধরে দেখেনি। ওকে একনজর দেখার জন্য তাহমিদের বুকের ভিতর হা’হা’কা’র করছে। কিন্তু সেই মেয়ের আসার নামই নেই।
” এই মেয়েটাও না। এতক্ষণ কেন আসছেনা। ” নিজের সাথে কথা বলছে তাহমিদ। তখনই ওর চোখ যায় রাস্তার ওপাশে।
হালকা গোলাপি রঙের থ্রি পিস আর মাথায় হিজাব বাঁধা কুহুকে অপলক নয়নে দেখছে তাহমিদ। কুহু কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা রাস্তা পার হয়ে কোচিং-এর দিকে হাঁটছে।
তাহমিদ কুহুকে দেখেই উঠে, এক দৌড়ে এসে দাঁড়ায় কুহুর সামনে।
এভাবে হঠাৎ নিজের সামনে কাউকে দেখে ঘাবড়ে যায় কুহু। সামনের আগন্তুকের দিকে তাকাতেই তাহমিদকে দেখল। কিন্তু কুহুর দাঁড়াবার উপায় নেই। অলরেডি দশ মিনিট লেট হয়েছে। তাই কুহু কিছু না বলে কোচিং-এর গেইটের দিকে পা বাড়ায়। কিন্তু তখনই ওর হাত ধরে ফেলে তাহমিদ।
” একটু দাঁড়ালে কি হয়! কিছুক্ষণ পর যাও। আগে ভালো করে দেখে নেই। চারদিন ধরে এই মুখটা দেখিনি। আমার বুকের বাঁ পাশ এই চারদিন থেকে থমকে আছে। আগে তাকে স্বাভাবিক হতে দাও। একদিন দেরি হলে ক্ষতি কি? যে দেরিতে একজন প্রেমিকের ব্যাকুল হৃদয় জুড়ায়, তাকে দেরি বলেনা, তাকে বলে প্রেম প্রস্ফুটিত ক্ষন। যে ক্ষনে শুধু ঝাঁক বেঁধে প্রেমেরা প্রষ্ফুটিত হয়। যে প্রেমের কোন তল নেই। এই অতল প্রেমের প্রস্ফুটনে আমি গর্বিত হতে চাই৷ ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহুর শরীর জুড়ে উতলা হাওয়া দোল দেয়। যে হাওয়ার প্রতিটি কনায় শুধু তাহমিদের নাম। সেই নাম যেন ছুঁয়ে দেয় কুহুর শ্যামলা শরীরের আনাচকানাচে। সেই সাথে হাওয়া যেন জানান দিচ্ছে, সামনে দাঁড়ানো এই পুরুষ একান্তই তোর। তোর মনের এমনি শরীরের অধিপতিও একমাত্র সে-ই। সময় যেন থমকে গেছে আজকের এই ক্ষনে।
কুহুর বুক শু’কি’য়ে চৌ’চি’র। আজব তো, একটু আগেই মেয়েটা প্রানভরে পানি পান করেই এসেছে। তবুও এখন কেন এত পিপাসা পেয়েছে! কেন যেন মনে হচ্ছে দুনিয়ার সমস্ত সরোবরের পানিতেও এই পিপাসা মিটবেনা। ফুলতলার পদ্ম বিলের পানিও এই পিপাসার কাছে নস্যি।
” পানি খাব। ” ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে কুহু। ও হাঁপাচ্ছে। বড্ড ক্লান্ত লাগছে শরীর। দাঁড়িয়ে থাকা দায় হয়ে গেছে।
তাহমিদ কুহুর কথা শুনেই দৌড়ে দোকান থেকে মিনারেল ওয়াটারের বোতল নিয়ে আসে। ছিপি খুলে এগিয়ে দেয় কুহুর দিকে। কুহু তাহমিদের হাত থেকে বোতল নিয়ে এক চুমুকেই অর্ধেক পানি শেষ করে।
তাহমিদ ঠোঁট কামড়ে চিন্তা করছে এই মেয়ের হলোটা কি! এমন অস্থির লাগছে কেন?
কুহু বোতল এগিয়ে দিলে তাহমিদ সেটা নিয়ে, ছিপি লাগিয়ে পুনরায় কুহুকে দেয়৷
” এখন ক্লাসে যাও। আজকের মত আপাতত এতটুকু দেখাতেই সন্তুষ্ট থাকি। পরে মন ভরে দেখব। ” কথা বলতে বলতে কুহুর হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দেয় তাহমিদ।
কুহু মুখ ফুলিয়ে নিশ্বাস নেয়। হনহন করে ঢুকে যায় কোচিং-এ। মনে মনে হাজারটা গা’লি দিচ্ছে তাহমিদকে।
” ব’দ লোক। তার দেখা শেষ, এবার কুহু তোর প্রয়োজনও শেষ। সে সবসময়ই বলবে কিন্তু আমার থেকে কিছু শোনার প্রয়োজন তার নেই। ” গোপন গালির মাঝেই কুহুর চোখ যায় প্যাকেটের দিকে। কি আছে এতে?
তাহমিদ বাসায় আসলে তাহমিনা আক্তার ওকে জানান, কুহু আর সিক্তা ফুলতলা যাবে বুধবার। তাহমিদ ভালোমন্দ কিছুই বলেনা।
রাতে তাহমিদ আনানের কাছে ফোন দেয়।
আনান ফোন রিসিভ করে। সে কোন কথা বলার আগেই তাহমিদ কথা বলে।
” তুই কি জানিস, তোর দুই বোন ফুলতলা যাচ্ছে? ”
” তোমার প্রশ্নের উত্তর পরে দিব। তার আগে বল, তুমি আমাকে কেন সালাম দিলেনা? বউয়ের বড় ভাই হিসেবে এ্যাটলিষ্ট এতটুকু সম্মান পেতেই পারি। এবার আসি তোমার প্রশ্নের উত্তরে। আর সেটা হল, আমি জানিনা। কে বা কারা ফুলতলা যাচ্ছে। ”
” কানের নিচে একটা দিলেই, সব ত্যা’ড়া’মি হাওয়ায় মিশবে। বউয়ের বড় ভাই সম্পর্ক হয়েছে পরে, তার আগে তুই আমার জুনিয়র কাজিন বুঝলি? এখন ভালো করে শুনে রাখ। বুধবার কুহু আর সিক্তা ফুলতলা যাচ্ছে। আমি চাইনা দুইজন মেয়ে এভাবে এতটা রাস্তা একা যাক। তুই আগামীকাল বিকেলে হোক কিংবা সন্ধ্যায় হোক, এখানে চলে আসবি। ওদের নিয়ে ফুলতলা তুই যাবি। আর হ্যাঁ কিছুতেই বড়দের বলবিনা যে আমি তোকে যেতে বলেছি। তুই বলবি, অনেকদিন যাসনি তাই যাচ্ছিস। তার আগে তোর বোনকে ফোন দিয়ে কথা বল। ”
” বাহ্ বাহ্ কি সুন্দর সলিউশন দিলে! একবারও জানতে চাইলেনা আমি যেতে চাই কি না! ”
” তোর মতামত জানার কি আছে? বড় ভাই হিসেবে বোনদের প্রটেকশনের দ্বায়িত্ব তোরই পালন করতে হবে, এটাই নিয়ম। অবশ্য বউটা আমার হয়ে গেলে, তোকে তেল মা’রা’র প্রয়োজন পরতনা। ”
” আচ্ছা, আমি কাল সন্ধ্যায় আসব। ” আনানের মুখ কালো হয়ে গেছে তাহমিদের কথা শুনে।
” এজন্য তোর একটা ট্রিট পাওনা রইল। চলে আসিস কাল। ”
তাহমিদ ফোন রাখলে আনান কিছুক্ষণ অবাক হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
” আজিব মানুষ! একটাবারও জিজ্ঞেস করলনা আমি কেমন আছি! সব সময়ই তার মন খালি বউ বউ করে! বিয়ে না হতেই এমন অবস্থা! ”
কুহু হোস্টেলে ফিরে কিছুক্ষণ মটকা মেরে শুয়ে থাকে। ওর কানে শুধু তাহমিদের বলা কথাগুলোই ভাসছে। প্যাকেটের কথা মনে হতেই উঠে বসে। প্যাকেটটা হাতে নিয়ে ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করে। র্যাপিং পেপারে মোড়ানো থাকায় বোঝা যায়না ভেতরে কি আছে। এরপর আগ্রহ নিয়ে খুলতে থাকে।
প্যাকেটের ভেতরটা উন্মুক্ত হতেই কুহুর চোখদুটো রসগোল্লার আকার ধারণ করে।
তিনটা মনিপুরী হ্যান্ডলুম শাড়ি, মনিপুরী হ্যান্ডলুম থ্রী পিস, মনিপুরী শাল, মনিপুরীদের তৈরি পার্স, হাতব্যাগ, হিজাব । শাড়ি থ্রী পিসের কালারের সাথে মিলিয়ে কানের দুল, চুরি, কয়েক জোড়া জুতা। এ যেন ছোটখাট দোকান! কুহু ভাবছে, মানুষটা এতটাই শৌখিন!
শাড়ি, থ্রী পিসগুলোর ভাঁজ ভেঙ্গে দেখছে কুহু। প্রত্যেকটাই অসম্ভব সুন্দর। কি সুন্দর কম্বিনেশন করা কালার! মানুষটার পছন্দ আছে স্বীকার করতে হবে।
দৃষ্টির বাবার বাড়ি থেকে আসার পর থেকেই সবুজের কোন খোঁজ নেই। টাকাগুলো নিয়ে কাঠ কেনার নাম করে সেইযে গেছে, আজ ছয়দিন হয়ে গেছে, বাড়িতে আসার নামগন্ধ নেই। দৃষ্টি ফোন করলে বলে, মিলের কাজে ব্যস্ত তাই আসতে দেরি হচ্ছে। এদিকে দৃষ্টির খুব চিন্তা হচ্ছে। এতগুলো টাকা নিয়ে গেছে, কিছু যদি হয়ে যায়! এদিকে যখন ওর শ্বশুর-শ্বাশুড়ি জেনেছে দৃষ্টির বাবা ছয় লাখ টাকা দিয়েছে, সেদিন থেকে তারা দৃষ্টির প্রতি একটু নমনীয় হয়েছে। আগেরমত কাজ এখন দৃষ্টিকে করতে হয়না।
আটদিন পর রাতে বাড়ি ফিরে সবুজ। এসেই দৃষ্টিকে জানায় মিল চালু করতে যা যা প্রয়োজন সব ঠিক করে এসেছে। দৃষ্টি সবুজের কথা শুনে খুব খুশি হয়। অবশেষে এই বাড়িতে নিজের অধিকারবলেই থাকতে পারবে।
কিন্তু দৃষ্টি জানেনা, তার জন্য নিয়তি অন্য খেলা সাজিয়ে রেখেছে। যে খেলার নিয়ন্ত্রক শুধুমাত্রই সবুজ।
চলবে…