বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ২৬

1
2447

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_২৬
জাওয়াদ জামী

কুহু ফোন রিসিভ করতে দোমনা করছে। ও চিন্তায় অস্থির হয়ে গেছে। ততক্ষণে ফোন কে’টে গেছে। পরক্ষণেই আবার ফোন বেজে উঠল।
” কেমন আছো ছোটমা? শিহ…” কুহুর কথা শেষ হবার আগেই ওপরপাশ থেকে কথা ভেসে আসে।
” আপু, আমি শিহাব। খুব জরুরি কথা আছে তোমার সাথে। ” শিহাবের গলায় উৎকন্ঠা গোপন থাকেনা।
” কি হয়েছে সোনা! তুই এভাবে কথা বলছিস কেন? বাবা ভালো আছে তো? তোরা সবাই ভালো আছিস? ”
” আমরা ভালো নেই আপু। আব্বু ভীষণ অসুস্থ। ”
” কি হয়েছে বাবার? বাবা ঠিক আছে তো? ” ভয়ে কুহুর গলা কাঁপছে। ওর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে।
শিহাবও কাঁদতে শুরু করেছে। কোনমতে কান্না থামিয়ে বলে,
” আপু, আম্মু আব্বুকে ধাক্কা মেরেছে, আব্বু পরে যেয়ে, বুকে লেগেছে। ” শিহাবের কথা শুনে কুহুর দম বন্ধ হবার উপক্রম হয়। এ কি শুনছে সে!
” কি বলছিস এসব শিহাব! আমাকে খুলে বল, কি হয়েছে? ”
” দৃষ্টি আপু, আমাদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের ছেলেকে পছন্দ করে। ওকে বিয়ে করতে চাচ্ছে। কিন্তু আব্বু এতে মত নেই। এদিকে আম্মু চায় ঐ ছেলেটার সাথেই আপুর বিয়ে হোক। এ নিয়ে আব্বুর সাথে আম্মুর খুব কথা কা’টা’কা’টি হয়। এক পর্যায়ে রে’গে যেয়ে আম্মু আব্বুকে জোরে ধা’ক্কা দেয়। আব্বু বারান্দার টেবিলে যেয়ে ধা’ক্কা খেয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। সেখানেই আব্বুকে ভালো করে শুইয়ে দিয়ে, মাথায় পানি ঢালে আম্মু। খানিকক্ষণ পর আব্বুর জ্ঞান ফিরে। তারপর থেকেই আব্বু অসুস্থ। জানো আপু, দৃষ্টি আপু যাকে বিয়ে করতে চাইছে, সেই ছেলেটা ভালো নয়। ও নে’শা করে আর জু’য়া খেলে । তাই আব্বু বিয়েতে রাজি নয়। আম্মু সব সময়ই নিজের ফোন আর আব্বুর ফোন তার কাছে রাখছে। আব্বুকে কেউ ফোন দিলে, তার সাথে আম্মুই কথা বলছে। তাই আমি এই কয়দিন তোমাকে ফোন করার সুযোগ পাইনি। একটু আগে কে যেন আব্বুর ফোনে ফোন দিয়েছে, আম্মু বাগানে যেয়ে কথা বলছে। এই সুযোগে আমি তোমার কাছে ফোন করেছি। ”
শিহাবের কথাগুলো শুনে কুহু কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে। এ কি শুনছে সে! ছোটমার এত অধঃপতন হয়েছে, যে বাবার গায়ে হাত তুলতে এতটুকু বাঁধলোনা!
” আপু, তুমি বাড়িতে একবার আসবে। আব্বু শুধু কাঁদছে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে আপু। তুমি এসে আব্বুকে বাঁচাও আপু। ” কুহুর ভাবনায় ব্য’ব’চ্ছে’দ ঘটিয়ে কথা বলে শিহাব।
” আমি আসব সোনা। তুই কাঁদিসনা, বাবাকে দেখে রাখিস। ”
” আপু, আমি যে তোমাকে ফোন করেছি, তা আম্মুকে বলোনা। আম্মু জানতে পারলে আমাকে মা’র’বে। ”
” আচ্ছা বলবনা। তুই শুধু বাবাকে দেখে রাখিস। আমি খুব তারাতারি আসব। ” কুহু ফোন কে’টে দেয়। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকে। এমনটা কেন হল!
কুহু ধাতস্থ হয়ে বড় ফুপুকে ফোন করে। তাকে সবটা জানিয়ে, একবার গ্রামে যেতে চায়। কিন্তু আফরোজা নাজনীন কুহুকে সেখানে একা যেতে দিতে রাজি হয়না। তিনি নিজেও কুহুর সাথে যেতে চান। তিনি জানান আগামী সোমবার তিনি কুহুকে নিয়ে ফুলতলা যাবেন। তিনি এখন রীতির শ্বশুর বাড়ি আছেন। সেখান থেকে আগামীকাল ঢাকায় ফিরে সোমবার ফুলতলা যাবেন। কুহু ফুপুর কথায় সায় দেয়৷ তবে ওর মন বড্ড উচাটন করছে। আজ কেবল শনিবার। মাঝখানে আরও একটা দিন অপেক্ষা করতে হবে।

পরদিন দুপুরেই আফরোজা নাজনীন নিজ বাসায় হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করেন। তিনি দুই বোনের সাথে কথা বলেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও তারা এখন কেউই আসতে পারবেনা। আনানের পরীক্ষা চলছে তাই শাহনাজ সুলতানার পক্ষে এখন ফুলতলা যাওয়া সম্ভব নয়। আর নাজমা পারভিনের শ্বশুর অসুস্থ হয়ে বিছানা নিয়েছে। তিনি ছাড়া শ্বশুরকে দেখার মত কেউই নেই। তাই তিনিও আসতে পারবেননা। অগত্যা আফরোজা নাজনীনকে একাই যেতে হবে। তিনি যেহেতু দুপুরের মধ্যেই ফিরেছেন, তাই সিদ্ধান্ত নেন আজই কুহুকে নিয়ে ফুলতলা যাবেন। তাহমিনা আক্তারকে সব খুলে বলতেই, তিনি বাধ সাধছেন। গ্রামে যেতে রাত হয়ে যাবে। যেহেতু সানাউল রাশেদিন এখন ঢাকায় নেই, তাই একা দুইজনকে একা যেতে দিতে তিনি নারাজ।

” বড় ভাবি, আপনি কুহুকে নিয়ে একা যাবেননা। এত রাস্তা তারউপর যেতে রাত হয়ে যাবে। যতই ড্রাইভার থাকুক, তবুও চিন্তা থেকেই যায়৷ আপনি বরং তাহমিদকে সাথে নিন। ”
” ও কি যাবে? আমার সাথে কুহু যাচ্ছে, এতে তাহমিদের যদি অসুবিধা হয়। আমি চাইনা, আবার আমাদের ভুলে কুহু চিরদিনের জন্য দূরে চলে যাক। ”
” একই ভুল মানুষ একবারই করে। আর তাহমিদ প্রথমবার ভুল করার পর থেকে, অনুশোচনায় ভুগছে। তাই আমি জানি একই ভুল ও দুইবার করবেনা। আর সময়ও তো পাল্টায়। কে বলতে পারে, যে কুহুকে ও একদিন অসম্মান করেছিল, একসময় দেখা গেল সেই কুহুই ওর সবকিছু হয়ে গেছে। আমরা অনেক কিছু জানলেও, কার মন কখন, কিসে হারাবে তা কিন্তু জানিনা। ” তাহমিনা আক্তারের কথা শুনে আফরোজা নাজনীন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
” কি বলতে চাচ্ছিস তুই, তাহমিনা? আমার কাছে কিছু কি লুকাচ্ছিস? ”
” কিছুই লুকাচ্ছিনা। শুধু বলতে চাইছি, তোমার বাপ এখন আগের মত কাটখোট্টা নেই। কুহুর প্রতি যথেষ্ট নরম হয়েছে, ওর মন। ওকে যেতে বললে, ও বরং খুশিই হবে। কথা বলে সময় নষ্ট না করে, তুমি তোমার বাপকে ফোন করে কুহুকে নিয়ে আসতে বল। ওর মেডিকেল থেকে আসার সময় হয়ে গেছে। আর কুহুকেও তো তৈরি হয়ে থাকতে হবে। ” তাহমিনার কথায় যুক্তি আছে দেখে, আফরোজা নাজনীন আর কথা বাড়ায়না। তাহমিদকে ফোন করে, কুহুকে নিয়ে আসতে বলেন। আবার কুহুকে ফোন করে তৈরি হতে বলেন। এরপর শাহনাজ সুলতানাকে ফোন দিয়ে, সাজ্জাদ স্যারকে কুহুর হোস্টেল সুপারের কাছে বলতে বলেন।
শাহনাজ সুলতানা তার দেবরকে ফোন দিয়ে সবটা জানালে, তিনি হোস্টেল সুপারকে বলে দেন কুহুকে কেউ নিতে গেলে যেন বের হতে দেয়।
কুহু ফুপুর কথামত তৈরি হয়ে থাকে। তাহমিদ হোস্টেলের গেইটে এসে কুহুকে ফোন করে। আননোন নম্বর দেখে কুহু একটু ইতস্তত করে, ফোন রিসিভ করে।
” আসসালামু আলাইকুম। ” সালাম দিয়ে নিশ্চুপ থাকে কুহু।
” ওয়ালাইকুমু সালাম। আমি তাহমিদ বলছি। আসি গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। তুমি তৈরি হয়ে থাকলে চলে এস। ”
” জ্বি, আমি তৈরি আছি। এক্ষুনি আসছি। ” বলেই ফোন কে’টে দেয় কুহু৷
তাহমিদ গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষন পর দেখল কুহু একটা ছোট ব্যাগ হাতে নিয়ে গেইট দিয়ে বের হচ্ছে। ও গাড়ির কাছে আসলে তাহমিদ দরজা খুলে দেয়। কুহু কোন কথা না বলে গাড়িতে উঠে বসে।
সারা রাস্তা কেউ কোন কথা বলেনা। কুহুর মন খারাপ দেখে তাহমিদও ওকে ঘাঁটায়না।

ওরা ” কুঞ্জছায়া”য় পৌঁছে দেখল আফরোজা নাজনীন তৈরি হয়ে ওদের অপেক্ষা করছিল। আর তাহমিনা আক্তার ওদের দুজনের জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছিল। তাকমিদকে ফ্রেশ হতে বলে, তিনি খাবার বাড়েন। তাহমিদ ফ্রেশ হয়ে একেবারে তৈরি হয়ে নিচে নামে। কুহু খেতে না চাইলেও তাহমিনা আক্তার ওকে জোর করে খাওয়ায়। দুজনকেই একসাথে খাইয়ে দেয় তাহমিনা আক্তার।
ওদের খাওয়া শেষ হওয়া মাত্রই আফরোজা নাজনীন বেরিয়ে পরেন।

গ্রামে পৌঁছাতে ওদের রাত আটটার বেশি বেজে যায়। পথিমধ্যে তাহমিদ রাতের জন্য খাবার কিনে। কারন ও জানে, সেখানে রাতে রান্না করার মত কোন পরিস্থিতি থাকবেনা। তাছাড়া ড্রাইভার আংকেল যাচ্ছেন, ওরা নিজেরা না খেয়ে থাকলেও, আংকেলকে না খাইয়ে রাখা তাদের পরিবারের জন্য সম্মানজনক হবেনা।

কুহুর বাড়ির গেইটের সামনে এসে গাড়ি থামায় ড্রাইভার। কয়েকবার বেশ জোরে হর্ন বাজায়।
শিউলি তখন একটা রুমে মেয়ের সাথে ফুসুরফাসুর করছিল।
” তরে কইলাম, এখনই বাপের কাছে পোলাডার কথা কইসনা। আগে ঐ কুহু হা’রা’ম’জা’দি’র একটা ব্যবস্থা করি। হেরে বাড়ি থাইকা চিরদিনের মত তাড়াই, সব নিজের হাতের মুঠায় লই, তারপর তুই নিজের কথা কইস। কিন্তু তুই আমার কথা না শুইনা, দিলি আমার পরিকল্পনার বারোডা বাজায়। ”
দৃষ্টি মায়ের কথা শুনেও না শোনার ভান ধরে। ওর আপাতত কারও কোন কথা শোনার ইচ্ছে নেইে। ওর মাথায় এখন শুধু চেয়ারম্যানের ছেলে সবুজ ঘুরছে।
এমতাবস্থায় গাড়ির হর্নের আওয়াজ শুনে মা-মেয়ে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।
” এখন কে আসল, আম্মু! আমাদের গেইটের সামনেই তো হর্ন বাজছে, মনে হচ্ছে। ”
” আমিও তো বুঝতাছিনা কে আইল। চল তো গিয়া দেখি। ”
শিউলি আক্তার গেইট খুলেই থমকে গেছে৷ ও স্বপ্নেও ভাবেনি, এখন ওর ননদকে মোটেও আশা করেনি। আবার সাথে কুহু আর তাহমিদও আছে!
” আপা, আপ্নে এত রাইতে! আসেন ভিতরে আসেন। ”
” কেমন আছিস তোরা? কায়েস কই? দোকান থেকে আসেনি? এতক্ষণ তো দোকান থেকে চলে আসার কথা। ”
আফরোজা নাজনীনের কথা শুনে শিউলির বুক শুকিয়ে আসছে। এখন কি জবাব দিবে সে!
” কি রে, কথা বলছিসনা কেন! কায়েস কই? ”
” আপা, হেয় অসুস্থ। তাই দোকানে যায়নি। ঘরে শুইয়া রইছে। ” ভয়ে ভয়ে জবাব দেয় শিউলি।
” কি বলছিস! কি হয়েছে ওর! ” বলেই আফরোজা নাজনীন দৌড়ে যায় ভাইয়ের রুমে৷
আসলে কুহুই তাকে বলতে নিষেধ করেছিল, শিউলির কাছে যাতে সত্য না বলে। পরে দেখা গেল শিউলি শিহাবকে মা’র’ধ’র করল।
তাই আফরোজা নাজনীনও শিউলিকে ধরা দেননি।

কায়েস বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে, ব্য’থা’য় কা’ত’রা’চ্ছে। আফরোজা নাজনীন হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে, ভাইয়ের অবস্থা দেখে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে। কুহুও বাবার মাথার পাশে বসে কাঁদছে। ওর বাবার শরীর শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে, মুখটা শুকনো।
” বাবা, ও বাবা, কি হয়েছে তোমার? তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে? ” কুহু কান্নার মাঝেই বাবাকে প্রশ্ন করে।
” আমাকে মাফ করে দিস, মা। তোর প্রতি আমি অনেক অন্যায় করেছি। ” বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বলে কায়েস। ব্য’থা’র কারনে তার কথা বলতে ক’ষ্ট হচ্ছে।
” ও বাবা, তুমি কেন আমার কাছে ক্ষমা চাইছ। তুমি তো আমার বাবা। বাবাদের মুখ কখনোই সন্তানের কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য নয়। ঐ মুখ শুধু দোয়া করার জন্য। ”
কুহুর কথা তাহমিদের বুকে লা’গে। মেয়েটা কত সহজেই, কঠিন কথাটা বলল।
” শিউলি, আমার ভাইয়ের এমন অবস্থা, অথচ তুই একটিবারও আমাকে বলার প্রয়োজনবোধ করিসনি? আমি কাল সকালেও তোর সাথে কথা বলেছি, তুই তখনও আমাকে কিছু বলিসনি! এত লুকোচুরি কিসের তোর? কালকের আগেরদিনও তোর সাথে কথা হয়েছে, কায়েসের ফোনেই। কুই বললি, ও ফোন ভুল করে রেখে গাজীপুর গেছে। তুই মিথ্যা বললি কেন আমার কাছে? জবাব দে, চুপ করে থাকিসনা। আর ওকে ডাক্তার দেখিয়েছিস? ” আফরোজা নাজনীন রা’গে দিশেহারা হয়ে গেছেন।
” নগেন ডাক্তারকে দেখাইতাছি। হেয় ওষুধ দিছে। ”
” কায়েসের বোনেরা ঢাকায়ই থাকে। তুই তাদের সাথে আলোচনা না করে, তাদেরকে না জানিয়ে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিস! নিজেকে খুব বড় মনে করিস তুই? তোর মাথায় কি একবারও আসেনি, আমরা আমাদের ভাইয়ের এমন অবস্থা দেখে তোকে কি করতে পারি? তুই বে’য়া’দ’ব এটা জানতাম, কিন্তু এতবড় দ্বায়িত্বজ্ঞানহীন তা জানতামনা৷ আরে নিজের স্বামীর ওপর সব মেয়েরই ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, মায়া সবই থাকে। কিন্তু তোর কি এসবের কিছুই নেই! ” আজ আফরোজা নাজনীনের মুখে কিছুই আটকাচ্ছেনা।
” বড়মা, এত হাইপার হয়োনা। শান্ত হও, প্লিজ৷ তুমি দেখ মামার কিচ্ছু হবেনা। আমরা আছিতো। ” তাহমিদ বড়মাকে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছে।
” ও বাপ, তুই একটু দেখনা, আমার ভাইটার কি হয়েছে। তুই তো ডাক্তারি পড়ছিস, একটু হলেও তো বুঝবি, বল? এরা গ্রাম্য ডাক্তারের কাছে আমার ভাইকে চিকিৎসা করাচ্ছে। নগেন ডাক্তার চিকিৎসার কি জানে! ”
” আমি দেখছি, বড়মা। তার আগে তুমি একটু শান্ত হও। ”
তাহমিদ ধীরে ধীরে সময় নিয়ে কায়েসকে পর্যবেক্ষন করলো।
” কি হয়েছে, বাপ? কিছু বুঝলি? বড়মাকে, বল কি হয়েছে? ”
” আন্টি, আমাকে মামার ঔষধগুলো দেখাবেন? ” বড়মার কথার উত্তর না দিয়ে, তাহমিদ শিউলির সাথে কথা বলে।
শিউলি ঔষধের বাক্স এনে দেয় তাহমিদের কাছে। তাহমিদ বাক্সটা নিয়ে বারান্দায় আসে৷ আফরোজা নাজনীনও ওর পিছু পিছু আসে। সেই সাথে কুহু আর শিউলিও আসে।
” বড়মা, মামার বুকের হাড় ভেঙেছে। তবে বোঝা যাচ্ছেনা কয়টা ভে’ঙে’ছে। মেডিকেলে নিতে হবে। তা নাহলে ই’ন’ফে’ক’শ’নে’র ভয় আছে। আর এই ঔষধগুলোও উনার জন্য ভুল। ”
তাহমিদের কথা শুনে এবার ভয় পায় শিউলি। ও ভেবেছিল বুকে হয়তো জোরে আ’ঘা’ত লেগেছে, তাই কায়েস বিছানা থেকে উঠতে পারছেনা৷ ও ভাবতেও পারেনি এমন কিছু ঘটতে পারে। মানুষটার যদি কিছু হয়ে যায়! ভাবতেই শিউলির বুক ফে’টে যাচ্ছে। ও মেয়ের সাথ দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু এখন স্বামীকে হারিয়ে ও মেয়ের চাওয়া পূরণ করতে পারবেনা।
” বাবা তাহমিদ, তুমি মানুষটারে ঠিক কইরা দেও।
যা যা করন লাগে, তুমি কর৷ ”
আফরোজা নাজনীন তাহমিদের কথা শোনার পর থেকে শুধু কেঁদেই যাচ্ছেন। এ পর্যায়ে তিনি মুখ খোলেন।
” বাপ, আমি ওকে ঢাকায় নিয়ে যাব। তুই ব্যবস্থা কর। আজ রাতেই যেতে চাই। ”
” এ্যাম্বুলেন্স লাগবে, বড়মা। আমি দেখছি, এদিকে কোন এ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায় কিনা। ”

তাহমিদ অনেক চেষ্টা করেও এই এলাকার কোন এ্যাম্বুলেন্স পায়না। বাধ্য হয়ে ঢাকায় ফোন করেছে৷ রাতেই একটা এ্যাম্বুলেন্স ফুলতলার পথে রওনা দিবে।
তাহমিদ ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে বাজারে এসে দুইটা ঔষধ নেয় কায়েসের জন্য। আজ রাতের জন্য এই দুইটা ঔষধ কায়েসকে একটু নিরাপদ রাখবে৷

কুহু শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। শিহাব ফুপুর পাশে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। তাহমিদ ঔষধ এনে কায়েসকে খাইয়ে দিয়েছে।
কিছুক্ষণ পর আফরোজা নাজনীন উঠে, ড্রাইভারকে খেতে দেন। তিনি তাহমিদের আনা খাবারগুলোই খেতে দেন। এরপর তিনি তাহমিদ আর শিহাবকে খেতে দেন। সবশেষে তিনি আর কুহু খেয়ে কায়েসের পাশে এসে বসেন। তিনি ভুলে একবারের জন্যও শিউলি আর তার মেয়েকে খেতে ডাকেননি।

তাহমিদকে দক্ষিণের ঘরে থাকতে দেয়া হয়েছে। ওর পাশের রুমে ড্রাইভার শুয়েছে। তাহমিদের চোখে ঘুম নেই। ওর বারবার কুহুর কান্নারত মুখ চোখে ভাসছে।

শিউলি ব্যাগ গোছাচ্ছে। কায়েসের কাপড়চোপড় সহ প্রয়োজনিয় জিনিসপত্র ব্যাগে তুলে দিয়েছে। এরপর ওর নিজের কাপড়চোপড়ের ব্যাগ গোছাতে গেলেই বাঁধা দেন আফরোজা নাজনীন।
” তুই আমাদের সাথে যাচ্ছিসনা। আমার ভাইকে আমিই নিয়ে যেতে পারব। তার চিকিৎসাও আমিই করাব। এরমধ্যে তোকে কোন প্রয়োজন নেই। ”
” এসব কি কন, আপা! আমার স্বামী আর আমিই যামুনা? ”
” না ছোটমা, তুমি যাবেনা। বাবার জন্য আমি আছি। আমি আমার টাকায় বাবার চিকিৎসা করাব। দাদু আমাকে যা দিয়ে গেছেন, তা দিয়ে বাবার চিকিৎসা করতে অসুবিধা হবেনা। ”
” কুহু, বেশি কথা কইবিনা কইলাম। তুই কথা কওনের কে? ”
” এতদিন চুপ ছিলাম জন্যই তুমি এতটা বেড়েছ৷ আমি বাবার মেয়ে। তার বিষয়ে যেকোনো কথা বলার অধিকার আমার আছে। আজ তোমার জন্যই বাবার এই অবস্থা ভুলে যেওনা। এতদিন বাবাকে হারানোর ভয়ে চুপ থেকেছি। কিন্তু আজ যখন আমি চুপ থেকেও বাবার এমন অবস্থা হল, তখন তুমি কি করে আশা কর আমি আরও চুপ থাকব? তুমি আমার কোমল মন দেখেছ, কিন্তু প্রয়োজনে যে আমি কঠিন হতে পারি, এখন থেকে সেইটা দেখবে। আমার একটাই কথা তুমি যাবেনা। ” কুহুর কথা শুনে শিউলি তব্দা খেয়ে যায়।
ননদ আর সতীনের মেয়ের বিরোধিতায় শিউলির কাপড় গোছানো হয়না। সারারাত আফরোজা, শিউলি আর কুহু মিলে কায়েসের কাছে বসে থাকে। দৃষ্টি দশটার আগেই নিজের ঘরে গিয়ে দরজা দিয়েছে। ও মাঝরাত পর্যন্ত সবুজের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত থাকে৷ একটাবারও বাবার খোঁজ নেয়ার প্রয়োজনবোধ করেনা।

ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনিতে ঘুম ভাঙ্গে কুহুর। চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছে, বুঝতে পারেনি৷ আড়মোড়া ভেঙে উঠে অজু করে নামাজ আদায় করে। এরপর সোজা চলে যায় রান্নাঘরে।

সকাল ছয়টায় ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো তাহমিদের। এ্যাস্বুলেন্সের চালক ফোন দিয়েছে। তাহমিদ ফোন রিসিভ করতেই সে জানায়, ফুলতলা পৌঁছেছে। তাহমিদ লোকেশন জানিয়ে দিয়ে বাইরে আসে৷
আফরোজা নাজনীন উঠানে দাঁড়িয়ে কিছু একটা করছিলেন।
” বড়মা, এ্যাম্বুলেন্স এসে গেছে। মামাকে তৈরি করে, নিজেরাও তৈরি হও। ”
” তুই ফ্রেশ হয়ে নে, বাপ। গোছানো শেষ। ড্রাইভারকে খেতে দিয়েছি। ফ্রেশ হয়ে তুইও খেয়ে নে। এ্যাম্বুলেন্স আসলে সেই ড্রাইভারকেও খাইয়েই তবে বের হব। ”
” এত সকালে খাবনা বড়মা। তুমি বরং আর সবাইকে খেতে দিও। ”
” কুহু সেই ফজরের নামাজ আদায় করে রান্না করেছে৷ মেয়েটা এত কষ্ট করে রান্না করেছে, আর তুই বলছিস না খেয়েই চলে যাবি! ঢাকা পৌঁছাতে দেরি হবে, এতক্ষণ না খেয়ে থাকবি? ”
তাহমিদ কিছু না বলে ফ্রেশ হতে যায়।

টেবিলে গরম ভাত, বেগুন ভাজা, কৈ মাছ ভাজা, আর ধোঁয়া ওঠা মুরগীর মাংসের ঝোল দেখেই এই সাত সকালে তাহমিদের পেটে ক্ষুধা মোচড় দেয়। অথচ সে একটু আগেই বলেছে খাবেনা। কিন্তু যেই শুনেছে, কুহু রান্না করেছে, তখন আর না করেনি৷
তৃপ্তি সহকারে খেয়ে উঠে তাহমিদ। মনে মনে বলে, বউ আমার দারুণ গুণবতী!

গতরাতে তাহমিদের আনা ঔষধ খেয়ে ব্যথা অনেকটাই কমেছে কায়েসের। ওরা দুই-তিনজন মিলে ধরাধরি করে তাকে এ্যাম্বুলেন্সে তোলে৷ শিউলিকে রেখেই এ্যাম্বুলেন্সে উঠে কুহু, আফরোজা আর তাহমিদ। ওদের বাড়ির গাড়িতে ব্যাগপত্র পাঠিয়ে দেয়। তাহমিদ রাতেই মেডিকেলে ফোন দিয়ে কেবিন রেডি করতে বলেছে। ওরা পৌঁছানো মাত্রই ভর্তি করানো হবে৷ তাহমিদ ওর স্যারদের সাথে কথা বলেছে।
কুহু বারবার আল্লাহকে ডাকছে।
আফরোজা নাজনীন বোনদের ফোন করতে ব্যস্ত।

চলবে…

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here