#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৮
জাওয়াদ জামী
” আহ্ শিউলি, তুই এসব কি শুরু করেছিস? এ আহাজারির কি হয়েছে! তোর কি মিনিমাম সম্মানটুকুও নেই? একে-তো অন্যায় করেছিস, তার উপর এভাবে গলা চড়াচ্ছিস! ধন্যি মেয়ে তুই। একটুতো লজ্জা কর। ” শাহনাজ সুলতানার গলায় ব্যঙ্গ স্পষ্ট।
এবার যেন জোঁকের শরীরে লবন পরল। থেমে
গেল শিউলির আহাজারি।
নাজমা পারভিনের মেয়ে মাইশা আর শাহনাজ সুলতানার ছেলে-মেয়ে আনান, আরোশী তিনজন অনেকদিন পর নানুর বাড়িতে এসেছে। তাই ওরা মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কুহু আর শিহাবকেও ওদের সাথে নিয়েছে। দৃষ্টিকেও ওরা বলেছিল, কিছু দৃষ্টি ওর মায়ের সাথে কাজ করছিল তাই যেতে পারেনি।
আনান এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিবে। আর আরোশি আগামী বছর এসএসসি দিবে। আনান দৃষ্টির থেকেও কুহুকে বেশি পছন্দ করে। দৃষ্টির কিছু কিছু জিনিস ওর পছন্দ হয়না। তার মধ্যে আছে কুহুকে খোঁ’চা মেরে কথা বলা আর সব জায়গায় নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করা। যদিওবা আনান কুহু আর আরোশিকে আলাদা দৃষ্টিতে দেখেনা তবুও দৃষ্টি বারবার কুহু আর আনানকে নিয়ে টিটকারি মারে। এসব কারনে আনান চুড়ান্ত পর্যায়ের অপছন্দ করে।
রাতে কায়েস বাড়ি ফিরে বোনদের দেখে অবাক হয়ে যায়।
” আপা তোমরা কখন এসেছ? আমাকে জানাওনি যে! তোমরা সবাই কেমন আছো? ” ভাগ্নে-ভাগ্নীদের আদর করতে করতে কায়েস বিস্মিত হয়ে জানতে চায়।
” আমরা সেই দুপুরে এসেছি। বাবার বাড়িতে এসেছি এখন তোকে জানানোর দ্বায়িত্ব তোর আদরের বউয়ের। সে যদি ননদদের দেখে ভয় পেয়ে তোকে না জানায় এই দোষ কি আমাদের? ” নাজমা চোখের সামনে অন্যায় দেখলে কিছুতেই নিজের মুখকে সামাল দিতে পারেনা।
কায়েস মেজো বোনের কথা শুনে মুখ কালো করে। সত্যিই তো আপারা সেই দুপুরে এসেছে কিন্তু শিউলি এ কথা তাকে জানায়নি!
” এসব কথা বাদ দাওতো আপা। আমি মুখহাত ধুয়ে এসে সবাই একসাথে খাব। কতদিন আমরা ভাই-বোনেরা একসাথে খাইনা। ” কায়েস কলপাড়ে যায় মুখহাত ধুতে।
ততক্ষণে শিউলি ভাত-তরকারি সাজিয়ে দিয়েছে বারান্দার মেঝেতে। বিছিয়ে দিয়েছে মাদুর।
ছেলে-মেয়েরা একে একে সবাই হাত ধুয়ে এসে বসেছে মাদুরে।
কায়েস বোনদের মাদুরে বসতে বলে নিজেও বসে।
” শিউলি, তুই ও বস আমাদের সাথে। আজ সবাই একসাথে খাই৷ ” আফরোজা নাজনীন স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন।
” না আপা, আপ্নেরা ভাই-বোন মিল্লা একসাথে খান। আমি পরে খামুনে। ”
” আরে বস, আজ একসাথে খাই। এতদিন তো একাই খেয়েছিস আজ আমাদের সাথে খা। ” নাজমা পারভিন বাচ্চাদের প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে বলেন।
মায়ের কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠে মাইশা।
” ও আম্মু, তুমি মামিমাকে একেক সময় একেক ভাবে সম্মোধন কর কেন? একবার তুই বলো তো আরেকবার তুমি। এটা কেমন ডাক বলতো? দিনদিন তোমার স্মৃতি বোধহয় কমে যাচ্ছে! ”
” চুপ থাক৷ এত কথা বলিস কেন? বড়দের মাঝে কথা বলার বদঅভ্যাস রপ্ত করলি কবে থেকে? এই শিক্ষা দিয়েছি তোকে। ” মায়ের হুং’কা’র শুনে চুপসে যায় মাইশা।
” শিউলি আমার ভাগ্নে-ভাগ্নীদের ঠিকমত খাওয়াও। ভালো দেখে মাংস দাও। দেখি বাটি আমার কাছে দাও। আমিই তুলে দিচ্ছি আমার আব্বা-আম্মাদের। ” কায়েস মাংসের বাটি নিয়ে বেছে বেছে মাংস তুলে দেয়। তাই দেখে শিউলি আক্তার ভেতরে ভেতরে ফুঁ’স’তে থাকে।
ছেলে-মেয়েদের পাতে মাংস তুলে দেয়ার পর দেখা যায় বাটিতে দু-চারটা হাড় রয়েছে। অথচ বড়দের পাতে এখনও মাংস উঠেনি। ওরা তিন বোন মাছ ভাজা আর বেগুন ভাজা দিয়েই খেতে থাকে। কায়েস শিউলির কাছে আরও মাংস চাইলে শিউলি জানায় মাংসের তরকারি বাটিতে যা আছে তাই। এতে কায়েস বেশ অবাক হয়। বাচ্চাদের পাতে দিতেই মাংস শেষ! অথচ এখনও তার বোনদের খাওয়া হয়নি।
” তুই চুপ করে খা। ছেলে-মেয়েরা মাংস খাচ্ছে এতেই হবে। আমাদের খাওয়া লাগবেনা। শিউলি, কায়েসের প্লেটে মাংসের তরকারির যা আছে তাই দে। ” আফরোজা নাজনীন মুখে খাবার তুলতে তুলতে কথা বলেন।
কায়েসের আজ শিউলির উপর ভিষণ রা’গ হচ্ছে। এই বেয়াক্কেল মহিলা বোধহয় একটা হাঁস জবাই করেছে৷ এর কি কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছে!
কোন ঝামেলা ছাড়াই খাওয়া শেষ করে সবাই।
উত্তরের ঘরের বারান্দায় বসেছে ভাই-বোন মিলে। বাচ্চারা কুহুর ঘরে আড্ডায় মেতেছে।
শিউলি নিজ ঘরে প্লেটে খাবার নিয়ে এসেছে। ভাতের প্লেট টেবিলের উপর রেখে আলমারির ভেতর থেকে ঢাকনা আঁটা বক্স বের করে। খাটে এসে বসে বক্সের ঢাকনা খুলে ভাতের উপর ঢেলে নেয় তিন টুকরা মাংস আর ঝোল। সে রান্নার পরপরই একটুকু তরকারি তুলে রেখেছিল। এত কষ্ট করে হাঁস কেটে, বেছে শেষ পর্যন্ত কিনা খেতে পারবেনা এটা হতে পারেনা।
আগামীকাল থেকে তাহমিদের পরিক্ষা শুরু। ও মনযোগ দিয়ে পড়ছে। তাহমিনা আক্তার বেশ কয়েকবার এসে খেতে ডেকেছে কিন্তু ও এখন খাবেনা। একবারে শোয়ার আগে খাবে। তাহমিনা আক্তার টেবিলে খাবার ঢেকে রেখে তাহমিদের রুমে এসে ওর বিছানায় শুয়ে পরে।
” মা, তুমি এখানে শুচ্ছ কেন! আমার পড়া শেষ করতে রাত তিনটা বাজবে। এতক্ষণ রুমের লাইট অন থাকবে। তোমার ঘুম হবেনা৷ তুমি তোমার রুমে যাও। ”
” আমার সমস্যা নেই। তুই পড়। আমি রুমে গেলে তুই তো আর পড়া শেষ করে ডাকবিনা। তাই তোর পড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি এখানেই আছি। তোর শোয়ার আগে খাবার গরম করে, তোকে খাইয়ে তারপর আমার রুমে যাব। ”
তাহমিদ বুঝল ওর মা এখন এখানেই থাকবে। তাই কোন প্রত্যুত্তর না করে পড়ায় মনযোগ দেয়।
সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার বই নিয়ে বসে তাহমিদ। একটু বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে নেয়। কিছুক্ষণ পর ওর মা এসে খাইয়ে দেয়। এরপর তৈরি হয় সে। তবে পরিক্ষা দিতে যাওয়ার আগে বড়মার সাথে কথা বলতে হবে৷ ফোন হাতে নিয়ে বড়মার নম্বর বের করে তার উপর আঙুল ছোঁয়ায়। আজ ও নতুন একটা নম্বর থেকে ফোন করেছে বড়মার কাছে। যেটা বড়মার ফোনে সেইভ করা নেই। আননোন নম্বর দিয়ে বড়মার সাথে একটু দুষ্টুমি করবে ও।
আফরোজা নাজনীনের ফোন বেজেই চলেছে। পরপর দুইবার ফোন বেজে আবার কেটেও যায়।
কুহু একটা কাজে নিজের ঘরে এসে ফুপুর ফোনের রিংটন শুনতে পায়। টেবিলের উপর থাকা ফোন হাতে নিয়ে দেখে আননোন নম্বর। এবারেও কেটে গেছে। কুহু দেখল এর আগেও তিনবার ফোন এসেছে একই নম্বর থেকে। ফোন কুহুর হাতে থাকা অবস্থায়ই আবার বেজে ওঠে।
কুহু একটু চমকায়। এদিকে ফুপুও বাড়িতে নেই৷
যদি গুরুত্বপূর্ণ কিছু হয় এই ভেবে রিসিভ করে কুহু।
” আসসালামু আলাইকুম। ফুপুতো বাড়িতে নেই। একটু বাইরে গেছে। ”
অতি পরিচিত গলার আওয়াজ শুনে তাহমিদের বুকের ভিতর ধুকপুক করছে। উত্তেজনায় হাত-পা কাঁপছে। এই মুহূর্তে প্রচন্ড পিপাসা পেয়েছে ওর। সে কি প্রত্যুত্তর দেবে এই মেয়ের কথার!
এদিকে কুহু কথা বলে চুপ করে থাকে অপরদিকের উত্তর শোনার আশায়।
” ওয়ালাইকুমুসসালাম। বড়মা, আসলে বলো আমি পরিক্ষা দিতে যাচ্ছি। ” এক নিশ্বাসে বলে তাহমিদ।
কুহুর শরীর অবশ হয়ে আসছে তাহমিদের গলা শুনে। ও কোন কারন ছাড়াই এই ছেলেটাকে ভয় পায়। হঠাৎই মনে হয় সেদিনের কথা। সাথে সাথে চোখের কোনে পানি এসে জমে। অনেক কষ্টে উত্তর দেয়,
” আ..আচ্ছা আমি ফু..ফুপুকে বলব। রাখছি। ” কুহু ফোন কাটতে নিলেই পুনরায় কথা বলে তাহমিদ।
” কংগ্রেচুলেশন। খুব ভালো থেকো। ” বলেই ফোন কেটে দেয়।
এদিকে কুহু হতভম্ব হয়ে গেছে। তাহমিদ ভাইয়া কেন ওকে কংগ্রেচুলেশন জানাল!
চলবে….
বিঃদ্রঃ আমার ছেলে আরও অসুস্থ হয়ে গেছে। সারাদিন ওকে নিয়ে দৌড়ের ওপর ছিলাম। ডক্টর দেখিয়ে সন্ধ্যার পরে বাসায় এসে এতটুকুই লিখতে পেরেছি। পার্ট ছোট হওয়ার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।