#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_২১
জাওয়াদ জামী
কিছুক্ষণ আগে সুপ্তি বিদায় নিয়েছে, রওনা দিয়েছে নতুন ঠিকানায়। পেছনে ফেলে রেখে গেছে অস্তিত্বের সাথে মিশে থাকা আপনজনদের।
সানাউল রাশেদিন ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। এই মেয়েটা তার বড় আদরের ছিল। রীতির জন্মের পাঁচ বছর পর যখন সুপ্তির জন্ম হলো তখন অনেকেই অনেক কথা বলেছিল। অনেকেই আক্ষেপ করে বলেছিল, এবারও মেয়ে হলো! একটা ছেলের জন্য তৃতীয় সন্তান নিল, কিন্তু ফলাফল শূন্য। এ জন্মে আর ছেলের মুখ দেখা হলোনা। সেসব কথা শুনে কষ্ট পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মেয়ের থেকে মুখ সরিয়ে নেননি। বরং আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরেছিলেন এই মেয়েটিকে৷ মেয়েটিও তেমনি বাবার ভালোবাসার প্রতিদান দিতে ভুল করেনি। বাবার বাধ্য মেয়ে হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বাবার সকল চাওয়াকে নিজের চাওয়া হিসেবে মনে করেছে। বাবার স্বপ্ন পূরনের জন্য ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখায় মনযোগী হয়েছে। ঘুচিয়েছে বাবার সকল আক্ষেপ। প্রতিদিন সকালে প্রথমেই এই মেয়ের মুখ না দেখলে তার ভালো লাগতনা। আজ থেকে আর সকালবেলায় মেয়েটার মুখ দেখতে পাবেননা ভেবেই তার ভেতরটা ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে।
তাহমিনা আক্তার হলরুমের এক কোনে বসে কাঁদছেন। তাহমিদের একমাসের ছোট সুপ্তি। ছোটবেলা থেকেই ওদের সম্পর্ক বন্ধুর মত। তাহমিদের যখন জন্ম হয় তখন তিনি অসুস্থ হয়ে পরায়, আফরোজা নাজনীন তাহমিদকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। বড়মার কাছে সন্তানের মত বড় হতে থাকে তাহমিদ। এরপর সুপ্তির জন্ম হলো। দুইজনকেই তখন বুকের দুধ খাইয়ে বড় করতে থাকে আফরোজা নাজনীন। সাত মাস শয্যাশায়ী ছিলেন তাহমিনা। ততদিনে তাহমিদের দুনিয়া জুড়ে বড়মার বাস। এমনকি তাহমিনা আক্তার সুস্থ হওয়ার পরও মায়ের কাছে আসতে চাইতনা। সুপ্তি ছিল ওর খেলার সাথী, বোন, বন্ধু। সুপ্তিও ছোটমার ভক্ত ছিল। তিনি খাওয়ালেই তবে সুপ্তি খেত। বিয়ের আগ পর্যন্তও তিনি সুপ্তিকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন। নিজের একটা মেয়ে না হওয়ার আক্ষেপ তিনি সুপ্তিকে দিয়ে পূরণ করেছিলেন। আজ সেই মেয়ে তাদের ছেড়ে শ্বশুর বাড়িতে পারি জমালো। কিভাবে থাকবেন তিনি সুপ্তিকে ছাড়া!
সবাই কমিউনিটি সেন্টার ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আফরোজা নাজনীন কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পরেছেন।
কুহু বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ দেখছে। চাঁদের আলোয় বিচ্ছুরিত হচ্ছে চারপাশ। কিন্তু এই বিচ্ছুরণ ওর মনে কোন প্রভাব ফেলছেনা। ও ফুপুর জন্য কষ্ট পাচ্ছে। ফুপু আজ থেকে অনেকটাই একা হয়ে গেল। সুপ্তি আপু সকল বিপদেআপদে ফুপুর পাশে থাকত। ফুপুকে সাপোর্ট দিত। আজ ফুপু অসুস্থ হয়ে গেছে, এই অসুস্থতা থেকে ফুপু বেরিয়ে আসতে পারবেনা তা কুহু বেশ বুঝতে পারছে। নানান চিন্তা কুহুকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে৷
তাহমিদ ভেতরে কুহুকে দেখতে না পেয়ে বাইরে এসে বারান্দায় দেখতে পেল। ও একমনে কিছু ভেবে চলেছে। তাহমিদ আনানকে ডেকে কুহুকে হোস্টেলে পৌঁছে দিতে বলে। অনেক রাত হয়েছে। এরপর যেতে সমস্যা হতে পারে।
আনান তাহমিদের কথা শুনে কুহুর কাছে আসে।
” কুহু,,চল তোকে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে আসি। অলরেডি এগারোটা বেজে গেছে। ”
” ভাইয়া, আজ হোস্টেলে যাবনা। বড় ফুপুর সাথে যাব। ফুপু খুব কষ্ট পাচ্ছে। এই অবস্থায় তাকে রেখে আমি হোস্টেলে যেতে পারবনা। ” আনান কুহুর কথা শুনে তাহমিদের কাছে আসল।
” ভাই, ও বলল, তোমাদের বাসায় যাবে। খালামনির এই অবস্থায় তাকে রেখে হোস্টেলে যাবেনা ও৷ ” আনানের কথা শোনামাত্র তাহমিদের বুকের ভেতর র’ক্ত ছলকে উঠে। শক্ত করে আনানকে জড়িয়ে ধরে টুপ করে ওর গালে চুমু খায়।
” ছিহ্ ভাই, তুমি এটা কি করলে! প্রেমে পড়ার সাথে সাথে তুমি কি লুচুও হয়েছ! জেন্ডার না মানছনা দেখছি! সমজাতীর প্রতি আজকাল আকর্ষন বোধ করছ নাকি! নাউজুবিল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ। ” তাহমিদকে ছাড়িয়ে একট দূরে সরে আসে আমান।
আনানের কথা শুনে তাহমিদ ভ্যাবাচ্যাকা খায়। এই ছেলে বলে কি!
আনানের দিকে তাকিয়ে দেখল বেচারা চোখমুখে ভয় ফুটিয়ে, দই গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আনানের এহেন আচরণ দেখে তাহমিদ পারলে লজ্জায় মাটিতে মিশে যায়।
পাঞ্জাবীর কলার ঠিক করে, হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে বলে উঠে,
” গর্দভ, আমাকে কি তোর ঐসব মানুষদের মত মনে হয়! আমি শারীরিক এবং মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ। বে’য়া’দ’ব ছেলে। বড় ভাইয়ের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তা জানিসনা? কানের দুই ইঞ্চি নিচে ঠাঁটিয়ে একটা দিলেই তবে সব জেনে যাবি। ” তাহমিদের কাছ থেকে উল্টো ঝাড়ি খেয়ে চুপসে যায় আনান। সুড়সুড় করে ভেতরে চলে যায়।
আনানের চলে যাওয়া দেখে হাঁফ ছাড়ে তাহমিদ। নিজের অজান্তেই আনন্দে, আবেগে ভেসে একটা কেলেঙ্কারি বাঁধিয়ে ফেলছিল!
খুশিমনে হলরুমে মায়ের কাছে ছুটে যায় তাহমিদ৷
এক বছরের বেশি সময় পর কুহু পা রাখে ‘কুঞ্জছায়া’র চৌকাঠে। ওর পা দুটো ভারী হয়ে গেছে। বারবার মনে পরছে সেইদিনের সেই কথাগুলো। শরীরে হালকা কাঁপন টের পায়। হাতের চেটোয় ঘামের অস্তিত্ব বুঝতে পারছে। কিন্তু ফুপুর ভালোবাসার কাছে সব অপমান ফিঁকে হয়ে গেছে। নিজের সাথে অনেক বোঝাপড়া করে, খানিকটা জড়তা, খানিক ইতস্ততা নিয়ে প্রবেশ করে ‘ কুঞ্জছায়া’র ড্রইংরুমে৷ তাহমিনা আক্তারের চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। এবার বুঝি সব ঠিক হয়ে যাবে! আফরোজা নাজনীনও ভেতরে ভেতরে খুশিতে ফেটে পরছেন। মেয়েটা যে শুধুমাত্র তার মন ভালো করতেই এ বাড়িতে এসেছে তা তিনি বেশ বুঝতে পারছেন। দিদুনও খুব খুশি। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কুহুকে রাতে নিজের কাছে রাখবেন।
তাহমিদের আনন্দ কে দেখে। খুশিতে ওর হৃ’দ’পি’ণ্ড বুক ফে’টে বের হয়ে আসতে চাইছে। বুকের ওপর থেকে পাথর নেমে যাওয়ার সুখ অনুভূত হয়৷ একবার যখন তার শ্যামাঙ্গীনি এ বাড়িতে পা রেখেছে, এবার ওকে আর দূরে ঠেলে দিবেনা।
‘ কুহু, বোনু তুই বড় বউমাকে কিছু খাইয়ে দিয়ে আমার কাছে চলে আসিস। আজ আমার কাছে থাকবি তুই। ” দিদুনের কথা শুনে, মাথা নাড়ে কুহু৷
এই বাড়িতে কুহু পা দেয়ার পর থেকে কুহুর প্রতি সবার ভালোবাসা দেখে, সেসব শিউলির কাছে আদিখ্যেতা মনে হচ্ছে। ভেতরে ভেতরে রাগ জমা হতে থাকে। তার মেয়েকে তো কেউই এভাবে চোখে হারায়না! কেউ তো ওকে মাথায় তুলে রাখেনা। শিউলির ভেতরের প’শু মাথাচাড়া দিল। কেন ওর মেয়ে এদের ভালোবাসা পাবেনা? কুহুই কেন সব ভোগ করবে? সব ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার একমাত্র তার মেয়ের। ঐ কালীর ভেতর কি এমন আছে, যা আমার মেয়ের মধ্যে নেই! আমার মেয়ে কুহুর থেকে হাজারগুনে সুন্দরী। এবার ঐ কালীর একটা ব্যবস্থা না করলেই নয়। মনে মনে ছক কষে শিউলি। কিভাবে কুহুকে শিক্ষা দিবে। ভেবেচিন্তে সব প্ল্যান ঠিক করে। এবার শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা এবং পরিকল্পনা প্রনয়নের পালা।
চলবে…