#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৬
জাওয়াদ জামী
ছোট ফুপুর ফোন পেয়ে হাসি ফুটে কুহুর ঠোঁটে। মায়ের কোন স্মৃতিই ওর মস্তিষ্কে নেই। ছোট থেকেই বড় হয়েছে দাদা-দাদীর কাছে। তারা যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন নাতনিকে আগলে রাখতে। তারা যতদিন বেঁচে ছিলেন ছোটমা তাদের আড়ালে কুহুকে আঘাত করেছে। তারপর যখন দাদা-দাদী দুজনেই একে একে চলে গেল তখন কুহু এ বাড়িতে একা হয়ে যায়। তখন থেকেই শুরু হয় ছোটমার প্রকাশ্য নি’র্যা’ত’ন। সেই সাথে হুমকি দেয় ফুপুরা যেন এসবের কিছুই না জানে। কুহুও তাই ফুপুদের কিছুই জানায়নি। ফুপুরা বছরে দুই-চার এসে বেরিয়ে যায়। কখনও কখনও কুহু যায় ফুপুদের বাড়ি। সেখানে গিয়ে থেকে আসে কিছুদিন। এই ফুপুরাই ওর প্রান। কুহুর মায়ের শূন্য আসন তারাই পূরণ করেছে।
ফোন একনাগাড়ে বেজেই চলেছে কিন্তু কুহুর সেদিকে হুঁশ নেই। সে একমনে চিন্তা করছে।
ততক্ষণে ফোন কেটে গেছে। পরেরবার ফোনের শব্দ কানে আসতেই রিসিভ করে। ছোট ফুপুর সাথে অনেকসময় নিয়ে কথা বলে কুহু। ছোট ফুপু একটা নতুন জামা বের করে পরতে বলেছে। তার কথামত কুহু তাহমিদের দিদুনের দেয়া একটা নতুন জামা পরে।
এরইমধ্যে শিউলি আক্তার ডাকতে থাকে কুহুকে। কুহু দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। শিউলি আক্তার নিজ ঘরের বারান্দায় ছেলে-মেয়ের পাশে বসে আছে। দৃষ্টি, শিহাব হারিকেন জ্বালিয়ে পড়ছে। এই সন্ধ্যায় কুহুকে নতুন জামা পরতে দেখে বাঁকা হাসে দৃষ্টি।
” আপু তোমার ভালোই হয়েছে। বছরে কয়েকবার রিলিফের, দানের কাপড় পাও। সবাই জানে তোমার মা নেই তাই তারা ভালোই দান বরাদ্দ রাখে তোমার জন্য। সকালে, দুপুরে, বিকেলে, সন্ধ্যায় যখন খুশি তখনই দানের কাপড় পরতে পার। ” দৃষ্টির টিটকারি যুক্ত কথা শুনে শিউলি আক্তার কিটকিটিয়ে হেসে উঠে। তার সাথে তাল মেলাচ্ছে দৃষ্টিও। শুধু শিহাব অবাক হয়ে চেয়ে থাকে মা-বোনের দিকে।
দৃষ্টির কথা কুহুর বুকে বিঁধে। ওর মা নেই, অসহায় সেই জন্যই কি সবাই ওকে এত ভালোবাসে, পোশাক দান করে! ও কি সত্যি সবার দেয়া দানের কাপড় পরে! এতটাই অসহায় ও! কুহুর চোখ দিয়ে কখন যে টপটপ করে পানি পরতে শুরু করেছে তা বুঝতেও পারেনি।
ছোট্ট শিহাব এটা বেশ বুঝতে পেরেছে আম্মু আর আপু মিলে কুহু আপাকে কষ্ট দিচ্ছে। ও উঠে কুহুর কোমড় জড়িয়ে ধরে।
” তুমি কেঁদনা আপা। দেখ আমি বড় হয়ে তোমাকে অনেক জামা কিনে দিব। তুমি সেগুলো পরে শেষ করতেই পারবেনা। ” ছোট ভাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে কুহুর দুচোখ আনন্দের অশ্রুতে ভরে যায়। এই ছোট্ট ছেলেটা ওকে খুব বেশি ভালোবাসে তা ও ভালো করেই জানে।
” আমাকে ডাকলে কেন ছোটমা? কোন কাজ আছে? ”
” কেন রে নবাবজাদী কাজ না থাকলে তোকে ডাকা যাবেনা? আমি ডাকলে তোর শরিলে ফো’স্কা পরে বুঝি? তুই কোন লাটের মাইয়া আইছিস যে আমারে প্রশ্ন করস? দিছস তো সামান্য মেট্টিক পাশ তাতেই এত ভাব বাড়ছে! হায়রে কপাল, এমন দিনও আমার দেখন লাগতাছে! ” শিউলি আক্তার গলা ফাটিয়ে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে।
কুহু ভেবে পায়না ওর যেকোন সামান্য কথায়ই কেন ছোটমা এভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। ওর বলা ভালো কথাও ছোটমা কেন বাঁকা ভাবে নেয়! ও কি এতটাই ঘৃণ্য!
শিউলি আক্তারের আহাজারির মাঝেই কুহু নিজের ঘরে আসে। ছোটমার ন্যাকামো দেখার ইচ্ছে ওর মোটেও নেই।
কায়েস রাতে বাড়িতে আসার সময় কয়েক কেজি মিষ্টি, ফলমূল, কুহুর জন্য নতুন পোশাক নিয়ে আসে। বাড়িতে এসেই কুহুকে ডেকে ওর জন্য নিয়ে আসা পোশাকগুলো হাতে দেয়।
এমনিতেই শিউলির মন মেজাজ খিঁচে ছিল তারউপর মেয়ের জন্য এরূপ আদিখ্যেতা দেখে তার মাথায় দা’উ’দা’উ করে আ’গু’ন জ্ব’লে উঠে।
” আদিখ্যেতা দেখছ! যেন তার মাইয়াই খালি পাস করছে! সামান্য মেট্টিক পাশই দিছে তাতেই এত পয়সা খরচ করন লাগবো! দিনরাত খাইট্যা পয়সা রোজগার কইরা একদিনেই সব শ্যাষ কইরা দিল! ” শিউলি আক্তার পারলে কায়েসকে চিবিয়ে খায়।
” শিউলি, একদিন বাজার করলেই আমার সব টাকা শেষ হয়ে যাবেনা। আমি যথেষ্ট রোজগার করি তাছাড়া আব্বাও আমার জন্য অনেককিছুই রেখে গেছে। আমি আমার মেয়ের জন্য খরচ করেছি এ নিয়ে তোমার মুখ থেকে একটা কথাও শুনতে চাইনা। ” কায়েসও দ্বিগুণ রে’গে জবাব দেয়।
কিন্তু শিউলি স্বামীর কথা শুনলে তো।
” তুমি তোমার মাইয়ার জন্য আনছো। আমার পোলা-মাইয়ার জন্য কি আনছো? তোমার সব কিছুই তো ঐ কালীর জন্য বরাদ্দ। নিজের সন্তানগোর কথা একবারও ভাবো কোনদিন? ” কায়েসকে পাত্তা না দিয়ে আবার গলা চড়ায় শিউলি।
” কুহু, দৃষ্টি, শিহাব তিনজনই আমার সন্তান। তিনজনই আমার কাছে সমান। তোমাকে এর আগেও বলেছি আমার সন্তানদের মধ্যে তুমি বিভাজন সৃষ্টি করবেনা। আর বারবার কুহুকে তুমি ঐ নামে সম্মোধন করবেনা বলে দিলাম। কিছুদিন আগেই যখন শিহাব, দৃষ্টিকে নতুন কাপড় কিনে দিলাম তখন তুমি তো একবারও কুহুর কথা বলোনি? আমি কি তখন তোমাকে দোষারোপ করেছিলাম? আমাকে কিছু বলার আগে তুমি নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ। ”
” হ এহন আমারই সব দোষ। আমিই খারাপ। এতদিন যে ঐ মাইয়ারে কোলে-পিঠে কইরা মানুষ করলাম তার বেলায় কিছুই না। আমি আর থাকমুনা এই সংসারে। এই সংসারে ঝাঁটার বাড়ি দিয়া আমি বাপের বাড়ি যামুগা। ” শুরু হয়েছে সেই পুরাতন ডায়লগ। কায়েস বিরক্ত হয়ে নিজে৷ ঘরে যায়।
কুহুর এসব আর ভালো লাগছেনা। ওর মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় দূরে কোথাও চলে যেতে যেখানে এই সৎমা নামক বি’ষা’ক্ত ফনা থাকবেনা। যেখানে তার করালগ্রাস থেকে মুক্ত থাকবে কুহু। যেখানে থাকবে শুধুই ভালোবাসা। কুহুর খুব ইচ্ছে করে এই পৃথিবীটা ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে। যেই পৃথিবীতে থাকবেনা কোন দুঃখ-কষ্ট, রাগ, ঘৃ’ণা, হিং’সা।
চুলে টান লাগায় ভাবনার জগৎ থেকে ছিটকে আসে কুহু৷ শিউলি আক্তার ওর চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে কুহুর ঘরে নিয়ে আসে। কায়েসের রা’গ সে ঝাড়বে কুহুর উপর। কুহুকে উঠানে মা’র’লে কায়েস জানতে পারবে তাই ঘরে নিয়ে এসেছে।
” হা’রা’ম’জা’দি তুই তর বাপরে কইতে পারলিনা নতুন জামা নিবিনা? আমার দৃষ্টিরে না দিয়া তুই হাতে নিলি কেন? এত শখ নতুন জামা পরনের? ”
কুহুর দুই গাল শক্ত করে চেপে ধরেছে শিউলি আক্তার। ব্যথায় কুহুর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে। শিউলি আক্তারের দুই আঙুল সাঁড়াশির ন্যায় চেপে রেখেছে কুহুর গাল। মুখের ভেতরের অংশ দাঁতের সাথে লেগে কে’টে গেছে বোধহয়। কুহু ব্যথায় ছটফট করছে। ওর শরীর কেমন নিস্তেজ হয়ে আসে। এমনিতেই সকাল থেকে না খাওয়া, সেকারণে বেশ দুর্বল ছিল। আর এখন এভাবে ধরায় ওর শরীরের সমস্ত শক্তি শেষ হয়ে যায়। দাঁড়ানো অবস্থায়ই ঢলে পরে শিউলি আক্তারের গায়ে। হঠাৎ এমন হওয়ায় শিউলি আক্তার ভয় পেয়ে গেছে। কুহুর গাল ছেড়ে দিয়ে ওকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। টেবিলের উপর থাকা জগ থেকে পানি নিয়ে কুহুর চোখেমুখে ছিটিয়ে দেয়। শিউলি স্বামী ভয় পাচ্ছে এখন যদি কায়েস এখানে আসে তবে অনর্থ হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ পর কুহু একটু স্বাভাবিক হলে শিউলি আক্তার ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা বাহির থেকে টেনে দিয়ে নিজের ঘরে যায়।
কুহুর কান্না কিছুতেই থামছেনা। কি দোষ ছিল ওর? কেন এত অত্যাচারিত হয় বারবার? নিয়তি কেন ওর সাথে ছিনিমিনি খেলেছে? আরও কতদিন বন্দী হয়ে থাকবে বর্বরতার শেকলে? ওর কি মুক্তি কভু নেই? একটু সুখ কি ওর কাম্য নয়? একের পর এক প্রশ্নের উত্তর জানতে ইচ্ছে করছে আজ। কিন্তু উত্তর দিবে কে?
তাহমিদ আজ রাতে আবারও ছাদে এসেছে। পুরো ছাদ হাসনাহেনার গন্ধে ম ম করছে। হাসনাহেনার মাতাল করা ঘ্রানে এক নিমেষেই তাহমিদের মন ভালো হয়ে যায়। আঙুলের ডগা দিয়ে আলতোকরে ছুঁয়ে দেয় ছোট্ট গাছের প্রতিটা ফুল। অজান্তেই ওর ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠেছে তা টেরই পায়নি।
” ভীতু কন্যা দেখি ফুলও ভালোবাসে! বাব্বাহ্ তার পছন্দও দেখছি খাসা। এমন ফুলকে সে পছন্দ করেছে যে ফুল তার সুবাস দিয়ে সকলকে কাছে টানে। আচ্ছা ঐ ভীতুকন্যারও কি এই হাসনাহেনার মত সবাইকে এমনই ভাবে কাছে টানার গুণ আছে! ” তাহমিদের চোখের সামনে কুহুর ভীতু ভীতু রুপ ভেসে উঠেছে। জ্বলজ্বল করছে ওর চোখদুটো। আজ কি হয়েছে তার! বারবার ঐ ভীতু মুখটা মন-মস্তিস্কে ঘুরঘুর করছে! এত ভালো লাগছে কেন তার কথা চিন্তা করতে!
” আচ্ছা ঐ মেয়েটা যখন জানবে আমি ওর কথা চিন্তা করছি তখন ওর প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? ও কি স্বভাবসুলভ ভাবেই ভয়ে জড়সড় হয়ে যাবে? ওর মুখটা দেখতে তখন কেমন লাগবে? ” তাহমিদের হো হো হাসিতে মুখরিত হতে থাকে পুরো ছাদ।
(বিঃদ্রঃ আমার ছেলেটা ভিষণ অসুস্থ। তাই ইচ্ছে থাকা স্বত্বেও বড় করে লিখতে পারিনি। আপনারা আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন।)
চলবে…