বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ২৩

0
2288

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_২৩
জাওয়াদ জামী

” কি রে নবাবজাদী, না’গ’র জুটাইতে গিয়া না’গ’রে’র মায়েরে পটাইছস দেখতাছি! যেই দেখলি হেই পোলা ফিইরাও তাকাইতাছেনা, ওমনি পোলার মায়েরে হাত করলি! যেই পোলা তরে বিয়া করতে মানা করছে, তার বাড়িতে আইতে তর ল’জ্জা করলনা? কি নি’র্ল’জ্জ মাইয়া তুই! ফুপুরা কইল, আর তুই নাচতে নাচতে ঢাকা আইলি। আমার কাছে থাইকা ন’ষ্টা’মি করবার পারতাছিলিনা তাই দূরে আইছস। যাতে ভালোভাবে ন’ষ্টা’মি করবার পারস? হা’রা’ম’জা’দি এত শখ না’গ’রে’র লগে ঢ’লা’ঢ’লি করার? ” কুহুর চুলের মু’ঠি ধরে ঝাঁ’কি’য়ে দেয় শিউলি আক্তার। কুহুর মনে হলো মাথাটা বুঝি ছিঁড়ে নিল ছোটমা।
” ছোটমা, আমি আন্টিকে বলেছিলাম, হোস্টেলে গিয়ে আমার কাপড়চোপড় নিয়ে আসব। কিন্তু তিনি আমার কথা শোনেননি। আমি অনেকবার তাকে বলেছি, তবুও তিনি আমাকে হোস্টেলে যেতে দেননি।” কুহু মাথা ধরে হেঁচকি তুলে কাঁদছে।
” তুই এই বাড়িতে আইলি ক্যা? ফুপুর উপ্রে দরদ উথলায় পরতাছে? তুই আইয়া ফুপুরে সুস্থ করছস? নাকি নাগরের মন পাওয়ার জন্য আইছস? ” কুহুর গাল চেপে ধরে বলে শিউলি। কুহু অনেক কষ্টে শিউলির হাত ছাড়ায়৷
” বিশ্বাস কর ছোটমা, বড় ফুপকে ঐ অবস্থায় দেখে আমি হোস্টেলে ফিরে যেতে পারিনি৷ সেখানে গেলেও আমি থাকতে পারতামনা। আমি কালকেই হোস্টেলে ফিরে যাব। ”
” কাইল সুপ্তির শ্বশুর বাড়ি থাইকা আইসা তুই সোজা হোস্টেলে যাবি। আমার কথা যেন মাথায় থাকে। ”
” মনে থাকবে ছোটমা। “। শিউলি আক্তার আবারও কুহুকে মা’র’তে যাচ্ছিল কিন্তু তাহমিদকে বারান্দায় আসতে দেখে থেমে যায়।
তাহমিদ কাউকে কিছু খুঁজছিল। কিন্তু সেখানে না পেয়ে ফিরে যায়। দুজনের কারও সাথে কথা বলেনা। কিন্তু ওরা কেউ জানতে পারলনা তাহমিদ শিউলি আর কুহুর কথপোকথন পুরোটাই শুনেছে। সে যখন বুঝতে পারল শিউলি আবার কুহুকে মা’র’বে তখন কাউকে খোঁজার অযুহাতে বারান্দায় এসেছিল।
কুহুকে আরেকবার মা’র’তে না পেরে শিউলি তড়পাচ্ছিল। কুহু এ বাড়িতে আসায় তার রা’গ নেই। তার রা’গ মুলত দৃষ্টিকে মাথায় না তুলে সবাই কেন কুহুকে মাথায় তুলে রাখছে। তাই সে ছুঁতো খুঁজছে কিভাবে কুহুকে অ’ত্যা’চা’র করা যায়।
এদিকে তাহমিদ নিজের রুমে এসে ছটফট করছে। সে ইচ্ছে করলেই শিউলি আক্তারকে দু-চারটা কথা শুনিয়ে দিতে পারত। কিন্তু সেই কথার আঁচ এসে পরবে কুহুর কাছে। নিজের গ্রামে ওকে যেতেই হবে। তখন শিউলি আক্তার কুহুকে সেসব নিয়ে আবার অ’ত্যা’চা’র করবে। নানান কিছু ভেবে তাহমিদ শিউলিকে কিছু না বলে বারান্দা থেকে ফিরে আসে।
ওর বুকের ভিতর রা’গ ক্রমাগত হা’তু’ড়ি পে’টা’চ্ছে। একটা মানুষ এতটা নীচ কিভাবে হতে পারে! এত বাজেভাবে যে কেউ কথা বলতে পারে, তা আজ শিউলিকে না দেখলে বিশ্বাস করতনা। নাহোক কুহু তার নিজের মেয়ে, কিন্তু ও তো তার মেয়েরই মতন। তার সন্তানদের আর কুহুর মাঝে তো র’ক্তে’র সম্পর্ক। এতটা নি’কৃ’ষ্ট মানুষ কিভাবে হয়! নিজেকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছেনা তাহমিদ। একদিন দিদুনের কাছে কুহুর জীবনের গল্প শুনেছিল, আজ তার কিয়দংশ স্বচক্ষে দেখল। আজ তার আফসোস হচ্ছে সেদিনের সেই ভুলের জন্য। সেদিন সে রাজি থাকলে আজ কুহু এখানে সসম্মানে থাকত৷ ভালো থাকত। এত অ’প’বা’দ সইতে হতনা। তাহমিদ ভাবতে থাকে কিভাবে আবার কুহুকে বিয়ের কথা বড়মার কাছে উপস্থাপন করবে।

কুহু সিক্তার রুমে ঘাপটি মেরে বসে আছে। ওর বাইরে যাওয়ার মন-মানসিকতা এখন নেই। কাল সুপ্তি আপুর রিসিপশন পার্টি থেকে এসেই সোজা হোস্টেলে ফিরে যাবে। আর দ্বিতীয়বার এ বাড়ির ছায়া সে মাড়াবেনা। একবার ভাবল বাবার কাছে বিচার দিবে। কিন্তু পরক্ষণেই গত কয়েকমাসের বাবার আচরণ পর্যবেক্ষন করে সিদ্ধান্ত পাল্টায়। বাবা যেন হুট করেই পাল্টে গেছে। আগে নিয়ম করে প্রতিদিন তিনবার ফোন করত। এখন দিনে একবার ফোন করে। আবার কোনদিন তা-ও করেনা। অনেকসময় দেখা যায় কুহু ফোন দিলে তার সাথে কথা হয়, তাছাড়া নয়। বাবা হুট করে কেন পাল্টে গেল, তার কোন উত্তর খুঁজে পায়না কুহু। এবাবে কতদিন অন্যের আশ্রয়ে কাটবে আর ছোটমার পেষনে নি’ষ্পে’ষি’ত হবে?

বিকেল থেকেই আফরোজা নাজনীন কিছুটা সুস্থ বোধ করতে থাকেন। এরমাঝে কয়েকবার সুপ্তির সাথে কথা বলেছেন। তিনি মেয়েকে জানতে দেননি তার অসুস্থতার কথা। কিন্তু সুপ্তি ঠিকই বুঝে নেয়। সে-ও মায়ের জন্য কান্নাকাটি শুরু করেছে। সানাউল রাশেদিন পরেছেন বিপদে। তিনি না পারছেন মেয়ের কান্না থামাতে, না পারছেন স্ত্রীকে শান্ত করতে। দুই মা-মেয়ের মাঝখানে পরে তিনি মেয়ের জন্য নিজের কষ্ট প্রকাশ করতে পারছেননা।

তাহমিদ দিদুনকে বলে, কুহুকে তার কাছে ডেকে নিতে। দিদুন তাহমিদের মুখ দেখেই বুঝে যান কিছু একটা ঘটেছে। তিনি তাহমিদকে কোন প্রশ্ন না করে রোজিকে দিয়ে কুহুকে ডাকতে পাঠান। কুহু দিদুনে ডাকছে শুনেই দেরি না করে দিদুনের রুমে আসে।
” আমি ভেবেছিলাম কুহু বোধহয় আমাকে ভুলেই গেছে। সেই সকালের পর থেকে তোমার কোন সাড়াশব্দ নেই। ” দিদুন আফসোস নিয়ে বলেন।
” আমি সিক্তার রুমে শুয়েছিলাম দিদুন। মাথা ব্যথা করছে তাই নিচে আসিনি। তুমি রাগ করোনা। ” কুহু ম্লান হেসে জবাব দেয়।
” আমার পাশে এসে বস। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, দেখ মাথা ব্যথা কোথায় পালাবে, তুমি বুঝতেই পারবেনা। ”
কুহুর চুলের গোড়ায় খুব ব্যথা করছে। দিদুন হাত দিলে যদি আরও ব্যথা পায়, তাই সে সাহস পায়না।
” তোমার কষ্ট করতে হবেনা দিদুন। ব্যথা এমনিতেই সেরে যাবে। তুমি বরং আমাকে দাদুর গল্প শোনাও। আমি শুয়ে শুয়ে শুনি। ” দিদুনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বিছানার একপাশে শুয়ে পরে।

সন্ধ্যার পর রোজি কুহুকে টেনে ছাদে নিয়ে আসে। এ বাসায় আসা অবধি কুহু এখনও ছাদে আসেনি। ছাদে পা দিয়েই থমকে দাঁড়ায় কুহু। তার লাগানো হাসনাহেনা গাছটা অনেক বড় হয়েছে। সেই সাথে পরিবর্তন করা হয়েছে টব। টবের জায়গায় একটা হাফ ড্রাম শোভা পাচ্ছে সেখানে। ফুলের ভারে হেলে পড়েছে গাছটি। কুহু কৌতুহলী হয়ে এগিয়ে আসে গাছের দিকে। ছুঁয়ে দেয় ফুলগুলো।
” রোজি, হঠাৎ টব পরিবর্তন করেছ কেন? নিয়মিত যে যত্ন নাও তা বোঝাই যাচ্ছে। তোমাকে এত্ত এত্ত ধন্যবাদ। ” দুহাত প্রসারিত করে রোজিকে ধন্যবাদ জানায় কুহু।
” আপু, আমিতো টব পরিবর্তন করিনি। তাহমিদ ভাইয়া করেছে। ভাইয়াই নিয়মিত গাছের পরিচর্যা করে। আগে তো ভাইয়া ছাদে আসতনা, কিন্তু এখন প্রতিদিনই একবার করে ছাদে এসে গাছে পানি দেয়া তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আর এই হাসনাহেনা গাছটার যত্নের কোন ত্রুটি হতে দেয়না ভাইয়া। ”
রোজির কথা শুনে আরেকবার হোঁচট খায় কুহু।
” ভাইয়া জানে যে গাছটা আমি লাগিয়েছি? ” ইতস্তত করে জানতে চায় কুহু।
” জানেতো, সেই প্রথম দিনই আমি ভাইয়াকে জানিয়েছিলাম। ” উচ্ছ্বসিত হয়ে জবাব দেয় রোজি।
রোজির কথা শুনে কুহু বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। ওর মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, তাহমিদ ভাইয়া কেন ওর কেনা গাছের এত যত্ন নিচ্ছে!
একটু পর রোজি কাজের জন্য নিচে চলে যায়। কুহু ছাদেই থেকে যায়। রেলিং ধরে দাঁড়ায়। দখিনের পবনের সুশীতল স্পর্শে কুহুর শরীর জুড়িয়ে যায়। পবনের দোলায় নব কিশোলয়ের দল তিরতির করে কাঁপছে। মুগ্ধ নয়নে কুহু কিশোলয়ের কাঁপন দেখছে। সেই সাথে কাঁপছে ওর আঁখিপল্লব। ধরনী যেন পবনের দোলায় দুলছে। কুহু চোখ বুঁদে অনুভব করছে পবনের নিবিড় ছোঁয়া। যে ছোঁয়ায় মুছে যায় সকল ক্লেশ।
হঠাৎই পেছনে খুটখাট আওয়াজ শুনে চমকে তাকায় কুহু। রোজি চলে যাওয়ার পর ও ছাদের লাইট অফ করে দিয়েছিল। পুরো ছাদ অন্ধকারে ডুবে আছে। শুধু কিছুটা আন্দাজ করতে পারছিল, কেউ এসেছে। কিন্তু কে!
” ও মা গো। ” বলে চিৎকার করে কুহু। বুকে ফুঁ দেয়।
ছাদের সেই আগন্তুকও কুহুর চিৎকারে কিছুটা দিগভ্রান্ত হয়ে এদিক ওদিক চায়। সামনে রেলিঙের ধার ঘেষে দাঁড়ানো কাউকে আবিষ্কার করে। অন্ধকারে কে দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে না পারলেও, গলার স্বরে বুঝে নেয়।
” ভয় পেওনা। আমি তাহমিদ। ” কথা বলেই পেছনে যেয়ে ঝটপট সুইচ অন করে
সুইচ অন করতেই, ঝলমলে আলোয় উদ্ভাসিত হয় চারপাশ। তাহমিদ দেখল তার সামনে এক শ্যামাঙ্গীনি দাঁড়িয়ে। কোমড় ছাড়ানো চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। তার শ্যামাঙ্গীনির চোখমুখ বিষন্নতার চাদরে ঢাকা। ভয় সে ভালোমতোই পেয়েছে তা বেশ বুঝতে পারছে তাহমিদ।
” অন্ধকারে এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন? ” কুহু তাহমিদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।
” চলে যাচ্ছ যে? ” তাহমিদ জানে তার প্রশ্নের উত্তর সে পাবেনা। সকালে যা হয়েছে, এরপর কুহু ওর সাথে কথা বলবেনা তা ভালো করেই জানে। শিউলি আক্তার যখনতখন চলে আসতে পারে ভেবেই তাহমিদ আর কথা বাড়ায়না।
কুহুও নিচে নামে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here