তুমি আমার অভিমান পর্ব ৯

0
1534

#তুমি_আমার_অভিমান❤
|| পর্ব – ৯ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

অভিক তার বন্ধুদের সাথে কথা বলছিল। তাদের মধ্যে একজন নীরাকে দেখিয়ে বলল,

‘দোস্ত, মেয়েটা কে রে? শি ইজ সো বিউটিফুল।’

অভিক তার বন্ধুর তাকানো দেখে চোখ রাঙ্গীয়ে বলে,

‘শি ইজ মাই উডবি ওয়াইফ। ডোন্ট লুক অ্যাট হার।’

তার বন্ধুরা চেঁচিয়ে বলল,

‘হোয়াট?’

অভিক ওদের আস্তে করে বলে,

‘ও জানে না এসব। আসলে ও আমার পিএ। যথেষ্ট ভদ্র একটা মেয়ে। আর আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি।’

অভিকের বন্ধু বলে,

‘তাইতো ভাবি। এতো পরিবর্তন হলি কিভাবে তুই৷ আগে ওয়াইন এর বোতল আর দুই তিনটে মেয়ে ছাড়া যার দিনই কাটতো না। সে এখন একজনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।’

‘অভিক এখন এক নারীতে আসক্ত। ওরা তো ছিল জাস্ট টাইমপাস করার জন্য। ওদের সাথে আমি কিছু করিনি তোরা ভালো করেই জানিস।’

অভিকের অন্য একটা বন্ধু বলে,

‘জিও শালা। এতোদিনে একটা কাজের কাজ করলি।’

অভিক আবারো তার বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলে,

‘শোন, যদি কোনো মেয়েকে সম্মান দিতে না পারিস তবুও তাকে নিয়ে অরুচিকর কথা বার্তা বলবি না। কোনো মেয়েকে টিজ করবিনা।’

নীরা অভিকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, অভিকের এই কথাগুলো নীরার কানে আসে। নীরা অন্য পাশে গিয়ে অভিকের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে বলছে,

‘অভিক স্যার এতো সুন্দর কথা কোথা থেকে শিখেছে? মেয়েদের সম্মান নিয়ে কি সুন্দর করে বলল। অভিক স্যার সত্যিই অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। নাহলে অভিক স্যার যে মেয়েগুলোর সাথে থাকতো তাদের একজনও নেই পার্টিতে।’

অভিকের একটা বন্ধু সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল,

‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলম্যান। আজ এই মুহুর্তে আপনাদের সামনে গান পরিবেশন করে শোনাবে দ্যা বার্থডে বয়, অভিক।’

অভিকের নাম নিতেই সবাই হাততালি দেয়। নীরাও সবার সাথে হাততালি দেয়৷ অভিকের একটা ফ্রেন্ড তাকে গিটার দেয়। অভিক সেটা নিয়ে মাঝখানে একটা চেয়ার টেনে বসে। ফোকাস লাইটগুলো অভিকের দিকে তাক করে রেখেছে। অভিক আড়চোখে নীরার দিকে তাকিয়ে গাইতে শুরু করে।

“দেখলে তোকে বদলায় দিন
বদলায় রাত, বদলায় ঘুম, সঙ্গে সময়
সন্ধ্যে হলে বন্ধ ঘরে
মনে পড়ে তোরই কথা, এমনই হয়

কেন যে তোকে পাহারা, পাহারা দিলো মন?
কেন রে এত সাহারা, সাহারা সারাদিন?
কেন যে তোকে পাই না, পাই না মনে হয়
সারাটা দিন?

কেন যে তোকে পাহারা, পাহারা দিলো মন?
কেন রে এত সাহারা, সাহারা সারাদিন?
কেন যে তোকে পাই না, পাই না মনে হয়
সারাটা দিন?

চাঁদেরই ঝর্ণা যেমন ভেজায় পাহাড়
ততটা আদর আছে তোকে দেওয়ার
দেখে যা ইচ্ছে কত আকাশ ছোঁয়ার

কেন যে তোকে পাহারা, পাহারা দিলো মন?
কেন রে এত সাহারা, সাহারা সারাদিন?
কেন যে তোকে পাই না, পাই না মনে হয়
সারাটা দিন?

কেন যে তোকে পাহারা, পাহারা দিলো মন?
কেন রে এত সাহারা, সাহারা সারাদিন?
কেন যে তোকে পাই না, পাই না মনে হয়
সারাটা দিন?

মনেরা মনের কথা যেই শেখালো
মুখেরা দু’চোখ বুজে তাল মেলালো
তোরই তো রাস্তা ধরে মন পালালো

কেন যে তোকে পাহারা, পাহারা দিলো মন?
কেন রে এত সাহারা, সাহারা সারাদিন?
কেন যে তোকে পাই না, পাই না মনে হয়
সারাটা দিন?

কেন যে তোকে পাহারা, পাহারা দিলো মন?
কেন রে এত সাহারা, সাহারা সারাদিন?
কেন যে তোকে পাই না, পাই না মনে হয়
সারাটা দিন?”

অভিকের গান গাওয়া শেষ হলেই সবাই হাততালি দেয় করজোড়ে। অভিকের বন্ধুরা মুচকি মুচকি হাসছে, কারণ তারা খেয়াল করেছে অভিক পুরো গানটা নিরার দিকে তাকিয়েই গাইছিল। এদিকে নীরা বেশ লজ্জা পেয়েছে। এভাবে অভিক যে কেন তার দিকে তাকিয়ে গান করছিল সে জন্য। ইশ! লোকজন কি ভাবছে ওকে এবার?
.
খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই বিদায় জানায় অভিককে। অভিকও সবার সাথে কুশল বিনিময় করে বিদায় জানায়। অভিকের বন্ধুরা অভিককে বলে,

‘কবে জানাবি ওকে?’

‘এইতো সবাই যাক না।’

‘সবার সাথে নীরাও বেরিয়ে যাচ্ছে ওই দেখ।’

অভিক দেখে নীরা তার অফিসের অন্য স্টাফদের সাথে বেরিয়ে যাচ্ছে। অভিক বলে,

‘আরে, সব প্ল্যান ভেস্তে দিচ্ছে মেয়েটা। তোরা যা, আমি আটকাচ্ছি ওকে।’

অভিকের বন্ধুরা সবাইকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য বের হয়। নীরা যেতে নিলেই তারা বলে,

‘তোমাকে অভিক ডাকছে, পিছনে তাকিয়ে দেখো।’

নীরা পিছনে তাকিয়ে দেখে অভিক নেই।

‘কই, উনি নেই তো।’

‘আরে ভেতরে আছে, ডাকছে তোমাকে। অভিক কিন্তু খুব রাগী। জানো নিশ্চয়ই?’

নীরা অভিকের বন্ধুদের কথা শুনে বাসার ভিতরে চলে গেল৷ অভিকের বন্ধুরাও নীরা যাওয়ার পর বাসার বাইরে চলে গেল৷

নীরা বাসায় ভিতরে ঢুকে দেখে অভিক কোথাও নেই। নীরা অভিককে ডাকতে শুরু করে,

‘স্যার! আপনি কোথায়?’

নীরার কেমন যেন ভয় লাগছে। সে আবারও বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে নেয়৷ দরজার কাছে আসতেই কেউ একজন নীরার পিছন থেকে কালো কাপড় দিতে চোখ বেঁধে দেয়। নীরা ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।

‘কে? আমার চোখ বাঁধলেন কেন? আমি আশ্রমে যাবো। ছাড়ুন আমায়।’

নীরা যেন হাওয়ায় ভাসছে। অথ্যাৎ নীরাকে কেউ কোলে তুলে নিয়েছে। নীরার ভয় দ্বিগুণ বেড়ে গেল। নীরা হাত পা ছোড়াছুড়ি করছে শুধু। নীরাকে নিয়ে কেউ একজন একটা রুমে ঢুকে৷ নীরাকে কোল থেকে নামিয়ে নীরার চোখের বাঁধন খুলে দেয়। নীরা চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে দেখে অভিক দাঁড়িয়ে আছে। নীরা রেগে বলে,

‘আপনি? আমায় যেতে দিন স্যার। ভালো লাগছে না এসব।’

অভিক নীরাকে নীরার পিছনে ইশারা দিকে তাকাতে বলে। নীরা তার পিছনে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে রইলো। নীরা দেখলো, তার ছবি কেউ রং তুলি দিয়ে ক্যানভাসে এঁকেছে। নীরা স্তব্ধ হয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর পুরো রুমে চোখ বোলালো। পুরো রুমটা গোলাপ আর বেলুন দিয়ে সাজানো। নীরার পায়ের কাছে অনেক বেলুন পড়ে আছে। নীরা এসবের কিছুই বুঝতে পারছেনা। নীরা পিছন ফিরে অভিকের দিকে তাকায়। অভিক মুচকি হেসে নীরার সামনে হাটু গেড়ে বসে। এক গুচ্ছ গোলাপ নীরার সামনে এগিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করে।

‘ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ কিভাবে করতে হয় আমার তা জানা নেই। কিন্তু আমি আজ আমার মনের অনুভূতিগুলো তোমায় বলতে চাই। নীরা, যেদিন তোমায় প্রথম দেখেছিলাম, এতোটাও গুরুত্ব দেইনি সেদিন। তোমাকে ভয় দেখিয়েছিলাম ঠিকি। কিন্তু কোনো কিছু ফিল হয়নি তখন। কিন্তু বাসায় এসে যখন রং তুলি নিয়ে আঁকতে বসলাম, আনমনে আমি তোমার ছবিই এঁকেছি। বিশ্বাস করো, আমি নিজেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। প্রথম দেখায় আমি অচেনা একটা মেয়ের ছবি নিজের ক্যানভাসে আঁকবো ভাবিইনি কখনো। তারপর থেকে তোমাকে দেখতাম। তোমার আচরণ, তোমার লাইফস্টাইল কেমন সেসব বিষয়ে জানলাম। আমার কাছে যে মেয়েগুলো আসতো, কোনো মেয়েকেই আমার ভালো লাগতো না। তোমাকে কেন জানিনা আমার ভালো লেগে গিয়েছিল। তোমাকে ভালোলাগার পর অন্য কোনো মেয়েকে আমি আমার আশে পাশেই আসতে দেইনি। সেদিন প্রথম তোমার শাড়ি পড়া অবস্থায় দেখে আমার ভেতরটা নাড়া দিয়ে উঠেছিল। অন্য রকম একটা অনুভূতি হচ্ছিল আমার। বৃষ্টিতে তোমার আমাকে জড়িয়ে ধরা আমাকে আরো দূর্বল করে দিয়েছে তোমার প্রতি। আমি জানি না কেন তোমায় দেখলেই আমার কি জানি হয়। আমি পুরো উন্মাদ হয়ে যাই। নীরা তুমিই আমার মানসিক শান্তি। তোমাকে দেখলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়। অভিক নিজের পরিবর্তন দেখে নিজেই অবাক। যেই অভিক কিনা ওয়াইন এর বোতল আর মেয়ে ছাড়া কিছুই বুঝতো না। সেই অভিক এখন অন্য কোনো মেয়েকে নিজের কাছেই ঘেঁষতে দেয়না। ওয়াইন আর সিগারেট ছিল অভিকের প্রিয় নেশা। অভিক সেগুলোই বাদ দিয়ে দিয়েছে। অভিক নিজেকে পুরো চেঞ্জ করে ফেলেছে। আর সেটা শুধু মাত্র তোমার জন্য। আমি জানি না, আমি তোমাকে সবটা বোঝাতে পেরেছি কিনা, কিন্তু আই লাভ ইউ। আই লাভ ইউ নীরা।’

অভিক তার পিছন থেকে একটা ডায়মন্ডের আংটি বের করে নীরার সামনে ধরে বলে,

‘উইল ইউ ম্যারি মি নীরা? প্লিজ সে ইয়েস।’

নীরা এতক্ষণ অভিকের বলা প্রত্যেকটা কথা শুনছিল। নীরার ভেতরটা খাঁ খাঁ করছে। কান্না চেপে অভিককে বলতে থাকে,

‘স্যার, পাগলামি বাদ দিন। উঠুন। আমায় যেতে দিন।’

অভিক নীরার কথা শুনে বলে,

‘আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাও।’

‘আমি আপনার সাথে কোনো সম্পর্কেই যেতে রাজি নই। আপনাকে আমার কোনো দিনই ভালো লাগবে না।’

অভিকের প্রচন্ড রাগ উঠে। অভিক নীরার সামনে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

‘নীরা আমি আর আগের মতো নেই। তাও কেন বলছ এসব?’

নীরা পাল্টা জবাব দিয়ে বলে,

‘আপনি আমার কাছে সারাজীবন খারাপ লোক হয়েই থাকবেন।’

অভিক নীরার কথা সহ্য করতে পারেনা। সে রেগে নীরার গলা টিপে ধরে বলে,

‘এই, কি সমস্যা তোমার? খুব অহংকার দেখাচ্ছ না? খুব দেমাগ বেড়েছে তোমার। কাকে রিজেক্ট করছ তুমি?’

নীরা ধরা গলায় বলে,

‘প্লিজ… ছাড়ুন।’

অভিক নীরাকে আরও শক্ত করে গলা টিপে ধরে নীরা ব্যথায় কাঁন্না করে দেয়। অভিক নীরার কাঁন্না দেখে ওকে ছেড়ে দেয়। নীরা কাশতে শুরু করে। অভিকের উদ্দেশ্যে বলে,

‘আপনি কেন বুঝতে চাইছেন না। আপনার সাথে আমার যায়না। আর কখনো আমাকে এসব বলবেন না।’

নীরা কাঁদতে কাঁদতে ওখান থেকে বেরিয়ে যায়। অভিক রেগে হাতে থাকা গোলাপ আর আংটিটা ফ্লোরে ছুড়ে ফেলে দেয়। তারপর রুমের দরজা লক করে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পরে।

.
নীরা আশ্রমে স্বাভাবিক হয়ে আসে, কিন্তু রুমে ঢুকেই সব ছুড়ে ফেলে দেয়। বিছানায় শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করে দেয়। কাঁদতে কাঁদতে বলে,

‘আমাকে ক্ষমা করে দিন স্যার। আপনার সাথে আমার যায়না। আপনি সত্যিই অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছেন, কিন্তু.. আমার জীবনের সাথে আপনাকে আমি জড়াতে পারবো না। আমার একটা অন্ধকার অতীত আছে।’

নীরা কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পরে।
.
এদিকে অভিক এক হাতে অ্যালকোহলের বোতল নিয়ে অ্যালকোহল খাচ্ছে, আর অন্য হাত দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। অভিকের যখন নেশা ধরে যায় তখন রাস্তায় অ্যালকোহলের বোতলটা ছুড়ে ফেলে দেয়। চুলগুলো এলোমেলো করে রেখেছে। প্রচন্ড স্প্রিডে গাড়ি চালাচ্ছে ও। শার্টের উপরের দুটো বোতাম খোলা। পাগল পাগল লাগছে অভিককে। চোখ লেগে আসছে বারবার। হঠাৎ করেই অভিকের গাড়ি একটা বড় ট্রাকের সামনে চলে আসে। অভিক সেটা দেখেই দ্রুত গাড়ি সাইডে নিয়ে থামানোর চেষ্টা করে। কিন্তু একটা গাছের সাথে অভিকের গাড়ি ধাক্কা খায়। অভিক আঘাত পেয়ে সেখানেই সেন্সলেস হয়ে যায়।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here