#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৩০
জাওয়াদ জামী
” শাহনাজ, তুইও নাজমার মত প্র’তি’শো’ধপ’রা’য়’ন আচরণ করছিস! আব্বা-আম্মা এই শিক্ষাই তোদের দিয়েছিল! তাদের শিক্ষাকে ভুল প্রমানিত করলি তোরা? ” আফরোজা নাজনীন আফসোস নিয়ে বলতে থাকেন।
” বড় আপা, সবক্ষেত্রে বাবা-মা’ র শিক্ষার বড়াই দেখান ঠিক নয়। কিছু কিছু সময় নিজের বিবেক দিয়েও কাজ করতে হয়। আজ যদি আব্বা-আম্মার দেয়া শিক্ষার দোহাই দিয়ে একে ছেড়ে দিই, তবে আমাদের আব্বা-আম্মার শিক্ষার অ’প’মা’ন করা হবে। আর এর মত মানুষকেতো ছাড় দিতেই নেই। এরা অন্ধকার সমাজ গড়ার হাতিয়ার। সময় থাকতে এদের উপড়ে ফেলতে হয়। তা নাহলে এরা সমাজে সং’ক্রা’ম’ক ব্য’ধি ছড়িয়ে দেয়। ” আজ শাহনাজ সুলতানা তার বড় বোনের কোন কথাই শুনতে রাজি নয়। কথাগুলো শেষ করেই শাহনাজ সুলতানা শিউলি আক্তারকে মেঝে থেকে তুলে, তিনিও পরপর কয়েকটা থা’প্প’ড় মারেন।
” শোন শিউলি, তুই যা করেছিস সেটা ক্ষমার অযোগ্য। শুধু আমরা বলে, তোকে এখন পর্যন্ত পুলিশে দিইনি। তাই বলে ভাবিসনা, তোকে ছেড়ে কথা বলব। ”
ছোট বোনের এমন রূপ কখনোই দেখননি আফরোজা নাজনীন।
কুহু স্তব্ধ হয়ে ফুপুদের কর্মকান্ড দেখছে। প্রয়োজনে ওর ফুপরাও যে প্রতিবাদী হতে পারে, তা দেখে কুহু চরম বিস্মিত।
শিহাব মায়ের এরূপ হেনস্তা দেখেও চুপচাপ থাকে। ও সেদিন চোখের সামনে বাবাকে মা’র খেতে দেখেছিল। তাই সেদিন থেকেই নিজের মায়ের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে এসেছে।
” তা তুই শুধু শিহাবকে এনেছিস কেন? তোর গুনধর মেয়ে কোথায়? যে এই সকল কিছুর মুলে, তার মুখ দর্শন করতে পারবনা! এই সুযোগে তাকেও শিক্ষা দিতাম। ” নাজমা পারভিন ব্যঙ্গ করে বললেন।
এই ভয়টাই শিউলি পাচ্ছিল। সে কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ থাকে। এদিকে ওর তিন ননদ একই কথা বারবার জিজ্ঞেস করছে। তবুও শিউলি কিছু বলেনা।
” ফুপু দৃষ্টি আপু, চেয়ারম্যানের ছেলে সবুজের সাথে আজ রাতে পালিয়েছে। ” শিহাব মায়ের বদলে উত্তর দেয়।
শিহাবের কথা শুনে কেবিনের সকলে স্তব্ধ হয়ে গেছে। তারা কথা বলার মত অবস্থায় নেই। সকলে শুধু একে-অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। অবশেষে নিরবতা ভেঙে কথা বললেন, নাজমা পারভিন।
” বাহ, বংশের মুখে চু’ন’কা’লি মাখাতে আর কিছু লাগবেনা। তুই আর তোর মেয়েই এর জন্য যথেষ্ট। বড় কপাল করে তোকে ঐ সংসারে এনেছিলাম , আর অবশেষে বাপের নামও ডু’বা’লা’ম। ”
শিউলির মাথা নিচু করে কথা শোনা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তবে মেয়ে যে পালিয়েছে এর জন্য তার আফসোস নেই। মেয়ে তার চেয়ারম্যান বাড়ির বউ। এটা চাট্টিখানি কথা!
আফরোজা নাজনীন ডুকরে কেঁদে উঠেন। ঐ ছোট্ট মেয়েটা এইভাবে বাপ-দাদার নাম ডু’বা’লো!
তিনি বেশ বুঝতে পারছেন শিউলির আস্কারা পেয়েই দৃষ্টি ভুল পথে গেছে।
কুহু হতবিহবল হয়ে ফুপুর দিকে তাকিয়ে থাকে। এই ফুপু যেকোন পরিস্থিতি শক্ত হাতে সামাল দিতে পারেন। সবাইকে সব সময়ই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ধৈর্য্য রাখতে রাখতে বলেন। কিন্তু আজ তিনি কাঁদছেন। আজ কে তাকে সামাল দিবে! সবারই যে মনের অবস্থা বিরূপ।
সারাটাদিন কেবিনে থমথমে অবস্থা বিরাজ করেছে। নাজমা পারভিন থেকে থেকেই শিউলিকে মারতে তেড়ে গেছেন। কখনোবা গালাগালি করেছেন। আর শিউলি এসব কিছুই নিরবে সহ্য করে গেছেন।
সন্ধ্যায় কায়েসকে কেবিনে স্থানান্তরিত করা হয়।
তার জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু শরীর দূর্বল থাকায় কথা বলতে পারছেননা। তাকে কেবিনে দেয়া হলে শিউলিকে দেখা মাত্রই ঘৃণায় মুখ কুঁচকে ফেলে। এই নারীকে দেখার কোন ইচ্ছে তার নেই।
বাবাকে দেখেই শিহাব সেই যে তার পাশে বসেছে, উঠার নাম নেই। কুহুও বাবার আশেপাশেই থাকছে।
পরদিন সকালে শিউলি তার ছেলেকে নিয়ে গ্রামে ফিরে যায়। গ্রামে যাবার আগ পর্যন্ত কায়েস শিউলির সাথে একবারের জন্যও কথা বলেলনি।
বোনদের সেবাশুশ্রূষা, মেয়ের যত্নআত্তি পেয়ে একমাসের মধ্যেই কায়েস প্রায় সুস্থ হয়ে যায়। এই একমাস সে বড় বোনের বাসায় থেকেছে।
ব্যবসার যাবতীয় কিছু ফোনেই সামলেছে। তবে কুহু বাবার হয়ে দুইবার গ্রামে গিয়ে টাকার হিসেব নিয়েছে। পুরো মার্কেটের ভাড়া তুলে এনেছে। বাবার কথামত সেই টাকাগুলো নিজের এ্যাকাউন্টে জমা রেখেছে।
শিউলি যখন শুনেছে, কুহু সব টাকা নিয়ে ঢাকায় ফিরে গেছে, তখন থেকেই রা’গে ফুঁ’স’ছে।
এদিকে দৃষ্টি দিন দশেক পরেই স্বামীর সাথে ফুলতলা এসেছে ৷ মেয়ে-জামাইকে পেয়ে শিউলি আনন্দে আটখানা হয়ে যায়। জামাইয়ের যত্নআত্তির ত্রুটি রাখেনা। তিনদিন পর মেয়ে যখন শ্বশুর বাড়ি ফিরে যায়, সে অনেক কিছু বেঁধে দেয় । নিজের জমানো টাকা থেকে বিশ হাজার টাকা জামাইয়ের হাতে দেয়৷ নিজেদের দোকানে যেয়ে ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, টিভি, ল্যাপটপ, খাট, আলমারি, সোফা, ড্রেসিংটেবিল সবকিছুই জামাইয়ের পছন্দমত নিয়ে, তাদের সাথে পাঠিয়ে দেয়। জামাই এতকিছু পেয়ে ভিষণ খুশি হয়।
চেয়ারম্যান বাড়িতে এসব নিয়ে যখন ওরা প্রবেশ করে, তখন চারদিকে দ্রুত খবর ছড়িয়ে পরে সবুজ শ্বশুর বাড়ি থেকে কতকিছু নিয়ে আসছে৷
আহলাদে দৃষ্টি যেন আকাশে উড়ছে। ও ভেবেছে বাবার বাড়ি থেকে এতকিছু এনে, সবাইকে নিজের অধীনে করে নিবে। কিন্তু সে ভুল।
দীর্ঘ একমাস পর আফরোজা নাজনীন তার ভাইকে নিয়ে গ্রামে আসে। সাথে কুহুও রয়েছে।
কায়েকসে দেখে শিউলি দৌড়ে তার কাছে আসে। কিন্তু কায়েস ওকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
কায়েস ভালোমত হাঁটতে পারছেনা। এদিকে ডক্টরও তাকে বেশি নড়াচড়া করতে নিষেধ করেছে। তাই ঢাকায় ফেরার আগে আফরোজা নাজনীন ভাইয়ের ব্যবসার ম্যানেজারকে ডেকে যাবতীয় সকল নির্দেশ দেন। সেই সাথে একটা এ্যাকাউন্ট নম্বর দেন, যেখানে মাস শেষে টাকা পাঠাতে বলেন। শিউলি দেখল তার থেকে সব ফসকে যাচ্ছে। কিন্তু আপাতত সে এসব নিয়ে কিছুই বলবেনা। আগে সবকিছু আবার পূর্বের ন্যায় হয়ে যাক। তারপর আবার সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ সে-ই করবে।
এমন সময় ম্যানেজার জানায়, কিছুদিন আগে শিউলি আক্তার তার মেয়ে-জামাইকে মার্কেটে নিয়ে যেয়ে বেশ কিছু জিনিসপত্র নিয়েছেন। একথা শুনেই কায়েস রেগে উঠে। কিন্তু বোনের চোখের ইশারায় থেমে যায়। আফরোজা নাজনীন চাননা পরিবারের এসব বিষয় বাহিরে যাক।
ম্যানেজার বিদায় নিলে, দুই ভাই-বোন মিলে শিউলিকে চেপে ধরে। দুজনের চাপে পরে শিউলি সব স্বীকার করতে বাধ্য হয়। আফরোজা নাজনীন অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে থাকেন শিউলির দিকে। কতটা সাহস থাকলে, এতকিছুর পরও কোন মানুষ এমন করতে পারে!
” বড় আপা, আমি নিরুপায় হয়ে এই মহিলাকে সংসারে রেখেছি। তার সাহস কত দেখ! যে মেয়ের বিষয়ে আমি কিছুই জানিনা, তার বিয়ে হয়েছে আমি আজই জানলাম। আর সে কিনা, মেয়ে-জামাইকে হাত ভর্তি করে গিফ্ট পাঠিয়েছে! ওর বুক একটুও কাঁপেনি! আমাকে জানানোর প্রয়োজনও মনে করেনি! আমি আর ভাবতে পারছিনা, আপা। ”
” ভাই, তুই এসব চিন্তা করে শরীরের ক্ষতি করিসনা। আমরা আছিতো। তুই বাড়িতে থেকেই ব্যবসা দেখাশোনা করবি। প্রতিমাসেই আমরা তিনবোন গ্রামে আসব। ব্যবসার সব হিসাব-নিকাশ আমরাই দেখব। এছাড়া কুহু আছে। ও ফোনে ম্যানেজারের সাথে যোগাযোগ রাখবে। আগে তুই সুস্থ হ। তারপর কার কি ব্যবস্থা নিতে হবে, সেটা আমরা দেখব। ”
কায়েস বোনের কথায় সায় দেয়।
তাহমিদ কিছুদিন থেকে ঠিকঠাক খাওয়া-দাওয়া করছেনা। সবসময়ই মনমরা হয়ে থাকছে। তাহমিনা ছেলের এমন অবস্থা দেখে চিন্তায় পরে গেছেন। আফরোজা নাজনীনও লক্ষ্য করেছেন তাহমিদ কেমন শুকিয়ে গেছে। তিনি তাহমিদকে
জিজ্ঞেসও করেছেন , কি হয়েছে। কিন্তু তাহমিদ কিছুই জানায়নি, বরং এড়িয়ে গেছে।
( বাসায় হঠাৎ করেই পাঁচজন মেহমান এসেছে। মেহমানদারি করতে যেয়ে, লিখা হয়ে উঠেনি। যতটুকু লিখতে পেরেছি, ততটুকুই পোস্ট করলাম।)
চলবে…