#তুমি_আমার_অভিমান❤
|| পর্ব – ১০ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
দীপ্তিময় সূর্যের আলো চারদিকে ছড়িয়েছে। হালকা হালকা শীতের আমেজ। কয়েকদিন পর শীত পড়বে পুরোপুরি। তখন কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকবে সূর্য।
নীরা ঘুম থেকে উঠে দেখে, কাল যে গাউন পরে ছিল সেটা আর খোলা হয়নি। নীরা জামা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। দশ মিনিট পর শাওয়ার শেষ করে বের হয়। নীরা আজ একটা লাল চুড়িদার পরেছে। নীরা ওয়াশরুম থেকে আসতেই তার ফোন বেজে উঠে। নীরা মোবাইল ধরতে ধরতেই কল কেটে যায়। নীরা মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে, ২৬+ কল এসেছে নীরার মোবাইলে। কিছু নাম্বার সেভ করা আর কিছু নাম্বার আননোন। নীরা ভয় পেয়ে যায়। এতগুলো কল এসেছে নীরা টেরই পায়নি? চেক করে দেখে যে মধ্যরাতেই বেশি কল এসেছে। নীরার মোবাইল আবারও বেজে উঠে। অফিসের ম্যানেজার কল দিয়েছে। নীরা সাথে সাথেই কল রিসিভ করলে ওপাশ থেকে ম্যানেজার বলা শুরু করে,
‘নীরা? তোমার কোনো আইডিয়া আছে কি হয়েছে? কতোগুলো কল দিলাম তুমি রিসিভ করছো না কেন? অভিক স্যারের পিএ হিসেবে অভিক স্যারের বিষয়ে সব খবর তোমার সবাইকে দেওয়ার কথা। সে জায়গায় আমি তোমাকে খবর দিচ্ছি।’
নীরা চিন্তিত স্বরে বলে,
‘কি হয়েছে স্যার? বলবেন তো।’
‘অভিক স্যারের কাল একটা মারাত্মক অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। অবস্থা খুবই ক্রিটিকাল। ঢাকা মেডিকেল এ ভর্তি আপাতত।’
নীরার বুক ধক করে উঠে অভিককের অ্যাকসিডেন্টের কথা শুনে। ধপাস করে নীরার হাত থেকে থেকে মোবাইলটা পরে যায়। কোথায় যাবে, কি করবে কিচ্ছুটি ভেবে পাচ্ছেনা নীরা। ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে নীরার। কাল অভিককে ওসব কথা বলার ফল নয়তো এটা?
.
নীরা একপ্রকার পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে হাসপাতালে এলো। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে নীরার। এমনিতেই ওর শ্বাসকষ্ট আছে। তারউপর এভাবে দৌড়ের উপর হাসপাতালে আসায় শ্বাস বেড়ে গেছে। নীরা সেটায় গুরুত্ব দিলনা। অভিকের এক ফ্রেন্ড নীরাকে দেখে তার কাছে গিয়ে বলল,
‘তুমি এসেছ নীরা?’
নীরা কথা বলার শক্তি পাচ্ছেনা। অভিকের বন্ধু দেখছে নীরা নিঃশ্বাস টানছে জোরে জোরে। অনেক কষ্টে একটা বাক্য বলতে পেরছে নীরা।
‘অভিক স্যার কোথায়?’
অভিকের বন্ধু ফাহাদ নীরাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
‘নীরা তোমার তো দেখছি শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তুমি একটু শান্ত হয়ে বসো।’
ফাহাদ নীরাকে ধরে একটা বেঞ্চিতে বসায়। নীরা শান্ত হয়ে কিছুক্ষণ বসে। একজন নার্স এসে নীরাকে একটা ঔষধ দেয়। ওটা খাওয়ার কিছুক্ষণ পর নীরার শ্বাসকষ্ট কমতে থাকে৷ এদিকে অফিসের ম্যানেজার এসে নীরাকে বকাবকি শুরু করলেই ফাহাদ রাগ দেখায়। অভিকের বন্ধু জেনে ম্যানেজার চুপ হয়ে যায়। ফাহাদ নীরার কাছে এসে বলে,
‘আর ইউ ওকে নীরা?’
নীরা আস্তে করে বলে,
‘আমি ঠিকাছি ভাইয়া, কিন্তু অভিক স্যার?’
ফাহাদ এক কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে বলে,
‘অভিকের অবস্থা ভালো না। মাথা থেকে শুরু করে হাত পা সব জায়গায় আঘাত পেয়েছে। মাথার আঘাতই বেশি। অনেক রক্ত গেছে। চার ব্যাগ রক্ত লেগেছে। অপারেশন থিয়েটারে আছে এখন। অপারেশন হচ্ছে। স্মৃতি ড্যামেজ হওয়ারও সম্ভাবনা আছে। আমি তোমাকে রাতে কল দেইনি কারণ খবরটা শুনে হয়তো ঠিক থাকতে পারবেনা। আমরা দুই বন্ধু যখন ওর অ্যাকসিডেন্ট এর খবর পাই, তখন ওকে নিয়ে হাসপাতালে আসি। ভেবেছিলাম এখন কল দিয়ে তোমায় জানাবো। অভিকের ফোন আমার কাছেই আছে। পরে দেখলাম তুমি চলে এসেছ। ডাক্তার বলেছে, ও নাকি প্রচুর ড্রিংক করেছে। ড্রাংক হয়ে স্প্রিডে গাড়ি চালিয়েছে, তাই নেশার ঘোরে এই অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।’
ফাহাদের মুখে এসব শুনে নীরার মনে ব্যথা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। নীরা কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘উনি এমনটা করবেন আমি কখনো ভাবতে পারিনি।’
ফাহাদ নীরাকে জিজ্ঞেস করে,
‘কাল রাতে কি হয়েছিল নীরা? অভিক তো তোমাকে প্রপোজ করেছিল তাই না? তুমি কি কিছু বলেছ?’
নীরা কাঁদতে থাকে। নীরার কাঁন্না দেখে ফাহাদ বুঝতে পারে কাল রাতে নিশ্চয়ই কিছু হয়েছিল। হয়তো অভিককে রিজেক্ট করে দিয়েছিল নীরা। আর সেটা না মানতে পেরেই অভিক ড্রিংক করেছে। ফাহাদ নীরাকে শান্ত করার চেষ্টা করে।
‘নীরা কেঁদো না। তুমি কিভাবে জানো অভিকের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে? আর ও এই হসপিটালেই আছে?’
‘ম্যানেজার বলেছে কল দিয়ে। আরো কিছু আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছিল। কিন্তু জানি না তারা কে বা কারা।’
নীরা বেশ ভেঙে পড়েছে। মনে মনে নিজেকেই দোষারোপ করছে। ওর জন্যই এসব হয়েছে। ও যদি কাল অভিককে ওসব না বলতো তাহলে এসবের কিছুই হতো না। কিন্তু ও-ই বা কি করবে। এ ছাড়া যে ওর আর কোনো উপায় ছিল না।
.
অপারেশন করার প্রায় ছয় ঘন্টা কেটে যায়। অভিকের এখনো জ্ঞান ফিরেনি। তবে ডাক্তারেরা জানিয়েছেন, অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে।
নীরা আই সি ইউ’র বাইরে থেকে অভিককে দেখছে। অভিকের মাথার পুরোটা ব্যান্ডেজ। হাত আর পায়েও আছে কিছুটা। অভিকের চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। নীরা বাইরে থেকে অভিককে দেখেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।
অভিকের বন্ধু ফাহাদ আর শুভ্র নীরার কান্না দেখে স্তম্ভিত। এদিকে অভিককে দেখতে অভিকের অফিসের অনেকেই এসেছে। তখন নীরাকে কাঁদতে দেখে তারাও অবাক হচ্ছে। ফাহাদ আর শুভ্র নীরাকে ওখান থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে আসে। নীরা কিচ্ছুটি খেয়ে আসেনি। কাঁদতে কাঁদতে নীরা সেন্সলেস হয়ে পরে যায়। ফাহাদ আর শুভ্র নীরাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায় তাড়াতাড়ি। একজন নার্স নীরাকে একটা কেবিনে নিয়ে যায়। ওখান থেকে ডাক্তার চেকাপ করে জানায় যে, প্রচন্ড মানসিক চাপ আর না খাওয়ার ফলে শরীর দূর্বল হয়ে পরেছে। তাই সেন্সলেস হয়ে পরেছে। এখনই ওকে খাবার খাওয়াতে হবে, নইলে হীতে বিপরীত কিছু হয়ে যেতে পারে।
ফাহাদ শুভ্রকে বলছে,
‘এদের দুজনের চিন্তায় আমরাই শেষ হয়ে যাবো। আরে যখন দুজন দুজনকে ছাড়া থাকতেই পারবিনা তাহলে এতো নাটক করার কি ছিল?’
শুভ্র ভেবে বলে,
‘আই থিংক নীরা কোনো কিছু নিয়ে ভয় বা টেনশনে আছে, নইলে অভিকের প্রপোজাল রিজেক্ট করার কোনো কারণ দেখছিনা। আর অভিককেও বলি, রিজেক্ট করেছে বলে কি ড্রিংক করে স্প্রিডে গাড়ি চালাতে হবে? মানে এদের নিয়ে আমাদের টেনশনের কোনো শেষ নেই।’
অভিকের জ্ঞান ফিরলে একজন নার্স এসে ফাহাদ আর শুভ্রকে খবর দেয়। ফাহাদ আর শুভ্র দ্রুত অভিকের কেবিনে যায়। অভিক মাথা ব্যথার কারণে তাকাতে পারছেনা ভালো করে। হাত পায়ের শক্তি একেবারেই কম। যাত ফলে হাত পা-ও ঠিকভাবে নাড়াচাড়া করতে পারছেনা।
ফাহাদ আর শুভ্র এসে অভিকের সামনে বসে। ফাহাদ জিজ্ঞেস করে,
‘এখন কেমন লাগছে?’
অভিক আস্তে করে বলে,
‘হুম ভালো। কিন্তু মাথা ব্যথা, শরীরে কোনো শক্তি নাই।’
শুভ্র বলে,
‘শালা, প্রেমিকা রিজেক্ট করেছে বলে কি তোকে ড্রিংক করে গাড়ি স্প্রিডে চালাতে হবে?’
‘তোরা কিভাবে জানলি এসব?’
ফাহাদ বলে,
‘মেডিকেল রিপোর্ট বলেছে কিছু আর বাকিটা একজনকে দেখেই বুঝেছি।’
অভিক ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে,
‘কাকে দেখে বুঝেছিস? কি বলছিস?’
শুভ্র হেসে বলে,
‘তোর প্রেমিকা তো অ্যাকসিডেন্টের কথা শুনে না খেয়েই চলে এসেছে। আর সে কি কাঁন্না। কাঁদতে কাঁদতে সেন্সলেস হয়ে গেছে।’
‘নীরা?’
ফাহাদ আর শুভ্র মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে।
‘কিন্তু ও তো আমাকে ভালোবাসবে না বলল।’
শুভ্র অভিকের দিকে এগিয়ে এসে বলল,
‘কেন রিজেক্ট করেছে সেটা আগে তোকে জানতে হবে অভিক। নীরার তোকে নিয়ে ফিলিংস আছে বলেই ও এসেছে এখানে। তুই সুস্থ হও আগে তারপর খোঁজ নিস।’
‘নীরা কিছু খেয়েছে?’
ফাহাদ গম্ভীর হয়ে বলে,
‘জোর করে খাইয়ে এলাম তোর প্রেমিকাকে। বাপরে! খাবেই না আর কান্নার তো শেষ নেই।’
‘নীরা কি সত্যিই আমায় ভালোবাসে দোস্ত?’
শুভ্র বলে,
‘সেটা জানি না। তবে কিছু একটা নিয়ে বেশ ভয়ে আছে ও তাই তোর প্রপোজালে রাজি হয়নি। আচ্ছা আমরা যাই। নীরা আসবে, কিচ্ছু বলবি না ওকে খবরদার।’
‘আমাকে কষ্ট দিয়েছে, শাস্তি দিবনা ভেবেছিস? সব জেনেও না জানার ভান ধরে থাকবো। আসুক।’
‘আরে ভাই মাপ চাই। এই চল তো।’
ফাহাদ এই কথা বলেই শুভ্রকে নিয়ে চলে গেল। অভিকের জ্ঞান ফিরেছে শুনেই নীরা অভিকের কাছে আসে। ঠিক তখনই অভিক ধমক দিয়ে বলে,
‘তোমাকে কে বলেছে এখানে আসতে? আমি মরে গেলে তোমার কি? তোমার চেহারা আমাকে দ্বিতীয়বার দেখাবে না। যাও এখান থেকে। আই জাস্ট হেইট ইউ নীরা।’
অভিকের কথা শুনে দু’চোখ ভিজে এলো নীরার। এক মুহুর্তও দাঁড়ালো না সেখানে। কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল হসপিটাল থেকে।
অভিক মনে মনে বলছে,
‘সরি নীরা। আগে আমি সুস্থ হই, তারপর তোমাকে আমি নিজের করেই ছাড়বো! কোনো কষ্ট তোমাকে ছুঁতে দিবনা। আর তোমার না বলার কারণও আমি বের করে ছাড়বো। তা নাহলে আমার নামও অভিক চৌধুরী নয়।’
চলবে…