আঠারো_বছর_বয়স পর্ব-২৬

0
997

আঠারো_বছর_বয়স পর্ব-২৬
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া

বিভোরের কাছ থেকে এই কথা শুনতে হবে তা কখনো ভাবেনি বাবর চৌধুরী। তার একটাই ছেলে। কত স্বপ্ন ছিলো ধুমধাম করে ছেলের বিয়ে দেবে, কিন্তু কিছু হলোনা। ওনার বিশ্বাস আর ভরসার মর্যাদা দিলোনা? ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেলে এতোটাই পর হয়ে যায় নাকি বাবা-মা? তাদের মতামতের কোনোই কি মূল্য নেই? মাথা ধরে আসছে নাসিমা চৌধুরীর। জিজ্ঞেস করলেন,

‘কবে করেছো বিয়ে?’

বিভোর ইতস্তত করে বলল,

‘অনেক বছর হয়ে গিয়েছে।’

বাবর চৌধুরী গলা উঁচিয়ে বললেন,

‘কয় বছর? বাচ্চাকাচ্চাও নিয়ে নিয়েছো নাকি? ভালোই তো।’

‘ছয় বছর। বাচ্চাকাচ্চা নিইনি।’

নাসিমা ভেবেছিলো কয়েক মাস হবে বোধহয়। কিন্তু ছয় বছর কথাটা শুনে ওনি অবাক হয়ে গেলেন। বাবর চৌধুরী প্রচুর শকড হলেন। এতো বছরে তার ছেলে একবারও কথাটা বলতে পারলোনা? তার ছেলে কি মেয়েদের ধোঁকা দেয় নাকি! এখন কি মেয়েটা ওকে চেপে ধরেছে সবাইকে কথাটা জানানোর জন্য, সচরাচর যেমন হয়!

বিভোর ক্ষীণ কন্ঠে বলল,

‘আমি আসলে বিয়ের কথাটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। দেশে ফেরার পরে ওর সাথে যখন আমার আবার দেখা হলো তখন আমি বুঝতে পারলাম ওকে ছাড়া আমার
চলবেনা। ওকে আমার চাই-ই চাই।’

‘দেশে ফিরেছো দুই বছরেরও বেশি সময় হয়ে গিয়েছে। আর তুমি এসব কি বলছো? আমরা কিছু বুঝতে পারছিনা।’

নাসিমা চাঁছাছোলা প্রশ্ন করলেন। বিভোর মাকে বলল,

‘আসলে আমি বিয়ে করতে চাইনি। পরিস্থিতি বাধ্য করেছিলো তখন আমাদের।’

‘পরিস্থিতি? কী এমন হলো যে তোমরা বিয়ে করতে বাধ্য হয়ে গেলে?’

বিভোর বলল,

‘সেইবার আমি ফ্রেন্ডের বাসা থেকে ফিরছিলাম। ট্রেনেই ওর সাথে প্রথম দেখা, কয়েকটা ছেলে মিলে আমাদেরকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়।’

পুরো ঘটনাটা বাবা-মাকে খুলে বললো বিভোর। মাহিমের অত্যাচার, ট্রেনে দেখা আর পরিস্থিতির চাপে বিয়ে করা! এমনকি রুহিকে একা শহরে ছেড়ে দেওয়া, স্বামীর দায়িত্ব পালন না করা, ওর খোঁজ না নেওয়া এভরিথিং। বিদেশে গিয়ে কলিগের সাথে রিলেশন এবং ব্রেকআপ করা সবকিছু ওরা মনোযোগ দিয়ে শুনলো। কিন্তু কিছু বললোনা। রাগে থমথম করছে বাবর চৌধুরীর চেহারা। নিজের ছেলেকে ঠকবাজ মনে হচ্ছে তার। এতো লেখাপড়া শিখিয়ে, ডাক্তার বানিয়েছিলো কী একটা মেয়ের সাথে এইরকম করার জন্য? এই শিক্ষা কোথায় পেয়েছে সে?

বসার ঘরে সুনশান নীরবতা বিরাজমান। গুমোট পরিস্থিতি সবসময়ই অস্বস্তিজনক ও বিরক্তিকর। মা-বাবার মুখের রঙ পাল্টাচ্ছে। দীপ্তিমান চেহারায় ভর করছে বর্ষার কালো মেঘেরা। প্রশান্তির বাতাসের ছিঁটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছেনা। বিভোর থমকালো, বাব-মা কী তবে ওর বিয়ের কথাটা হজম করতে পারছেন না? ওরা কী বিভোরকে বুঝবেনা? কয়েক সেকেন্ড নীরবতায় কাটলো। ওর বুকের বাঁ পাশে চিনচিন ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। কোনোমতে বলল,

‘কিছু বলছোনা কেন তোমরা?’

বাবর চৌধুরী বললেন,

‘কী বলবো? বলার মতো মুখ রেখেছো আমাদের?’

‘তোমরা আমার পুরো কথাটা শুনো..’

গর্জন করে উঠলেন বাবর চৌধুরী।

‘থামো। তোমার মতো কুলাঙ্গার ছেলের মুখ থেকে আর একটা কথাও শুনতে চাইনা।’

বিভোর আহত হলো। ওরা মানতে পারছেনা এটা। তবুও বলার চেষ্টা করলো,

‘আব্বু তুমি আমার কথা..’

‘স্টপ ইট। আমাকে একদম আব্বু বলে ডাকবেনা।’

‘আমাকে ভুল বুঝছো তোমরা। আমার সিচুয়েশনটা একটু বুঝো প্লিজ?’

‘আরকিছুই আমরা বুঝতে চাচ্ছিনা। তুমি এবার চাইছো যে সামাজিকভাবে তোমাদের বিয়েটা আবার দিতে, তাই তো? ওকে ফাইন। এটা আমি করবো। আফটার অল তুমি আমাদের একমাত্র পুত্র। কিন্তু তোমার বিহেভিয়ার অনুযায়ী তুমি একটা কাপুরুষ। এরকম সন্তান বাবা-মায়ের জন্য লজ্জ্বার। আমার ভীষণ লজ্জ্বা করছে, মাথা নিচু করে দিয়েছো তুমি আমার। এতোটাও ইররেস্পন্সিবল কী করে হলে তুমি। আমি এখন সেই মেয়ের কাছে কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াবো? আন্সার মি!’

বিভোর ঝটপট করে বলে ফেললো ,

‘মেয়েটা কে জানো তোমরা? রুহানি।’

নাসিমা অবাক হয়ে বললেন,

‘কোন রুহানি?’

অপরাধীর মতো মুখ বিভোরের। অসহায় গলায় বলল,

‘নাদিরা আন্টির বাসায় যে থাকে, রুহি। আমার স্ত্রী, অর্ধাঙ্গিনী সে। তাঁর সাথে আমি প্রচুর অন্যায় করে ফেলেছি তার শাস্তিও পাচ্ছি৷ আমাকে প্লিজ নিজের ভুল শুধরানোর সুযোগ দাও তোমরা!’

রুহির কথা শুনে ওনারা আকাশ থেকে পড়লেন। তার মানে ওনাদের ছেলের জন্যই মেয়েটার আজ এই অবস্থা? কীভাবে পারলো এটা করতে বিভোর? মেয়েটার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, অন্যের বাড়িতে আশ্রিতার মতো থাকে যদিও নাদিরা নিজের মেয়ের মতোই রাখে। ওরা আশ্রয় না দিলে মেয়েটা সত্যিই পাগলখানায় থাকতো আজ, নয়তো রাস্তায়। রুহির খুঁটিনাটি সবকিছুই জানে ওরা, বিয়ের কথাটা তো কাউকে বলেনি। কতোটা ভালো হলে একটা মেয়ে নিজের স্বামীর পরিচয় লুকিয়ে রাখতে পারে, একবার নিজের অধিকারটুকুও চাইতে আসলোনা। অথচ আজকাল ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার ছেলের পিছনে মেয়েরা লাইন লেগে থাকে। রাগ হচ্ছে বাবর চৌধুরীর। সেই মুহূর্তে বাবর চৌধুরী একটা আশ্চর্যজনক কাজ করে বসলেন। উঠে দাঁড়িয়ে ঠাস করে থাপ্পড় মারলেন ছেলেকে। বললেন,

‘তুমি এটারই যোগ্য। নাও গো টু হেল।’

চৌধুরী বাড়ির লনটা বেশ বড়সড়। সেখানে বিভিন্ন ফুলের গাছ আছে। দেশী-বিদেশী নানরকম ফুল সারাবছরই বাগানটাকে মাতিয়ে রাখে। রোদে পোড়া শান্ত বিকেলে স্নিগ্ধতার পরশ ছড়িয়ে দেয় বাহারি ফুলেরা। ম ম করে উঠে আদুরে সুবাসে। সবচেয়ে বেশি আছে রেইন লিলি। ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে তাদের কলিগুলো দেখা যায়। পায়ের নিচে চাপা পড়ে যায় বলে সেদিকটায় মালি ছাড়া আর কেউ যায়না। বাগানের প্রায় অর্ধেক অংশ জুড়েই রেইন লিলিদের বিস্তার। সাদা-গোলাপী রঙের ফুলগুলোতে রোজ সকালে হাত বুলিয়ে দেন বাবর চৌধুরী। প্রকৃতিপ্রেমী একজন মানুষ। কিন্তু ছেলে বিভোরকে শত চেষ্টা করেও প্রকৃতিপ্রেমী বানাতে পারেননি, তবে প্রকৃতির ক্ষতি সে করেনা। যাইহোক, সকালবেলা মর্নিং ওয়াক করার জন্য লনে নামতেই দেখলেন সদ্য নতুন গোলাপ গাছটিতে ফোঁটা কালোগোলাপ ফুলটা কেউ ছিঁড়ে নিয়েছে। বাবর চৌধুরীর মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। রাগ উঠলো এবং একপর্যায়ে লাল চেহারা নিয়ে তিনি মালি রতনকে ডেকে পাঠালেন। মালি হাঁকডাক শুনেই দ্রুত দৌড়ে এলো, নতমুখী হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘কী করতে পারি স্যার?’

বাবর চৌধুরী কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

‘গোলাপগুলো কে তুলেছে?’

রতন আস্তে করে বলল,

‘জানিনা স্যার।’

‘আশ্চর্য! তুমি বাগানের মালি আর তুমিই জানোনা গাছ থেকে কে ফুল ছিঁড়েছে?’

মালি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। বাবর চৌধুরী রাগে গজগজ করতে করতে বললেন,

‘লাল, গোলাপি গুলো ছিঁড়ে নিলে তাও মানা যেতো, কালো গোলাপটা ছিঁড়ে নিলো কোন সাহসে? কার এতো বুকের পাটা আমার গাছে হাত দেয়? কে সে?’

মালি রতনের মুখটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গিয়েছে। বাবর চৌধুরী খুব ভালো একটা মানুষ। সবার সাথে বন্ধুর মতো আচরণ করেন , হাসিখুশি থাকতে পছন্দ করেন। কিন্তু তাঁর বাগানের গাছ থেকে কারোর ফুল ছিঁড়ার পারমিশন নেই। এমন হলে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে ছাড়েন তিনি। ওনার মতে হাতে নয়, ফুলেদের মানায় ফুলগাছেই। সবটাই রতন জানে। তবে আজ এই দুঃসাহস কে দেখালো? রতন মনে মনে মজা পাচ্ছে আবার ভয়ও হচ্ছে। চাকরিটা না আবার চলে যায়। যদিও এই সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ শহরে আজকাল মালি পাওয়া দুষ্কর হয়ে গিয়েছে। রতনকে তো অনেক খুঁজে তারপর পেয়েছেন বাবর চৌধুরী। রতন বলল,

‘স্যার। একটাই তো ছিঁড়ছে। হয়তো বাতাসে নিচে পইড়া গেছে।’

তেতে উঠলেন বাবর চৌধুরী।

‘বাতাসে যদি ফুলটা পড়েই যেতো, তাহলে নিচে থাকতো। কোথায়? আছে ফুলের কোনো চিহ্ন?’

‘না স্যার।’

‘তাহলে বোকার মতো কথা বলো কেন? তুমি জানো আমি কত বিচক্ষণ ব্যক্তি? সেনাবাহিনীর বড় অফিসার ছিলাম আমি, আর তুমি আমাকে লজিক ছাড়া কথা শোনাও? ড্যাম ইট!’

‘ছাইড়া দেন স্যার। আর লজিক ছাড়া কথা কমুনা।’

‘পলিটিক্স শিখেছো ভালোই।’

‘এর লগে পলিটিক্সের কী সম্পর্ক স্যার?’

-‘তোমার মাথা। যাও কাজ করো। ভালো করে ডালগুলো ছেঁটে দিও। সার দিয়েছো?’

‘একটু পরে দিমু। রোদটা পশ্চিমমুখী হইয়া নেক।’

‘আচ্ছা৷ আর শুনো, ক’দিন পর বাসায় বিয়েটিয়ে লাগবে। তুমি বাগানটা ভালো করে পরিষ্কার করে, শুকনোপাতা ফেলে দিও। কয়েকটা গাঁদা আর বেলিফুলের চারা এনে গেইটের কাছে লাগিয়ে দিও। কৃষ্ণচূড়া নেই বাসায়, একটা গাছ এনে পেছনের দিকে লাগিও। বুঝেছ?’

রতন মনোযোগ দিয়ে সব শুনে খাতায় নোট করে রাখলো। ভেবেচিন্তে বলল,

‘দাদাভাইয়ের বিয়ে নাকি স্যার?’

‘হুম।’

‘বিয়া করতে রাজি হইছে নাকি?’

‘হুম।’

রতন কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিছু একটা মনে হতেই উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,

‘ওনার তো তাহলে লাল টকটকে জবাফুল পছন্দ। আমাদের বাগানে সাদা আর গোলাপি জবা আছে, লাল নাই। একটা রক্তজবার চারা নিয়া আসুম স্যার?’

বাবর চৌধুরী বললেন,

‘বিভোর তোমাকে বলেছে ওর রক্তজবা পছন্দ?’

‘তেমনভাবে বলে নাই। সকালে বাগানে এসে জিজ্ঞেস করলো লাল টকটকে জবা আছে কিনা। আমি বললাম নাই!’

বাবর চৌধুরী গম্ভীরকন্ঠে বললেন,

‘তাহলে নিয়ে এসো। ছেলে তো নিজের পছন্দ-অপছন্দের কথা আমাদের বলেই না। এতো গোপনীয়তা কীভাবে শিখলো বুঝতে পারছিনা। তুমি জানো বিভোর আরও ছয় বছর আগেই বিয়ে করে ফেলেছে। আমাদেরকে একবারের জন্য বলেওনি। ভাবতে পারছো আমার গুণধর ডাক্তার ছেলে কতোটা ডেঞ্জারাস!’

বলেই বাবর চৌধুরী হেঁটে চলে গেলেন। রতন এই কথাটা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বিভোর বিয়ে করতে এতোদিন রাজি হয়নি দেখে সেও মনে মনে বিয়ে না করার প্রতিজ্ঞা করেছিলো। কারণ মেয়ে মানেই ঝামেলা আর বউ মানে আরও বেশি ঝামেলা। ওরা ‘ক’ বললে ‘কলকাতা’ বুঝবেই। কিন্তু বিভোর আরো আগেই বিয়ে করে রেখেছে শুনে রতনের বুকটা দুমড়েমুচড়ে গেলো। এবার ওকেও বিয়ে করতে হবে আর বউয়ের কথায় উঠবস করতে হবে। কারণ বিভোরকে অনুসরণ করতে সে ভালোবাসে। ও যা করে রতনও তা-ই করে। বিভোর এখন জিম করা শুরু করেছে, রতনও করছে। মনটা খারাপ হয়ে গেলো ওর। কাঁচি আর বালতিটা হাতে তুলে নিয়ে ধীরপায়ে কাজে লেগে পড়লো।

চলবে…ইনশাআল্লাহ! ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here