আঠারো_বছর_বয়স পর্ব-২৯
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
আকাশে মেঘরাশিদের মতোন উড়ছে ঘোলাটে কুয়াশার কণারা। তখন পড়ন্ত বিকেল। রাউন্ড শেষ করে রুহির কেবিনে আসে বিভোর। ওর মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। সকালে জ্ঞান ফেরার পরই শ্বাসকষ্টের সমস্যা শুরু হয় রুহির। ডাক্তার এসে দেখলেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। ঘুমের ইঞ্জেকশন দিলেন। জানালেন, খুব দ্রুতই ঠিক হয়ে যাবে রুহি। দুপুরে ঘুম ভাঙার পর রুহিকে নরম খাবার খাইয়ে দিলেন নাসিমা। বিভোর তখন ডিউটিতে ছিলো। ফোন করে জানালে, তৎক্ষনাৎ বিভোর ছুটে এসে দেখলো রুহি আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।
মা’কে খেয়াল রাখতে বলে বিভোর হতাশ হয়ে আবার ফিরে যায় নিজের কাজে। সব কাজ শেষ করে এখন আসলো আর দেখলো রুহির ঘুমটা এখনো ভাঙেনি। নাসিমা আজ বাসায় যাবে, হসপিটালে থাকতে থাকতে ওনি নিজেই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। বিভোর জোর করেই মাকে পাঠিয়ে দিলো। তিনি চলে যাওয়ার পরে বিভোর ঔষধপত্র গুছিয়ে রেখে, ফাইলগুলোতে চোখ বুলাচ্ছিলো তখন দেখলো রুহি নড়ছে। কাগজপত্র রেখে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আস্তে করে ডাকতেই চোখ খুললো রুহি। বিভোর উতলা হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কেমন লাগছে এখন? ঠিক আছো তুমি?’
রুহি মাথা নাড়িয়ে জানালো সে ঠিক আছে। উঠে বসতে চায় সেটাও জানালো। বিভোর ওকে সাবধানে ধরে বসালো। তারপর ঔষধ খাইয়ে দিলো। তোয়ালে ভিজিয়ে চোখমুখ মুছে দিলো, আর এলোমেলো চুলগুলোতে পাতলা বিনুনি করার চেষ্টা চালালো। রুহি ওকে বলল,
‘আপনি পারবেন না, রেখে দিন।’
‘পারবো।’
বলেই অনেক চেষ্টা করে কোনোমতে বিনুনি করে দিলো। তারপর ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
‘নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে?’
‘নাহ।’
বিভোর রাগী গলায় হঠাৎ বলল,
‘এরকমই করো তুমি। খাবার-দাবার না খেয়ে শরীরের কী অবস্থা করেছ তুমি? আর এতো দুর্বল শরীর নিয়ে অফিস কীভাবে করো? আমাকে বলোনি কেন যে তোমার এই অবস্থা? হ্যাঁ?’
রুহি মাথা নিচু করে আছে। বিভোর তা দেখে আবারো ধমক দিলো।
‘কত বয়স তোমার? জানো তুমি? আন্টির কী এখন সেই অবস্থা আছে যে তোমার পিছু ঘুরে ঘুরে খাওয়াবে? আরে, নিজের ভালো তো পাগলেও বুঝে। সামান্য সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েই তিনদিন অজ্ঞান! স্ট্রেঞ্জ!’
রুহি মিনমিন করে বলল,
‘বকছেন কেন আমায়?’
বিভোর হতাশ ভঙ্গিতে বলল,
‘কাকে কি বলছি আমি? আমি জানতে চাইছি তোমার এই অবস্থা কেন? খাওয়ার প্রতি উদাসীন কেন?’
‘আমি তো খাই-ই।’
বিভোর তাচ্ছিল্য করে বলল,
‘হ্যাঁ, জানিতো কি খাও। সকালে এককাপ চা আর বিস্কিট খেয়ে অফিসে বেরিয়ে পড়ো৷ দুপুরে ডিম দিয়ে একচামচ ভাত আর রাতে শুকনো রুটি আর আলুভাজা। এসব কোনো খাবার? তুমি কী মোটা হয়ে গিয়েছো যে এই চিকনা শরীর নিয়ে ডায়েট করো! তোমার হাজব্যান্ড একজন ডাক্তার। আর তার বউ কিনা সবকিছুতে উদাসীন। এমন হলে তো মাথা ঘুরবেই। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে কেন, হাঁটতে হাঁটতেই পড়ে যাবে। ড্যাম ইট!’
রুহি বাচ্চাদের মতো কেঁদে দিলো। বিভোর আর রেগে থাকতে পারলোনা। ওর মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে বলল,
‘ইশ। আর কাঁদতে হবেনা। নাকের পানিতে কি আমার শার্ট ভিজিয়ে দিবে নাকি!’
এ পর্যায়ে এসে কেবিনে ঢুকলো সিস্টার কিয়ারা। বিভোর থতমত খেয়ে গেলো। রুহির হাসি পেলো। দুজনে ঠিকঠাক হয়ে বসলো। সিস্টার কিয়ারা হেসে বললেন,
‘আমাকে লজ্জ্বা পাবার কিছু নেই। তোরা এরকম করছিস কেন!’
বিভোর মাথা চুলকে বলল,
‘তেমন কিছুই নয়।’
কিয়ারা হেসে বলল,
‘জানি। সেদিনের ঘটনাটা বলি তাহলে তোর বউকে।’
‘না, একদমই না।’
‘তুই বললেই আমি শুনবো কেন? বড়বোনের মুখের উপর একদম কথা বলবিনা।’
রুহি বুঝলো বিভোর আর কিয়ারা দুজনের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক। নইলে কি আর তুই তুই করে কথা বলতে পারে কেউ! অবশ্য বিভোর সবার সাথেই ফ্রি মাইন্ডেড। কিয়ারা রুহির প্রয়োজনীয় কিছু কাজ করতে করতেই সেদিনের পাগলামির কথা জানালেন রুহিকে। ও হাসতে হাসতে খুন, বেশ লজ্জ্বাও পেলো। বিভোর গম্ভীরমুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এখন খুব হাসছে যে খুব, সেদিন তো ওর জানটাই প্রায় কেড়ে নিতে বসেছিলো।
সিস্টার কিয়ারা চলে যাওয়ার পরে রুহি চোখ গরম করে বিভোরের দিকে তাকালো। বলল,
‘এরকম পাগলামি-ছাগলামি করার মানে কী?’
বিভোর অভিমানী গলায় বলল,
‘আমার জায়গায় থাকলে বুঝতে।’
রুহি হাসি হাসি মুখ করে বলল,
‘আপনি কী ভেবেছিলেন আমি মরে যাবো?’
বিভোর রেগে গেলো। ওর গাল চেপে ধরে বলল,
‘এরকম কথা শুধু মুখে নয়, তোমার মনেও জায়গা দেবেনা। আর কখনো আমাকে বলবেনা, তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে। তুমি শুধু আমার হাসিখুশি চেহারা আর ভালোমানুষি দেখেছো। রেগে গেলে আমি কি করতে পারি সেটা কিন্তু ধারণাও করতে পারবেনা তুমি। সো মাইন্ড ইট!’
দুজনের মধ্যে তারপর নীরবতা নেমে এলো। মাতাল হাওয়া ছুঁয়ে দিচ্ছিলো রুহির চোখ, গাল, চিবুক। চুলগুলো উড়ে এসে পড়ছিলো কপালের উপর। বিভোর উঠে চলে গেলো বাইরে। অনেকক্ষণ পরে ফিরে এসে দেখলো রুহি বেড থেকে নামার চেষ্টা করছে। হাতে ক্যানোলা নেই। ও অবাক হলো। নামতে গিয়ে হঠাৎ পা ফসকে পড়ে যেতে নিলে বিভোর দ্রুত ওকে গিয়ে ধরে ফেললো। রাগী গলায় চেঁচিয়ে বলল,
‘মানে কী এসবের? নামছো কেন?’
রুহি বলল,
‘আমার হাঁটতে ইচ্ছে করছে। পিঠ ব্যথা হয়ে গিয়েছে শুয়ে থাকতে থাকতে। আমাকে একটু ধরুন প্লিজ, আমি হাঁটতে চাই!’
‘পাগল হলে তুমি? এখনো পুরোপুরি ঠিক হওনি। আর লাফঝাঁপ দেওয়া শুরু করেছো! আর ক্যানোলা এসব কে খুলেছে? নিশ্চয়ই তুমি?’
‘না। কিয়ারা আন্টি খুলে দিয়েছে, আমার নাকি আর এসবের দরকার নেই।’
বিভোর রেগে বলল,
‘ওনি কী তোমাকে হাঁটতে বলে গিয়েছে?’
‘না। ওনি বারবার না-ই করেছেন। কিন্তু আমার ইচ্ছে হলো তাই নামলাম।’
‘বাহ! ভালো তো। আমার কথার তো কোনোই দাম নেই। না খেয়ে ওনি অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকবে আর আমি টেনশন করতে করতেই মরে যাবো। আবার নিজের যখন যা ইচ্ছা হলো ওনি তা-ই করবেন। আমি কে? আমিতো কেউওই না তাঁর!’
‘আপনি বাচ্চাদের মতোন করছেন কেন? আমি ঠিক আছি। অতো চিন্তা করার কিছু হয়নি। ইভেন আমিতো এক/দুদিনের মধ্যে বাড়িও যেতে পারবো।’
‘হ্যাঁ। তা তো যাবেই। সারাদিন লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে অফিসে যাবে আর গাধার খাটুনি খাটবে। নিজের প্রতি যত্ন নিবেনা। যা ইচ্ছা তা-ই করবে।’
একটু থেমে আবার বলল, ‘তুমি কি আমাকে মেরে ফেলতে চাও রুহানি?’
রুহি অবাক হয়ে বলল,
‘এসব কী বলছেন আপনি? উল্টাপালটা ভাবনা ভাবছেন কেন এতো? আর রুহানি ডাকলেন যে, আমি তো আপনার রক্তজবা! ভুলে গেলেন?’
বিভোর রুহির প্রশ্নটা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেলো। জোর করে ওকে বেডে শুইয়ে দিয়ে গায়ে চাদর টেনে দিলো। ইভা ফোন করেছিলো। রুহির সাথে অনেকক্ষণ কথাবার্তা বললো৷ নাদিরা ওকে অনেক বোঝালো, নিজের শরীরের প্রতি খেয়াল না রাখার জন্য অনেক বকাঝকাও করলো। বিভোর শুধু ওকে নিজের বুকে জড়িয়ে আছে। সিঙ্গেল বেডটায় জায়গা হয়না, বিভোর নিজের কেবিন থেকে ডিভানটা নিয়ে এসে বেডের পাশে জুড়ে দিয়েছে। যার ফলে দুজনের জায়গা অতি সহজেই হয়ে গিয়েছিলো।
পৃথিবীর বুকে অসাধারণ এক মায়াবী রাত। যে রাতে দুজন মানব-মানবী তাঁদের ভালোবাসার মানুষের হৃদস্পন্দনের শব্দ শুনে শুনেই পুরোটা রাত কাটিয়ে দিয়েছিলো, হাসপাতালের ওই নীল রঙা কেবিনটাতে। কাঁচের জানালার ফাঁক দিয়ে আসা রুপালি চাঁদের কণারা যখন রক্তজবার চোখমুখে আলো ফেলছিলো, বিভোরের তখন মনে হচ্ছিলো এত সুখের মতো অনুভূতি কোনোদিন সে অনুভব করেনি। আর যা-ই হোক, এই অসাধারণ মানবীটিকে সে বুকের ভেতর সারাজীবন বদ্ধ করে রেখে দেবে৷ কোত্থাও যেতে দেবেনা৷ ওর শুধু জানার ছিলো, একই অনুভূতি কী সেদিন তাঁর রক্তজবারও হয়েছিলো?
ছোট হয়েছে জানি। আগামীকাল দিতে পারবোনা হয়তো। ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি। স্যাড নাকি হ্যাপি সেটা আপনারাই বুঝে নিয়েন।
চলবে…ইনশাআল্লাহ!