#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_২৯
জাওয়াদ জামী
” দেখুন আমি চাইনা আপনি কোন সিনক্রিয়েট করুন। তাই এতরাতে ছাদে এসেছি। কি বলবেন জলদি বলে ফেলুন। এমনিতেই আমার মন মানসিকতা ভালো নেই। ”
” আমি জানি তোমার মন ভালো নেই। কোন মেয়ে তার বাবার এমন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক থাকতে পারেনা। এমনকি আমি এটাও জানি, আমার আবদারটাও অন্যায়। একটা মেয়ের এমন অবস্থায় তার সাথে নির্জনে কথা বলা খুব ভালো দেখায়না। কিন্তু আমি নিরুপায়। আজ তোমার সাথে আলাদাভাবে কথা না বললেই হতনা। ”
” কি এমন কথা আছে, যার জন্য আপনি এত অধৈর্য্য হয়ে গেছেন? আর এমনিতেও আমি জানি, আপনি যতসব ফা’ল’তু কথা বলতেই আমাকে এখানে ডেকেছেন। ”
” আমি ফা’ল’তু কথা বলতে তোমাকে এখানে ডেকেছি! আরে, তোমার বিয়ের আলোচনা করছিল শাহনাজ আন্টি। সেই কথা শুনেই মনে মনে হচ্ছিল আমি পা’গ’ল হয়ে যাব। আর তুমি বলছ আমি ফালতু কথা বলতে ডেকেছি? ”
” আমার বিয়ের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল! এসব কি বলছেন আপনি? ”
” হুম, শাহনাজ আন্টির কোন এক প্রতিবেশি তার ছেলের জন্য তোমাকে পছন্দ করেছে। সেই কথাই তিনি বড়মার সাথে আলোচনা করছিলেন।সব শুনে মনে হল, বড়মারও এতে সায় আছে। তবে তিনি আগে তোমার সাথে দেখা বলতে চান। যখন আমি সেকথা শুনলাম, তখন মনে হলো আজ তোমার সাথে কথা না বললেই নয়। এবার বলো আমার কি খুব বেশি অন্যায় হয়েছে? ”
নিজের বিয়ের কথা শুনে কুহুর বুকের ভিতর ধুকপুক করছে।
” আচ্ছা, আমি এখন আসছি। আর কখনোই এভাবে রাত-বিরেতে আমাকে ডাকবেননা। কেউ জানলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। ” কথাগুলো বলেই কুহু তড়িঘড়ি করে ছাদ থেকে নিচে আসে।
আর তাহমিদ বিমর্ষচিত্তে তাকিয়ে থাকে কুহুর যাওয়ার দিকে। ওর একটা কথাই মনে হচ্ছে, কুহু এভাবে না গেলেও পারত। পাঁচটা মিনিটও কি ওকে দেয়ার মত সময় ছিলনা কুহুর কাছে? সেই দিনের সেই অন্যায়ের জন্য আর কতদিন এভাবে তড়পাতে হবে? ওর অন্যায়ের কোন ক্ষমা কুহুর ঝুলিতে কি নেই?
” আচ্ছা, আমি কি কুহুর কাছে নিজেকে খুব সস্তাভাবে উপস্থাপন করছি? যে কারনে কুহু আজও সেই ভুলের জন্য আমাকে ক্ষমা করতে চাইছেনা। তাকে ভালোবাসি জন্যই কারনে-অকারনে তার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে। তার আশেপাশে ছায়া হয়ে থাকতে সাধ হয়। কিন্তু আমার ভালোবাসাকে ও কি তুচ্ছ ভাবছে? যদি তাই হয়, তবে নিজেকে আর সস্তা হতে দিবনা। ওকে সারাজীবন ভালোবেসে যাব, কিন্তু ওর কাছে আর নিজেকে ছোট করবনা। ওকে আগে বুঝতে হবে আমার ভালোবাসার গভীরতা। ” হাসনাহেনা গাছের নিচে সটান হয়ে শুয়ে, অন্তরীক্ষের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলেছে তাহমিদ।
আজ নিজেকে বড্ড অযোগ্য মনে হচ্ছে। সেদিন সেই ভুলটা না করলে, কুহু তার একান্তই নিজের হয়ে যেত। ওকে হারানোর কোন ভয় থেকে থেকে মনে উঁকি দিতনা। এখন বুঝতে পারছে, সময় থাকতে যার মূল্য দেয়নি, আজ সেই মূল্যহীন মেয়েই অমূল্য সম্পদ রুপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে তাহমিদের হৃদ মাজারে।
কুহু দিদুনের রুমে এসে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। ফুপু যদি ওর জন্য কাউকে পছন্দ করে, তবে সে কিছুতেই না করতে পারবেনা। কুহু চায়না ফুপুরা ওর জন্য কোন কষ্ট পাক। যে ফুপুদের কারনে আজ ও এ পর্যন্ত আসতে পেরেছে, সেই ফুপুদের কথা কখনোই অমান্য করতে পারবেনা। সেই সাহসও কুহুর নেই। যে ফুপুদের কথার অবাধ্য ও কখনোই হয়নি আর আজও হবেনা। আনমনে কখন যে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে তা সে বুঝতেই পারেনি। বারান্দার গ্রীল ভেদ করে চাঁদের আলো বারান্দায় এসে পরছে। ভরা পূর্নিমায় চাঁদের আলো তার জৌলুস ছড়াচ্ছে। ধরনীর বুকে তার হৃদয় নিং’ড়া’নো সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিয়ে গর্বে বিচরণ করেছে বিশ্বব্রহ্মান্ডে। কিন্তু গৌরবে গরবিনী চাঁদের আলোর কারসাজি উপভোগ করার মত মন এখন কুহুর নেই। ওর মনে এখন বিরাজ করছে বি’ষা’দে’র কালো ছায়া। যে ছায়াতলে ঢাকা পরে যায় তাহমিদ নামক একজন পুরুষের ভালোবাসা। যে ভালোবাসার উর্ধ্বে ঠাঁই পায় ফুপু নামক মমতাময়ীদের স্নেহ, ভালোবাসা।
একই বাড়িতে দুজন মানব-মানবী সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে দেয়। একজন নিজেকে বদলানোর প্রত্যয় নিয়েছে, তো আরেকজন বিসর্জন দিয়েছে তার প্রেমিক পুরুষের ভালোবাসা।
পরদিন সকালে কুহু আসে তাহমিদের রুমে। তাহমিদ কিছুক্ষণ আগে রুমে এসেছে। ওর হাতে গতকালের তাহমিদের দেয়া শপিংব্যাগ। কুহু এর আগে কখনো তাহমিদের রুমে আসেনি, তাই ও বেশ অপ্রস্তুত বোধ করছে। কুহুকে দেখে তাহমিদ ভুরু কুঁচকে তাকায়।
” এই নিন আপনার জিনিস। আশা করব ভবিষ্যতে এমন কাজ আর করবেননা। আমার জন্য ফুপুদের সম্মান ক্ষুণ্ণ হোক তা আমি চাইনা। আশা করি কথাটা মনে রাখবেন। ”
তাহমিদ কিছু না বলে হাত বাড়িয়ে শপিংব্যাগ নেয়। কুহুর কথার কোন প্রত্যুত্তর করেনা।
কুহু শপিংব্যাগ তাহমিদকে দিয়ে সোজা বেরিয়ে আসে রুম থেকে।
তাহমিদ বিষন্ন হেসে শপিংব্যাগ রেখে দেয় আলমারিতে।
” আমার ভাগ্যের লিখন যদি তুমি হও, তবে তোমাকে আমার হতে কেউই রুখতে পারবেনা। নিয়তি যেদিন চাইবে, সেদিনই তোমার-আমার সম্পর্ক পরিণতি পাবে। আর সেদিন তুমি আজকের এই আচরণের জন্য লজ্জা পাবে। তবে আজকের মত সেদিনও তোমার ওপর কোন অভিযোগ আমি রাখবনা। কে’লে’ঙ্কা’রি’র ভয়ে তুমি সত্যিকারের ভালোবাসা পায়ে ঠেলে দিলে। কিন্তু একবারও জানলেনা, প্রয়োজনে তোমার সব ক’ল’ঙ্ক আমি বুকে তুলে নিতাম। কোন ক’ল’ঙ্ক তোমাকে ছুঁতেও পারতনা। তোমার একবিন্দু সুখের জন্য আমি ক’ল’ঙ্কে’র সাগরে ডুব দিতাম। কিন্তু আফসোস তুমি আমার ভালোবাসা বুঝলেনা। ”
ডাইনিং টেবিলে সবাই একসাথে বসে খাচ্ছে। কুহু কোনদিকে না তাকিয়েই একমনে খাচ্ছে। তাহমিদ একবার আড়চোখে কুহুর দিকে তাকিয়ে খাওয়ায় মন দেয়। কারো মুখে কোন কথা নেই। ডাইনিং রুমে সুনশান নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। ওদের এই নিস্তব্ধতা দেখে তাহমিনা আক্তারের মনে কু ডাকছে। কি চলছে দুজনের মধ্যে তা তিনি বুঝতে পারছেননা।
” তাহমিদ, তোর কি সকালে ক্লাস আছে? যদি ক্লাস থাকে মেডিকেলে যাবার সময় কুহুকেও নিয়ে যাস। ”
” ওকে মা। তুমি ওকে তৈরি হতে বলো। আমি আধাঘন্টা পরই বের হব। ”
তাহমিদের কথা শুনে তাহমিনা আক্তার নিশ্চিত হয়ে যান, দুজনের মধ্যে কিছু একটা ঘটেছে।
খাবার পর কুহু তৈরি হয়ে ড্রয়িংরুমে আসে। তাহমিনা আক্তার সেখানে কিছু একটা করছিলেন।
” কুহু মা, কি হয়েছে তোদের? আমার ছেলেটা এমন চুপচাপ হয়ে আছে কেন? শোন মা, মনে কোন প্রশ্নের উদয় হলে কিংবা কোন সমস্যা সৃষ্টি হলে, মিলেমিশে সমাধানের চেষ্টা করবি। তোর যথেষ্ট বয়স হয়েছে, আশা করি এর থেকে বেশি কিছু বলার দরকার হবেনা। ”
তাহমিনা আক্তারের কথায় কুহু কোন জবাব না দিয়ে শুধু মাথা নাড়ায়।
এমন সময় তাহমিদ তৈরি হয়ে ড্রয়িংরুমে আসে।
” মা, আমি বেরোলাম। ও যদি আসে, তবে আসতে বলো। ” তাহমিদ কথাটা বলেই বেরিয়ে আসে।
কুহুও তাহমিদের পিছু পিছু আসে।
ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে ওদের অপেক্ষা করছে।
তাহমিদ সোজা যেয়ে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে। এতে কুহুর কোন হেলদোল নেই। সে গিয়ে পেছনে বসে।
কুহুকে ওর বাবার কাছে পৌঁছে দিয়ে তাহমিদ ক্লাস করতে যায়। এরমধ্যে একটিবারও না কুহুর দিকে তাকিয়েছে, আর না কুহুর সাথে কথা বলেছে।
কুহু কেবিনে এসে দেখল কেবিনে শুধু ওর মেজো ফুপু বসে আছে। ফুপুকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে, বড় ফুপু ডক্টরের সাথে কথা বলছে, আর ছোট ফুপু বাবার কাছে গেছে। কুহু ফুপুকে বলে বাবাকে দেখতে যায়।
কাঁচের দরজা মধ্যে দিয়ে কুহু বাবার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। ওর চোখের কোনে পানি জমেছে। ও কি কখনো ভেবেছিল বাবার এমন কিছু হবে! আবার সবকিছু ভুলে যখন একজনের ওপর মায়া জন্মাল, ঠিক তখনই জানতে পারল, ফুপুরা ওর বিয়ের কথা ভাবছে। জীবন ওকে যে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তা বোধগম্য নয় কুহুর৷ ও শুধু জীবনটাকে নিজস্ব গতিতে চলতে দিয়েছে। দেখা যাক কোন ঘাটে এসে এই চলার সমাপ্তি ঘটে।
আফরোজা নাজনীন কেবিনে এসে জানায় সন্ধ্যায় কায়েসকে কেবিনে শিফট করবে। গতকালকের থেকে তার শারীরিক অবস্থা আজকে খানিকটা উন্নতি হয়েছে। একথা শোনার পর ওরা সবাই স্বস্তি পায়।
কুহু বাবার কথা শোনার পরপরই কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ক্লাস শেষে মেডিকেলে ডখন পৌঁছায় তখন দুপুর দুইটা বেজে গেছে।
এরমধ্যে আফরোজা নাজনীন বাসায় গিয়েছিলেন। তিনি দুই ঘন্টা বাসায় কাটিয়ে, বোনদের এবং কুহুর জন্য খাবার নিয়ে মেডিকেল আসেন।
খাবার পর যখন সবাই একসাথে টুকটাক কথা বলছিলেন, তখনই হন্তদন্ত হয়ে কেবিনে প্রবেশ করে শিউলি আক্তার। তার সাথে শিহাব আর সিক্তা এসেছে। সে মেডিকেলে কখনো আসেনি তাই প্রথমে বড় ননদের বাসায় যেয়ে সিক্তাকে নিয়ে এসেছে। ছোটমাকে দেখেই কুহুর চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। আর নাজমা পারভিন সোফা ছেড়ে উঠে সোজা দাঁড়ায় শিউলির সামনে। কোন কথা না বলেই আচমকা কয়েকটা থা’প্প’ড় বসিয়ে দেয় শিউলির গালে। ঘটনার আকস্মিকতায় শিউলি হতভম্ব হয়ে গেছে। কেবিনে ভ’য়া’ন’ক নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।
নাজমা পারভিন শুধু থা’প্প’ড় দিয়েই ক্ষান্ত হননি। তিনি এবার শিউলির চুলের মু’ঠি ধরে টেনে হিঁ’চ’ড়ে নিয়ে এসে কেবিনের মেঝেতে আ’ছা’ড় মারেন।
” ফ’কি’ন্নি’র মেয়ে, তোর সাহস কি করে হয় আমার ভাইকে ধা’ক্কা দেয়ার? এই কাজ করতে তোর কলিজা একবারও কাঁ’পে’নি? তোর মনে হয়নি একথা আমরা শুনলে, তোকে কি করতে পারি? তোকে আমার ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে এনে আমরা কি ভুল করেছিলাম? তোকে আমরা তোর প্রাপ্য মর্যাদা দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুই এর যোগ্য নয়। আসলে কাককে যতই ময়ূরের পালক পড়াই না কেন, কাক সবসময় কাকই থাকে, ময়ূর হয়না। তুই সেই কাক, যাকে হাজার চেষ্টা করেও ময়ূর বানানো যাবেনা। ” নাজমা পারভিন আজ নিজের মধ্যে নেই। চোখের সামনে শিউলিকে দেখেই হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছে।
” নাজমা, তুই এসব কি শুরু করেছিস? এতটা বে’য়া’দ’ব হয়েছিস তুই, যে ভাইয়ের বউয়ের গায়ে হা’ত তুলছিস! ” আফরোজা নাজনীন রেগে উঠেছেন।
” কিসের ভাইয়ের বউ! এই শ’য়’তা’নি কখনো আমাদের ননদের সম্মান দিয়েছে! নিজে সম্মান পেতে হলে অন্যকেও সম্মান দিতে হয়। এই বে’য়া’দ’ব মহিলা কখনো আমাদের সেই সম্মান দিয়েছে, যে ওকে আমরা মাথায় তুলে রাখব? যেদিন ও আমার ভাইকে মে’রে’ছে, সেদিন থেকে ওর সাথে সম্মুখ ল’ড়া’ই শুরু হয়েছে। আমি যা করছি, তাই করতে দাও। তুমি বাঁধা দিতে আসলেও মানবোনা। ” দ্বিগুণ তেজে বলে উঠে
নাজমা পারভিন।
” বড় আপা, তুমি একটা কথাও বলবেনা। মেজো আপা যা করছে, তাকে করতে দাও। ওর এই শাস্তিটুকুর প্রয়োজন আছে। এখন যদি ও না শোধরায়, তবে ভবিষ্যতে কিন্তু আমাদের পস্তাতে হবে। ”
শিউলি আক্তার মেঝেতে উপুড় হয়ে পরে কাঁদছে।
চলবে…
Baki ta kobe asbe