বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ২২

0
1860

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_২২
জাওয়াদ জামী

কুহু ফুপুর রুমে খাবার নিয়ে আসে। আফরোজা নাজনীন অসার হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। গত কয়েকদিনের পরিশ্রম এবং নিয়মিত খাবার না খাওয়ায় তিনি এমনিতেই দুর্বল ছিলেন। তারউপর মেয়ের বিদায়ের কষ্ট তিনি নিতে পারেননি। প্রেশার ফল করেছে ভয়ানকভাবে। ডক্টর এসে চেক-আপ করে ঔষধ লিখে দিয়েছে। তাহমিদ ঔষধ নিয়েও এসেছে।

কুহু ওর ফুপুর পাশে বসে তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তিনি খেতে চাইছেননা৷ কুহু বেশ জোরজবরদস্তি করে কয়েক লোকমা খাইয়ে, ঔষধ খাইয়ে দেয়। এরপর ফুপুর মাথার পাশে বসে চুলে বিলি কেটে দেয় যতক্ষণ না ফুপু ঘুমায় একসময় তিনি ঘুমিয়ে পরলে কুহু দিদুনের কাছে আসে। তাহমিদ ড্রয়িংরুমে বসে কুহুর দিদুনের রুমে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। যখন দেখল কুহু দিদুনের রুমে যেয়ে দরজা লক করে দিয়েছে তখন সে নিজের রুমে আসে। আনান তাহমিদের বিছানার একপাশে টানটান হয়ে শুয়ে আছে। ওর পাশে শিহাব বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। বাসায় আত্মীয় স্বজনরা থাকায় তাহমিদের রুমে কয়েকদিন থেকে শিহাব আর আনান থাকছে।
তাহমিদ ফ্রেশ হয়ে এসে ওর জন্য রাখা ফাঁকা জায়গায় শুয়ে পরে। সারাদিন অনেক পরিশ্রম করায়,শরীর ক্লান্ত হয়ে গেছে। বিছানায় পিঠ ঠেকানোর প্রায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পরে।

ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি কানে আসতেই ঘুম ভাঙ্গলো আয়েশা সালেহার। তিনি ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠে, ফ্রেশ হয়ে অজু করে এসে কুহুকে ডাকেন।
পাশাপাশি নামাজে দাঁড়িয়েছে দুইজন, যাদের প্রজন্মের মাঝে অনেক তফাত। যাদের বয়সের ফারাক বিস্তর। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্যে আসার জন্য বয়সের কোন বাঁধা নেই। তাইতো দুই বয়সের দুইজন নারী একমনে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে ব্যস্ত।
নামাজ শেষে আয়েশা সালেহা তসবিহ পাঠ করছিলেন। কুহু জায়নামাজ গুছিয়ে রেখে বিছানায় উঠে। বাসায় অনেক লোকজন। তাই এখন ওর বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। শুধু ফুপু ঘুম থেকে উঠলে তার কাছে যাবে। তবে ঘুমের ঔষধের প্রভাবে উনি সম্ভবত দেরি করে উঠবেন।

তাহমিনা আক্তার ফজরের নামাজ আদায় করে রান্নাঘরে আসেন। নাজমা পারভিন, শাহনাজ সুলতানাও ততক্ষণে নামাজ আদায় করে রান্নাঘরে এসেছেন। তারা হাতে হাত মিলিয়ে নাস্তা বানাতে শুরু করেন। অনেকক্ষণ পর শিউলি আক্তার এসে তাদের সাথে যোগ দেয়।
আফরোজা নাজনীনের ছোট জা আসেন এরপর। তারা কয়েকজন মিলে সকলের খাবার তৈরি করেন।
একে একে সবাই আসতে শুরু করেছে ডাইনিং রুমে।
একসময় কুহু ধীর পায়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করে। তাহমিনা আক্তার কুহুকে দেখেই বিগলিত গলায় কাছে ডাকেন। কুহু উনার কাছে গেলে, তিনি কুহুকে তার পাশে একটা টুলে বসান। তিনি প্লেটে দুইটা পরোটা, ডিম ভাজি এবং একটু মাংসের তরকারি নিয়ে কুহুর পাশে বসেন। পরোটার এককোণা ছিঁড়ে সাথে মাংস নিয়ে কুহুর মুখের সামনে ধরেন। তাহমিনা আক্তারের এহেন কাজে চমকিত কুহু সহসাই মুখ খুলতে পারেনা। আবেগে আপ্লুত হয়ে গেছে সে। নাজমা পারভিন এবং শাহনাজ সুলতানার চোখে পানি আসে। তার ছাড়াও কুহুকে ভালোবাসার কেউ আছে দেখলে আনন্দের অশ্রু বয় তাদের চোখ বেয়ে৷
শিউলি আক্তার চোখের সামনে এসব সহ্য করতে না পেরে ড্রইংরুমে আসে। রা’গে ফুঁ’স’ছে সে। দাঁত কিড়মিড়িয়ে ওঠে তার।
” কিমুন বেহায়া মাইয়া দেখছ! যারে ঐ বেডির পোলায় অপমান করল, এহন তার হাতেই খাবার খাইতাছে! ছি ছি ছি। আমার মাইয়াডা যে না খাইয়া রইছে সেদিকে কারও নজর নাই৷ খালি সকলে ঐ অ’প’য়া’রে নিয়া নাচে। ” আপনমনে গজগজ করছে শিউলি।

” এই যে মেয়ে, এভাবে মুখ বন্ধ রাখলে হবে? খেতে হবেনা? আমি কখন থেকে তোর মুখের সামনে খাবার ধরে আছি, কিন্তু তোর মুখ খোলারই নাম নেই! নাকি আমার হাতে খেতে চাসনা? ”
তাহমিনা আক্তারের কথা শুনে ঝটপট মুখ খোলে কুহু। পরোটা মুখে নিয়ে চিবাতে থাকে।
” তুমি আমাকে খাওয়াচ্ছো আর আমি মুখ খুলবনা এটা কেমন করে হয় আন্টি! ”
” কোন কথা নয়। চুপচাপ খেয়ে নে। খাওয়া হলে তোর দিদুনকে গিয়ে খাওয়াবি। তাকে কষ্ট করে বাইরে আসতে হবেনা। কি রে পারবি তো? ”
” খুব পারব। কিন্তু আমাকে যে সবার আগে খাওয়াচ্ছো এটা কি ঠিক হলো? ”
” এত বেশি ভাবতে হবেনা তোকে। তুই শুধু খেয়ে নে। ”
নাজমা পারভিন এবং শাহনাজ সুলতানা দুই বোন একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছেন। তারা কোন কিছু আঁচ করতে পেরেছেন। বিষয়টা তেমন হলে মন্দ হয়না। দুই বোন মুচকি মুচকি হাসছে।

কুহু ফুপুর রুমে এসে দেখল তিনি এখনও ঘুমাচ্ছেন। তাই সোজা চলে আসে সিক্তার রুমে। সেখানে সিক্তা, তনয়া, আরোশি, দৃষ্টি, সিক্তার চোট চাচার মেয়ে, আরও দুইজন মেয়ে বিছানা, মেঝে মিলে এলোমেলো হয়ে ঘুমাচ্ছে। ওদের অবস্থা দেখে কুহুর হাসি পায়। ভেতরে এসে ডাক দেয় সবাইকে। কিন্তু কেউই ওর ডাক শোনেনা। সবাই ঘুমে বিভোর। কপাল চাপড়ে ফিরে আসে দিদুনের কাছে।
” কুহুমনি, বান্ধবীদের ছেড়ে এই বুড়ির কাছে আবার আসছ। এসো বস, গল্প করি দুজনে। ”
কুহু দিদুনের পাশে বসে।
” বুঝলে কুহুমনি, বাসায় এই যে অনুষ্ঠান হচ্ছে। তোমার দাদু বেঁচে থাকলে খুব খুশি হত। তিনি সুপ্তিকে খুব আদর করতেন। নাতি-নাতনীদের মধ্যে তিনি তাহমিদ আর সুপ্তিকে বেশি ভালোবাসতেন। তাহমিদ তার প্রান ছিল। মেজো বউমা তাহমিদের জন্মের পর অসুস্থ হয়ে যায়, তখন বড় বউমা ওর দ্বায়িত্ব নেয়। এরপর সুপ্তির জন্ম হল। বিশাল এই সংসারের দ্বায়িত্ব আমাকে একা সামলাতে হত। বড় বউমা দুই ছেলে-মেয়েকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। তখন তোমার দাদু বড় বউমার চাপ কমাতে তাহমিদ, সুপ্তিকে নিয়ে সময় কাটায়। ওদের এক দোলনায় শুইয়ে দিয়ে তোমার দাদু ওদের পাহারা দেয়। তবে রীতি, দূত্যি, তাওহীদকে যে ভালোবাসতোনা এমনটা নয়। ওরা তার কলিজা ছিল। কিন্তু এই দুটোর সাথে বেশি সময় কাটানোর দরুন এদের প্রতি বেশি মায়া জন্মে যায়। ধীরে ধীরে ওরা বড় হতে থাকে, আর সেই সাথে ওরা দাদুর ন্যাওটা হয়ে যায়। উঠতে, বসতে দাদু দাদু করতে থাকে।
তারপর একদিন উনি সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন। তখন ওদের বয়স পনের বছর। তাহমিদ দাদুর শোকে অসুস্থ হয়ে যায়। টানা সাতদিন ওকে স্যালাইন দিয়ে রাখতে হয়। সুপ্তি না খেয়ে থাকে কয়েকদিন। কিভাবে যে ওদের স্বাভাবিক করতে হয়েছে, সেসব মনে হলে কষ্ট লাগে৷ আজ সেই সুপ্তি অন্যের ঘর আলো করছে। ” বৃদ্ধা অতীত রোমন্থন করতে করতে যেন সেই অতীতেই চলে গেছেন। সেই সোনালী অতীত কভু ভুলবার নয়।
” দাদু বুঝি খুব ভালো মানুষ ছিল, দিদুন? তোমাকে খুব ভালোবাসত? ”
” তার মত মানুষ আমি আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। তবে মাঝেমধ্যে তাহমিদের মাঝে তার ছায়া দেখতে পাই। তার প্রেমিক স্বত্বা, তার ব্যক্তিত্ব, তার কোমল মন সবকিছুই আমি তাহমিদের মাঝে দেখতে পাই। সেকারণেই বোধহয় আমি তাহমিদকে এত ভালোবাসি। ”
কুহু চুপচাপ দিদুনের কথা শুনছে। যেখানে তাহমিদকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সেখানে কুহু কথা বলতে নারাজ। বৃদ্ধা একমনে বলেই চলেছে,
” ভালোকথা, কুহুমনি আমার দাদুভাই তোমার কাছে মাফ চেয়েছে? সেদিনের পর থেকে ও কিন্তু খুব কষ্ট পাচ্ছে। তুমি ক্ষমা না করলে ওর শান্তি নেই। ভুলতো মানুষই করে। কিন্তু পরে যখন সেই মানুষ অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চায়, তখন তাকে ক্ষমা করা মনুষ্যত্বের পরিচয় বহন করে । কেউ ভুল করে, সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইলে, তাকে সুযোগ দিতে হয়। ভুল এবং ক্ষমা একই মুদ্রার দুই দিকে অবস্থান করে। তাকে একটা সুযোগ দাও কুহুমনি। এরপর সে যদি কোন অন্যায় করে তবে কেউ তোমাকে আর ক্ষমা করতে বলবেনা। ” বৃদ্ধার গলায় আকুলতা লুকানো থাকেনা।
” দিদুন, তিনি কোন অন্যায় করেননি। তিনি আমাকে যা যা বলেছিলেন, তার থেকেও কঠিন কথা ছোটমা আমাকে প্রতিনিয়ত বলে। আমি ছোটমার ওপরও যেমন রা’গ করে থাকিনা, তেমনি উনার ওপরও আমার কোন রা’গ নেই। আমার শুধু কষ্ট হয়। বারবার মনে হয়, মা বেঁচে থাকলে এমনভাবে আমাকে কেউ বলতে পারতনা। মা বেঁচে থাকলে আমাকে এমনভাবে ভেসে বেড়াতে হতনা। আর তখন তাহমিদ ভাইয়া আমাকে সেই কথাগুলো বলার সুযোগও পেতনা। আমার সব রাগ নিজের ওপর, দিদুন। ” কুহু সব সময়ই মন খুলে যেভাবে দিদুনের সাথে কথা বলে, সেভাবে আর কারও সাথে বলতে পারেনা। তেমনই আজও সে মন খুলে দিদুনের সাথে কথা বলছে। কিন্তু ওরা কেউই জানতে পারলনা তাহমিদ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ওর সব কথা শুনছে।

ড্রয়িংরুমে লোকজনের শোরগোলে টেকা দায়। কুহুর এখানে কোন কাজ নেই। ও দিদুনের সাথে গল্প করে ফিরে আসে ফুপুদের কাছে। বড় ফুপু ততক্ষণে ঘুম থেকে জেগে গেছেন। তাকে খাবার খাইয়ে ঔষধ দিয়েছেন তাহমিনা আক্তার। কুহু বড় ফুপুর রুমে এসে তাকে জানায়, হোস্টেলে যেতে হবে। কমিউনিটি সেন্টার থেকে সোজা এখানে আসায় কোন পোশাক নিয়ে আসতে পারেনি। রাতে সিক্তার পোশাক পরেছিল, এখনও সেই পোশাকেই আছে। পোশাক নিতে হোস্টেলে যেতে হবে। আফরোজা নাজনীন কিছু বলার আগেই তাহমিনা আক্তার কুহুকে না করে দেন। তিনি জানান, তিনি কুহুর পোশাকের ব্যবস্থা করবেন। কুহু আর দ্বিমত করেনা।
তাহমিনা আক্তার তার ছোট ছেলেকে সকলের অগোচরে শপিংয়ে পাঠান, কুহুর পোশাক কিনতে। তাহমিদ মনের মত কয়েকটা রেডিমেড থ্রিপিস কিনে এনে মায়ের কাছে দেয়। তাহমিনা আক্তার সেগুলো তুলে দেন কুহুর কাছে। কুহু প্রথমে নিতে না চাইলেও তাহমিনা আক্তারের জেদের কাছে হার মানতে হয়।

কুহু গোসল সেরে একটা নতুন থ্রিপিস পরে ড্রয়িংরুমে আসতেই, ওর চোখ আটকে যায় সোফায় বসে থাকা বাবার দিকে। সেখানে বাবার কোলে শিহাব আর পাশে দৃষ্টি বসে খুনসুটিতে ব্যস্ত। আশেপাশে কি ঘটছে সেসব দেখার সময় নেই কারও। কুহু লক্ষ্য করেছে এবার বিয়েতে আসার পর থেকে বাবা ওর সাথে খুব একটা কথা বলেনি। শুধু যেটুকু প্রয়োজন সেটুকুই বলেছে। একবারও আদর করে কাছে ডাকেনি, বুকে টেনে নেয়নি কিংবা মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়নি। কষ্টে কুহুর চোখে পানি আসে। টুপটুপ করে ঝরে পরতে একটুও সময় নেয়না। ডাইনিং টেবিলে বসে খেতে খেতে তাহমিদ সবটাই লক্ষ্য করে। কুহুর কান্না দেখে ওর ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। ছুটে যেয়ে ওকে বুকে জরিয়ে নিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সেই উপায় ওর নেই। প্লেট রেখে রান্নাঘরে মায়ের কাছে আসে। সংক্ষেপে মা’কে জানায় কুহুর কান্নার কথা। তাহমিনা আক্তার তৎক্ষনাৎ কাজ ফেলে কুহুর কাছে আসেন। কুহুকে বুঝতে না দিয়ে ওকে নিয়ে রান্নাঘরে এসে টুকটাক কাজের ফাঁকে ফাঁকে কুহুর সাথে গল্প করতে থাকেন৷ নিমেষেই কুহুর মনের সকল মেঘ কেটে যায়। ভালোবাসার শক্তি এত বেশি, যেখানে ভালোবাসা থাকে সেখানে কষ্টের কোন লেশমাত্র থাকেনা।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here